![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষকে বিশ্বাস করতে চাই এবং বিশ্বাস রেখেই কাজ করতে চাই।বাস্তবের ভিতরে বসবাস করতে ভালবাসি। কল্পনা করতে ভাল লাগে, কিন্তু বাস্তবকে ভুলে নয়। সততা বলতে আংশিক বুঝি না, পুরোটাই বুঝতে চাই। প্রকৃতির মাঝে শান্তি এবং স্বস্তি দু\\\'টোই খুজে পাই। নারীর প্রতি আকর্ষন আছে তবে উন্মাদনা নেই। বয়সকে অনেক ক্ষেত্রেই বাধা মনে করি না। লিখতে ভালবাসি, কবিতা-গল্প, যা কিছু। চারটে বই প্রকাশ করেছি নিজ উদ্যোগে। প্রতিভা নেই, শখ আছে। অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে করে, পারি না কেন বুঝি না।
ঘুম বা নিদ্রা কি এক ধরনের মৃত্যু? আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন নি:সন্দেহে আমরা জ্ঞানশুন্য থাকি। না'হলে আমাদের আশেপাশে কি হচ্ছে তা জানতে পারতাম। জেগে না ওঠা পর্যন্ত আমরা কিছুই জানতে পারিনা আমাদের ইহজাগতিক সকল কর্মযজ্ঞ। তবে স্বপ্ন দেখি বটে। কিন্তু বিজ্ঞান বলে আমাদের ৬/৭ ঘন্টা ঘুমের মধ্যে আমাদের স্বপ্ন নাকি কেবল কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়ে থাকে। ভাবতেও অবাক লাগে আমরা এমন কিছু স্বপ্ন দেখি যা প্রায় একটা দিনের ঘটনার মত অথবা তার একটা পরিপূর্ণ ঘটমান অংশ। অথচ তা কি না মাত্র কয়েক সেকেন্ডে ঘটে যায়! স্বপ্নের সময় কি তবে এই পৃথিবীর সময়ের বিচারে শতগুনে দ্রুততম! আর তাই বুঝি কিছু কিছু সুন্দর স্বপ্ন একটা জায়গায় যেয়ে হঠাৎ থেমে যায় অপূর্ণতা নিয়ে! আমাদের ইহজাগতিক মস্তক আর মগজ তার কর্মচাঞ্চল্য হারিয়ে ফেলে! কি জানি কি হয়। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের স্বপ্ন বাদ দিলে কি থাকে? আমরা কি কোন এক অনন্তের গহীনে পড়ে থাকি, মৃতের মতো? তা'হলে তো আমরা আমাদের অস্তিত্বের মধ্যেই থাকি না। অনস্তীত্বের আরেক নামই তো মৃত্যু। আর তাই বুঝি আল্লাহ্তা'লা বলেছেন...'মৃত্যু এলে আল্লাহ্ প্রান হরন করেন এবং যারা জীবিত তাদেরও চেতনা হরন করেন যখন ওরা নিদ্রিত থাকে। অত:পর যার জন্য মৃত্যু অবধারিত করেছেন তিনি তার প্রান রেখে দেন এবং অপরকে চেতনা ফিরিয়ে দেন এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য।' তা'হলে ঐ সময়টুকুর মধ্যে আমরা আমদের মাঝে থাকি না একেবারেই। আমাদের কোনই শক্তি নেই ইচ্ছে মত জেগে উঠবার, যদি না আমাদের জেগে ওঠার চেতনা ফিরিয়ে দেয়া হয়।
আর সার্জিক্যাল অপারেশন বা শল্য চিকিৎসার জন্য যে এনেস্থেসিয়া দেওয়া হয় সেও তো তবে এক ধরনের মৃত্যুই। ঘুমের চেয়েও গভীর, একেবারে অতলান্তিকে ডুবে যাওয়া! ঘুমন্ত কাউকে তবু ডেকে জাগিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু ইনজেকশান দিয়ে যাকে ঘুমের অতলান্তিকের গহীনে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাকে তো শত ডাকলেও সে জাগবে না। সে চেতনারহিত! তার উপর চলবে ছুরি-কাঁচির রক্তাক্ত খোড়াখুড়ি। নি:সার দেহ পড়ে থাকবে, কেবল কয়েকজন ডাক্তার আর নার্স জানবে মানুষটির প্রান আছে কি নেই। কিন্তু যে মানুষটি তার প্রান এবং শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে আছে তার সবকিছুই তো অনস্তিত্বের মাঝে হারিয়ে গেছে।
আমাকে অপারেশান থিয়েটারে নেয়া হয় পৌনে তিনটার কিছু আগে। তার প্রায় আধা ঘন্টা আগে পাশের রুমে শুইয়ে রাখা হয়েছিল স্যালাইন লাগিয়ে। ওটা অপারেশানের পূর্ব প্রস্তুতি। হেঁটে গিয়ে বেড-এ উঠে শুয়ে পড়লাম নার্সের নির্দেশ মতো। অপারেশানের বেড মনে হয় এই রকমই হয়…মেঝে থেকে বেশ উঁচু, সরু একটা বিছানা। একজন মানুষের শরীরের প্রস্থ সমান। এরই মধ্যে ঘটর-মটর শব্দ করে বেডের ছোট-খাটো রেলিং উঠানো হলো। বুঝলাম না কিছুই…. ইনজেকশান দেয়া শরীর অচেতন হয়ে পড়ে থাকবে, তার উপর চলবে অবলীলায় কাটাকুটি সেখানে আবার প্রটেকশান কেন! স্যালাইনটা আবার আমার হাতের ক্যাথেটারে পুশ করে দেয়ে হলো। একটু পরই ডাক্তার সাহেব (সার্জন) এলেন। অমায়িক ভদ্রলোক। আমার বুকে হাত রেখে বললেন, আপনি ইকোস্প্রিন খাচ্ছেন এটাতো আগে বলেন নি। ওটা সাধারনত: আমরা অপারেশানের এক সপ্তাহ আগে বন্ধ করতে বলি। আমি বললাম, আমাকে তো এর আগে আপনার এসিসট্যান্ট যখন হিস্টোরি লিখেন তখন জিজ্ঞেস করেন নি আমি কোন ওষুধ খাচ্ছি কি না! তিনি বললেন, আচ্ছা, ভয়ের কিছু নেই। আমরা ঘন্টা দু'এক আগে যে ব্লাড টেস্ট করিয়েছি তার রেজাল্ট ভাল আছে। কোন সমস্যা হবে না। আর, একটু পরই আপনাকে ঐ স্যালাইনের সঙ্গে একটা ইনজেকশান পুশ করা হবে...তার পরই আপনি ঘুমিয়ে যাবেন। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ঠিক আছে? আমি বললাম, থ্যাং ক্যু। কিন্তু থ্যাং ক্যু কেন বললাম বুঝতে পারলাম না। ‘ওকে’ বা ‘ঠিক আছে’ বললেই হতো। হয়তো আগাম জানিয়ে রাখলাম।
আমি জানি এর পর আমি খুব অল্প সময় হাতে পাবো ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি আসার আগে। আমি দ্রুত আমার কিছু প্রিয় মুখ কল্পনার আয়নায় দেখে নিলাম। এর মাঝে সময়ের ব্যাপারে একটা গড়বড় হয়ে গিয়েছিল। আমার অপারেশান হওয়ার কথা ছিল বিকাল সাড়ে তিনটায়, সেমতে আমাকে থিয়েটারে নেওয়ার কথা তিনটার দিকে। অথচ কি কারনে তারা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়লো আমাকে প্রায় এক ঘন্টা আগে অপারেশান করতে। ডাক্তার সাহেবের হাতে কাজ ছিল না মনে হয়।সিডিউল অনুযা্যী আমার স্ত্রীর আসার কথা আড়াইটার দিকে যেহেতু হসপিটাল আমার বাসার একেবারে কাছে। সঙ্গে থাকবে আমার প্রিয় দোস্ত 'বুদু'। কিন্তু ওদের আর আসা হয়নি হঠাৎ সময় এগিয়ে নিয়ে আসার কারনে। কাছে ছিল শুধু আমার ছেলে আর শেষ মূহুর্তে এসে যোগ দিল আমার ভাতিজা তার বউ নিয়ে। ছেলেকে বললাম ওর আম্মুকে ফোন করে জানিয়ে দিতে যে এখন আর আসার দরকার নেই এবং চিন্তারও কোন কারন নেই। সব ঠিক আছে। যদিও আমি জানি ওদিকে টেনশান আরও বেড়ে যাবে। এই সব কারনে আমার কয়েকটি প্রিয় মুখকে ঝটপট কল্পনার আয়নায় দেখে নিতে হলো যাদের আসার কথা ছিল তাদের এবং যাদেরকে মনে মনে খুব আশা করা হয় যদি একবার আসতো, তাদের মুখ। এরপর চার কল্মা শেষ করলাম। এর মাঝেই দেখলাম আমার উপরে বড় গোলাকার দু'টো সসারের মত লাইটের ডিব্বা পজিশনে আনা হচ্ছে, যার ভিতরে মনে হচ্ছে পাঁচটি করে ছোট ছোট চোখ। জ্বলে ওঠেনি তখনো। থিয়েটারের নাট্যমঞ্চ প্রায় প্রস্তুত। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝতে পারছিলাম আমার হাতের শিরা দিয়ে কিছু একটা ঢুকছে। আমি এও বুঝতে পারছিলাম অন্তত: কয়েক সেকেন্ডের জন্য যে আমি ঘুমিয়ে পড়ছি। ব্যস্, এখানেই আমার সকল চেতনার সমাপ্তি।….
আমার এই ভয় খুব একটা ছিল না যে অপারেশানে আমি মরে যেতে পারি। কারন আজকাল এই আধুনিক যুগে ল্যাপারস্কপিক সার্জারিতে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, যদি অন্য কোন জটিলতা দেখা না দেয়। আমার ভয়টা ঐ ঘুমের ব্যাপারে। যে ইনজেকশান আমাকে দেওয়া হবে তার পরিমানটা যদি খুব বেশী হয়ে যায়, তা'হলে! ঘুম ভাঙবে তো! যে এনেস্থেটিস্ট আমার জন্য ডোজ বা পরিমান নির্ধারন করবেন তিনি কতটুকু অভিজ্ঞ! আমার শারীরিক অবস্থা সম্বন্ধে তিনি পুরোপুরি ওয়াকিবহাল তো!
মরে তো যাইনি বুঝাই যাচ্ছে। নইলে লিখতে পারতাম না।
আমার যখন জ্ঞান ফিরলো তখনকার অনুভূতি সত্যিই ঘুম ভাংগার মত। আমার কানে আসছিল নারী কন্ঠের কথাবার্তা। চোখ খুলে প্রথমে একটু ঝাপসা তারপরই পরিস্কার, আমার মাথার উপর ছাদে লাগো্য়া দু'তিনটা লাইট জ্বলছে। অদুরে একজন নার্স বসা। দু'একজন এদিক সেদিক আসা যাওয়া করছে। আমি বুঝতে পারলাম যে আমার যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন আমি পোস্ট-অপারেটিভ রুমে আছি। আশে পাশে তাকিয়ে দেখতে চাইলাম ক'টা বাজে। বাঁ দিকের দেয়াল ঘড়িতে লক্ষ্য করলাম চারটা পনেরো। মানে দেড় ঘন্টা মৃতবৎ ছিলাম। পেটে হাল্কা ব্যথা অনুভব করলাম, তবে কাতর হবার মত কিছু নয়। মিনিট দশেক পর পাশের নার্স কাকে ডেকে বলছিল, এই...৭১২-এর পেশেন্টকে রুমে নিয়ে যেতে হবে। বুঝলাম আমাকে এখন আমার রুমে নিয়ে যাবে।
আমি ভাবতে থাকি এই দেড় ঘন্টা আমি কিছুই জানলাম না কি ঘটেছে অথচ ছুরি-কাঁচি ব্যবহার করে আমার পেটের ভিতর থেকে পিত্তথলিটা কেটে বের করে ফেলা হয়েছে। আর যদি জ্ঞান না ফিরতো তা'হলে সেই ঘুমই হয়ে যেতো আমার মৃত্যু! আমরা আসলে প্রতিদিন আমাদের জীবনটা ফিরে পাই চেতনার ধারায়, প্রতি সকালে সূর্য্যোদয়ের মতো, সৃষ্টিকর্তার অসীম দয়া আর করুনায়। তিনি চাইলে নিশচয়ই একটি সকালেই সারা বিশ্ব থেকে অযুত-নিযুত প্রাণ কেড়ে নিতে পারেন চেতনা রহিত করে। আমার আম্মা আজ থেকে কুড়ি বছর আগে রাতে ওজু করে নামাজ পড়ে শুয়েছিলেন। প্রতিদিনের মত সকালে উঠবেন, কিন্তু তিনি তো আরে উঠেন নি! বিধাতা আর ফিরিয়ে দেননি তার প্রাণ।
সেই মহাজ্ঞানী শুধু জীবন দান করেই ক্ষান্ত নন, প্রাণ ফিরিয়ে প্রাণ জুড়িয়ে দেন তার অবারিত সৃষ্টির প্রতি স্বত:স্ফূর্ত অধিকার দিয়ে। দীনহীন যে মানুষ সেও সকালে উঠে চাইলেই সূর্য্যের আলো গায়ে মাখতে পারে, অবারিত নীলাকাশ তার জন্য খোলা, মেঘেদের আনাগোনা সেও ইচ্ছে মতো দেখতে পারে, গাছের ছায়ায় বসতে পারে, চাইলে নদীতে সাঁতার কাটতে পারে, দিগন্তে দাঁড়িয়ে নির্মল বায়ুর আস্বাদ নিতে পারে। পাখীদের ওড়াউড়ির খেলা চাইলেই দেখতে পারে সে। বাধা নেই কোথাও। বাধা কেবল মানুষের সৃষ্ট সবকিছুতে। পরম পরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতে বাধা নেই কোন মানুষের অধিকার, তিনি উদার করুনা আর অনুগ্রহে, অকৃপন তার সৃষ্টিতে। তবু মানুষেরা গভীরভাবে অনুদার, কৃপন...উদ্ধত সকল সৃষ্টিতে!
আমি আমার সেই অন্তর্যামী পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তার কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই আমাকে প্রতিদিন জীবন দানের জন্য, প্রতি সকালের আলোয় আমার প্রাণ ফিরিয়ে দেবার জন্য। যে জীবন আমি প্রতিদিন উপভোগ করি সুখে দু:খে, আনন্দে-নিরানন্দে, প্রেম-ভালবাসায়, পাওয়া-না পাওয়ায়।
©somewhere in net ltd.