![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(২০২১ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে আমি করোনায় আক্রান্ত হই। ১৩ ই এপ্রিল আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই সময়কালের কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে এই লেখাটি আমি লিখেছি।)
১। করোনা নেগেটিভ
গলায় খুসখুসে কাশি অনুভূত হওয়া মাত্র আমি করোনা টেস্ট করালাম। পরদিন রিপোর্ট আসলো নেগেটিভ। অফিসে সেই সময় ক্লাস, সেমিনারসহ অনেক কাজের চাপ। অসুস্থতার কথা জানালে বলা হয় করোনা টেস্টের রিপোর্ট কি বলে। আমি জানাই - নেগেটিভ। তারপর আমাকে বোঝানো হয় যে এইসব সাধারণ সর্দি ও কাশি আদি কাল থেকেই মানুষের হয়ে আসছে এবং এটাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাই আমিও মহান আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ইউনিভার্সিটির সেমিনারে যাই। আমার কলিগদের সাথে বসে বসে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনতে থাকি। আলোচনা শোনার পর একসাথে খাই এবং আড্ডা দেই। অনলাইনে ক্লাস নেই এবং বকবক করি (করোনা শুরু হওয়ার পর থেকেই বিইউপির ক্লাসগুলো অনলাইনে নেয়া হয় )।
২। আদা চা খেলে আমার করোনা ভাল হয়ে যাবে-
খুসখুসে কাশিকে পাত্তা না দিয়ে দৈনন্দিন কাজ কর্ম করছিলাম। কিন্তু এরপর কাশি বাড়তে থাকে। কাশি বাড়ার সাথে সাথে শ্বাসকষ্ট। একসময় অবস্থা এমন হয় যে কথা বলতে গেলেই কাশি হয় এবং শ্বাস নিতে পারিনা। এমন অবস্থা হলো যে আমার পক্ষে আর ক্লাস নেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। কথাই বলতে পারিনা ক্লাস নিব কিভাবে। ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে যায় এবং জ্বর আসে। কিন্তু আমি তো করোনা নেগেটিভ। তাই আবার করোনা টেস্ট করলাম। দ্বিতীয় টেস্ট করানোর পর করোনা পজেটিভ আসলো।
করোনার প্রতি বাঙালীদের ভীতি ও সাহস দুটোই আমাকে অবাক করে।
করোনার শুরুর দিকে একসময় ফেসবুকে এরকম কথোপকথন দেখেছি-
>>জনৈক গ্রামবাসী - আমাদের গ্রামে গতকাল রাতে এক প্রবাসী এসেছে। আমরা এখন কি করব?
>>জনৈক সচেতন নাগরিক- লাথি মেরে গ্রাম থেকে বের করে দেন।
পরবর্তীতে সবার ভেতর থেকে এই ভীতি একদমই নাই হয়ে যায়। আমার কোভিড ধরা পরার পর ডাক্তার কিছু ওষুধ দেয়। আর চারপাশের মানুষ দেয় বিভিন্ন প্রকারের ফ্রি পরামর্শ। সবচাইতে বেশি যেই পরামর্শ পেয়েছি সেটা হল যে আদা চা খেলে নাকি করোনা ভাল হয়ে যাবে। কারও মনে কোন ভয় নেই। সবার পরামর্শ পেয়ে আমিও ভাবতে শুরু করি যে করোনা আসলে কিছুই না। মনের করোনাই বড় করোনা।
৩। ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি-
সবার কথামত বালতির পর বালতি আদা চা খেয়ে কোন লাভ হলো না। কাশি বাড়তে থাকে। নানা ধরনের ওষুধ খাওয়ার পরও জ্বর ১০৪ ডিগ্রি থেকে কমে না। জ্বর না কমার মানে হল শরীরের (ফুসফুসে) ইনফেকশন কমছে না। শ্বাস কষ্ট বেড়ে যায় অনেক এবং মনে হচ্ছিল সেই রাতেই নিঃশ্বাস না নিতে পেরে মরে যাব। সাথে সাথে বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ করা হয়। কুর্মিটোলা, এএমজেড ইত্যাদি। কোথাও সিট খালি নেই। অবশেষে ল্যাবএইড হসপিটালে একটি সিট খালি পাওয়া যায়।
সেখানে নেওয়ার পর নার্সরা আমাকে বলে হুইল চেয়ারে বসতে। হুইল চেয়ারে করে নেয়া হবে আমাকে রুমে। আমি বললাম আমি হাঁটতে পারব। হুইল চেয়ারে নেয়ার দরকার নেই। তারা বলল না প্রটোকল অনুযায়ী আমাকে হুইল চেয়ারে করেই নিতে হবে।
হুইল চেয়ারে বসার পর থেকেই নিজেকে খুবই অসহায় মনে হলো। মনে হল আমার নিজের জীবনের ওপর নিজের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করবে এখন অন্য অজানা কিছু মানুষ। সেটাই হল। হুইল চেয়ারে বসিয়ে প্রথমেই আমাকে নেয়া হল এমারজেন্সিতে। সেখানে ৩০ মিনিট রেখে অক্সিজেন দেয়া হল, প্রেশার চেক করা হল, গ্লুকোজ লেভেল চেক করা হল ইত্যাদি। এসব কাজ আমার জন্য বরাদ্দ রুমেও করা সম্ভব ছিল। কিন্তু তারা এসব এমারজেন্সি রুমে করে। পরবর্তীতে দেখতে পাই এই ৩০ মিনিটের জন্য প্রায় ১২ হাজার টাকার মত আলাদা চার্জ করা হয় – যেটা আমার মনে হয় অপ্রয়োজনীয় ছিল।
৪। কূটনামি-
হুইলচেয়ারে বসার পর থেকে নিজেকে মৃত্যুপথযাত্রী মনে হচ্ছিল। তাই মন মেজাজ ভাল ছিল না। এভাবে এক ক্ষুদ্র জীবাণুর হাতে মরে যাব সেটা ভাবতেই খারাপ লাগছিল। এমারেজেন্সি থেকে আমাকে আমার রুমে নেয়া হল। রুমে নেয়ার পর যেই ছেলে হুইলচেয়ার টেনে নিয়ে এল সে জিজ্ঞাসা করল-
---স্যার, টিভি দেখবেন?
আমি মরে যাই আর এই ব্যাটা বলে স্যার টিভি দেখবেন? এখন কি টিভি দেখার সময়? আমি মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করলাম যে না টিভি দেখব না।
ছেলে আমাকে পাত্তা না দিয়ে চিৎকার শুরু করল- টিভির রিমোট কই, টিভির রিমোট নাই কেন? তাড়াতাড়ি রিমোট দেন, স্যার টিভি দেখবেন।
আমি ত অবাক। পরে রুমের দায়িত্বে থাকা লোকজন এসে টিভির রিমোট খোঁজা শুরু করল, কিন্তু রিমোট পাওয়া যাচ্ছেনা। আমাকে বয়ে আনা ছেলে হাউকাউ শুরু করে দিল যে কেন রিমোট পাওয়া যাচ্ছেনা। তার হাউকাউ শুনে এবার রুমের দায়িত্বে থাকা আরেক ছেলে ঝগড়া শুরু করল-
>>>রুমের দায়িত্বে থাকা ছেলে - আপনার দায়িত্ব হচ্ছে রোগীকে রুমে দিয়ে চলে যাওয়া। আপনি রোগীকে এনে দিয়েছেন। থ্যাংক ইউ। এবার আপনে যান।
>>>হুইলচেয়ার ছেলে- মানে কি? স্যার টিভি দেখবেন। আর আপনারা ত কিছুই ঠিকমত দেন না। আগের রোগীও এটা পায় নাই…সেটা পাইনি (বলতে থাকলো নানা কথা)।
>>>রুমের দায়িত্বে থাকা ছেলে- আপনি এত কথা বলার কে? রোগী নিজে ত কিছু বলে না। আপনি এত কথা বলেন কেন?
>>>হুইলচেয়ার ছেলে – রোগী কথা বলবে কিভাবে? উনি শ্বাসকষ্টে কথা বলতে পারছেনা বলেই ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
>>>রুমের দায়িত্বে থাকা ছেলে- (আমার দিকে তাকিয়ে) স্যার, রিমোট আর ব্যটারি কালকে এনে দেই? আজকে ত রাত হয়ে গিয়েছে।
>>>আমি- না, আজকেই ব্যাটারি ম্যানেজ করেন।
তারা ব্যাটারি আনলো এবং রিমোট ঠিক করে আমাকে দিল। নিজের কাছে সৎ থাকার জন্য রিমোট দিয়ে টিভি চালালাম। বুঝলাম যে এদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক ভাল না। তাই শুধু শুধু সামান্য বিষয় নিয়ে ঝামেলা করেছে। রিমোটের চিন্তা করতে করতে আমার নিজের শরীরের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। শ্বাসকষ্ট বাড়াতে আবার মনে পড়ল। আমাকে পাঠানো হল সিটি স্ক্যান করতে। সিটি স্ক্যান রিপোর্টে দেখা গেল ফুসফুসের ৪০% আক্রান্ত হয়েছে কোভিডে। রিপোর্ট পাওয়ার কিছুক্ষণ পরই ডিউটি ডাক্তার এসে কিছু প্রশ্ন করল। দেখলাম নার্সরা একগাদা ওষুধ নিয়ে এসেছে। ক্যানোলা পরানো হলো। অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া হলো। হাতে ও পেটে ইনজেকশনের মাধ্যমে একের পর এক ওষুধ দেয়া হল । ভয়ানক অনুভূতি।
৫। রোবোকপ ডাক্তার-
ডিউটি ডাক্তারের পর মেইন ডাক্তারের সাথে দেখা হল পরেরদিন দুপুরে। ডাক্তার সাহেব ৬ ফুট লম্বা, সুঠাম দেহ। তিনি এমন পিপিআই পরেছেন যা অত্যাধুনিক। একটি অক্সিজেন মেশিন পোশাকের সাথে লাগানো ছিল যেখান থেকে সরাসরি উনি অক্সিজেন নিতেন। উনাকে দেখতে লেগেছিল রোবোকপের মত। ডাক্তার আমার রুমে এসে ৩০ সেকেন্ড রিপোর্ট দেখে চলে গেলেন। এভাবে প্রতিদিন তিনি এসে রিপোর্ট দেখেন আর বলেন- শরীর ভাল? আমি উত্তর দেই। তারপর নানা কথা জিজ্ঞাসা করতে থাকি। উত্তর আশা করি। কিন্তু সে আমার সব কথা ইগনোর করেন সম্পূর্ণভাবে। প্রতিদিন রুমে ঢুকেই বলেন- শরীর ভাল? এরপর যাই বলি আর কোনো কথা নেই।
৭। পোস্ট কভিড কমপ্লেক্সিটিস-
১০ দিন পর বাসায় ফিরলাম। ১০ দিন ধরে প্রতিদিন ৩ বেলা নানারকম ইনজেকশন আর অনেক রকমের ওষুধ নেওয়ার সাইড এফেক্ট হিসাবে আমার ডায়বেটিস হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়। আমার আগের থেকে ফ্যাটি লিভার এর গ্রেড ২ লেভের সমস্যা ছিল। সেটার অবস্থা আর খারাপ হয়। ইউরিক এসিড বেড়ে যায় অনেক। ইনফ্লেমেশান ও অন্যান্য অনেক ধরনের রিপোর্ট খারাপ আসে। দুর্বলতা, কাশি ও শ্বাসকষ্ট ত ছিলই। আমার ফুস্ফুস যেহেতু ৪০% আক্রান্ত হয়েছিল তাই ভীষণ দুর্বল অনুভব করতাম এবং কথা বলতে পারতাম না। সামান্য কথা বললেও কাশি আসত ও শ্বাস হারিয়ে ফেলতাম।
ডাক্তার বলেছিল ফুসফুস যদি ন্যাচারালি হিল না করে এবং ফাইব্রোসিস হয়ে যায় তবে সেটা আর ঠিক হবে না। সারাজীবন শ্বাসকষ্ট নিয়ে থাকতে হবে। এটা শুনে আমি ভয় পাই। আমার একজন ডাক্তার স্যারের সাথে কথা বলি। উনার সাথে কথা বললে সাধারণত আমি সাহস পাই কারণ উনি সবসময় সাহস দেন সবাইকে-
---স্যার- হ্যাঁ শাশীশ, তুমি ভয় পেও না। শোনো, ফুসফুস দেহের এমন একটি অংশ যার কয়েক টুকরা কেটে ফেললেও তুমি শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারবা। কোনো সমস্যা হবেনা।
---আমি- স্যার? আমার ফুসফুস কেটে ফেলতে হবে?
---স্যার- আরে না… বোকা ছেলে। ফুসফুস কেটে ফেলতে হবে কেন? আমি বললাম যদি কোনো কারণে কেটেও ফেলতেও হয় তাও তোমার সমস্যা হবেনা।
---আমি- জি স্যার।
---স্যার- তোমার রিপোর্টগুলো পাঠিয়ে দিও স্ক্যান করে।
---আমি- জি স্যার।
আমি একজন মানুষ ঘরে বসে আছি। এর মধ্যে আমার ফুসফুস কেটে টুকরা টুকরা করার কথা আসবে কেন? স্যারকে ভয়ে আর রিপোর্টগুলো পাঠাইনি।
(২০২২ সালের ১৩ ই এপ্রিল আপডেট- আমি আল্লাহর রহমতে পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হয়েছি।)
১৫ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ১১:১৬
শাশীশ বলেছেন: ২০০৭ এসএসসি, ২০০৯ এইচএসসি
২| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:০৮
জিকোব্লগ বলেছেন:
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আপনাকে অনেক রহমত করে করোনা থেকে সুস্থ করেছেন।
ব্লগে আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
১৫ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ১১:১৬
শাশীশ বলেছেন: ধন্যবাদ
৩| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩১
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন।
বাস্তব কথা। লেখায় কোনো ভান বা ভনিতা করেন নি। এটা ভালো লেগেছে।
১৫ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ১১:১৭
শাশীশ বলেছেন: হাহা। ধন্যবাদ।
৪| ১৫ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ১১:২২
জ্যাকেল বলেছেন: লেখার গুণাগুণ প্রশংসা করতেই হয়। যাইহোক, আপনার বয়স অনেক কম, সে তুলনায় কস্ট বেশি হইয়া গেছে।
১৬ ই এপ্রিল, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:১৪
শাশীশ বলেছেন: আমার ওজন অনেক বেশি। স্বাভাবিক যেই ওজন হওয়া উচিৎ তার চাইতে ২০ কেজি বেশি। এটা একটা কারণ হতে পারে।
©somewhere in net ltd.
১|
১৫ ই এপ্রিল, ২০২২ বিকাল ৫:১১
সোনাগাজী বলেছেন:
আপনার বয়স কত?