![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষ বলে ভুল করলেও নিজেকে মানুষই বলব আমি।
সালটা ১৯৩৪, বৃটিশ সাম্রাজ্য তখন স্বাধীকার আন্দোলন নিয়ে বেশ চিন্তিত আবার অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও উঁকি দিচ্ছে, এমন সময়েই জন্ম পঞ্চাশের কবি ‘আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ।’ পুরোনাম - আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ খান। ব্যক্তিগত জীবনে যিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ, আমলা, মন্ত্রী; তবে বাঙ্গালী, বাংলা সাহিত্য পিপাসুদের কাছে তিনি কবি ওবায়দুল্লাহ।
কবির সাথে কমবেশি সবার পরিচয় ‘কোন এক মাকে’ কবিতার মাধ্যমে, তবে তার কাব্যরীতি সাহিত্যিপ্রমীদের অনেকখানি আকর্ষিত করে। চটকদার বিজ্ঞাপনের অংশ কবি হয়েছেন কি হন নি তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতে পারে তবে তার, “আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি” বা “বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষদের জন্য প্রার্থনা” আধুনিক কবিতার এক অভূতপূর্ব সংযোজন।
জন্ম-পরিবার-শিক্ষা (বেড়েওঠা):
বরিশাল জেলা শহরে জন্ম নেন আবু জাফর, পিতা মুনসেফ আব্দুল জব্বার খান (পরবর্তী সময়ে স্পিকার), মাতা সালেহা খাতুন । সহোদরেরা হলেন – সাংবাদিক সাদেক খান, সাংবাদিক এনায়তুল্লাহ খান, ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী বেগম সেলিনা রহমান, দৈনিক নিউএজ এর প্রকাশক শহিদুল্লাহ খান। জন্ম বরিশালে হলেও তারা বেড়েওঠা ব্রহ্মপুত্রের পলি বিধৌত এবং গারো পাহারের কোলে, পিতার কর্মসূত্রে। পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহে আবু জাফর ওবায়দুল্লার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু। শান্ত স্বভাবের আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লেখাপড়ার প্রতি ছিলেন গভীর আগ্রহী। ১৯৪৮ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ভর্তি হন ঢাকা কলেজের কলা বিভাগে। ১৯৫০ সালে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে বি.এ. (অনার্স) কোর্সে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে অনার্স এবং ১৯৫৪ সালে মাস্টার্স কোর্স সমাপ্ত করে তিনি চাকরি জীবনে প্রবেশ করলেও লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন আজীবন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে তিনি আরো শিক্ষা লাভের আশায় পাড়ি জমিয়েছেন সুদূর পাশ্চাত্যে। ১৯১৫৮ সালে ‘Later Poems of Yeats : The Influence of Upanishads’ বিষয়ে যুক্ত্রাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেন এবং পরবর্তীতে ঐ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অর্থনীতিতে ডিপ্লোমা শেষ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে গবেষণা করার জন্য ফেলোশিপ পান। এছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হনলুলুর ইস্ট ওয়েস্ট সেন্টারের ফেলো ছিলেন।
বাবা আব্দুল জব্বার খান ছিলেন বিচারক। হাইকোর্টের জজ হিসাবে তিনি অবসর নেন। পরবর্তীতে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার হন। মা সালেহা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। অল্প বয়সে তাঁর মা মারা গেলে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। নতুন মা নিজেকে সত্ মা হিসেবে কখনও বুঝতে দেননি তাঁদের। ফলে সহোদর ভাই বোন এবং সত্ ভাই বোনের কোন ভেদরেখাও ছিলনা তাঁদের। আট ভাই পাঁচ বোনের সকলেই ছিলেন মেধাবি, একনিষ্ট এবং কর্মঠ। ফলে তাঁরা আজ সকলেই নিজ নামে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। তাঁর ভাইদের মাঝে রয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাপ্তাহিক 'হলিডে' সম্পাদক মরহুম এনায়েত উল্লাহ খান, বিশিষ্ট সাংবাদিক সাদেক খান, রয়েছেন বাংলাদেশের বাম রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। ছোট ভাই মাহীদুল্লাহ খান বাদল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। তিনি আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। তাঁর এক বোন বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের সাহসী কন্ঠস্বর সাবেক মন্ত্রী বেগম সেলিমা রহমান। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বিয়ে করেছিলেন ১৯৫৮ সালে। তাঁর স্ত্রী মাহজাবীন খান। এই দম্পতির দুই ছেলে এক মেয়ে।
সরকারী আমলা আবু জাফর :
১৯৫৪ থেকে ১৯৯৭ এই ৪৩ বছরের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বহু বৈচিত্রময় পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি ইংরেজিতে মাস্টার্স করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে লেকচারার হিসেবে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবনের শুরু হলেও পঞ্চাশ দশকের ক্যারিয়ারিস্ট জেনারেশনের চলতি রীতি ধরে তিনি ১৯৫৭ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকল পরীক্ষার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সচিব পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন পদে কাজ করেন। ১৯৮২ সালে সচিব হিসেবে অবসর নিয়ে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বাংলাদেশ সরকারের কৃষি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। ১৯৯১ সালে তিনি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ব্যাংককস্থ FAO (বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থায়) কার্যালয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৯৭ সালে FAO থেকে অবসর গ্রহণের সময় তিনি এ প্রতিষ্ঠানের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের মহাপরিচালক ছিলেন। ১৯৯৮ সালে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন উইনরক ফাউন্ডেশনের সাম্মানিক সদস্য; হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স ও জন এফ কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট-এর ফেলো।
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ –
সাতচল্লিশোত্তর বাংলা কবিতায় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ একটি বিশিষ্ট নাম। '৪৭-র দেশ বিভাগের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের কবিতায় ফররুখ আহমেদ, আবুল হোসেন, আহসান হাবীব প্রমুখ যে নতুন কাব্যভূমি তৈরি করেছিলেন সেই কাব্যভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর কাব্য পরিভ্রমণ। তবে তা কখনোই মসৃণ ছিল না। দেশ বিভাগ, নতুন জাতীয়তাবোধের চেতনা এবং সেই চেতনার অপমৃত্যুর দংশনে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে তাঁর কবিহৃদয় এবং সে বেদনার পরিস্ফুটন ঘটে তাঁর কবিতায়। ফলে আমরা দেখি কাব্যিক অভিযাত্রার শুরুতেই কবি যে দুঃসহ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন, তাকে কোনভাবে অস্বীকার করতে পারেননি তিনি বরং গ্রহণ করেছেন সত্য-উপাদান হিসেবে। ফলে ১৯৪৭ এর নতুন রাষ্ট্র অর্জনের উচ্ছ্বাস-উন্মাদনার চাইতেও তাঁর কাছে অধিক গুরুত্ব পেল বাংলার দুঃখ কষ্টের কাহিনী। উপরিকাঠামোর চাকচিক্য প্রত্যাখ্যাত হল কবির নিকটে। অপরিবর্তিত সামাজিক অবয়ব ও বাড়তি সংযোজন পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশকে তাঁর মত আরও অনেকেই আন্তরিকতার সঙ্গে চিত্রিত করলেন। পঞ্চাশের দশকের সৃজনশীল লেখকদের এবং আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ'র সাহিত্যিক স্বরূপকে তাই বলা চলে বিচ্ছিন্নতা-আক্রান্ত কিন্তু সত্যসন্ধানী। বিচ্ছিন্নতা রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও জাতীয়তাবাদের সঙ্গে এবং তাঁর অন্বিষ্ট বিষয়ের আড়ালে নিহিত। এ-স্বরূপটিকে কলিন উইলসন তাঁর 'দ্যা আউটসাইডার' গ্রন্থে আধুনিক কবি সাহিত্যিকদের একটি বিশিষ্ট প্রবণতা বলে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, জীবন-বিরোধী উপাদান বা পরিস্থিতির বিদ্যমানতা সত্যসন্ধানী লেখককে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধে আক্রান্ত করে কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতা জীবনের বিরুদ্ধে নয়। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ'র অবস্থান জীবনের ভিত্তিমূলে। সে অবস্থানটি যে কখনও টলেনি তার প্রমাণ তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'কমলের চোখ'। দশক বিচারে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ মূলত পঞ্চাশ দশকের কবি। পঞ্চাশের দশকেই তাঁর কবি হিসেবে আবির্ভাব এবং এই দশকেই তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'সাতনরী হার' প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। সওগাত প্রেস থেকে বইটি প্রকাশ করে দিয়েছিলেন কবি হাসান হাফিজুর রহমান। প্রথম গ্রন্থেই তিনি জানান দিয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব কন্ঠস্বরের। তাঁর লেখালেখির পেছনে হাসান হাফিজুর রহমানের প্রেরণা ছিল অসামান্য। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রথম সংকলনে প্রকাশিত তাঁর কবিতা 'কোন এক মাকে' কবি হিসাবে তাঁর সোচ্চার আবির্ভাব ঘোষণা করে। তাঁর ঐ কবিতা ভাষা শহীদ দিবসে দেশের প্রতিটি শহীদ মিনার থেকে উচ্চারিত হয়। কবিতার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন ছড়া ও গাঁথা কবিতার এক চিরায়ত লোকজ আঙ্গিক। আর এই আঙ্গিকের কারণেই প্রথম থেকেই তিনি তাঁর পঞ্চাশ দশকের অন্য সহযাত্রীদের থেকে ছিলেন আলাদা এবং স্বতন্ত্র। আর সে স্বাতন্ত্র্য তিনি তৈরী করেছিলেন এক ধরণের বাঙালিয়ানা আত্মস্থ করার ভেতর দিয়ে। ফলে আমরা দেখি পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে তাঁর সহযাত্রী অন্য কবিরা যখন ত্রিশের জীবনানন্দ দাশ কিংবা বুদ্ধদেব বসু'র কবিতায় প্রবলভাবে আচ্ছন্ন তখন তিনি ছড়া ও গাথা-কবিতার ভেতর দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন। কারণ তিনি তাঁর মনের মধ্যে বাঙালির শাশ্বত স্বরধ্বণি শুনতে পেয়েছিলেন। আর তাই ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের ভেতর দিয়ে হাজার বছরের লোকজ ছড়ার ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন- কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে আগুন লেগেছে, পলাশবনে লাল পরীরা নাইতে নেমেছে। কে দেখেছে? কে দেখেছে? কন্যে দেখেছে, নীল দীঘিতে স্বপ্ন হয়ে ভেসে উঠেছে। কে বলেছে? কে বলেছে? শালুক বলেছে, এলো খোঁপা বাঁধতে গিয়ে কন্যে কেঁদেছে। কে শুনেছে? কে শুনেছে? কেউতো শুনেছে, সোনার কাঁকন খুঁজতে মেয়ে জলে ডুবেছে। ('কুঁচবরণ কন্যে' 'সাতনরী হার'।
যদিও তিনি লোকজ ধারায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন তথাপি তাঁর কবিতায় আধুনিকতা এবং আধুনিক কবিতার আঙ্গিকের কমতি ছিল না কোন ক্রমেই। কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সম্পর্কে তাঁর উত্তরসূরী এক কবি ইকবাল আজিজ এক প্রবন্ধে বলেছেন- "১৯৫৫ সালে প্রকাশিত 'সাতনরি হার' কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটি ('কুঁচবরণ কন্যে' পড়েই বোঝা যায়, লোকজ ছড়ার ঢঙে তিনি যেন কাহিনী বলতে চেয়েছেন সেই শুরু থেকে, আর পুঁথি কবিতার মধ্য দিয়ে কাহিনী বলে যাওয়ার প্রবৃত্তি বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক আচরণ ও অভ্যাসের সঙ্গে বিজড়িত অথচ তিনি আধুনিক কবি; কবিতার দর্শন, আঙ্গিক ও চেতনার দিক দিয়ে জসীম উদ্দীন কিংবা বন্দে আলী মিয়ার কবিতা থেকে তিনি সম্পূর্ণ আলাদা অবস্থানে। এখানেই তাঁর প্রতিভার মৌলিকত্ব; তিনি লোকজ ছড়া ও গাথা-কবিতার ভাষায় কথা বলেছেন কিন্তু তাঁর চেতনা সুস্পষ্টভাবে একজন আধুনিক মানুষের মননকে প্রতিনিধিত্ব করেছে। এক্ষেত্রে ওবায়দুল্লাহকে সমকালীন আইরিশ কবি সিমাস হিনি কিংবা তাঁর বহু পূর্বের দুই মার্কিন কবি হুইটম্যান ও রবার্ট ফ্রস্টের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এই কবিরা যেমন আধুনিক হয়েও তাঁদের লোকজ অভিজ্ঞানকে ব্যবহার করেছেন অতিশয় নিপুণতার সঙ্গে; তেমনি ওবায়দুল্লাহও লোকজ ছড়া ও গাথা-কবিতার ঢঙে কবিতা নির্মাণ করেছেন।" ১৯৫৫ সালে প্রথম কাব্য প্রকাশ হলেও তাঁর দ্বিতীয় কাব্য প্রকাশ হয় দীর্ঘ বিরতিতে ১৯৭০ সালে। তাঁর দ্বিতীয় কাব্য 'কখনো রং কখনো সুর'। এরপর ১৯৭৪ সালে বেরিয়েছে 'কমলের চোখ'। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর সর্বাধিক পাঠকপ্রিয় কবিতার বই 'আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি'। মূলত আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিজীবনের টার্নিং পয়েন্টও এই কবিতাটি। 'আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি' কাব্যের ভেতর দিয়ে তিনি তাঁর কাব্যভাবনা ও কাব্যদেবী সম্পর্কে ঋজু ভঙ্গিতে যে সরল স্বীকারোক্তি করেছেন, তা প্রকাশ করেছেন অপরূপ মায়াবী এক ঐন্দ্রজালিক ভাষাময়তায়- আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিলো তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিলো। তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন। জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ মেঘমন্দ্র স্বরে এই কবিতায় যে অমোঘ সত্যবানী এবং মুক্তির আশা ব্যক্ত করেছিলেন তাতে করে এদেশের অনেক পাঠকই যেন দীর্ঘদিন পর কবিতায় কোন মহান মুক্তিদাতার কন্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিল। ফলে পাঠক সমাজে কবিতাটি বিপুলভাবে দাগ কেটেছিলে। এরপর এক এক করে বেরিয়েছে 'সহিষ্ণু প্রতীক্ষা', 'বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা', মৃত্যুর পর বেরিয়েছে 'মসৃণ কৃষ্ণ গোলাপ'। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর গ্রন্থ সংখ্যা বারোর অধিক। বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ছিল তাত্পর্যপূর্ণ অবদান। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রসমাজের আন্দোলন যখন চরম আকার ধারণ করে তখন শাসক গোষ্ঠী ছাত্রদের মিছিলে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশ সেই মিছিলে গুলি বর্ষণ করে এবং শহীদ হয় রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত প্রমুখ। ১৯৫২ সালে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। '৫২ ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে, মিছিলে, মিটিঙে তাঁর উপস্থিতি ছিল সরব। '৫২-র সেই মিছিল, পুলিশের গুলিবর্ষণ, শহীদ হওয়া ছাত্রদের লাশ তাঁর মনে গভীর বেদনার সৃষ্টি করেছিল। সেই বেদনা থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছিল তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'কোন এক মাকে'। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাহিত্য আন্দোলনেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন তিনি। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের প্রগতিশীল কবিদের নিয়ে গঠন করেছিলেন পদাবলী নামের একটি সাহিত্য সংগঠন। পদাবলী বাংলাদেশের সাহিত্য সংগঠনের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। দীর্ঘদিন ধরে কবিতার অনেকগুলো ধারাবাহিক সেশনের আয়োজন করেছিল এই পদাবলী। শুধু তাই নয় তাঁরা একটি নতুনত্বও এনেছিলেন তাঁদের আয়োজনে৷ দর্শনার্থী এবং শ্রোতাদের নির্দিষ্ট প্রবেশমূল্য পরিশোধ করে কবিতা ও কবিতার আলোচনা শুনতে হত। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এটি ছিল একটি বিরল ঘটনা।
কবি ওবায়দুল্লাহর কাব্যরীতি –
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ পঞ্চাশ দশকের অন্যতম কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর কবিতায় আবহমান বাংলার অকৃত্রিম ছবি পাওয়া যায়। তাঁর কবিতার সূচনা ভাষা আন্দোলনকে (১৯৫২) কেন্দ্র করে এবং বিকাশ ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সামগ্রিক জনজীবনের আশা-নিরাশা এবং স্বপ্ন-বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাঁর কাব্যরীতিতে মূলত দুটি প্রবণতাকে অনুসরণ করেছেন: একটি তাঁর প্রথম জীবনের প্রিয় গীতিমুখ্য কাব্যরীতি আর অন্যটি মহাকাব্যিক। পঞ্চাশের দশকে রচিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাত নরী হার (১৯৫৫) এবং পরবর্তীকালের কখনো রং কখনো সুর (১৯৭০) ও কমলের চোখ (১৯৭৪) এ ধরনের গীতিমুখ্য সুললিত কবিতার সংকলন। আশির দশক থেকে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ মহাকাব্যিক কাব্যরীতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। এ পর্যায়ে তাঁর কবিতার বিষয় হিসেবে উঠে আসা মা-মাটি ও সংগ্রামী মানুষের চিত্র পরিচিত দেশ-কালের সীমানা অতিক্রম করে স্পর্শ করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল। এ মহাকাব্যিক কাব্যভঙ্গিতেই তিনি রচনা করেন তাঁর সর্বাধিক জননন্দিত কাব্যগ্রন্থ আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি (১৯৮১)। এ ছাড়া সহিষ্ণু প্রতীক্ষা (১৯৮২), বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা (১৯৮৩) কাব্যগ্রন্থ দুটিতেও মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা লক্ষ্য করা যায়। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রচিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আমার সময় (১৯৮৭), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯১), আমার সকল কথা (১৯৯৩), খাঁচার ভিতর অচিন পাখি এবং জীবিত অবস্থার সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ মসৃণ কৃষ্ণগোলাপ (২০০২)। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেগুলির মধ্যে রয়েছে চীনের কমিউন সম্পর্কে Yellow Sands' Hills: China through Chinese Eyes; বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন সম্পর্কে Rural Development: Problems and Prospects; (Tom Hexner-এর সঙ্গে যৌথভাবে); Creative Development; Food and Faith । তিনি ‘পদাবলি’ নামে কবিদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। সংগঠনটি আশির দশকে দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা সন্ধ্যার আয়োজন করত।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
নাম: আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (ডাকনাম – সেন্টু)
জন্ম : ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪, বাহেরচর, বাবুগঞ্জ, বরিশাল।
মৃত্যু : ১৯ মার্চ ২০০১, ঢাকা৷
বাবা : আব্দুল জব্বার খান
মা : সালেহা খাতুন
স্ত্রী : মাহজাবীন খান
পেশা : সাবেক সচিব, সাবেক মন্ত্রী।
শিক্ষা :
মাধ্যমিক- ময়মনসিংহ জিলা স্কুল, ১৯৪৮।
উচ্চ মাধ্যমিক- ঢাকা কলেজ, ১৯৫০।
স্নাতক (সম্মান)- ইংরেজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৩।
স্নাতকোত্তর- ইংরেজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়. ১৯৫৪।
প্রকাশিত গ্রন্থ : কবিতা : সাতনরী হার (১৯৫৫), কখনো রং কখনো সুর (১৯৭০), কমলের চোখ (১৯৭৪), আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি (১৯৮১), সহিষ্ণু প্রতীক্ষা (১৯৮২), প্রেমের কবিতা (১৯৮২), বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা (১৯৮৩), আমার সময় (১৯৮৭), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯১), আমার সকল কথা (১৯৯৩), মসৃণ কৃষ্ণ গোলাপ প্রভৃতি৷
পুরস্কার : বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৯), একুশে পদক (১৯৮৫)৷
ব্রিটিশযুগে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, পাকিস্তান যুগে যৌবন এবং বাংলাদেশে দেখেছেন নিজের পরিণতি, সফল পরিসমাপ্তি। এই ত্রিকালদর্শী মহতী পুরুষ, মহান কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রায় এক বছর অসুস্থ থাকার পর ২০০১ সালের ১৯ মার্চ ৬৭ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার এই মৃত্যু দিবসে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
তথ্যসূত্র:
উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, বাংলা একাডেমী লেখক অভিধান, রাশেদ খান মেননের সাক্ষাৎকার ও কবি মুশারাফ করিম।
উৎসর্গ -
আতশবাজির মত প্রেম শেখানো প্রমাকে............
২| ২৩ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ১২:৩৯
এম.এ.জি তালুকদার বলেছেন: ব্লগ এইরকম লেখায় ভরে উঠুক।
©somewhere in net ltd.
১|
১৯ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ১০:৪৮
বিজন রয় বলেছেন: অনেক ভাল পোস্ট। অনেক কিছু জানলাম।
++++