নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যে পুকুরজলে ভাসে, ব্যথার নীলোৎপল। ঐ পুকুরজল ই লেখার কালি আমার।

সাখাওয়াত হোসেন সোহাগ

আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

সাখাওয়াত হোসেন সোহাগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ ত্রিকোনমিতি

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:৪৮

লোকটি হেলান দিয়ে বসে শান্ত চোখে মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটির নিষ্প্রাণ চোখ দু'টোর দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটির চুলহীন পুরো মাথায় সদ্য সদ্য তৈরী হওয়া দগদগে ক্ষত দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে এখনো। হাত আর পায়ের আঙ্গুলগুলোর মাথা থেকে অনর্গল বের হওয়া রক্তে মেঝে ভিজে যাচ্ছে। একটা মোটা লাইন আর একটা সরু লাইন ধরে রুমের এক কোনায় গড়িয়ে যাচ্ছে রক্তের দু'টো ধারা। সরু লাইনটা কিছুদুর গিয়েই জমাট বাঁধছে।

রক্তাক্ত মেয়েটি কিছুক্ষণ আগে কয়েকবার পেট কাঁপিয়ে বিশ্রী একটা ঘোঁ ঘোঁ শব্দ করে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে।
লোকটি ততোক্ষণ বসে ছিলো একটা পুরনো ঘুনে খাওয়া কাঠের চেয়ারে। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো মেয়েটিকে। মেয়েটির ছটফটানি, চিৎকার, ঘোঁ ঘোঁ।

মেয়েটির বয়স বিশ। ভাসা ভাসা চোখ, অতিরিক্ত চিকন ভ্রুঁ, হালকা উঁচু বুক, পাতলা কোমর। একটু আগেও মেয়েটির মাথায় ছিলো কোমর সমান লম্বা ঝরঝরে চুল, আর বামহাতের পাঁচটা আঙ্গুলেই শখ করে রাখা লম্বা পাঁচটা নখ। এখন কিছুই নেই। লোকটি শব্দ করে হাসলো। বাচ্চাদের মতো হাত তালি দিলো। মেয়েটি ঘোঁ ঘোঁ করে নিস্তেজ হয়ে যেতেই লোকটি চেয়ার ছেড়ে উঠে দু'হাত দু'দিকে মেলে ধরে মাথা নত করলো। চমৎকার একটা ম্যাজিক দেখানোর পর ম্যাজিশিয়ানরা দর্শকদের সামনে যেভাবে করে।
রাত তিনটা বেজে পঁয়ত্রিশ।

পরিত্যক্ত এই বাড়ির পেছনদিকে হালকা পাতলা জঙ্গল। কয়েকটা ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর হাজার খানেক জোনাকি ছেয়ে আছে এপাশটায়। আর আবছা অন্ধকার।
লোকটি দু'ঘন্টা আগে খোঁড়া মাঝারি সাইজের একটা গর্তে মেয়েটাকে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। এসময় কিছু বিড়বিড় করতে ও দেখা গেলো তাকে। তারপর চট করে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলো। ঠোঁটে বিদ্রুপের একটা হাসি।
হাঁটার সময় মাথা দুলিয়ে গুনগুন করে একটা গান গাওয়ার চেষ্টা ও করলো লোকটি। গানের প্রথম লাইন হচ্ছে, 'আমারো পরানে যাহা চায়...'

...
-- একটা ভয়ংকর সাইকো'র গল্প শুনবেন?

আমি একটু সরে বসলাম। ছোট্ট বেঞ্চি। লোকটি আমায় সরতে দেখে বিব্রত বোধ করলো। লজ্জা ও পেলো একটু। পুরুষ মানুষ লজ্জিত হলে চেহারায় হাবলা- ভ্যাবলা একটা ভাব চলে আসে। আমার মায়া লাগলো।
নিজের উপর রাগ ও হলো, এতোটা রিয়্যাক্ট দেখানো উচিৎ হয়নি। আবার রিয়্যাক্ট না করার ও কারণ খুঁজে পাচ্ছিনা।
আমি আছি এখন মায়াপুরী পার্কের সামনে। পার্ক বন্ধ। মেইন গেইটে মরচে ধরা দু'টা তালা ঝুলানো। রাস্তাটা নির্জন। রাস্তার এপাশে বেঞ্চি আছে বলেই রক্ষে। নয়তো কোথায় বসে অপেক্ষা করতাম কে জানে।

অপেক্ষা করছি শুভ্রার জন্যে। শুভ্রা দেখতে কেমন আমি জানিনা। কতোটুকু লম্বা, কেমন স্বাস্থ্য, ফর্সা কিনা কিংবা পরীর মতো দেখতে কিনা তাও জানিনা। আমি শুধু জানি কিছুক্ষণ পর ডানদিকের রাস্তা দিয়ে রিকশা করে একটা মেয়ে আসবে। মেয়ের পরনে সবুজ রঙের শাড়ি। কপালে টিপ। কানে দুল, নাকফুল। বাঁ হাতে মেহেদী। আর কোমর সমান লম্বা খোলা চুল।
শুভ্রাকে আমি ভালোবাসি, শুভ্রা আমাকে। কিংবা শুভ্রা আমাকে ভালোবাসে বলেই আমি শুভ্রাকে ভালোবাসি। ভালোবাসার প্রথম ও প্রধান শর্ত, ভালোবাসা ফেরত পাওয়া। এর ব্যতিক্রম দেখা দেয় বোকাদের ক্ষেত্রে। আমি বোকা না।
বিকেল এখন। লোকজন নেই এই জায়গাটায়, একটা পত্রিকা নিয়ে এসেছিলাম ভাগ্যিস। নয়তো সময় কি করে কাটতো কে জানে। পত্রিকার প্রথম পাতার ডানদিকের কোনায় ছোট্ট একটা খবরে চোখ আটকালো প্রথমেই। কুসুম নামের একটি মেয়ে বিভিৎস ভাবে খুন হয়েছে। এটা নিত্য দিনের ঘটনা। এসব সংবাদে চোখ পড়েও সরে যায় দ্রুত। কিন্তু আমার চোখ ঐ শিরোনাম আর কুসুমের ছোট্ট পাসপোর্ট সাইজের ছবিটা থেকে একটুর জন্যেও সরলোনা এখন। আটকে রইলো।

কুসুম কে আমার চেনা মনে হচ্ছে। কোথাও দেখেছি। পুরো সংবাদ পড়ে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। ঠিক ই সন্দেহ করেছি। পদ্মপুকুর কলেজ। ফার্স্ট ইয়ার। মেয়েটিকে ক্লাসেই দেখেছি। বড্ড অমনোযোগী। সারাক্ষণ জানালার বাইরে দৃষ্টি, ধমক দিলে চোখ জল জমে। আমি বারকয়েক ধমক দিয়েছিলাম, প্রত্যেকবার চোখে জল জমেছে।
মেয়েটির আমার কাছে একটা পড়া বুঝে নেয়ার কথা ছিলো। সন্ধ্যেয় আসতে বলেছিলাম। আসবে বলেও আসেনি। কি ভয়ানক! ঐদিন ই কি খুন হয়েছে কুসুম?
কুসুমের মৃত্যুটা অস্বাভাবিক, মাথার সমস্ত চুল আর হাত পায়ের সমস্ত নখ টেনে গোড়া থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। আমি অসুস্থ বোধ করলাম। এ কেমন পশু?
আমি খেয়াল করিনি, বেঞ্চির পাশে একটা লোক এসে বসেছেন। লোকটির পরনে ভদ্র পোশাক। ইস্ত্রি করা শার্ট, প্যান্ট, টাই... মনে হচ্ছে এক্ষুনি অফিস থেকে ফিরছেন। ভদ্রলোক কে চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় যেন দেখেছি? কুসুমকেও প্রথমে চিনতে পারিনি, দেখা যাবে ভদ্রলোককে হয়তো একটু পর ই চিনতে পারবো।

ভদ্রলোক হুট করে পত্রিকা চেয়ে বসলেন, প্রথম পাতায় দ্রুত চোখ বুলিয়ে ভাঁজ করে কোলের উপর পত্রিকা রেখে জিজ্ঞেস করলেন,
-- একটা ভয়ংকর সাইকো'র গল্প শুনবেন?

...
মেয়েটিকে মাটিচাপা দিয়ে
লোকটি গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে মেইন রোডে আসলো। চৌ রাস্তার মোড়। মোড়ে কিছু দোকান। সব দোকান ই বন্ধ। একটা দোকানের পাশে নলকুপ। লোকটির সারা গায়ে ঘাম।
মাথার সমস্ত চুল গোছায় গোছায় ধরে হাতে প্যাঁচিয়ে হেঁচকা টান দিয়ে একদম গোড়া থেকে তুলে আনা সহজ কোনো কর্ম নয়। শক্তির প্রয়োজন আছে। বিশ আঙ্গুলের বিশটা নখ টেনে তোলা আরো বেশি পরিশ্রমের। ঘাম দেয় শরীরে।
লোকটি নলকুপের সামনে গিয়ে ভেজা টি-শার্ট খুলে পানিতে ধুয়ে সারা গা মুছে নিয়ে, নিংড়ে পানি ফেলে আবার গায়ে দিলো সেটা। তারপর হাঁটতে লাগলো। হাঁটার সময় মাথা দুলিয়ে আগের মতো গান গাওয়ার চেষ্টা করলো, এই একটাই লাইন শুধু, যদিও সুর ঠিকঠাক হচ্ছেনা, কিন্তু গাইতে মজা পাচ্ছে লোকটি।
'আমারো পরানে যাহা চায়...'

গানের এই লাইনটি সম্ভবত লোকটির খুব প্রিয়।

রাস্তায় দু'য়েকটা কুকুর ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু লোকটি স্পষ্ট টের পেলো, কেউ একজন পেছনে আছে। পিছু নিয়েছে তার। পা টিপে টিপে হাঁটছে। অনেকক্ষণ ধরে। অতিমাত্রায় সতর্ক কেউ। পরিত্যক্ত বাড়িটির পেছনের জঙ্গলে মেয়েটিকে মাটিচাপা দিয়ে আসার পর থেকেই এই কেউ একজনের ঝাপসা উপস্থিতি টের পেয়েছে লোকটি।
গোয়েন্দা টোয়েন্দা নয়তো?

লোকটি সোজা পথে বাসায় ফিরলোনা। ঘুরতি পথে ততোক্ষণ শহরের এ গলি ও গলি ঘুরলো, যতোক্ষণ না পেছনের কেউ একজনটা পিছু নেয়া বন্ধ করে।

লোকটি বাসায় ফিরলো প্রায় ভোররাত্রির দিকে। বাসায় পৌঁছে লম্বা একটা গোসল দিয়ে বের হয়েই দেখলো, তার গুছিয়ে রাখা শুভ্র চাদরের বিছানায় কেউ একজন লম্বা হয়ে শুয়ে আছে।
লোকটি চমকে উঠে থতমত খেয়ে প্রায় চিৎকার করলো,
-- কে? কে শুয়ে আছে বিছানায়?

বিছানায় শুয়ে থাকা কেউ একজন হঠাৎ চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙ্গে লাফিয়ে উঠলো প্রায়। তারপর ডানদিকে চোখ ফিরিয়ে লোকটির থেকেও বেশি চমকে গিয়ে চোখ দু'টো প্রায় আপেলের মতো করে বললো,
-- আপনি, আপনি? আমার বাসায় কি করছেন? বের হন বলছি.. বের হন।

লোকটি হা করে তাকালো বিছানায় বসে থাকা মানুষটির দিকে। তার ই বাসাকে নিজের বাসা বলছে কেন মানুষটি?
মানুষটির কি মাথা খারাপ?

...
ভদ্রলোক অলরেডী দু'বার জিজ্ঞেস করে ফেলেছেন আমায়, একটা ভয়ংকর সাইকোর গল্প শুনাতে চান তিনি। আমি এমনিতেই সাইকো পাইকো কে ভয় পাই। তিনি আসছেন সাইকোর গল্প শুনাতে।

ভদ্রলোকের গল্প শুনাবার আকুতি দেখেই শুনতে রাজি হলাম। উহু, বাধ্য হলাম বলা যায়। শুভ্রা এখনো আসেনি। ভদ্রলোক কেশে গলা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করলেন,
-- সেরাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম। ভুল বললাম। স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন টা হচ্ছে, আমি একটা রুমে আছি। আমি একা নই। আরো দু'জন আছে সাথে। একটা শান্তশিষ্ট লোক, আর একটা বিশ- একুশ বৎসর বয়েসী অস্থির মেয়ে। দু'জনের একজনকেও আমি চিনিনা। লোকটির গায়ের রঙ কালো, চোখ দু'টোর কোনা হালকা লালচে হলেও দৃষ্টি শান্ত। মেয়েটি ফর্সা, কোমর সমান লম্বা চুল, ভাসা ভাসা চোখ, চোখভর্তি মায়া। আমি দাঁড়িয়ে আছি রুমের একটা কোনায়। চোখের সামনে সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। যেন স্বপ্ন নয়, বাস্তব। লোকটি দ্রুত মেয়েটির হাত পা বেঁধে ফেললো। তারপর মেয়েটিকে মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসিয়ে মেয়েটির কাঁধ ডান হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে রেখে গোছায় গোছায় চুল হাতে প্যাঁচিয়ে হেঁচকা টানে ছিঁড়তে শুরু করলো... প্রথম টানেই একগোছা চুল গোড়া থেকে ছিঁড়ে এলো, আমার বমি পেলো দেখে। চুলের গোড়ায় রক্তাক্ত মাংস লেগে আছে, মাথায় দগদগে ক্ষত, গল গল করে রক্ত বের হচ্ছে...
ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন। আমি ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক খানিক দম নিয়ে বললেন,
-- তীব্র ব্যথায় মেয়েটির চিৎকারে কানে তালা লেগে যাওয়ার অবস্থা হলো। আমি নড়তে পারছিলাম না, কিছু বলতে ও পারছিলাম না। আমার চোখের সামনেই লোকটি মেয়েটির সমস্ত মাথার চুল গোড়া থেকে তুলে নিলো। হাত পায়ের সমস্ত নখ ও টেনে তুলে নিলো। তারপর চেয়ারে বসে মেয়েটির শরীর কাঁপিয়ে ঘোঁ ঘোঁ করা উপভোগ করলো। মেয়েটি নিস্তেজ হয়ে পড়তেই মেয়েটিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে একটা গর্তে মাটি চাপা দিয়ে দিলো।

আমি বিরক্ত হলাম। প্রচন্ড বিরক্ত। পত্রিকায় কুসুমের নিউজটা পড়েছেন ভদ্রলোক। বসে বসে গল্প বানাচ্ছেন এখন। ভদ্রলোকের কি কথা বলার রোগ আছে? জিজ্ঞেস করলাম,
-- গল্প শেষ?

-- নাহ। শুনুন না, তারপর কি হলো। একটা চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গলো আমার। চোখ খুলে দেখি বাথরুমের দরজার সামনে গোসল সেরে বের হয়ে গোল গোল চোখে দাঁড়িয়ে আছে ঐ লোকটি, মেয়েটির চুল- নখ টেনে ছিঁড়েছিলো যে। চিৎকার টাও সে করেছে। জানতে চাইছে, আমি তার রুমে তার বিছানায় কি করছি?

-- অদ্ভুত!

ভদ্রলোক মাথা চুলকে বললো,
-- হু, অদ্ভুত ই। লোকটি দাবী করলো, বাসাটা তার। সে বাস করছে গত দু'বৎসর ধরে। দেয়ালে দু'টো ছবি টাঙানো আছে তার। আমায় দেখালো। একটা মধ্যবয়সী মহিলার ছবি, আরেকটা কিশোরীর। একটা তার মা, একটা বোন। ছবি দু'টোর দিকে তাকিয়ে আমার মাথা ঘুরালো। আমি পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলালাম। মাথার একাংশে তীব্র একটা ব্যথা টের পেলাম। ছবি দু'টো আমি লাগিয়েছি। মা আর মিষ্টির ছবি। মিষ্টি। আমার ছোট্ট বোন। পনেরো বৎসর বয়সে পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলো সে।
...
লোকটি চা করে এনেছে, মানুষটি চুপচাপ এখনো বিছানায় বসে আছে। চায়ে চুমুক দিচ্ছেনা। লোকটির ধারণা, মানুষটির মানসিক কোনো সমস্যা আছে। নয়তো তার বাসাকে নিজের বাসা বলতে যাবে কোন দুঃখে?
মানুষটি বিছানায় দম ধরে বসে রইলো কিছুক্ষণ, হঠাৎ বললো,
-- আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দুঃস্বপ্নে আপনি ছিলেন। আর একটি মেয়ে ছিলো। মেয়েটির নাম কুসুম। পদ্মপুকুর কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। আপনি মেয়েটির মাথার সমস্ত চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলেছেন, হাত পায়ের সমস্ত নখ টেনে খুলে নিয়েছেন। তারপর মাটিচাপা দিয়ে এসেছেন।

লোকটি শান্ত চোখে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর একটা চেয়ার টেনে বিছানার কাছে বসে কিছুক্ষণ মাথা চুলকে জিজ্ঞেস করলো,
-- একটা ভয়ংকর সাইকো'র গল্প শুনবেন?

মানুষটি মাথা নাড়তেই লোকটি গল্প বলতে আরম্ভ করলো,
-- একটা ছোট্ট বালকের গল্প বলি। পারিপার্শ্বিক অবস্থা কিংবা যেকোন কারণবশত কিভাবে যেন বালকটির মাথায় 'ইশ্বর' ঢুকে গেলো। ইশ্বর তিনি, যিনি সৃষ্টি করেন, ধ্বঃস করেন। জন্ম এবং মৃত্যু যার হাতে, তিনিই ইশ্বর। প্রাণ দিতে ও নিতে পারেন যিনি, তিনিই ইশ্বর। বালকটি ইশ্বরের ক্ষমতা পরখ করতে প্রথম এক্সপেরিমেন্ট করে ঐ বয়সেই। গিনিপিগ হয় বোন। বোনের বয়স পনেরো। গ্রামের ছেলেমেয়েরা খুব ছোট থেকেই সাঁতার শিখে ফেললেও, বোন টি তখনো শিখেনি। সবে শিখছে। বালকটি কি করলো শুনেন... বোন কে নিয়ে পুকুরপাড়ে গেলো। দুপুর তখন। মাথার উপর সূর্য। আশেপাশে কেউ নেই। আচমকা ধাক্কা দিয়ে বোনকে ফেলে দিলো পুকুরে, তারপর হাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আকুতি জানালো, 'হে ইশ্বর... জন্ম মৃত্যু তোমার হাতে। প্রথমে আমার বোনের প্রাণ নাও তারপর আবার ফিরিয়ে দাও...! আমি স্ব-চক্ষে দেখতে চাই।'

লোকটি দম নেয়ার জন্যে থামলো। মানুষটি চোখ কপালে তুলে বললো,
-- তারপর?

-- পুকুরে বোনের লাশ ভেসে উঠলো কিছুক্ষণ পর। বালকটি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে পুকুরপাড়ে বসে লাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। অপেক্ষার সেই শুরু।

-- কিসের অপেক্ষা?

-- বোনের। বালকটির ধারণা, ঐদিন ইশ্বর বোনের প্রাণ নিয়ে নেয়ার পর যেকোনো কারণেই হোক, প্রাণ আর ফিরিয়ে দিতে পারেন নি। এখন একটা শরীর খুঁজে বালক, একটা নারী শরীর। মৃত। যেখানে বোনের প্রাণ ফিরিয়ে দেবেন ইশ্বর।

-- কি অদ্ভুত!

লোকটি চায়ে চুমুক দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বললো,
-- বালকটি কিশোর হয়, তরুণ হয়। মগজে গেঁথে থাকা বীজ টা পরিপূর্ণ বৃক্ষ হয়ে ডালপালা ছড়াতে থাকে। বাইরের সাদাসিধে মানুষটি ভেতরে ভেতরে ভয়ংকর এক মানসিকতা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। গিনিপিগ হয় তরুণীরা, যাদের কোমর সমান লম্বা চুল আর বামহাতে শখ করে রাখা লম্বা নখ।

-- আশ্চর্য! এমন কেন?

-- বোনের অমন ছিলো। কোমর সমান লম্বা চুল, বামহাতে লম্বা নখ।

মানুষটি ঢোক গিলে, গায়ে ঘাম দেয়। জিজ্ঞেস করে,
-- সাইকো টা চুল আর নখ টেনে খুলে ফেলে কেন তাহলে?

লোকটি মাথা চুলকায় কিছুক্ষণ, তারপর গম্ভীর স্বরে বলে,
-- মানুষের নখ আর চুল, তার মৃত্যুর পরেও বাড়তে থাকে। সাইকো টার ধারণা, মানুষের প্রাণ আসলে নিষ্প্রাণ এই চুল আর নখ দু'টোতেই লুকোনো। প্রাণ নিয়ে নেয়ার পর ইশ্বর কিছুটা প্রাণ এ দু'টোতে রেখে দেন। এজন্যে শরীরটা বোন হয়ে আসার আগে, শরীর থেকে এ দু'টো সরাতে হয় তার। সরাতে তার ভালোই লাগে। যদিও প্রচন্ড পরিশ্রমের একটা কাজ।

মানুষটি ঘর্মাক্ত শরীরে সামনের চেয়ারে ঝুঁকে বসে থাকা লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষের চুল আর নখ তার মৃত্যুর পর ও বাড়তে থাকে, তথ্যটি ঠিক নয়। এটা একটা অপটিক্যাল ইল্যুশন। দৃষ্টিবিভ্রম। দেখার ভুল। লোকটি কি তা জানে?
মানুষটির কেন জানি মনে হলো, লোকটি এটা জানে। জানে বলেই লোকটির শান্ত চোখ দু'টোর দিকে তাকানো যায়না।
মানুষটি ভীত চোখে তাকায়, লোকটির ঠোঁটে হাসি। বিচ্ছিরি একটা হাসি। গা কেঁপে উঠে।

...
ভদ্রলোক কিছুক্ষণের জন্যে থেমেছেন। আমি ভদ্রলোক কে চিনতে পারছি এতোক্ষণে। আমাদের আগেও দেখা হয়েছে। কোথায় সেটা মনে করতে পারছিনা। জিজ্ঞেস করলাম,
-- লোকটি আপনার মা আর বোনের ছবিকে নিজের মা আর বোনের ছবি বলছে কেন?

ভদ্রলোক আমার দিকে শান্ত একটা দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
-- কারণ আমার মা, ওর ও মা। আমার বোন, ওর ও বোন। আর আমি হচ্ছি ও নিজেই। আমরা আলাদা কেউ নই। একিই মানুষের দু'টি সত্ত্বা।

আমি চমকালাম। চোখের পাতা কেঁপে উঠলো, ঠোঁট ও।
-- মানে?

-- খুলে বলি। একটা মানুষের তিনটে সত্ত্বা। ভালো, মন্দ, মাঝামাঝি। লোকটি হচ্ছে মন্দ সত্ত্বা। আমি হচ্ছি মাঝামাঝি সত্ত্বা। ভালো সত্ত্বা সারাজীবনেও তার মন্দ সত্ত্বার অস্তিত্ব টের পায়না। মন্দ সত্ত্বাটাও ঠিক তেমন। কিন্তু মাঝামাঝি সত্ত্বা টা দু'টোর অস্তিত্ব ই টের পায়। দু'টোকেই দেখতে পায়। দু'টোর সাথেই কথা বলে।

-- অদ্ভুত! আপনাকে তো পুলিশে দেয়া উচিৎ। কয়টা মার্ডার করেছেন এই পর্যন্ত?

-- এগারোটা। বারো নম্বরটা যেন না হয়, সেজন্যেই আপনার কাছে আসা।

আমি প্রচন্ড অবাক হচ্ছি, অবাকের চূড়ান্ত যাকে বলা যায়। উত্তেজনায় টিকতে না পেরে বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললাম,
-- মানে কি? কি বলতে চাচ্ছেন আপনি?

ভদ্রলোক কোলে ভাঁজ করা পত্রিকা পাশে বেঞ্চিতে রেখে সামনে সামান্য ঝুঁকে নিচের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-- শুভ্রা। ওর সাথে দেখা করোনা তুমি। শুভ্রার কোমর সমান লম্বা চুল, বামহাতে লম্বা নখ। দেখা হলেই তুমি ওকে কোনো এক সন্ধ্যেয় ডেকে নিয়ে যাবে কোনো এক নির্জন পরিত্যক্ত বাড়ির কাছাকাছি। তারপর...

আমি হা করে তাকিয়ে আছি ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক ভেজা স্বরে বলছেন,
-- দু'টো সত্ত্বার গল্প শুনেছো। মন্দ আর মাঝামাঝি। ভালো সত্ত্বাটা তুমি। আমরা তিনজন ই একটি মানুষ। তুমি একা নও। আমরা আলাদা নই মুনীর।

আমি রাগে কাঁপতে কাঁপতে চেঁচিয়ে উঠলাম,
-- মোটেও না। আমি খুনী না। বিশ্বাস করিনা আমি এসব। সব মিথ্যে। আপনি চলে যান এখান থেকে, চলে যান, এক্ষুনি...

ভদ্রলোক গেলেন না। চুপচাপ বসে রইলেন বেঞ্চিতে। ডানদিকের রাস্তা থেকে রিকশার টুংটাং আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আমার হাত পা কাঁপছে। শুভ্রা আসছে সম্ভবত। ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়েছেন। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-- আমি তোমার কাছে আসিনি। তুমি ই আমায় নিয়ে এসেছো। তুমি প্রথমবারের মতো প্রচন্ড প্রেমে পড়েছো। শুভ্রার প্রেমে। তুমি চাওনা শুভ্রার কোনো ক্ষতি হোক। তুমি চাও এই রোগ থেকে মুক্ত হতে। বলো চাওনা?

আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম, মাথা ব্যথা করছে, চিনচিন করে তীব্র একটা ব্যথা। ভদ্রলোক বললেন,
-- তবে আমায় বিশ্বাস করো। যদি আমায় দুরে সরিয়ে রাখো, তুমি কখনোই তোমার মন্দ সত্ত্বাটাকে দেখতে পাবেনা। আর যখনই তুমি আমায় বিশ্বাস করতে শুরু করবে, তোমার মন্দ সত্ত্বাটা এমনিতেই মরে যাবে।

রিকশা একটা এসে দুরে থেমেছে। রিকশা থেকে একটা মেয়েকে নামতে দেখছি। কোমর সমান লম্বা চুল, নাকফুল, কপালে টিপ, সবুজ শাড়ি। সবুজ রঙের শাড়ি পরার কারণে মেয়েটিকে সবুজ লতা বলে মনে হচ্ছে আমার। প্যাঁচানো একটা সবুজ লতা। মেয়েটি এক পা, দু'পা করে সামনে আসছে আমার। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। আমার চোখে জল...!

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:১০

স্রাঞ্জি সে বলেছেন:



হ্যাপি ব্লগিং........@

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:০১

সাখাওয়াত হোসেন সোহাগ বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.