নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্লগের স্বত্বাধিকারী সামিয়া

সামিয়া

Every breath is a blessing of Allah.

সামিয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

অনু গল্পঃ শেষ বিকেলে

১২ ই মে, ২০২৫ রাত ১০:৫১


ছবিঃনেট

শীত যাই যাই করছে, বিকেলের রোদের আলো আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে, পুকুর পাড় ঘেঁষে যে পুরোনো আমগাছটা দাঁড়িয়ে আছে, তার নিচে ছায়া পড়ে আছে নিঃশব্দে।

সেই ছায়ায় বসে আছেন মিজান হাওলাদার এবং তার স্ত্রী রুবিনা আক্তার। চারপাশে পাখির ডাক থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে, মাঝেমধ্যে বাতাসে পাতার মৃদু খসখস শব্দ, আলো-ছায়ার খেলা চলছে গায়ে-মুখে নাকে। রোদ যেন গাছের পাতার ফাঁক গলে বেরিয়ে আসছে মাঝেমধ্যে বাতাসে।

তাদের দুজনের গায়ের রঙ ধবধবে ফর্শা সুন্দর মিশুক ও অমায়িক চেহারা। মিজান হাওলাদার অনেকদিন পর উনার গ্রামে এসেছেন, পুরানো দিনের নানান স্মৃতিচারণ করছেন উনার স্ত্রীর সাথে, কথা বলতে বলতে কখনো মন খুলে হাসছেন কখনো গম্ভীর হচ্ছেন কখনো মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন অপর প্রান্তে বলতে থাকা ব্যক্তির কথায়।

মিজান হাওলাদারের চোখে-মুখে ঝরে পড়ছে ছেলেবেলার মধুর স্মৃতির শান্তি, অদূরেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলছে, তাদের কোলাহল মিশে যাচ্ছে বিকেলের স্নিগ্ধ পরিবেশে, এসব দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবনায় ডুবে যাচ্ছে তারা।
কিছুক্ষণ পর ছোট্ট এক কিশোরী কুমড়ো ফুলের বড়া, চিতই পিঠা, সঙ্গে শুটকি ও সরষে ভর্তা রেখে যায় ওদের সামনে।
পথের অন্য প্রান্ত থেকে ধীরে হেলে দুলে হাঁটতে হাঁটতে ওদের কাছে আসে হেলাল উদ্দিন। পায়জামা পাঞ্জাবীর উপরে এমন ভাবে এলোমেলো চাদর দিয়েছে গায়ে মনে হচ্ছে মাঘ মাসের শীত, কাছে আসতেই মিজান হাওলাদার উঠে দাঁড়ায়; দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে!
মিজান তাকে বললেন, আরেহ, হেলাল! কত দিন পরে দেখা! তুই তো বদলাসনি একটুও, এখনও সেই পুরনো চেহারা।

হেলাল হাসতে হাসতে বলল, বদলাইনি আবার! চুলে পাক ধরেছে, শরীরে শক্তি কমেছে, আর তুই বলছিস বদলাইনি? তবে তোর চেহারায় তেমন কিছু বদল দেখছি না। সেই আগের মতোই আছিস।

দুজনের কথা শুনতে শুনতে মৃদু হাসে রুবিনা আক্তার। তাকে সালাম দিয়ে হেলাল বলে
- ভাবি, আমাদের গল্প শুনলে মজা পাবেন। একবার স্কুল পালিয়ে মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়েছিলাম। খেলতে গিয়ে এমন মজা পেয়েছিলাম যে সময় ভুলে গেলাম। সন্ধ্যার পর যখন বাড়ি ফিরলাম, মিজানের বাবা লাঠি হাতে অপেক্ষা করছিলো, কী মারটাই না দিলো।

মিজান হাওলাদার হাসতে হাসতে বলে,
- ওই সময়টাই ছিল জীবন সেরা সময়। কোনো দুঃশ্চিন্তা ছিল না।

রুবিনা কুমড়ো ফুলের বড়া এগিয়ে দিলেন মিজান আর হেলালকে, খেতে খেতে মিজান বলে,
- আম্মা বেঁচে থাকতে এমন বড়া বানাতেন ছোটবেলায়, আমি আর ভাই-বোনেরা এক প্লেট নিয়ে ছুটতাম পুকুরপাড়ে, আম্মা রাগ করতেন, বলতেন; ভাজাপোড়া খাবার খেতে নেই বাইরে, ভুতের ভয় দেখাতেন।

রুবিনা আক্তারও বলেন
- হুম আমার শাশুড়ি আম্মার রান্নার কথা ভোলা যায় নাকি! শীতের সময় তো আম্মা চিতই পিঠা বানাতেন... আহা, গরম পিঠা গুড়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে কী স্বাদ! সেই সময়টা আর ফিরে আসবে না।

তারা যেখানে বসে আছে তার একটু দুরেই পুকুর; পরিস্কার টলমলে পানির উপর সারি সারি নারিকেল গাছ আম ও কাঁঠাল গাছ ছবির মত দৃশ্য,
একটি দা হাতে সেদিকে এগিয়ে যায় গফুর চাচা, মিজানের বাবার ফুফাতো ভাই সে, উনার বাবা মা মারা গিয়েছেন সেই ছোটবেলায়, তখন থেকেই পড়ে আছে ওদের কাছে, বিয়ে করেছিল কিন্তু সন্তান হয়নি তাদের, সে সব নিয়ে কোন আক্ষেপ নেই, ভালই আছে এই বাড়িতে উনারা।

এখন মোটামুটি বয়স হয়েছে কোমরে ভাঁজ পরেছে চাচার, কিন্তু চলাফেরায় সে মিজানদের থেকেও শক্তিশালী, কোমরে দড়ি বেঁধে ধীরে ধীরে উঠে গেলেন নারিকেল গাছে, বেশ কয়েকটি ডাব দা দিয়ে কুঁপিয়ে নিচে ফেললেন, কিছু পুকুরের পানিতে পড়লো কিছু পথের মধ্যে, ছোট কয়েকটা ছেলে মেয়ে ডাব সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে গেল, মিজান রুবিনা দুজনেই সেদিকে তাকিয়ে উপভোগ করছে সবকিছু, তার কিছুক্ষন পর গফুর চাচা গাছ থেকে নিচে নেমে এলেন, ছেলেমেয়েরা হইহই রইরই করে একসাথে এনে জড়ো করে রাখলো ডাব গুলো, চাচা প্রত্যেকের হাতে একটি করে ডাব ধরিয়ে দিলেন সেগুলো নিয়ে যে যার মত চলে গেল।

বাকী গুলো কেটে গ্লাসে ডাবের শ্বাস সহ পানি ভরে এগিয়ে দিলেন ওদের কাছে, চাচা আপনি আবার কষ্ট করতে গেলেন কেন বিনয় এবং আনন্দ ভরা কণ্ঠ মিজানের, চাচা বললেন
- বাড়ির পোলাপান বাড়ি ফেলে কই গিয়ে থাকো, এই তোমারে কোলে পীঠে করে বড় করলাম, এখন আর দেখা পাই কই! কত বছর পর দেখলাম বলো। আবেগে কণ্ঠ জড়িয়ে আসে। মিজান উঠে কাঁধে হাত রেখে শান্তনা দেয় তাকে।
- তোমাগোও তো একটাই পোলা, ভীনদেশে পড়তে পাঠাইলা, সেইখানে বিয়ে করে সেটেল হইলো, একলা লাগেনা বাপজান?
মিজান রুবিনার মুখে তীব্র বিষাদের ছায়া, মুখে মৃদু হাসি দিয়ে বলে
- না তা নয় আমরা তো চাইলে সেখানে যেতে পারি, একলা লাগবে কেন।

হেলাল উদ্দিন পকেট থেকে একটা পুরনো বাটন মোবাইল বের করে সময় দেখে নেয়। সূর্যটা আর একটু ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। সে একটু পাস ফিরে ঘাড় কাত করে বলে,
— এখন যেতে হবে, ছাত্ররা অপেক্ষা করছে।
তারপর একটু চুপ থেকে বলেন,
— বাসায় এখন আর কেউ থাকে না, শুধু আমি আর বইয়েরা।

মিজান একটু অবাক হয়ে তাকায়,
— মানে? ভাবি কোথায়?

হেলাল চোখ নামিয়ে বলে,
— গত মাসে চলে গেলো চিরতরে। ক্যানসার ধরা পড়েছিল। বেশি দিন টিকতে পারেনি।
রুবিনা আক্তার বলেন,
— আল্লাহ ভাবিকে জান্নাত নসিব করুক। আর ছেলে-মেয়ে?
- ছেলে মেয়ে দুইটাই বিয়ে করেছে, তাদের আলাদা ঘর সংসার। আমার খবর নেয়ার সময় কই তাদের!

হেলালের চোখে পানি চিকচিক করে ওঠে,সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
— আচ্ছা, আমি চলি। আবার দেখা হবে, ইনশাআল্লাহ।

হেলালের এলোমেলো চাদর, অবিন্যস্ত চুল, মুখে শুষ্কতা, চোখের কোণে বয়স আর নিঃসঙ্গতার গভীর ছাপ। এতক্ষণে চোখে পড়ে ওদের।
হেলাল হেঁটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে...তার ছায়া দীর্ঘ হয়ে মিশে যাচ্ছে মাটির ওপর। একটা দীর্ঘ জীবনের পরিসমাপ্তির কাছে।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই মে, ২০২৫ রাত ১:১৬

সৈয়দ কুতুব বলেছেন: আপনার লেখার একনিষ্ঠ পাঠক আমি। কোনোদিন মিস দেই না। কম কমেন্ট দেখে হতাশ হবেন না। লিখে যান।

২| ১৩ ই মে, ২০২৫ ভোর ৪:৩৯

নকল কাক বলেছেন: জোড়া ভেঙে যাওয়া পাখির গল্প

৩| ১৩ ই মে, ২০২৫ সকাল ৯:৩১

বাকপ্রবাস বলেছেন: নদীর জলের টলমল করা সাবলিল ছোট গল্প। তবে অণুগল্প আরেকটু ভিন্ন। সেটার স্বাদ আলাদা

৪| ১৩ ই মে, ২০২৫ সকাল ৯:৫৪

সাইফুলসাইফসাই বলেছেন: ভালো লাগলো পড়ে

৫| ১৩ ই মে, ২০২৫ সকাল ১১:১৭

সাখাওয়াত হোসেন বাবন বলেছেন: সুন্দর গল্প !

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.