| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস | 
শাওন আহমাদ
	এটা আমার ক্যানভাস। এখানে আমি আমার মনের কোণে উঁকি দেয়া রঙ-বেরঙের কথাগুলোর আঁকিবুঁকি করি।

ইট-কাঠের নিঃসঙ্গ শহরে জীবন যখন একঘেয়েমির ভারে ক্লান্ত হয়ে উঠছিল, তখন একদিন রাতে নুরুদ্দিন রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এলো টুনিকে। টুনি তখন খুবই ছোট। মুখে তুলে খেতে পারত না। জীর্ণশীর্ণ শরীর, হাঁটতে গেলেও পা জড়িয়ে পড়ে যেত ফ্লোরে। আমরা পালাক্রমে ওর যত্ন নিতে শুরু করলাম। প্রথম দিকে গুঁড়ো দুধ গুলিয়ে, নাহয় দুধের সঙ্গে বেশ করে ভাত মেখে মুখে তুলে খাওয়াতাম। এভাবে ধীরে ধীরে টুনি খাবার খাওয়া শিখে গেল। জীর্ণশীর্ণ শরীরে ফিরে এলো প্রাণ। শুরু হলো টুনির দৌড়ঝাঁপ আর লুকোচুরি।
 
 
 
অফিস শেষে যখন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতাম, দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ছাদের কোনো এক কোণ থেকে দৌড়ে এসে পা জড়িয়ে ধরত। মিউমিউ করে যেন সারাদিনের কুশল বিনিময় করত, কিংবা না-বলা নানা গল্প বলত। ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে যেতাম, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে যেত। রান্নার জন্য কাটাকুটি করতাম, গায়ের উষ্ণতায় গা মিশিয়ে বসে বসে দেখত। যতটা সময় রান্না করতাম, পায়ের কাছে ঘুরঘুর করত, ট্রাউজার বেয়ে কোলে উঠে আসত।
 
 
যখন সকল ব্যস্ততা শেষে একটু ফ্রি হতাম, তখন শুরু হতো ওর অহ্লাদ। হাতে মোবাইল দেখলে পা দিয়ে আঘাত করে ফেলে দিত। এমনভাবে নখগুলো গুটিয়ে আলতোভাবে আঘাত করত, যেন ব্যথা না পাই। এরপর বুকের ওপর উঠে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। কী নিষ্পাপ ছিল সেই চাহনি! কী অপার আদরে ভরা ছিল সেই মুখ! মোবাইল ফেলে ওর সাথে কথা বলা শুরু করলে, ও কানের কাছে, গলার কাছে মুখ ডুবিয়ে আদর করত। মৃদু স্বরে যেন অভিযোগের সুরে বলতে চাইত: "সারাদিন কোথায় ছিলে? একা একা ভীষণ মিস করেছি তোমাকে।"
 
 
কখনো কখনো ভয় দেখানোর জন্য ছাদজুড়ে লাগানো ফুলগাছের টবের আড়ালে, দরজার ফাঁকে, জুতোর বাক্সে, বুকশেলফের ভেতরে লুকিয়ে থাকত টুনি। ডাকলেও সাড়া দিত না। যখন ডাকতে ডাকতে গলার স্বরে চিন্তার ভাঁজ পড়ত, তখন লাফিয়ে এসে আমাদের গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। এদিক-ওদিক আলতো করে কামড় দিত।
অফিস থেকে ফেরার পথে যখন ওর জন্য চিকেন নিয়ে যেতাম, ও ঠিক টের পেয়ে যেত। রুমে এসে ব্যাগ রাখার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে দৌড়ে গিয়ে ব্যাগের চেইন খোলার চেষ্টা করত। খাবার বের করে খেতে দিলে একবার গিয়ে খাবারে মুখ দিত, আবার ফিরে এসে আমাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চুমু দিত। খাবার শেষ হওয়া অবধি চলত এ আহ্লাদ। এটা ছিল তার ভালোবাসা প্রকাশের এক ভিন্ন ভাষা।
 
 
এই পাষাণ শহরে আমার অফিস শেষে বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া ছিল না, অবশ্য আমার জন্য অপেক্ষা করারও কেউ ছিল না। কিন্তু টুনি আসার পর সব পালটে গেল। অফিস শেষে টুনির জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতাম, আর টুনিও এদিকে খাবার না খেয়ে আমাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় না খেয়ে বসে থাকত। যদিও আমরা অফিসে যাওয়ার আগে ওকে খাবার দিয়ে যেতাম, কিন্তু একটু খাবারও মুখে তুলত না। আমরা বাড়ি ফিরে এলে, তবেই সে খাবারে মুখ দিত।
কখনো কখনো অফিসে যাওয়ার পথ আগলে দাঁড়াত। মিউমিউ করে বলতে চাইত, "আজ অফিসে না গেলে হয় না? আজ থেকে যাও। চলো আমরা লুকোচুরি খেলি।" দিন যত গড়াচ্ছিল, আমরা টুনিতে আর টুনি আমাদের প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছিল। অদৃশ্য এক মায়ার বাঁধন শীতের রাতের উষ্ণ কম্বলের মতো পেঁচিয়ে নিচ্ছিল আমাদের।
 
 
কিন্তু হঠাৎই টুনির জীবনে এক ভয়ানক রাত নেমে এলো, যে রাত আমাদের মায়ার শান্ত নদীতে বিষাদের ঢেউ তুলল, নাড়িয়ে দিল আমাদের ভেতর-বাহির। টুনি পাশের ফ্লাটের কিচেনে দেওয়া তেলাপোকার বিষ খেয়ে চলে গেল না ফেরার দেশে। ভোরবেলা ওর নিথর দেহ খুঁজে পেলাম কিচেনের ফ্লোরে। বরফ-শীতল নিথর দেহ! করুণ চাহনি নিয়ে মায়াবী চোখ দুটো স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে, যেন শেষবারের মতো বলছে, "আমি তোমাদের সঙ্গে আরও অনেকটা দিন বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু..."
 
 
টুনিকে ময়লার গাড়িতে তুলে দিয়ে অফিসে গেলাম। কিন্তু মোটেও আমার অফিস কাজে মন বসছে না। বিড়াল মরে যাওয়ার শোকে যদি অফিস কামাই করার সুযোগ থাকত, তাহলে অফিসে বসে আমাকে বিষাদমাখা মন নিয়ে কীবোর্ডে বিরক্তিকর খটখট আওয়াজ করতে হতো না। সন্ধ্যায় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছি, চারদিকে একদম সুনসান নীরবতা। মনে হচ্ছিল, টুনির মৃত্যু শোকে আজ আকাশেরও মন খারাপ।
 
 
যখন রুমের কাছে এলাম, মনে হচ্ছিল, টুনি মিউমিউ করে ডাকছে। মুহূর্তেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম, এ আমার মনের ভুল। রুমের তালা খুলছি, টুনি এসে পা জড়িয়ে ধরছে না। রান্না করছি, ওয়াশরুমে যাচ্ছি; কোত্থাও টুনিকে দেখতে পাচ্ছি না। টুনি কোত্থাও নেই।
আমাদের বাড়িতে এখন শোকের মাতম। বাড়ির প্রতিটি জায়গায় টুনির স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মায়া বড় অদ্ভুত এক বন্ধন, একবার হৃদয়ে জড়িয়ে গেলে সহজে তার মুক্তি মেলে না।
 
 
০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৫  বিকাল ৩:১০
শাওন আহমাদ বলেছেন: কেউ কারো জায়গা নিতে পারে না। এ বিষাদ কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সময় লাগবে। 
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
২| 
০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৫  দুপুর ২:৫৫
নতুন নকিব বলেছেন: 
খুবই হৃদয় বিদারক। আপনার জন্য সমবেদনা।
 
০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৫  বিকাল ৩:১০
শাওন আহমাদ বলেছেন: এ বিষাদ কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সময় লাগবে। 
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
©somewhere in net ltd.
১|
০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৫  দুপুর ২:৩৮
আফলাতুন হায়দার চৌধুরী বলেছেন: .
টুনির জন্য মন খারাপ হল।
আরেকটা টুনি পান কিনা দেখুন। যদি মন একটু শান্ত হয়।