নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যে পুকুরজলে ভাসে, ব্যথার নীলোৎপল। ঐ পুকুরজল ই লেখার কালি আমার।

সাখাওয়াত হোসেন সোহাগ

আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

সাখাওয়াত হোসেন সোহাগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ ঘোর

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৪৩

ইরাবতীর মন ভালো নেই।

পড়ার টেবিলে খুলে রাখা কেমিস্ট্রি বইয়ের পাতার উপর মাথা রেখে অনেকক্ষণ ধরে চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলো সে, ঠিক কি কারণে তার মন খারাপ। মনে করতে পারলোনা। অথচ ইরা জানে, কিছু একটা কারণ অবশ্য আছে। কারণ ছাড়া মন খারাপ করে থাকার মতো বোকা সোকা মেয়ে সে না। কিন্তু সেটা কি?

বাবা একটা কারণ হতে পারে।
মা ও হতে পারে।

এ দু'টো কমন ব্যাপার, প্রায়ই হয়। এগুলো ভুলে যাওয়া হয়না ইরার। আজ অবশ্যই অন্য একটা কিছু ঘটেছে। সেটা কি হতে পারে?

মন খারাপ হলেই ইরার মরে যেতে ইচ্ছে করে। একসাথে কয়েকটা লিব্রিয়াম গিলে মরে যাওয়ার পর, তার মৃতদেহটি দেখে বাবা মায়ের অনুশোচনাভরা মুখ, কিংবা যে মানুষটি তাকে দু'চক্ষে সহ্য করতে পারেনা, তার অনুশোচনাভরা চেহারা কল্পনা করে প্রচন্ড তৃপ্তি পায় ইরা। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে নেমে বইয়ের পাতা ভিজে যায়। মাঝে মাঝে চেষ্টা ও করে সে। শুধু জানালার ফাঁক গলিয়ে ঢুকে পড়া চাঁদের আলোর জন্যে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকার ইচ্ছে জন্মায় তার।

বড্ড অভিমানী!

ভীষণ গোপন সে!

এই যে ছোট্ট ছোট্ট কষ্টগুলোয় এতো বেশি কাঁদে, এতোবার মরতে ইচ্ছে করে তার, অথচ কেউ জানেনা। এমনকি সবচে প্রিয় বন্ধুটি ও না।

-- ঘুমোচ্ছিস?
ইরা চমকে উঠে মাথা তুলে পেছনে তাকালো, মা দাঁড়িয়ে। ইরা মাথা নাড়লো, মোটেও ঘুমোচ্ছে না সে। মা পেছনে দাঁড়িয়ে ইরার পিঠের উপর দৃষ্টি ফেলে কিছু কথা বললেন। শব্দহীন। কথাগুলো হচ্ছে,

-- কি, ঘুমোচ্ছিস না? এসেই তো দেখলাম বইয়ের উপর মাথা পেতে ঘুমোচ্ছিস। রুমের কি অবস্থা করে রেখেছিস? এখানে কাপড়, ওখানে বই, উলট- পালট সব। এই অগোছালো রুমে ঘুম আসে কি করে তোদের বুঝিনা। আমার তো দমবন্ধ হয়ে আসে।

ইরার পিঠ নিঃশব্দে এইসব শব্দহীন চিৎকার চুষে নিলো। অনেকক্ষণ শব্দহীন চিৎকার চেঁচামেচির পর চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে মা মুখে শুধু বললেন,
-- না ঘুমোলেই ভালো।

ইরার কান- শব্দ তিনটে চট করে চুষে নিতেই ইরা স্পষ্ট টের পেলো, মায়ের এই 'না ঘুমোলেই ভালো'র ভেতরের না বলা কথাগুলো হচ্ছে,
-- যতোক্ষণ জেগে থাকিস ততোক্ষণ চোখের সামনে মোবাইল নয়তো গল্পের বই থাকে... পড়াশোনার ধারেকাছে তো নাই। পড়ার টেবিলে বসে ঝিমুবি না তো কি করবি? এভাবে পড়েই তো গোল্ডেন আসে নাই। কি মনে করিস? আমি কিছু বুঝিনা? ভালো করেই বুঝি।

ইরা পিঠের পেছনদিকে ঠিক মাঝ বরাবর একটা জমাট অস্বস্তি টের পেলো। মা তাকিয়ে আছে বোধহয় এখনো। পেছনে না তাকিয়েই সে বললো,
-- আমি ঘুমোচ্ছিলাম না মা, বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। মোবাইল তো তোমার কাছেই, বুকশেলপে ও তালা দেওয়া। আর কি? দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে হবেনা তোমার। যাও...

দশ সেকেন্ডের মধ্যেই ইরা টের পেলো পিঠের ঠিক মাঝখান বরাবর জমাট বাঁধা অস্বস্তি যেটা সুড়সুড়ি দিচ্ছিলো এতোক্ষণ ধরে- হুট করে উধাও হয়ে গিয়েছে সেটা। ইরা মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো, মা নেই।
কেমিস্ট্রি বইয়ের তলায় থাকা 'আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী' বের করে বইয়ের উপরে রাখলো ইরা। কি চমৎকার! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইরা। কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স গুলা এই ডায়েরীর মতো অনবদ্য হয়না কেন?

প্রচ্ছদে হাসৌজ্জল আনা ফ্রাঙ্ক। প্রচ্ছদ উল্টে বইয়ের গন্ধটা নাকে শুঁকেই মনে হলো, পৃথিবীর সবচে দামী সুঘ্রাণের জন্যে প্যারিস যাবে কেন মানুষ? ওটা তো এই দেড়শো টাকার বইয়ের পাতার ভাঁজেই লুকোনো।
এই একিই বই এতোবার পড়া হয়েছে ইরার, অথচ তৃপ্তি মেটেনা। ইরার স্মরনশক্তি খুব বেশি ভালো না হলেও এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক্ষেত্রে সে হড়বড় করে বলে দিতে পারে আনা কয় তারিখ কি নিয়ে ভেবেছে, কান্না করেছে, অভিমান করেছে কিংবা পিটার কয় তারিখ, ঠিক কয়টা বাজে চুমু খেয়েছিলো আনাকে।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ইরা প্রায়শই চুল কেটে ফেলার কথা ভাবে। আনার চুল কাঁধ পর্যন্ত কাটা ছিলো। চুলের কথা ভাবতেই চট করে ইরার মনে পড়লো, কেন মন খারাপ তার আজ।

অনিকেত ব্যস্ততা দেখাচ্ছে আজকাল খুব। ইরা 'আনা'কে কেমিস্ট্রি বইয়ের তলায় লুকিয়ে রেখে বই বন্ধ করে উঠে পড়লো। অনিকেতের সাথে সারাদিন কথা হয়নি। ফোন- মেসেজে কিছুই না। নিজেকে 'মুই কি হনু রে' ভাবে কেন এতো ছেলেটা? প্রচন্ড রাগ হলো ইরার। বাবা বাসায় আসার সময় হয়নি এখনো। আসলে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে পড়তে হবে কিছুক্ষণ। ইরা নিঃশব্দে ছাদে উঠলো...

অন্ধকার ছাদ, চন্দ্রমাসের হিসেব নেই। অমাবস্যা চলছে কিনা কে জানে! ইরা ছাদের রেলিং ধরে দুরে তাকালো। একটা অন্ধকার সমুদ্র সামনে, কালচে ঢেউ, একটু বাতাস... রাগ কমেছে। অনিকেত কে এখন ফোন দেয়া যায়।

-- ইরাবতী...

ইরার মনে হলো, অনেকগুলো জোনাকি ভীড় করেছে পাশে তার। গা ঘেঁষে উড়ছে। একটা কোমল আলো মিশিয়ে দিচ্ছে গায়ে... ঐ আলো বিষন্নতা চুষে নেয়। রাগ চুষে নেয়। ভীষণ সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করে ইরাবতীর। ফোনের ওপাশে এই নামে শুধু অনিকেত ই ডাকে তাকে।

...

-- আপনার নাম কি ইরাবতী?

ইরা স্পষ্ট বুঝতে পারলো, এই ছেলেটির কোনো একটা বদমতলব আছে। তারা দাঁড়িয়ে আছে একটা লাইব্রেরীর সামনে। ইরা একটি বই কিনবে। পুরনো বই। একটা নতুন বইয়ের টাকা দিয়ে পাঁচটা পুরনো বই কেনা যায়। এখন কিনবে সে, ফালি ফালি করে কাঁটা চাঁদ। হুমায়ুন আজাদ। ইরার ধারনা, হুমায়ুন আজাদ পড়ার জন্যে একটা নির্দিষ্ট বয়স প্রয়োজন হয়। এর আগে পড়া যায়না।

ইরা এর আগে একবার পড়েছে এটা কোথাও, বুঝতে পারেনি তেমন। এখন আরেকবার পড়বে। ইরার ধারণা, সে যথেষ্ট বড় হয়েছে। যদিও তার চারোপাশের কেউ সেটা মানতে চায়না। ইরার প্রায়শই মন খারাপ হয় তাই।
-- আপনার নাম ইরাবতী?

ছেলেটির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ইরা, অন্য যে কোনো ছেলে হলেই এক দৃষ্টিতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে যেতো। এই ছেলে খেলোনা। বরং চোখের দৃষ্টি আরেকটু মেলে দিয়ে বললো,
-- আপনি কি 'ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ' কিনতে এসেছেন?

ইরাবতী চমকালো। ছেলেটির মোটেও তা জানার কথা নয়। নাম নাহয় খোঁজখবর করে জেনে নিতে পারে। ইরার ধারণা, ছেলেটা সারাদিন ধরে ফলো করছে তাকে। কিন্তু বইয়ের নামটা কি করে জানলো?
-- কে আপনি?

-- আমি অনিকেত।

একটু হাসলো অনিকেত নামের ছেলেটি। বামদিকে সিঁথি করে আঁচড়ানো তৈলাক্ত পরিপাটি চুল, ঢোলা টি- শার্ট, প্যান্ট... আর নরম দৃষ্টি অনিকেতের।

-- আপনি আমায় ফলো করছেন?

-- নাহ।

-- নাম কি করে জানেন?

কিছুক্ষণ চুপ করে ডানদিকের পিচ রাস্তায় চলা হুড়তোলা রিকশার দিকে তাকিয়ে রইলো অনিকেত নামের ছেলেটি। রিকশা ডানদিকের মোড় ঘুরে দৃষ্টির আড়াল হয়ে যাবার পরেও ওদিক থেকে চোখ সরালোনা, ওদিকে তাকিয়ে থেকেই যেন ঘোরের মধ্যে বললো,
-- কেন জানি মনে হলো, আজ ইরাবতী নামের কোনো একটা মেয়ের সাথে দেখা হবে আমার। সে একটি বই কিনবে। বইয়ের নাম, ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ। বইটা সে একবার পড়েছে, তখন কিছু বুঝেনি। আরেকবার পড়বে। তার ধারণা, সে যথেষ্ট বড় হয়েছে এখন।

অনিকেত নামের ছেলেটি হড়বড় করে কথাগুলো বলে পেছন ফিরে হাঁটতে লাগলো। বিষ্মিত ইরার মনে হলো, পা দু'টো তার পেরেক হয়ে মাটির সাথে গেঁথে আছে। নড়তে পারছেনা সে। হুশ ফিরে পেলো পুরো পাঁচ মিনিট পর। দ্রুত হেঁটে চৌ রাস্তার মোড়ে গেলো সে, চারদিকে চারটা রাস্তা চলে গিয়েছে। কোথাও কেউ নেই।

একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরলো ইরা, হাতে ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ। প্রচ্ছদের অবস্থা ভালোনা, প্রথম পৃষ্ঠা উল্টোতেই চমৎকার গুটি গুটি অক্ষরের হাতের লেখা চোখে পড়লো,

"একটা বদ্ধ জানালা, স্যাঁতসেঁতে রুম, মেঘলা ছাদ... আমায় না বুঝা কিছু মানুষ, হাতে ক'টা লিব্রিয়াম.. বহুদিন পর আজ জানালা খুলেছি। রাত সাড়ে দশটা। হুড়মুড় করে জোৎস্না ঢুকছে ঘরে.. এমন রাতে মরতে ইচ্ছে করেনা। থাক। আর কিছুদিন বাঁচি।
_অনিকেত"

...

-- ইরাবতী জানো? তোমার নামে একটা নদী আছে...

ইরা একহাতে ছাদের রেলিং মুঠো করে ধরে বলে,

-- তাই?

-- হু, শুধু নদী না, ডলফিন ও আছে।

-- বাহ। এখন কি তুমি আমায় শুশুক বলে ডাকবা?

অনিকেতের হাসির আওয়াজ শোনা গেলো। ইরা কানে ফোন একদম মিশিয়ে রেখে অনুভব করলো শব্দগুলো। বললো,
-- এক বৎসর হতে চললো। আচ্ছা, আমাদের অদ্ভুত পরিচয়ের বিষয়ে তোমার বোকা বোকা থিওরি কি? বলো তো শুনি...

অনিকেত ফোনের ওপাশে কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে,
-- আমার ধারণা, পুরো বিষয়টাই তোমার কল্পনা। বই কিনে বাসায় এসে পড়ার পর একটা ঘোর তৈরী হয়েছে, ঐ ঘোরে ঘি ঢেলেছে আমার ঐ লেখাটা। তারপর তুমি পুরো বিষয়টাই শুরু থেকে কল্পনা করেছো। কল্পনা করেছো, তুমি লাইব্রেরীর সামনে, অনিকেত নামের কেউ একজন তোমার পাশে দাঁড়িয়ে। যে তোমার ভেতর পড়তে পারে। বুঝেছো?

ইরা মাথা নাড়ে, অনিকেত কখনোই বিশ্বাস করেনি। এখনো না। অথচ ইরা জানে সে কিছু কল্পনা করেনি। সে কোনো স্বপ্ন দেখেনি। ওটা কোনো ঘোর ছিলোনা।

-- অনি...

-- হুম

-- অতো ঝুট ঝামেলার পর যখন তোমার নাম্বার খুঁজে পাই, তখন তুমি ফোনের ওপাশে আমায় প্রথম কি বলেছিলে মনে আছে?

-- কি?

-- বলেছিলে, 'আপনার নাম কি ইরাবতী?'

-- হু, মনে পড়েছে।

-- একিই কথা তুমি এখানে লাইব্রেরীর সামনে ও বলেছো। তুমি কি করে জেনেছো?

-- মুকুল ফোনে জানিয়েছিলো, ইরা নামের কেউ আমায় খুঁজছে। মুকুলের নাম ঠিকানা জোগাড় করেছে একটা বই থেকে। বইয়ের নাম, ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ।

-- আমি তোমায় সত্যিই দেখেছি অনিকেত। লাইব্রেরীর সামনে। তুমি আমার সাথে কথা বলেছো।

-- সম্ভবই না, আমি কখনো আমার শহরের বাইরেই পা দিইনি। অতোদুর তোমার শহরে তো নয়ই।

ইরা শব্দ করে ফোন রাখলো, প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ওর। কেন তাকে বিশ্বাস করবেনা অনিকেত। সে তো গাল গপ্প ফাঁদেনি। যেটা সত্যি সেটাই বলেছে।

টুং করে আওয়াজ হতেই মোবাইলের স্ক্রীনে চোখ রাখলো ইরা।

অনিকেতের মেসেজ।

'তুমি আবার চুল কেটেছো কেন? কাটবানা প্লিজ। আর শুনো, ছাদ থেকে দ্রুত নেমে আসো... আমার ভয় করে। কল্পনা করো, আমি হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছি.. সিঁড়ির গোড়ায়। নেমে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ো বুকে... আমার নিজের উপর ই নিজের হিংসে হয়, এতো ভালোবাসি কেন তোমায়!'

মেসেজ পড়েই চোখে জল জমলো ইরার। জোনাকিরা আবার এসে ভীড় করেছে পাশে। কি অদ্ভুত তীব্র সুখ। ইরার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। অনিকেত তাকে ভয় পায়। প্রচন্ড অভিমান জড়িয়ে ছাদ থেকে মোটেও লাফ দেয়ার মতো বাজে চিন্তা মাথায় আনবেনা সে এখন আর। তার 'অনিকেত' আছে। এখান থেকে বহুদুর, নদী ছাড়িয়ে, শহর ছাড়িয়ে, দেশের অন্য একটা প্রান্তে... অনিকেত দাঁড়িয়ে আছে কোনো এক সিঁড়ির গোড়ায়। দু'হাত মেলে। তার ইরাবতী জলে ভেজা চোখ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে বুকে, অপেক্ষায়...।

ইরা একটা ঘোরের মাঝে ছাদের দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নামে। সিঁড়ির প্রত্যেকটা ধাপ বড্ড অপরিচিত মনে হয় তার, মাথা ভারী হয়ে আছে, দৃষ্টি ঝাপসা। ইরা টের পেলো, জ্বর আসছে সম্ভবত...।

...
ঠক ঠক করে দরজায় কেউ নক করছে, অনিকেত কয়েকবার জেগে উঠতে উঠতে ও উঠলোনা। অসীম ধৈর্যবান কেউ অনবরত ঠক ঠক করেই চলেছে দরজায়। অনিকেত ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে উঠে দরজা খুলে বহু কষ্টে চোখের পাতা অর্ধেক খুলে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? সমস্যা কি? ঠকঠক করছেন কেন?

চোখে ঘুম থাকার কারণে তিনটে প্রশ্নের জায়গায় গলা দিয়ে বের হলো,
-- হুম.. হুউম... হুউউম...?

দরজায় মেশকাত দাঁড়িয়ে আছে। পাশের বাসার বড় ভাইয়া টাইপের কেউ। ভার্সিটির সিনিয়র ভাইয়া। এই বিল্ডিং এর দু'রুমের ছোট্ট ছোট্ট বাসাগুলোর প্রত্যেকটিতে একজন অথবা দু'জন করে ভার্সিটির ছেলেপেলে থাকে। সবার চেয়ে বড় সম্ভবত ইনি। অনিকেত যথেষ্ট সন্মান করে তাকে, কিন্তু মেশকাতের ধারণা সেটা যথেষ্ট হচ্ছেনা। প্রতিদিন সকালে প্রত্যেকের দরজায় ঠক ঠক করে সালাম নিয়ে যায় মেশকাত। ঘুম ঘুম চোখে সবাই সালাম দেয়। অনিকেত সালাম দিলেও আজ মেশকাত দরজা থেকে সরলোনা।

মেশকাতের বিষ্ময়ে বড় হওয়া গোল গোল চোখের দৃষ্টি অনিকেতের বিছানায়। অনিকেত তার দেখাদেখি ঘুমঘুম চোখে পেছনে তাকালো। তারপর চমকালো। ঘুম পুরোপুরি কেটে গেলে নিমিষেই।

বিছানায় একটা মেয়ে শুয়ে আছে। বয়স আঠারো। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙ, উঁচু নাক, চওড়া কপাল, ঝরঝরে চুল...। মেয়েটি কে চিনে অনিকেত। মেয়েটির নাম ইরাবতী। গতরাতেই ফোনে কথা হয়েছে। প্রচন্ড অভিমানী এই মেয়েটি গতকাল ও ছিলো অনেক দুর, দেশের অন্য প্রান্তে, অন্য একটা শহরে। এখন এই বিছানায় শুয়ে আছে।

তার কাছে, এ প্রান্তে, এই শহরেই।

অদ্ভুত!

মেশকাতের হা করা মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দ্রুত বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালো অনিকেত, তার পা কাঁপছে। এটা অবশ্যই কোনো স্বপ্ন। স্বপ্নের লজিক হয়না।
মেয়েটি চোখ মেলে তাকায়, ঘুম ঘুম গলায় বলে,

-- অনি... এ্যাই অনি, তুমি এখন বিশ্বাস করেছো?
অনিকেত চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে, না। আমি বিশ্বাস করিনা। এসব স্বপ্ন আমার। সব কল্পনা, ঘোর। হ্যালুসিনেশন।

...

দু'বৎসর পরঃ ইরা বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করলো অনেকক্ষণ ধরে। ঘুমোচ্ছেনা বাবুটা। তুলতুলে হাত পা নাড়াচ্ছে অনবরত, পা এসে লাগছে ইরার মুখে। ইরার বড্ড ভালো লাগছে। পাশে আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে অনিকেত। ফালি ফালি করে কাটা চাঁদ। ইরা কপট রাগ করে বললো,
-- এই এক বই কতবার পড়ো? বাবুটাকে কোলে নাও। ঘুম পাড়াও দেখি। সব কাজ আমার উপর ফেলে রাখো...

অনিকেত বই রেখে ঝুঁকে পড়ে, চিৎ হয়ে শুয়ে খেলা করা বাবুর বুকের উপর। বাবুটা ছোট্ট ছোট্ট নরম হাত পা দিয়ে ছুঁয়ে দিতে লাগলো অনিকেতের মুখ। অনিকেত বাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- বাবুর ছবি পাঠিয়েছো বাবা মায়ের কাছে? দেখতে কবে আসবেন বলেছেন উনারা?

ছোট ছোট ভেজা কাঁথা দু'টো বালতিতে নিয়ে রেখে চোখের সামনে চলে আসা কিছু উশৃঙ্খল চুল কানের পাশে গুজে দিতে দিতে ইরা বললো,

-- আসবেন শীঘ্রই।

-- আচ্ছা, বাবুর নাম কি রাখবে?

-- বলিনি তোমায় আগে? লীলাবতী।

-- লীলাবতী বড় হয়ে যদি জানতে চায়, 'তোমাদের প্রেম- বিয়ে কি করে হলো?' কি বলবে? একটা সিম্পল মিথ্যে গল্প, নাকি অদ্ভুত সত্য গল্প।

ইরা মুচকি হেসে বললো,
-- আমার ধারণা, লীলাবতী কোনোটাই বিশ্বাস করবেনা।

অনিকেত ঝুঁকে পড়ে চুমু দেয় বাবুর গালে। ইরা ওদিকে তাকিয়ে বলে,
-- ঐ দিন যা রাগ হয়েছিলো তোমার উপর। জ্বলজ্যান্ত আমি দাঁড়িয়ে আছি সামনে তোমার, অথচ তুমি চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করছো, সব ভুল, সব মিথ্যে, সব হ্যালুসিনেশন... ইডিয়ট।

-- কোনো ব্যাখ্যা আছে তোমার কাছে? কখন- কেন- কিভাবে?

ইরা ভ্রুঁ উঁচু করে বলে,
-- ব্যাখ্যা একটা আছে। প্রচন্ড ভালোবাসার ঘোর। এটা স্থান, সময়, দুরত্ব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

-- তুমি না সাইন্স পড়েছো?

ইরা মিষ্টি করে হেসে বলে,
-- তাই? তো তুমি তো বিশ্বাস করোনা এসব। অথচ এখনো আমার জ্বর হলে দু'হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ঘুমোও। কেন? জ্বরের ঘোরে আবার কোথায় না কোথায় চলে যাই, তাই? ভয়? গাধা কোথাকার। আমার গন্তব্য ছিলো প্রচন্ড ভালোবাসা। আমি ওখানেই এসে পৌঁছেছি। অবশ্য এর জন্যে তো কম ঝুট ঝামেলা পোহাতে হয়নি আমার...

ইরা শব্দ করে হাসে। অনিকেত মুগ্ধ চোখে তাকায়। ঝুঁকে থাকে লীলাবতীর বুকের উপর। তুলতুলে লীলাবতী ঘুমোচ্ছো। ডানদিকের জানালা দিয়ে গলগল করে সকালের মিষ্টি রোদ ঢুকছে। কাছেই ইরাবতী দাঁড়িয়ে। একটি ব্যাখ্যাতীত আশ্চর্য রাতে কাছে পাওয়া তার সবচে মূল্যবান বই। এই বইয়ের প্রত্যেকটি পৃষ্ঠা পড়েছে- জেনেছে সে...

ঐ 'কখন, কেন, কিভাবে'- না জানলেও চলবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.