নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনেকের তীব্র আপত্তি থাকা সত্ত্বেও জোর করে নিজেকে একজন সাদা মনের সহজ-সরল মানুষ হিসেবে ঘোষণা করলাম।www.facebook.com/shashish.shamikamal

শাশীশ

শাশীশের ব্লগ

শাশীশ › বিস্তারিত পোস্টঃ

কান নিয়েছে চিলে

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ৯:৫৬

[জাতীয় গ্রিডে সমস্যার কারণে ২০১৪ সালের নভেম্বর ১ (সকাল) থেকে নভেম্বর ২ পর্যন্ত সারা বাংলাদেশের সব জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে এত দীর্ঘ বিদ্যুৎ বিপর্যয় এর আগে হয়নি। এই লেখাটি আমার সেই সময়ের অভিজ্ঞতার বর্ণনা। তবে এই অভিজ্ঞতা আজকের দিনেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক বলে আমি মনে করি।]

কবি শামসুর রহমানের ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতাটি আমরা সবাই পড়েছি। কবিতার মূল কাহিনী অনেকটা এরকম- একটি চিল তার স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী আকাশে উড়ে যাচ্ছে। মাটিতে এক লোক তার পাশেরজনকে বলে উঠল- হায় হায় চিল তো দেখি আপনার কান নিয়ে চলে যাচ্ছে। এই কথা শুনে সেই লোক তার কান ফেরত পাওয়ার আশায় চিলের বিরুদ্ধে নানা মিটিং ও পরিকল্পনা শুরু করল। পরবর্তীতে দেখা গেল যে কান তার কানের জায়গাতেই আছে। অর্থাৎ এক ব্যক্তি এক গুজব রটিয়ে দেয় এবং অন্যরাও সেই উড়ো কথার অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে হইচই শুরু করে দেয়। এই কবিতা পড়ার পর বরাবরই আমার মনে হতো যে একজন মানুষের মাথায় এমন শয়তানি বুদ্ধি কিভাবে আসে? সামান্য একটি চিল পাখি। সেই চিল পাখি আবার এত কিছু থাকতে কান নিতে যাবে কেন? আর শত শত লোকই বা চিলের মিটিং মিছিল করবে কেন? এরকম কি শুধু বাঙ্গালীদের মধ্যেই হয় নাকি অন্যান্য প্রজাতির মধ্যেও হয়ে থাকে?

তবে গতকালের (২০১৪ সালের নভেম্বর ১) ব্ল্যাকআউটের পর কবিতাটির প্রতি আমার ভক্তি কয়েকগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুপুরে বাসায় ফিরে দেখি আমাদের প্রতিবেশী আঙ্কেল ৪০ লিটার পানি, ২০ কেজি চাল ও ৭ কেজি ডাল বাসায় মজুদ করেছেন। আবার ট্যাংক থেকে পানি সেচন করে বালতির পর বালতি ভরাচ্ছেন। পানি সেচ করছেন খুবই আগ্রাসী ভঙ্গিতে। একাই সব নিব, তোরা আমার সাথে পারবি না- এই ধরনের ভঙ্গিমা। তার পানি নেওয়ার ভঙ্গিমা ও দরদর করে ঘামতে থাকা দেখে আশেপাশের মহিলারা অনেক ভয় পাচ্ছে। আমাকে দেখে আঙ্কেল সতর্ক করলেন যে দেশে এক প্রকারের যুদ্ধ পরিস্থিতি শুরু হয়েছে। বাঁচতে হলে বুদ্ধি খাটাতে হবে। আমি ঘটনাটা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে বললে তিনি বলেন যে এত কথা না বলে বিপদের সময় টিকে থাকার জন্য কিছু রশদ সংগ্রহ করতে। আমি তাই করলাম। দোকান থেকে শিক-কাবাব,নানরুটি আর ২ লিটার কোক নিয়ে বাসায় রেখে দিলাম।

বিকালের দিকে কিছুক্ষণ বাসার ভেতর পায়চারি করার পর পরিস্থিতি ভালোমতো বুঝতে আবার বাসার বাইরে বের হলাম। আমাদের বাসার সামনে রয়েছে একটা গলি। দেখলাম সেই গলিতে পিচ্চি-পাচ্চারা খেলছে এবং তাদের শ্রদ্ধেয় মা, খালা, নানী ও অন্যান্য মহিলারা একত্রে গল্প করছেন। আরও নেমে এসেছে আশে-পাশের বাসার যুবতী মেয়েরা। বিকালের পড়ন্ত রোদের মাঝে মেয়েদের কলকাকলি। এদেরকে থার্টি-ফার্স্ট নাইট ছাড়া দেখা যায় না। থার্টি-ফার্স্ট নাইটে তারা বাসার ছাদের মধ্যে একটু খিচুড়ি খায় ও গল্প করে। তারপর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়- Had a really wild party…at rooftop. এই ব্ল্যাকআউটের অজুহাতে তারা যে ফেসবুক বাদ দিয়ে গলিতে গল্প করতে বের হয়েছে সেটা দেখে ভালো লাগলো। তবে এত ভালো লাগার সময় আমার নেই। দেশে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি।

আমি হেঁটে হেঁটে গলির বাইরে গেলাম। বাইরে একটা রমরমা পরিবেশ। খুব ভালো লাগল আমার। এলাকার নাপিত, কসাই, মুরগি বিক্রেতা সবাই এক পরিচিত খুচরা দোকানদারের দোকানে বৈঠক করছেন। শুধুমাত্র দোকানদার সাহেবই ব্যস্ত, বাকিরা সবাই বেকার। উনাদের সবার সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক। ভালো ছাত্র এবং ভালো চরিত্রের ছেলে হিসাবে আমাকে চিনে সবাই। ভালো চরিত্র ভাবে কারণ আমাকে দেখে তারা ধারণা করে নিয়েছে আমি হাবাগোবা এবং আমার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই। সত্যিই তাই। আমি অনেক ভালো। কোন মেয়ে থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন করছে আর কোন মেয়ে ফেসবুকে কি স্ট্যাটাস দিচ্ছে এসব হাবিজাবি নিয়ে কখনোই আমি ভাবি না। দোকানে আসা সবার সাথে খাতির থাকায় তারা বিভিন্ন সময় আমাকে বিভিন্ন গোপন ইনফরমেশন দিয়ে থাকেন। আজকে জানালেন যে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে বাঙালি হত্যার পরিকল্পনার পেছনে রয়েছে ভারত মাতা। ইহুদি ইসরাইল ও আমেরিকারও একটু একটু যোগসাজশ থাকতে পারে,যেহেতু ফিলিস্তিনে ইসরাইলী হামলার প্রতিবাদ করেছিল বাংলাদেশ। দোকানদার সাহেব আমার কানের কাছে এসে মৃত্যুর পূর্বে সান্ত্বনা দেয়ার মত করে বললেন- “তুমি বাবা চুপিচুপি ৩ টা মোমবাতি নিয়ে যাও। সবাইকে দিচ্ছি না”। দোকানে সবার মাঝে এক চাপা উত্তেজনার অনুভূতি। দেশ কোন দিকে যাচ্ছে?

সন্ধ্যার দিকে কয়েকজন বন্ধুর সাথে গেলাম আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। দেখলাম যে প্রেমিক-প্রেমিকারা ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো হয়েছে। আমি আমার বন্ধুদের সাথেই ক্যাম্পাসে হাঁটতে থাকলাম। চারপাশের পরিবেশ দেখে আমার বন্ধুদের মন খারাপ হয়ে গেল। ফার্স্ট ইয়ার এর ছেলেরা আবার এর মধ্যে মিছিল শুরু করেছে। প্রেমের ক্ষেত্রে অসাম্যের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদী স্লোগান দিচ্ছে- “কেউ পাবে, কেউ পাবেনা- তা হবে না, তা হবে না”। আমার বন্ধুরা কিছুক্ষণ মিছিলরত ছেলেগুলোকে গালিগালাজ করল, কাজ নাই তাদের, সারাক্ষণ ফাজলামি। তারপর আবার প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিয়েও কিছুক্ষণ টিটকারি করল। বন্ধুরা আসলে কাকে সমর্থন করছে আর কার বিরোধিতা করছে কিছুই বুঝতে পারলাম না। নিজের আপন কেউ না থাকায় সবাই যেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে।। একটু পর কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেয়ে যে যার মত মন খারাপ করে বাসায় চলে গেলাম।

রাত ১২ টায় আমি বাসায় ফিরলাম। মা বলল অনেকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে যে আগামী ৭ দিন কারেন্ট আসবে না। ব্যাপারটি আমার কাছে খুব ভয়ানক মনে হল। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। ঘুমাতে যাবো এমন সময় রাত ১২.৩০ এর দিকেই কারেন্ট চলে আসল। চারিদিকে খুশিতে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হল। পিচ্চি তো পিচ্চি, বড়রাও চিৎকার দিল। মেয়েগুলা তো এত জোরে চীৎকার দিল যে আমি ভাবলাম কি না কি বিপদে পড়েছে। বদের দল! বিশেষ করে একটা মেয়ে খুবই অহংকারি। যেদিন সত্যিই বিপদে পড়ে চিৎকার দিবে আমি বাঁচাতে যাবো না বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।

চিল পাখি শরীরের এত অঙ্গ প্রতঙ্গ থাকতে কেন কান নিয়ে উড়াল দেয়, সেটার একটা উত্তর পেলাম। কান আমরা নিজ চোখে দেখতে পারি না। যেই জিনিস সরাসরি আমরা দেখি না, তা আমরা নিজের মত করে বানিয়ে নেই। বাস্তবকে গড়ে তুলি কল্পনা দিয়ে। সেই কল্পনায় আমাদের মনের গভীর চাহিদাগুলোই প্রকাশিত হয়। এই কথা আমাদের এলাকার দোকানদার, নাপিত, কসাই থেকে শুরু করে বড় বড় পন্ডিত- সবার জন্যই সমানভাবে সত্য। দেখতে পাওয়া, না পাওয়ার ছায়াখেলার মধ্যেই চিল নিয়ে যায় আমাদের কান। আমরাও ছুটে চলি তার পিছে। একবার ভাবলাম পাশের বাসার আঙ্কেলকে যেয়ে বলি যে যুদ্ধ তো হলো না, এত পানি, চাল ডাল দিয়ে কি করবেন? যুদ্ধ যে হয়নি সেই খুশিতে এগুলো সব গরীব মানুষদের দান করে দেন। কিন্তু দেশের এনার্জি ফিরে এলেও আমার আর এনার্জি ছিল না। কিছুদিন ধরেই আমার জ্বর। তাই শীত শীত লাগছিল। ঘুমিয়ে পড়লাম।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.