![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষকে বিশ্বাস করতে চাই এবং বিশ্বাস রেখেই কাজ করতে চাই।বাস্তবের ভিতরে বসবাস করতে ভালবাসি। কল্পনা করতে ভাল লাগে, কিন্তু বাস্তবকে ভুলে নয়। সততা বলতে আংশিক বুঝি না, পুরোটাই বুঝতে চাই। প্রকৃতির মাঝে শান্তি এবং স্বস্তি দু\\\'টোই খুজে পাই। নারীর প্রতি আকর্ষন আছে তবে উন্মাদনা নেই। বয়সকে অনেক ক্ষেত্রেই বাধা মনে করি না। লিখতে ভালবাসি, কবিতা-গল্প, যা কিছু। চারটে বই প্রকাশ করেছি নিজ উদ্যোগে। প্রতিভা নেই, শখ আছে। অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে করে, পারি না কেন বুঝি না।
এই সেদিন সন্ধ্যার পর কামাল ফোন করেছিল আমেরিকা থেকে। এখন ওর ফোন করার কথা না, কারন কিছুদিন আগেই ওর সঙ্গে কথা হয়েছে। আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করতেই বললো, ‘গতকাল ফেসবুকে আপনি যে লেখাটা পোস্ট করেছেন, তার উপর কিছু লিখে কমেন্ট না করে ভাবলাম ফোন করে ভাল লাগাটা জানাই। খুব সুন্দর লিখেছেন।‘
এই কামালের কথা একটু লিখতেই হয়। ওর পুরো নাম খালিদ কামাল। বন্ধু-বান্ধবরা জানে শামীম বলে। বাড়িতেও শামীম। ওটা ওর ডাক নাম। এই ভদ্রলোক হচ্ছে যেমন মজার তেমনি যন্ত্রনার। যন্ত্রনার কথা আগে বলি। ওর অনেক বন্ধু-বান্ধব থাকার পরও আমার সঙ্গে সেই রকম সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও আমাকে ওর খুব ভাল লাগে। নিজেই বলেছে কি কারনে তা সে জানে না। আবার মাঝে মাঝে দু’একটা ব্যাখ্যাও করেছে। সে সব না-ই বললাম... শেষে নিজের স্তুতি হয়ে যাবে। এই কামাল আমারও খুব প্রিয় পাত্র। এই রকম অবস্থার মধ্যেও ওর কিছু খেয়ালিপনা আছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে...স্বেচ্ছা উধাও। উধাও হওয়াটা শরীরী নয়। কারন ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখন শুধু টেলিফোনে আটকে আছে। এক সময় আমি চলে গিয়েছিলাম দেশের বাইরে, সুদুর আফ্রিকায়। আর এখন আমি দেশে আর ও সুদুর আমেরিকায়। আমি দেশে বেড়াতে আসলে যেমন দেখা হতো তেমনি ও এখন দেশে আসলে দেখা হয় দু’একদিন হয়তো কোথাও বসা হয়। যে কারনে এখন সম্পর্কটা যা আছে ঐ টেলিফোনের বদৌলতে। কখনো কখনো মাসে দু’বার ফোন করবে, আবার হঠাৎ গায়েব। দু’তিন মাসে কোন ফোন নেই। এই ভদ্রলোক হঠাৎ কঠিন কথা বলে বসবে। হেসে খেলে কঠিন কথা। যেমন, যদি জিজ্ঞেস করি...কি ব্যাপার, এতদিন একবারও ফোন করলেন না যে! জবাব দেবে, কেন? আপনাকে ফোন করতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা আছে নাকি? তা’ছাড়া এতদিন ইচ্ছে করেনি আপনাকে ফোন করতে।
এই রকম কথা শুনে প্রথম প্রথম খুব রাগ হতো, মনটা খারাপ হয়ে যেতো। একটু পরেই অন্যরকম সব কথা বলে সব হালকা করে ফেলতো। এই রকম উধাও সে ভয়ংকরভাবে হয়ে গিয়েছিল আমি যখন আফ্রিকায়। জাম্বিয়া থেকে আমার কথা হতো টেলিফোনে মাসে দু’একবার। (ওর সঙ্গে পরিচয়ের ব্যাপারটায় পরে আসছি)। আমি ‘৯১ তে জাম্বিয়ায় যাই, আর ’৯৫-এর দিকে আমি জানতে পারলাম যে কামাল আমেরিকা চলে যাচ্ছে একেবারে পরিবার নিয়ে, ভিসা পেয়ে গেছে। আমি জানলাম অন্যের মাধ্যমে। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ও যাওয়ার আগে আমাকে বলে যাবে। একদিন ফোন করে জানতে পারলাম যে সে বাংলাদেশে নেই, আমেরিকায় চলে গেছে। আমি তো ‘থ’। ভিতরে করুন ব্যথার সুর বাজতে লাগলো। অফিসে জিজ্ঞেস করে ঠিকানা বা কোন ফোন নাম্বার পেলাম না। কারও কাছে কোন ঠিকানা রেখে যায় নি। কারনটা ছিল ওকে অস্থায়ী ভাবে কোথাও উঠতে হবে। অনেক চেষ্টায় একটা নাম্বার পেলাম, ফোন করে পেলাম এক আমেরিকানকে। কামালের কথা জিজ্ঞেস করাতে জবাব পেলাম, ইউ প্রব্যাবলি গট আ রং নাম্বার। আমার শেষ আশাটাও গেল। তারপরও আমার একটা ধারনা ছিল যে ও একদিন আমাকে ফোন করবে। কিন্তু বছর গড়িয়ে গেল তবু ওর ফোন আর এলো না। অবশেষে আমি সত্যিই ওর প্রতি অসম্ভব রাগ এবং বিরূপ ধারনা নিয়ে আশা ছেড়ে দেই, এই ভেবে যে মানুষের মাঝে স্থায়ী সম্পর্ক বলে কিছু নেই। কষ্ট পাওয়ার কারন হলো যতদিন এক সঙ্গে দেশে ছিলাম ততদিন ওর সঙ্গে একটা অন্য রকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বন্ধু নয়, হয়তো সুহৃদ। কোথাও একটা মিল যেন আছে দু’জনের যা দু’জনে ভাগ করে নিতাম।
এই উধাও হওয়া কামাল তিন বছর পর একদিন হঠাৎ ফোন করে বসলো আমাকে। আমি তখন অফিসে। অফিস সেক্রেটারী ফোন করে জানালো, ‘সামওয়ান ইজ অন দ্য লাইন ফর ইউ। ইটস অ্যান ওভারসিস কল।‘ কল রিসিভ করে কামালের কন্ঠ শুনে আমি তো বিস্ময়াভিভূত! আমার এতো রাগ থাকার পরও আমি সব ভুলে গেলাম। আর ওদিক থেকে সে নির্লজ্জ আর বেহায়ার মতো হাসছে আর কথা বলে যাচ্ছে। আমি বললাম, ‘আপনি যখন এতদিন ফোন করেনই নি, তাহলে এখন আর কেন করলেন?’ ওর জবাব শুনে সব ভুলে গেলাম। বললো, ‘আপনাকে ফোন না করে থাকতে পারলাম না।‘ এই রকম মানুষের সঙ্গে কেউ কখনো সম্পর্ক রাখতে পারে! কিন্তু তারপরও আমি রেখেছি ঐ একটা কারনে। হয়তো এই হেয়ালিপনার কারনেই। এগুলো হলো ওর যন্ত্রণার কথা।
এখন বলি ওর সঙ্গে আমার পরিচয় এবং মজার কথা। আমরা একই কোম্পানিতে চাকরি করতাম। বিদেশী কোম্পানি। কামাল চাকরিতে আমার চেয়ে তিন বছরের জ্যেষ্ঠ, মানে সিনিয়র। বয়সে হয়তো দু’এক বছর হবে। আমাদের অফিস ছিল পাঁচ তাঁরা সোনারগাঁও হোটেলে। কিন্তু আমাকে প্রজেক্ট নিয়ে ঢাকার বাইরেই থাকতে হতো বেশির ভাগ সময়। চাকরিতে ঢুকে ৭/৮ মাস ঢাকায় ছিলাম, তারপর প্রজেক্ট নিয়ে খুলনায় চলে যাই। ঐ ৭/৮ মাস ওর সঙ্গে ছিলাম একই অফিসে। কামাল ছিল একাউন্ট অফিসার, আমি ছিলাম এডমিনিস্ট্রেশানে। খুলনার পর বাকি প্রজেক্টগুলো ঢাকার আশেপাশেই ছিল বলে প্রায়ই ঢাকায় আসা হতো অফিসের কাজে। যে কারনে যোগাযোগটা ভালই ছিল। কোম্পানির নিয়ম ছিল প্রজেক্ট এডমিনিস্ট্রেশান অফিসারকে একাউন্টস জানতে হবে কারন প্রশাসনের পাশাপাশি তাকেই প্রজেক্ট সাইটের সব হিসাব নিকাশের কাজও করতে হবে। অর্থাৎ একাউন্টসের জন্য আলাদা করে কেউ থাকবে না। যে কারনে আমাকে কোম্পানির একাউন্টসের নিয়ম-কানুন প্রথমেই শিখে নিতে হয়েছে ঐ কামালের কাছ থেকেই। আর সেই সুবাদেই ওর সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে।
ওর সঙ্গে সবচেয়ে ভাল সময় কেটেছে ’৮৬ সালে যখন আমি ঢাকায় ছিলাম প্রায় এক বছর। নতুন কোন প্রজেক্ট ছিল না তখন। ফ্যামিলি নিয়ে রামপুরায় ছোট্ট একটা বাসায় ছিলাম, তিন জনের ছোট পরিবার। তখন কত সময় কেটেছে অফিসের পর কখনো এক সঙ্গে অফিস থেকে বের হয়েছি। ও থাকতো পুরান ঢাকার নারিন্দায়। নিজেদের বাড়ি। সেই সময় ভি,আই,পি রোড বলতে কিছু ছিল না। সব রাস্তাতেই রিক্সা চলতো। আমি যেমন রিক্সায় বাসায় ফিরতাম, তেমনি কামালও। কামাল শাহবাগ হয়ে যেতো, আমি বাংলামোটর থেকে বাঁয়ে ইস্কাটন-মৌচাক হয়ে রামপুরা। অফিস শেষ হতো ঠিক পাঁচটায়। সবাই একসঙ্গে বের হতাম। কামাল মাঝে মাঝে আমাকে উঠিয়ে নিতো ওর রিক্সায়। বলতো, চলেন, আজ একসঙ্গে যাবো মৌচাক পর্যন্ত দু’জনে গল্প করতে করতে। আমি মৌচাকে নেমে অন্য রিক্সা নিয়ে রামপুরা চলে যেতাম। ঐ পথটুকু আমরা কত যে কথা বলেছি। দেশের কথা, নিজেদের কথা। তারপর ওর দুষ্টামি তো আছেই। যেমন, একদিন আমি হাই তুলেছি কিন্তু মুখে হাত দিই নি। ও হঠাৎ করে আমার মুখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছে। এত তড়িত ও এই কাজটি করলো আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমি বলি, ‘এটা কি করলেন?’ সে হেসে বলে, ‘মুখে হাত দেন নাই ক্যান। এর পর দেখবেন হাই উঠলে মুখে হাত দিতে ভুলবেন না।‘ কথাটা খুবই সত্যি।
কখনো এমন হয়েছে মৌচাক যেয়ে আমাকে আর নামতে দেয় নি, বলেছে, চলেন আমার বাসায়। চা খেতে খেতে গান শুনবো। আমি চলে গিয়েছি। ওর সঙ্গ ভাল লাগতো বলেই। তখন মোবাইল ফোনের যুগ ছিল না। বাসায় জানতে পারতো না। তবু সেই দিনগুলোয় এত দুশ্চিন্তা ছিল না। তখন সোনারগাঁও হোটেল থেকে রিক্সা করে নারিন্দা যেতে ২০/২৫ মিনিটের বেশি লাগতো না। কোন জ্যাম-জট ছিল না। তখন ঢাকা শহরে যাত্রাবাড়ি-সাইদাবাদ এবং আর দু’একটি জায়গা ছাড়া জ্যাম হতো না। ওর বাসায় ঘণ্টা খানেক থেকে চলে আসতাম। ওর বাসায় বড় মিউজিক সিস্টেম ছিল, ভাল ভাল ইংরেজি গানের কালেকশান ছিল। আমি ওর কাছ থেকেই সব ভাল গানের খোঁজ পেয়েছি। মাঝে মাঝে অফিস শেষে একসঙ্গে চলে গিয়েছি এলিফ্যান্ট রোডের গানের দোকানে। গীতালি অথাবা গানের ডালি। আরেকটা ছিল যেখানে ইংরেজি গানের কালেকশান ভাল ছিল, রেকর্ডিং-এর কোয়ালিটিও ভাল ছিল। নাম ভুলে গেছি। তখন ছিল টেপ রেকর্ডারের যুগ। ভাল ক্যাসেটের মধ্যে ছিল TDK, SONY, MAXELL এইসব। তখন ব্যান্ডের মধ্যে WHAM, UB-40, CULTURE CLUB, THE POLICE ইত্যাদি এবং Individual-এর মধ্যে Leo Sayer, Paul Young, Kenny Rogers, Cindy Lauper-দের মত অনেকেই আর reggae-তে ছিল Bob Marley বিখ্যাত। John Denver-এর Country road..., Conway Twitty-এর Hallo darling..., Leo Sayer-এর I love you more than I can say..., Raggae king Bob Marley’র Buffalo soldier... এগুলো ছিল তখন হিট করা গান। Michael Jackson তো ছিলই। গান নিয়ে কথা হতো খুব...বাংলা-ইংরেজি সবকিছু নিয়েই। তখন মাঝে মাঝে প্ল্যান করেই চলে যেতাম ওর বাসায়। শাহবাগের ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের পিছন দিয়ে হেয়ার রোড ধরে রিক্সায় যাওয়ার আনন্দই ছিল অন্যরকম। হেয়ার রোডের ঐ রাস্তাটা ছিল গাছ-গাছালিতে ভরা। পুরো রাস্তাটাই ছায়াঘেরা। বৃষ্টির দিনে ছিল অসম্ভব সবুজ। আমরা এখনো সেই হেয়ার রোড ধরে যাওয়ার কথা মনে করি।
লাঞ্চ অনেকেই বাইরে করতো। তবে আমি প্রায়ই রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে যেতাম, সময়ে কুলিয়ে যেতো তার কারন আমাদের লাঞ্চ আওয়ার ছিল দেড় ঘণ্টা, সাড়ে বারোটা থেক দুইটা। মাঝে মাঝে কামালকে নিয়ে যেতাম আমার বাসায় লাঞ্চ করতে। একবার মনে আছে আমরা খাচ্ছি, আমি বললাম, ‘শাকটা বেশ ভাল হয়েছে।‘ সঙ্গে সঙ্গে কামাল বলে উঠলো, ‘হ্যা, খুব ভাল হয়েছে।‘ অথচ ও কিন্তু শাক নেয়ই নি। ও শাকসবজি কম পছন্দ করতো। এড়িয়ে যাওয়ার জন্য কথাটা বলে ধরা পড়ে গেল। আমি বললাম, ‘আপনি তো শাক নেন নাই, তো বুঝলেন ক্যামনে?’ ব্যস, ধরা পড়ে হেসে উঠলো। বাধ্য হয়ে একটু শাক নিতে হলো। ও উচ্ছে বা করলা ভাজি খেতো না, কিন্তু আমার স্ত্রীর হাতের করলা ভাজি খেয়ে ওর অভ্যাস হয়ে যায় এবং আ স্বীকারও করে সে কথা।
মাঝে মাঝে অফিসে প্যাকেট লাঞ্চ নিয়ে আসা হতো। একবার মনে আছে লাঞ্চ শেষ করে আমরা ওয়াশ রুমে গিয়েছি হাত ধুতে। ওটা অফিসের বাইরে কমন ওয়াশ রুম। অফিস রুমগুলোতে কোন ওয়াশ রুম ছিল না। সব অফিসের জন্য ছিল এনেক্স বিল্ডিং-এর দুই দিকে ঝক ঝকে ওয়াশ রুম। কামাল আগে হাত ধুচ্ছে, আমি অপেক্ষা করছি। এর মধ্যে কথাও হচ্ছে। ওর ধোওয়া শেষ হলে বললো, ‘যান, হাত ধোন।‘ ও ট্যাপ খুলেই এসেছে। পানি পড়ছে, আমি হাত লাগিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তড়িতাহতের মতো চকিতে হাত সরিয়ে নেই। এই বদমাশটা নিজে ধোয়া শেষ করে কোন ফাঁকে ট্যাপের হট ওয়াটার লাইনটা চালু করে দিয়েছে আমার সঙ্গে মজা করার জন্য। কামাল তো আমার অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ার অবস্থা। আমিও ওর কান্ড দেখে না হেসে পারি না। কাউকে হঠাৎ বোকা বানাতে বা বিব্রত করতে ওর জুড়ি নেই। কখনো কখনো মিথ্যে কথা বলবে অবলীলায়, নির্নিমেষ। কিচ্ছু বুঝার উপায় নেই সেটা সত্য কি মিথ্যা। যদিও ওগুলো বেশির ভাগই white lies.
লাঞ্চের আগে মাঝে মাঝে স্টারটার নেওয়া হতো। সেটা আবার অন্যরকম। এই ব্যাপারটা পরে ধরতে পারি। লাঞ্চের ঠিক আগে কামাল এবং আরও দু’একজনকে দেখতাম বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে (আমাদের অফিস দোতলায় ছিল)। আমিও একদিন দাঁড়ালাম এবং দেখলাম সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের অফিস থেকে আঁটসাঁট শাড়ি পড়া এক মধ্যবয়সী মহিলা বেড়িয়ে আসছে...ফরসা, কাটা কাটা চোখ, ফিট বডি। সৌদিয়া’র অফিস আমাদের সামনেই বাঁ দিকটায়। মুল হোটেলের পিছনে এই এনেক্স বিল্ডিংটা U প্যাটার্নের। মহিলার বয়স আনুমানিক চল্লিশের কোঠায় হলেও বডি একেবারে ফিট...স্মার্ট, হাই হিল পড়ে গট গট করে হেঁটে যেতো। আকর্ষণীয় ছিল সন্দেহ নেই। তাদের লাঞ্চের সময়টাও ছিল একই সময়েই। ঐ দিন বুঝলাম লাঞ্চের ঠিক আগে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকার রহস্য কি! এটা ছিল খাবারের আগের স্টার্টার, মাঝে মাঝে।
মাঝে মাঝে প্রাক্টিক্যাল জোক করে বসতো। তখন একটা ভাল বাংলা সিনেমা রিলিজ হলো “বড় ভাল মানুষ ছিল”। ছবিটা একজন সাদা মনের মানুষকে নিয়ে, যিনি পরে পীর-দরবেশের মত হয়ে যান এবং এক সময় মৃত্যু বরন করেন। তখন তার এলাকার সবাই বলাবলি করে যে তিনি খুব ভাল মানুষ ছিলেন। এই শেষের দৃশ্যটার কারনেই ছবির নামকরণ করা হয়। কয়েকদিন পর একদিন অফিসে কামাল আমাকে বলছে, ‘আলম...আমার খুব ইচ্ছা হয় ‘আপনি খুব ভাল লোক ছিলেন’ এই কথাটা বলতে।‘ আমি হেসে ফেললাম। তার মানে হচ্ছে আমি মরে যাই। মানে আমার মৃত্যু-কামনা। আমি হেসে ফেলি। বলি, ‘তাই বলে এই রকম একটা সাধ আপনার!’ ও বলে, ‘না হলে তো বলতে পারবো না। বেঁচে থাকা মানুষদের এভাবে বলা যায় না।‘...এই হলো ওর মজা করা।
এই বয়সেই ওর মাথার চুল উধাও। সামনে চুল নেই বললেই চলে। কোনরকমে টেনেটুনে কিছু চুল সামনে নিয়ে আসে। নিজেই বলে, ‘আপনি ব্যাক ব্রাশ করে চুল পেছনে নেন, আর আমি পিছন থেকে ফ্রন্ট ব্রাশ করে সামনে নিয়ে আসি।‘
আমার লেখালেখি খুব পছন্দ করতো কামাল। এখনও করে। আমার একজন ভাল ভক্ত বা ফ্যান বলা যায়। আমার মনে হয় না আমি যা লিখি তা ছাপার যোগ্য। কিন্তু ওর প্ররোচনাতেই আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশ করি, যাতে ওর উৎসাহ আর অবদান ছিল অনেক। যদিও লাভ হয় নি কোন। সাদা-মাটা একটা বই ছিল, যার ব্যাক কভারে আমি ওর উপর ছোট্ট একটা নোট লিখেছিলাম। সেদিনও বললো...আপনার লেখাগুলো রেখে দিচ্ছি। এক সময় ছাপাবো। আমি বললাম, আমাকে আর লজ্জা দেবেন না।
ওর অনেক ভাল গুন আছে। যাকে তাকে অনেক সাহায্য করে থাকে। বাড়ীর বড় ছেলে। যথেষ্ট দায়িত্বশীল। বাবা মারা যাওয়ার পর নিজেই সংসারের হাল ধরেছে। ছোট দুই ভাইকে মানুষ করেছে, বোনদের বিয়ে দিয়েছে। এমনিতে ভদ্র-নম্র এবং শালীন। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গেই শুধু অন্যরকম। সব মানুষের ভিতরেই সম্ভবতঃ দুই রকম রূপ লুকিয়ে থাকে। যারা দেখতে পায় তাঁরা তাকে চিনতে পারে, যারা দেখতে পায় না তাঁরা ভুল বুঝে। আমি প্রথম প্রথম মাঝে মাঝে বিব্রত হলেও পরে ওকে চিনে ফেলেছি। আমি তো এখন ওর অস্ত্র দিয়েই ওকে ঘায়েল করি। যেমন, যদি বলে কি ভাই খোঁজ খবর নাই। আমি বলি, আপনাকে খোঁজ খবর দিতে হবে সে রকম কথা আছে নাকি! শুনে ও হেসে ফেলে।
কামালের সহযোগিতা না পেলে আফ্রিকায় যেয়ে কাজ করাও আমার জন্য কঠিন হতো। কোম্পানির পুরো একাউন্টিং সিস্টেম আমাকে শিখে যেতে হয়েছিল। আমাকে এডমিনিস্ট্রেশান এবং একাউন্টস দু’টোই দেখতে হবে বলে। সব শিখে যাওয়ার পরও অনেক সময় আটকে যেতাম। সফটওয়্যারে নতুন কিছু এসে যেতো। তখন কামালকে ফোন করে জেনে নিতাম। ও খুব ভাল করে বুঝিয়ে দিতো।
এত সখ্যতার পরও কামালের সঙ্গে আমার ‘তুমি’ সম্পর্কটা হয় নি। দু’জনে চেষ্টা করেছি অনেক। এখনও ফোনে মাঝে মাঝে ‘তুমি’ দিয়ে শুরু করে আবার ‘আপনি’তে চলে যাই। কেন হয় না জানি না।
সেই কামাল এখন আমেরিকায় সেটল্ড, স্থায়ী বাসিন্দা। গাড়ি-বাড়ি সব করেছে। ব্যবসা করছে। দুই ছেলে নিয়ে সুখের সংসার। আমাকে অনেক বলেছে, ‘আলম...চলে আসেন। আমরা একসঙ্গে থাকলে খুব ভাল থকবো। আপনার তো ভিসা আছেই। আমার এখানে থাকবেন যতদিন কিছু না হয়।‘ জাম্বিয়া থেকে চলে আসার আগে আমি পুরো পরিবারের জন্য আমেরিকার ভিসা নিয়ে এসেছিলাম। ও জানতো। তারপরও উৎসাহ দেখাই নি। অবৈধ ভাবে থেকে পরে কবে বৈধতা পাবো তার নিশ্চয়তা কি? তার চেয়ে এই ভাল অতলান্তিকের এপার ওপারে দু’জনের বসবাস। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। দু’জনেই স্মৃতিচারণ করে হাসাহাসি করি, আবার আফসোসও করি। এভাবেই একদিন সব ফেলে চলে যাবো...আমি আগে গেলে কামাল ঠিক বলতে পারবে “বড় ভাল লোক ছিল”!
©somewhere in net ltd.