নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

মানব সেবাই আমার মূল ধর্ম। বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে বৃহত্তর কুমিল্লার সংবাদ জানতে ভিজিট করুন www.comillardak.com এ ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

মানব সেবাই আমার মূল ধর্ম

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্রছিল ২০১২ সালে

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:০০

চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার ভারতীয় নারী দামিনির এই নৃশংস পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। তার মৃতদেহ একটি বিশেষ বিমানে করে সিঙ্গাপুর থেকে রাজধানী দিল্লিতে রোববার (৩০ ডিসেম্বর) ভোরে তার লাশ ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে পৌঁছায়। সেসময় বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী উপস্থিত ছিলেন।

প্রসঙ্গত: গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে বাসায় ফেরার পথে একটি চলন্ত বাসে গণধর্ষণের শিকার হন ২৩ বছর বয়সী মেডিকেল ছাত্রী দামিনি। এসময় তাকে মারধরও করে দুষ্কৃতিকারীরা। এরপর তাকে বাস থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়। বিষয়টা ঠিক টিস্যু পেপারের মতো। দুই সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের পর গত শনিবার ভোরে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালেই মারা যান দামিনি। দামিনির মৃত্যুতে অবশ্য গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের নীতিনির্ধারকেরা। আর এ গণধর্ষণের ঘটনায় ভারতজুড়ে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। টনক নড়ে সারা বিশ্বের মানুষের। রাজপথ থেকে সংসদ- এ ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে। এটা নারী নির্যাতিত হবার পরের ঘটনা। নারী নির্যাতিতও হয় আবার এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড়ও হয় কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। নারী নির্যাতনের ভয়াবহ রূপ জানতে এখন একটু ফিরে যাওয়া যাক পেছনের দিকে।



২০১২ সালে নারী নির্যাতনের চিত্র ভয়াবহই ছিল বলে জানা যায়। আর এক্ষেত্রে ইভটিজিং ছিল অন্যতম আলোচিত বিষয়। আত্মহত্যা, হত্যা, ধর্ষণসহ নানা ঘটনাই ছিল ২০১২ সালে। ২০১১ সালে পুলিশ সদর দপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা দেশে নারী নির্যাতনের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৩৪৪ জন, যা ২০১২ সালে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত যার সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১০,০২৯। ৩৪৪৮ জন নারী। এসিড আক্রমণের শিকার হয়েছে ৪৯ জন নারী। অপহরণ হয়েছে ২০৭৭ জন। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৮৬৯ জন এবং ধর্ষণের পর খুন হয়েছে ১৩ জন। এছাড়া বিভিন্ন কারণে খুন হয়েছে ১১৬ জন নারী এবং অনান্য ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে ২৩৯৪ জন। এদিকে, বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালের ১১ মাসে ৭৭১ জন নারী যৌতুকের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ২৫৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ৪৮৫ জনকে বিভিন্নভাবে অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে । নারী ও শিশু অধিদপ্তরের আওতাধীন নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেলের তথ্য মতে, ২০১২ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ৬টি বিভাগ থেকে নির্যাতিত নারীদের ২৩৩০টি আবেদন জমা হয়েছে সেলে। এর মধ্যে ২৩০০টি মামলা নিষ্পিত্তি হয়েছে। দেনমোহর ও খোরপোষ বাবদ টাকা আদায় হয়েছে ৯২ লাখ, ৩৫ হাজার ৫০ টাকা। সিমি, মহিমা, বুশরা, স্বপ্না, তৃষা, তানিয়া, সেলিনা, শাজনীন, মাহমুদা- এ নামগুলো মনে আছে ? এরা সবাই কোন-না-কোনভাবে খবরের শিরোনাম হয়ে নাড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের বিবেক। আমাদের অসার সভ্যতার মুখে চপেটাঘাত করে এরা পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। এদের কেউ ধর্ষণের অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিল, কাউকে আমরাই হত্যা করেছিলাম কিংবা তাদের কেউ আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছিল। কাউকে মারা হয় এসিডে পুড়িয়ে। এরা অল্প কয়েকজন খবরের শিরোনাম হয় বলে তাদের নাম আমাদের জানা। কিন্তু শতগুণ রয়ে যায় খবরের বাইরে।



গত ১০ বছরে প্রায় ৪০ হাজার নারী নির্যাতনের শিকার হয়? গত বছরের নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ‘নারী ও কন্যা শিশু নির্যাতনকারীদের আর ক্ষমা নয়।’ প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে তাদের ৮০ ভাগই রেহাই পেয়ে যায়। সে জন্যই প্রতিবছর নির্যাতনের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বুশরা-তৃষা-মহিমার মত যাদের নাম খবরের পাতায় আসে তাদের কেউ কেউ বিচার পায়। বাকিরা পায় না। যারা বিচার পায় তাদের আত্মীয়-স্বজন আবার রায় কার্যকর হতে দেখে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, নারী নির্যাতনের ৯০-৯৫ ভাগ ঘটনারই কোন বিচার হয় না। আবার এসিড নিক্ষপের ৯০ ভাগেরও বিচার হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্বল ও দরিদ্র নির্যাতিতরা নির্যাতনের ঘটনার বিচার চাইতে আইনের দ্বারস্থ হয় না। হয়রানি ও আর নির্যাতনের ভয়ে এবং আর্থিক সংকটের ফলে তারা নীরব থাকে। উপযুক্ত তদন্ত ও তথ্য প্রমাণের অভাব, বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়নের অভাবে বিচার কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় না। এছাড়া নির্যাতনকারীরা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তারা পার পেয়ে যায়। তাছাড়া অনেক নারী নির্যাতন হয় স্বামীর দ্বারা। স্বামীর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আর্থিক সংগতি ও আশ্রয় মেয়েদের থাকে না। পরিবারে কন্যা শিশুদের প্রতি অবহেলার যে ঘটনা যুগ যুগ ধরে চলছে তারও কোন পরিসংখ্যান নেই। গৃহেও কাজের মেয়ে নির্যাতনের ঘটনা তো খুব কমই প্রকাশ পায়। অন্য যেসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে সেগুলো হচ্ছে নানা ধরনের শারীরিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, পুলিশী নির্যাতন, কাজের মেয়ে নির্যাতন, এসিডদগ্ধ, ফতোয়া, রহস্যজনক মৃত্যু, জোরপূর্বক বিয়ে প্রভৃতি। আর যে শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নারী দিবসের সুচনা সেই শিল্পখাতে বাংলাদেশের নারীরা কি নির্যাতনের শিকার হয় তা ২০ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিকের দিকে তাকালে পরিষ্কার হয়ে যায়। সেখানে তারা নায্য মজুরি পায় না, কাজের পরিবেশ পায় না, শ্রম আইন বাস্তবায়ন হয় না।

প্রতি বছর যে নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে সে জন্য সালওয়ারি নির্যাতন চিত্রটা দেখলেই স্পষ্ট হবে। ১৯৯৭ সালে মোট ১৩৬৯টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ‘৯৮ সালে কমে ৫১৩তে দাঁড়ায়। ‘৯৯ সালে ১৬৪৫, ২০০০ সালে ১৯৪৫, ‘২০০১ সালে ৩১৩১টি, ‘২০০২ সালে ৫৭৯২টি, ‘২০০৩ সালে ৫৬১৮, ‘২০০৪ সালে ৫৯০৮ টি, ‘২০০৫ সালে ৬৯২২ ও ২০০৬ সালে ৬০৫৪ টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। আর ২০০৮ সালের প্রথম দুই মাসে ৭৯৪ জন নারী নির্যাতিত হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জাতীয় দৈনিকগুলোয় প্রকাশিত তথ্য থেকে এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে।



নির্যাতিত নারীদের নিয়ে কাজ করে এমন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, গত বছরগুলোতে দেশ রাজনৈতিকভাবে সহিংস হয়ে উঠে । দেশে-বিদেশে সন্ত্রাসীর সংখ্যাও বেড়ে যায়। নারী নির্যাতনকারীরা রাজনৈতিক আশ্রয় পায়। এছাড়া বছরগুলোতে নারীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে পুরুষের পাশাপাশি সমঅধিকার দাবি করলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাদের প্রতি নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে নির্যাতনের ঘটনা বাড়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাড. সুলতানা কামাল বলেছেন, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ ঘটনার কোন রায় হয় না। কারণ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অপরাধীরা আইনের উর্ধ্বে থেকে যায়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন, পারিবারিক আইনসহ নারী নির্যাতন বিরোধী বেশ কয়েকটি আইন দেশে রয়েছে। কিন্তু সেগুলো কার্যকর প্রয়োগ হয় না। বছরের পর বছর সেগুলো ঝুলে থাকে। এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) হিসেবে ৯০ ভাগ এসিড নিক্ষেপকারীর কোন বিচার হয় না। গত ৮ বছরে এক হাজার ৯১৪টি এসিড নিক্ষেপের ঘটনায় মোট দুই হাজার ৪৫৩ জন আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৮৬০ জন নারী ও শিশু। আর ২০০৭ সালের প্রায় দুই মাসেই ১৭টি এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এএসএফ এসিড সন্ত্রাস রোধে পুরুষদের সচেতনতার পাশাপাশি এসিড নিয়ন্ত্রণ ও এসিড সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ আইনের সঠিক বাস্তবায়নে দ্রুত বিচার আইনে বিচার ও কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল গঠনের দাবি করা হয়।



লক্ষণীয় যে, প্রায় সকলক্ষেত্রে পরিবারই নারী নির্যাতনের প্রধান উৎস৷ পারিবারিক অঙ্গনেই নির্যাতন ও নিপীড়নের প্রায় সকল ঘটনা ঘটে থাকে, যদিও রাষ্ট্র থেকেও ন্যায্য প্রাপ্য নারীরা অনেক সময় পায় না৷ নির্যাতনবিরোধী আইনি কাঠামোও নারীদের জন্য সহায়ক নয়৷ এত কিছুর পরেও নারীরা আশা করে এ সমাজে নারী নির্যাতন থাকবে না। অধিকাংশ নারী নির্যাতনের পিছনে কোন না কোনভাবে পুরুষের সংশ্লিষ্টতা থাকে। যদিও গৃহে নির্যাতনের ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকাও কম নয়। তবু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলে নারী নির্যাতন রোধে পুরুষদের অঙ্গীকারের বিকল্প নেই। পাশাপাশি নির্যাতনকারীদের বিচার হলে বন্ধ হবে নারী নির্যাতন। গবেষকরা বলছেন, নারী নির্যাতন রোধ করতে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে উন্নীত করতে নারীর গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের কোন বিকল্প নেই। তাই কেন্দ্রে, বিভাগে, নগরে, জেলায়, উপজেলায় ও ইউনিয়নে পুরুষের সাথে সমমর্যাদায় ১০০-১০০ প্রতিনিধিত্বে নারীর গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে প্রণীত ১১ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন খুবই জরুরী। নারী নির্যাতনে পশ্চিমা বিশ্বও কিন্তুও পিছিয়ে নেই। নারী নির্যাতনের সমাধান হিসাবে পশ্চিমা বিশ্ব সমস্ত পৃথিবীব্যাপী ফ্রিডম বা স্বাধীনতার ধ্যানধারণাকে জোরের সাথে প্রচার করলেও, প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার মিথ্যা স্লোগানে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে পশ্চিমের নারীরা হয়েছে এক অভিনব দাসত্বের শিকার। বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতা, সুপার হিট হলিউড মুভি, নামী-দামী ফ্যাশন ম্যাগাজিন কিংবা চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপনের সাহায্যে তারা মুসলিম বিশ্বেও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করছে তাদের মুক্ত-স্বাধীন নারীদের। তাদের ইলেক্ট্রনিক আর প্রিন্ট মিডিয়াতে আধুনিকা নারীদের দেখলে মনে হয় জীবনের সবক্ষেত্রেই তারা প্রচন্ড রকম স্বাধীন। স্বাধীন সমাজে তাদের ভূমিকা নির্ধারণের ক্ষেত্রে, স্বাধীন পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে কিংবা স্বাধীন পুরুষের সাথে সম্পর্ক তৈরীর ক্ষেত্রে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাদের শরীরের ওজন, প্রতিটি অঙ্গের মাপ, পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে সাজসজ্জা পর্যন্ত সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় ফ্যাশন, ডায়েট কিংবা কসমেটিকস ইন্ডাস্ট্রির দ্বারা। সমাজের নির্দেশ মানতে গিয়ে তারা নিজেকে পরিণত করে সস্তা বিনোদনের পাত্রে। আর, মুক্ত-স্বাধীন হবার জন্য বাধ্যতামূলক ভাবে কাঁধে তুলে নেয় জীবিকা উপার্জনের মতো কঠিন দায়িত্ব। পশ্চিমা পুঁজিবাদী সভ্যতা নারী নির্যাতনের মূল কারণ পুঁজিবাদ হচ্ছে মানুষের তৈরী এক জীবনব্যবস্থা, যার মূলভিত্তি ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধি। এ জীবন ব্যবস্থায় মানুষের নেই কারো কাছে কোন জবাবদিহিতা। বরং রয়েছে লাগামহীন ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারীতার সুযোগ। তাই, পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত সমাজে জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি আর চূড়ান্ত ব্যক্তি স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে মানুষ, অন্যের চাওয়া-পাওয়া, আবেগ-অনুভূতি, অসহায়ত্ব এমনকি নারীকেও পরিণত করে মুনাফা হাসিলের পণ্যে। পুঁজিবাদী সমাজ নারীকে দেখে নিরেট ভোগ্যপণ্য ও মুনাফা হাসিলের উপকরণ হিসেবে। ফলে, নারী সমাজের কোন সম্মানিত সদস্য হিসেবে বিবেচিত না হয়ে, সমাজে প্রচলিত অন্যান্য পণ্যের মতোই পরিণত হয় বিকিকিনির পণ্যে। আর হীন স্বার্থ সিদ্ধির মোহে অন্ধ মানুষ নারীর দৈহিক সৌন্দর্যকে পুঁজি করে চালায় জমজমাট ব্যবসা। বস্তুতঃ নারীর প্রতি এ জঘণ্য দৃষ্টিভঙ্গীর প্রত্যক্ষ ফলাফল হিসেবে স্বেচ্ছাচারী মানুষ শুধুমাত্র লাভবান হবার জন্য শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র সকল নারীকেই করে নির্যাতিত। মুক্ত সমাজ, মুক্ত মানুষ, মুক্ত অর্থনীতি ইত্যাদি পশ্চিমা পুঁজিবাদী জীবনদর্শনের মূলমন্ত্র হলেও, মুক্ত সমাজের মুক্ত জীবনের ধারণা নারীকে মুক্তি দেয়নি বরং বহুগুনে বেড়েছে তার উপর অত্যাচার আর নির্যাতনের পরিমাণ। বাস্তবতা হলো, ফ্রিডম বা স্বাধীনতার ধারণা পশ্চিমা সমাজের মানুষকে ঠেলে দিয়েছে স্বেচ্ছাচারী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন এক জীবনের দিকে। যেখানে স্বাধীনতার অপব্যবহারে নির্যাতিত হচ্ছে নারীসহ সমাজের অগণিত মানুষ। জবাবদিহিতার অনুপস্থিতিতে এক মানুষের স্বাধীনতা হচ্ছে অন্য মানুষের দাসত্বের কারণ। আর, ব্যক্তি স্বাধীনতার চূড়ান্ত অপপ্রয়োগে তাদের সমাজে বাড়ছে খুন, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও পারিবারিক সহিংসতাসহ সকল প্রকার নারী নির্যাতন। এছাড়া, সীমাহীন স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোও শুধুমাত্র লাভবান হবার জন্য নারীকে পরিণত করছে নিখাদ ভোগ্যপণ্যে। পশ্চিমা সমাজে মূলতঃ তাদের ফ্যাশন, ডায়েট আর কসমেটিকস্ ইন্ডাস্ট্রিগুলোই নির্ধারণ করে নারীর পোশাক, তার সাজ-সজ্জা, এমনকি তার দেহের প্রতিটি অঙ্গের মাপ। স্বাধীনতার মিথ্যা স্লোগানে নারীকে তারা বাধ্য করে জঘন্যভাবে দেহ প্রদর্শন করতে। তারপর, অর্ধনগ্ন সেইসব নারীদেহকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেনটাল হেলথ এর প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ২০ জনে ১ জন নারী অ্যানোরেক্সিয়া, বুলেমিয়া কিংবা মারাত্মক ক্ষুধামন্দার শিকার হয়। আর প্রতিবছর ১০০০ জন মার্কিন নারী অ্যানোরেক্সিয়া রোগে মৃত্যুবরণ করে। (সূত্র: আমেরিকান অ্যানোরেক্সিয়া/বুলেমিয়া অ্যাসোসিয়েশন)। বস্তুতঃ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিগুলোর বেঁধে দেয়া ভাইটাল স্ট্যাটিকটিকস্ অর্জন করতে গিয়েই পশ্চিমে অকালে ঝরে যায় এ সব নারীর জীবন। নারী-পুরুষের লাগামহীন মেলামেশা আর প্রবৃত্তি পূরণের অবাধ স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ ফলাফল স্বরূপ পশ্চিমা সমাজের নারীরা অহরহ হয় ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার। এমনকি এই বিকৃত আচরণ থেকে সে সমাজের নিষ্পাপ শিশুরা পর্যন্ত রেহাই পায় না। নারী স্বাধীনতার অগ্রপথিক যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৪৫ সেকেন্ডে ধর্ষিত হয় একজন নারী, আর বছরে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় সাড়ে সাত লক্ষে। (সূত্র : দি আগলি ট্রুথ, লেখক মাইকেল প্যারেন্টি)। আর, বৃটেনে প্রতি ২০ জনের মধ্যে একজন নারী ধর্ষিত হয় এবং মাত্র ১০০ জনের মধ্যে একজন ধর্ষক ধরা পড়ে। গণমাধ্যমগুলোতে নারীকে প্রতিনিয়ত সেক্স সিম্বল হিসেবে উপস্থাপন করার ফলে নারীর প্রতি সমাজের সর্বস্তরে তৈরী হয় অসম্মানজনক এক বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি। আর বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গির ফলাফল হিসেবে শিক্ষিত নারীরাও কর্মক্ষেত্রে তাদের পুরুষ সহকর্মীর কাছে প্রতিনিয়ত হয় যৌন হয়রানির শিকার। মিডিয়া ও সরকারী তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর শতকরা ৪০-৬০ ভাগ নারী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হয়। আর ইউরোপিয়ান উইমেনস লবির প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যেও শতকরা ৪০-৫০ ভাগ নারী তার পুরুষ সহকর্মীর কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হয়। যে সমাজে নেই কারো কোন জবাবদিহিতা, নেই পরস্পরের প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধ আর সেই সাথে রয়েছে সীমাহীন স্বেচ্ছাচারীতার সুযোগ, সে সমাজে ভয়াবহ পারিবারিক সহিংসতা হয় নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। বস্তুতঃ জীবন সম্পর্কে এ ধরনের ভয়ঙ্কর ভ্রান্তিমূলক ধারণা থেকেই বিয়ের পূর্বে বা পরে সবসময়ই পশ্চিমের নারীরা হয় তার পুরুষসঙ্গীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১৮ সেকেন্ডে একজন নারী স্বামী দ্বারা প্রহৃত হয়। ইউএস জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের ১৯৯৮ সালে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ৯ লাখ ৬০ হাজার পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। আর, প্রায় ৪০ লাখ নারী তার স্বামী অথবা ছেলেবন্ধুর দ্বারা শারীরিকভাবে হয় নির্যাতিত। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার প্রধান অসহায় শিকার হয় পশ্চিমের কুমারী অল্পবয়সী নারীরা। আনন্দের পর্ব শেষে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষ সঙ্গী আর্থিক বা সামাজিক কোন দায়দায়িত্ব স্বীকার না করায় একাকি নিতে হয় তাকে অনাহুত সন্তানের দায়িত্ব। আর, অপরিণত বয়সে পর্বতসম দায়িত্ব নিয়ে গিয়ে তাকে হতে হয় ভয়ঙ্কর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। যুক্তরাষ্ট্রের গুটম্যাচার ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ১৫-১৭ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার অবিবাহিত নারী গর্ভবতী হয়। আর, সেদেশের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে বছরে ১ লাখ ১৩ হাজার কিশোরী মেয়ে গর্ভধারণ করে। পশ্চিমা সভ্যতা পৃথিবীব্যাপী নারী-পুরুষের সমঅধিকারের বার্তা প্রচার করলেও তাদের নিজেদের সমাজেই নারীরা প্রচন্ড বৈষ্যমের শিকার। শুধুমাত্র নারী হবার জন্য একই কাজের জন্য তাকে পুরুষের চাইতে দেয়া হয় অনেক কম অর্থ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি যুক্তরাষ্ট্রে ইকুয়েল পে অ্যাক্ট আইন পাশ করলেও, এখনও ১৫ বছর ও তার উর্ধ্বে কর্মরত নারীরা একই কাজের জন্য পুরুষদের চাইতে প্রতি ডলারে ২৩ সেন্ট কম উপার্জন করে। ইউ.এস গর্ভমেন্ট অ্যাকাউন্টেবিলিটি অফিসের এক জরিপ দেখা যায়, সে দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা বিভাগের মোট কর্মচারীর প্রায় ৭০ ভাগ নারী হলেও নারী ব্যবস্থাপকরা পুরুষের চাইতে অনেক কম অর্থ পেয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, ১৯৯৫-২০০০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে নারী-পুরুষের উপার্জনের এই বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। বস্তুতঃ পশ্চিমের দেশগুলোতে নারীরা শুধুমাত্র দুটি পেশায় পুরুষদের চাইতে বেশী উপার্জন করে, তার একটি হচ্ছে মডেলিং আর অন্যটি হচ্ছে পতিতাবৃত্তি। এছাড়াও পশ্চিমা বিশ্বে নারীরা সবচাইতে জঘন্যভাবে নির্যাতিত হয় পর্ণোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে। যেখানে, ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির মতোই নারীদেহকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে পৃথিবীব্যাপী বিস্মৃত মুনাফালোভী এক চক্র। আর, এর জঘন্য শিকার হচ্ছে লাখ কোটি অসহায় নারী ও শিশু। শুধু নারী দেহকে উপজীব্য করে এই পৃথিবীতে ৫৭ বিলিয়ন ইউ.এস ডলারের পর্ণোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পর্ণোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রির বার্ষিক রাজস্ব সে দেশের বহুল প্রচারিত ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এ.বি.সি, সি.বি.এস এবং এন.বি.সি-র প্রদত্ত মোট রাজস্বের চাইতেও বেশী (৬.২ বিলিয়ন ডলার)।

তাই নারী অধিকার আর নারী নির্যাতন নিয়ে চিৎকার করে কোন লাভ নাই কেবল মাত্র প্রতিটি মানুষ তার ঘর থেকে শুরু করতে পারেন নারী নির্যাতন বন্ধে ব্যক্তিগত পদক্ষেপ। তবেই যদি বন্ধ করা যায় এ জঘন্য প্রক্রিয়া।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.