নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্লগের স্বত্বাধিকারী সামিয়া

সামিয়া

Every breath is a blessing of Allah.

সামিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোট গল্পঃ ইলিশ মাছ

২০ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:২০

ছবিঃ নেট

রাতে সামান্য কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে জুলেখার স্বামী জুলেখার মাথার মধ্যে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে লাথি বসিয়ে দেয় দু'চারটা, ব্যথায় যন্ত্রণায় চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে অনেকক্ষণ একভাবে পড়ে থাকে জুলেখা, অতিরিক্ত ব্যথার সাথে সাথে যোগ হয় লজ্জা অপমান, ক্ষণিক সময়ের জন্য মরে যেতেও ইচ্ছা হয় স্কাউন্ড্রেলটার জন্য।
তার কিছু সময় পর অন্য সব মায়ের মতন ছোট ছোট বাচ্চাদের তার মৃত্যুর পর কি হবে না হবে,এই চিন্তায় ভয়ে আতঙ্কে অসাড় হয়ে একভাবে পড়ে থাকেন একাকী।
জীবন এইখানে যন্ত্রণাদায়ক নিষ্ঠুর নির্দয় চোখের জল ফেলতে ফেলতে গভীর দীর্ঘশ্বাসের সাথে স্মরণ করে সে কথা।
বাংলাদেশের আট দশটা অসহায় মেয়েদের মতন জুলেখার বাবার বাড়িতে তার জন্য কোন জায়গা নেই, বাড়িতে এমনিতে গেলেই ভাইয়ের বউদের বাঁকা চোখের দৃষ্টি সহ্য করতে হয় যতক্ষন থাকে, ঘণ্টাখানেকের একটু বেশি সময় বসলেই তারা বলে, জুলেখা যাবা কখন? দুপুরের ভাত কি খেয়ে যেতে চাও? এই ধরনের কথা শুনতে অনভ্যস্ত জুলেখা।

ওদের বাড়িতে এক সময় বাড়ির লোকজনের সাথে সাথে দশ বারো জন বাড়তি মানুষের জন্য রান্না হতো প্রত্যেক বেলায়।
সেই দশ বারো জন বাড়তি মানুষ জুটেও যেতো খাওয়ার জন্য।

তারপর দেখতে দেখতে জুলেখার বাপের বাড়ির পরিবেশ পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়ে গেলো খুব খারাপ ভাবেই। বাবা মারা গেলো, মাও অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলো, ভাইয়েরা বিয়ে করে আলাদা আলাদা থাকা শুরু করলো।

জুলেখা লজ্জিত মুখে মাথা নিচু করে অভুক্ত বাচ্চাদের হাত ধরে তাড়াতাড়ি মাকে জড়িয়ে ধরে, চোখের পানি আড়াল করে বেরিয়ে আসে অন্য মানুষের মত যে ঘর এক সময় তার ও ঘর ছিল; যেখানে জন্মের পর থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত সে নিজের বাড়ি মনে করতো, সেই ঘর সেই বাড়িতে এখন সে অন্য বাড়ির লোকের মতন বাইরের ঘর থেকে অনায়াসে বিদায় নিয়ে চলে আসে বাধ্যতামূলক ভাবে।

প্রত্যেকবার স্বামীর হাতে মার খাওয়ার পর এই রকম নানান গভীর চিন্তা ভাবনা শেষে নিজ বাচ্চাদের বাবা হীন অনিশ্চিত জীবনের থেকে; এইসব মেনে নিয়ে চোখ মুখ বুঁজে সহ্য করাটাই তুলনামূলক সহজ মনে হয় জুলেখার কাছে।
গত আট বছরে বিয়ের পর থেকে এই হয়ে আসছে  জীবনে, এ থেকে পরিত্রাণের কোন পথ ও পায় না; কোনোদিন পাবেও না; কারন এসব থেকে বের হতে যে বুদ্ধি আর সাহস ও অর্থনৈতিক অবস্থা কিংবা কাছের মানুষদের যে সামাজিক অর্থনৈতিক মানসিক সাপোর্ট  লাগে তার কিছুই তার নেই।

এইসব ভেবে ভেবে কেঁদে কেটে অন্য সব বারের মতন দীর্ঘ রাত শেষে আবার সকাল হয়; সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ে বারান্দায়, জানালার পর্দায়, গাছের পাতায়। 
সব কিছু একদম স্বাভাবিক জুলেখার স্বামীর ব্যবহারেও, আগের রাতে যেন কিছুই হয়নি। এসব দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে জুলেখা। ওর ফোলা চোখ; কালচে জমাট বাঁধা রক্ত ঠোঁটের কোনে, নীলচে হয়ে ফুলে থাকা কপাল; কোন কিছুই যেন চোখে পড়েনা স্বামীর চোখে,তাকে দেখে মনে হচ্ছে কত ভালো মনের ভালোবাসা পূর্ণ স্বামী; আদর্শ পিতা।

কিছুক্ষণ আগে সে বাজার থেকে বড় একটা ইলিশ মাছ কিনে এনেছে, হাসতে হাসতে বলছে পুরো তিন হাজার টাকার বাজারের সবচেয়ে বড় ইলিশ মাছ সে কিনেছে। ছেলেমেয়ে দুটো খুশিতে হইহই করতে থাকে অত বড় ইলিশ মাছ দেখে।
জুলেখা চোখের জল ফেলতে ফেলতে মাথা ব্যথায় কুঁকড়ে যেতে যেতে মন দিয়ে মাছটি কেঁটে ধুয়ে ভেজে স্বামী সন্তানদের খেতে দেয়। খেতে খেতে ছেলে মেয়ে ও তার স্বামী আনন্দময় গলায় নানারকম গল্প করে। সেসব শুনতে শুনতে জুলেখা হাসে, সেই হাসি সব সময়ের মতোই বড্ড করুন বড্ড বেদনার।

জুলেখার স্বামী কাছেই একটা কারখানায় চাকরি করে সেখানে যাবার উদ্দেশ্যে বের হতে হতে জুলেখাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে
-ইলিশ মাছ আছে না?
-আছে, মাথা নিচু করে জানায় জুলেখা; ইতিমধ্যে স্বামীর লাঞ্চ বক্সে দুই টুকরো ভাজা ইলিশ দিয়ে দিয়েছে,
-লাঞ্চে ইলিশ মাছ দুই পিচ বেশি দিয়ে দিও খুশি খুশি গলায় বলে সে,
কেন শব্দটা বলতে চেয়েও কথা বাড়ালো না। একটা বিবেকহীন পুরুষের সাথে কথা বলার প্রয়োজন মনে করলো না ও।
এর ভেতর সব ইলিশ ভাজা খাওয়া শেষ করেছে তারা, এক টুকরো জুলেখা ছোট ছেলেটার জন্য রেখেছিল সেটাই লাঞ্চ বক্সে দিয়ে দেয়। বাটির শেষ মাছের টুকরোটা পর্যন্ত তুলে দিয়েছে জুলেখা, ও খেয়েছে কিনা সেটা জানার প্রয়োজন বোধ করে না তবু।

মেইনরোডে এসে জুলেখার স্বামী দেখে রাস্তায় আন্দোলন চলছে কোন কিছুর কারনে; গাড়ি ভাঙচুর করছে কিছু উঠতি বয়সী ছেলেরা, মোটা ভারী রড হাতে বাসস্ট্যান্ডের দিকেও ৬-৭ জন দৌড়ে এগিয়ে আসতে আসতে ভারি ভারি রড দিয়ে বারি টারি দিয়ে এটা ওটা হাতের কাছে যাই পাচ্ছে ধ্বংস করতেছে সমানে, হঠাৎ আক্রমণে জুলেখার স্বামী অন্য সবার সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে হাত ফসকে ইলিশ মাছের লাঞ্চ বক্সটা পড়ে যাওয়ায় সেটি তুলতে গিয়ে পিছনে পড়ে গেলেন অন্য সবার থেকে, ওই অবস্থায় আন্দোলনকারীর কারো একটা রডের বারি এসে পড়ে জুলেখা স্বামীর পায়ে, হাড় হাড্ডি গুলো ভেঙে চৌচির হয়ে যায় পায়ের গোড়ালি বরাবর। জুলেখার মতোই একদম কলিজা এফোড় এফোড় হয় ব্যথায় যন্ত্রণায়।

কয়েকজন লোক এগিয়ে এসে তাকে ধরে রাস্তার একদম সাইডে নিয়ে যায় যেখানে কিছুটা যাত্রী ছাওনির নিরাপদ স্থান আছে, দেখতে দেখতে ঘন আঠালো লাল টকটকে রক্তে জায়গাটা ভরে যেতে থাকে। মাঝেমধ্যে গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে জুলেখার স্বামী কাতরাতে কাতরাতে বলতে থাকে আল্লাহ আল্লাহ আল্লাহ;
আন্দোলনের কারণে রাস্তাঘাট পরিবহন শূন্য হওয়ায় ঘটনার আরো ঘন্টা দুই পর পথচারীরা তাকে হাসপাতালে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।

প্রায় এক সপ্তাহ পর জুলেখার স্বামীর পায়ের গোড়ালিতে ৩-৪ বার অস্ত্র পাচার শেষে মোটামুটি নিরাপদ হিসেবে ডাক্তার হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়; মাসখানেক বেড রেষ্টে থেকে আবার হাসপাতালে যেতে বলে চেকআপের জন্য।

এখন ব্যান্ডেজ করা সেই পা নিয়ে জুলেখার স্বামী বাড়ির বারান্দায় বসে থাকে বেশিরভাগ সময়, মাঝে মাঝে এক মনে আল্লাহ আল্লাহ বলতে থাকে, জুলেখা সে রাতে মাথায় লাথি খেয়েও একই ভাবে আল্লাহ আল্লাহ বলেছিল একথা ভাবতে ভাবতে জুলেখা বলে;
-বাজার থেকে একটা বড় ইলিশ মাছ এনে ভাইজ্যা দেই ? খাইবেন?

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:০২

ঠাকুরমাহমুদ বলেছেন:



বীর পুরুষ! বীর পুরুষ পা ভেঙ্গেছে এখন আর কাজ করতে হবে না। ইলিশ মাছের মাথার মুড়িঘন্ট, ইলিশ মাছের দোঁপেয়াজা, ইলিশ মাছের ডিমের দোঁপেয়াজা, ইলিশ মাছের পাতুরি, কাঁচ কলা ইলিশ ঝোল, ইলিশ পোলাও, সরিষা ইলিশ, লোনতা ইলিশ ভুনা সহ বীর পুরুষকে ঘারে তুলে মাওয়া ঘাটে নিয়ে যেতে হবে - ইলিশ রেস্টোরেন্টে খাওয়াতে হবে। সাব্বাস বেটা, বাঘের বেটা।

২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:২৫

সামিয়া বলেছেন: আরেহ কি মন্তব্য!! সেই রকম ছিল,
হুম শেষ কথাটা তীব্র কটাক্ষ করেই জুলেখা বলেছিল।
ভাল থাকুন ধন্যবাদ।

২| ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০২

রাজীব নুর বলেছেন: গল্পের শুরুতেই একটা ধাক্কা দিয়েছেন!!
জুলেখার বদমাশ স্বামী স্ত্রীর মাথায় লাথথি দিলো!!!! পাষণ্ড স্বামী।

২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১০

সামিয়া বলেছেন: ধাক্কা দেওয়ার পরও তেমন পাঠক পেলাম কই। কেমন আছেন? আশাকরি ভালো।

৩| ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:১০

মাহমুদুর রহমান সুজন বলেছেন: সুন্দর করে এই সমাজের ঘটে যাওয়া ঘটনা গল্পে ফুটিয়ে তুললেন।

২২ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪২

সামিয়া বলেছেন: ধন্যবাদ

৪| ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:২৩

মনিরা সুলতানা বলেছেন: প্রত্যেকবার স্বামীর হাতে মার খাওয়ার পর এই রকম নানান গভীর চিন্তা ভাবনা শেষে নিজ বাচ্চাদের বাবা হীন অনিশ্চিত জীবনের থেকে; এইসব মেনে নিয়ে চোখ মুখ বুঁজে সহ্য করাটাই তুলনামূলক সহজ মনে হয় জুলেখার কাছে।
গত আট বছরে বিয়ের পর থেকে এই হয়ে আসছে জীবনে, এ থেকে পরিত্রাণের কোন পথ ও পায় না; কোনোদিন পাবেও না; কারন এসব থেকে বের হতে যে বুদ্ধি আর সাহস ও অর্থনৈতিক অবস্থা কিংবা কাছের মানুষদের যে সামাজিক অর্থনৈতিক মানসিক সাপোর্ট লাগে তার কিছুই তার নেই।

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৪৭

সামিয়া বলেছেন: কোট করা কথাগুলো কি ভালো লেগেছে না খারাপ লেগেছে? আপু কিছু তো বুঝলাম না!!

৫| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ১:২৬

সৈয়দ তাজুল ইসলাম বলেছেন: গল্পটা পড়ে কষ্ট প্রকাশ করাটা যেমন স্বাভাবিক তেমন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বীর পুরুষেরা শোষণ করে যাচ্ছে আপন গৃহের রাণীদের। আপনি হয়ত গল্প লিখছেন কল্পনার সাহায্যে অথবা বাস্তবতার সাহায্যে। যদি বাস্তবতার সাহায্যে তবু জানতে ইচ্ছে করে, এসবের সমাধান কোথায়!

২৪ শে জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ৯:২৬

সামিয়া বলেছেন: আপনার কথাগুলো গভীর বেদনা আর বাস্তবতার প্রতিফলন। সত্যি বলতে, এই শোষণের চিত্র সমাজের এতটাই গভীরে যে, কখনো কখনো এটি আমাদের সংস্কৃতির অংশ বলেও মনে হয়। তবে সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, এবং আইনি পর্যায়ে একসঙ্গে কাজ করার। ধন্যবাদ ভালো থাকুন।

৬| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৫ বিকাল ৫:৩৮

শায়মা বলেছেন: জুলেখার কষ্টের প্রতিশোধ স্বয়ং বিধাতা দিয়েছেন কিন্তু তাদের বাড়িতে উপার্জনকারী এখন কে ভাবছিলাম। নিশ্চয় জুলেখা। খুবই কষ্টকর গল্প আপুনি কিন্তু শেষে শাস্তি দেখে শান্তি পেলাম একটু।

০৩ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ১০:৩৮

সামিয়া বলেছেন: জুলেখার স্বামীই সংসার চালাবে, সে তো আর চিরকালের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়নি। সে সুস্থ হয়ে সংসারের হাল ধরবে। জুলেখা কষ্ট করবে কেন অফিস থেকে ক্ষতিপূরণ তো পাবেই এই কদিন চলার জন্যে চিকিৎসার জন্য এটা প্রায় সব অফিসের ইন্সুরেন্স পলিসি। ধন্যবাদ আপু ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.