![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানব সেবাই আমার মূল ধর্ম
কুমিল্লার সর্বত্রই এখন বাহার খলিফাদের নিয়ন্ত্রণ। শহরের হাট-ঘাট-ফুটপাত থেকে শুরু করে অফিস-আদালত সর্বত্রই এসব বাহার খলিফার দাপট। এদের অধিকাংশই স্থানীয় এমপি বাহারের আত্মীয়স্বজন কিংবা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। তাদের ভয়ে তটস্থ পুরো কুমিল্লার মানুষ। রাজনৈতিক হানাহানি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, চাঁদাবাজি, খুন-খারাবিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির নেপথ্যেও রয়েছে এসব খলিফা ও তাদের লোকজন। শুধু বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাই নয়, খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও এসব বাহার খলিফার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। বাহার খলিফাদের বাধায় কুমিল্লার প্রভাবশালী সরকারদলীয় এমপিরাও শহরে গিয়ে জনসভা করতে পারেন না। দলীয় প্রতিপক্ষ আফজল খানের সঙ্গে তার সাপে নেউলে সম্পর্ক। ফলে বিরোধী দলই শুধু নয়, সরকারদলীয় এমপিরাও বাহার বাহিনীর হাতে নিরাপদ নন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের এক নেতা জানান, বিগত নির্বাচনে কুমিল্লাা-৬ আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই কুমিল্লার ‘মুকুটবিহীন সম্রাট’-এ পরিণত হয়েছেন এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। তার খলিফারা ছাড়া কোনো ঠিকাদারি বা টেন্ডারের কথা কেউ চিন্তাও করতে পারে না। অন্য উপজেলার এমপির লোকজন বা দলীয় লোকজনও কাজ পেতে চাইলে এমপি বাহার কিংবা তার দলের লোকজনকে ‘ফাইভ পার্সেন্ট’ কমিশন দিতে হয়। অপর এক নেতা বলেন, হাজী বাহারের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললে ‘বাড়িঘরে আগুন জ্বালাইয়া দিব।’
আরেক এক নেতা জানান, এমপি বাহার ও পৌর মেয়র দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুল হক সাক্কু কাজ করেন একজোট হয়ে। ফলে বাহার ও সাক্কু বিরোধী যারা আছেন তারা প্রায়ই হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হন।
কুমিল্লা (দক্ষিণ) জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাজী আমিনুর রশিদ ইয়াসিন (হাজী ইয়াসিন) জানান, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কুমিল্লায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। হামলা-মামলা এখন আর মুখে হিসাব করা যায় না। এসবের জন্য রেজিস্ট্রার খাতা দরকার। খোদ এমপি বাহার নিজেই হামলায় নেতৃত্ব দেন। ৪ মার্চ হরতাল চলাকালে খোদ এমপির নেতৃত্বে মিছিলে হামলা হয়েছে। এলাকার ফুটপাত, বালুমহাল থেকে এমন কোনো খাত নাই যেখানে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি হচ্ছে না। তিনি আরও জানান, রিকশাচালক কিংবা ইজিবাইকের চালকরাও বাহার খলিফাদের চাঁদাবাজির শিকার। তিনি বলেন, সম্প্রতি শহরে বাহারের লোকজন টাউন সার্ভিসের বাস চালুর নামে ইজিবাইক চলাচল বন্ধ করে দেয়। অথচ প্রতিটি ইজিবাইকের কাছ থেকে এমপির খলিফারা মাসে ৩০০ টাকা করে চাঁদা নিচ্ছেন।
কুমিল্লার প্রবীণ রাজনীতিবিদ দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি রাবেয়া চৌধুরী জানান, সরকারি দল আশ্রিত ক্যাডার মাস্তানরা প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে মিছিল করছে, হামলা করছে, বোমা ককটেল মারছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরো কুমিল্লা এখন ভীতি ও আতঙ্কের জনপদ।
কুমিল্লার চকবাজারে গরুর হাটের কয়েকজন বেপারি জানান, হাটে হাসিল ছাড়াও প্রতিটি গরু বাজারে উঠালে এমপির লোকজনকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। সপ্তাহে দুই দিন হাট। কিন্তু অনেক বেপারি চাঁদা দেয়ার ভয়ে হাটেই গরু রেখে দেন।
কুমিল্লায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের নিয়ন্ত্রণ করেন এমপি বাহারের অন্যতম খলিফা তার ফুপাতো ভাই দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সহসভাপতি আরফানুল হক রিফাত। তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন এমপি বাহারের ভাই কুতুবউদ্দিন হেলাল, জিএস শহীদ, নজরুল ইসলাম রিংকু, বাহারের আত্মীয় শামীম, কবির ও মাওলাসহ কয়েকজন। তাদের ভয়ে সওজের প্রকৌশলী বা অপর ঠিকাদাররা তটস্থ থাকেন।
স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) কুমিল্লা নিয়ন্ত্রণ করেন এমপি বাহার নিজেই। তার প্রধান খলিফা হিসেবে কাজ করেন, এমপি বাহারের ভাতিজা নাইমুর রহমান তুহিন। তাদের সহযোগী হিসেবে রয়েছেন হাসান ও মনি। সদর হাসপাতাল ও অন্যান্য হাসপাতাল কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি ও যাবতীয় কাজের নিয়ন্ত্রক বাহার খলিফা রুমি ও বাহারের ভাতিজা সাদী মোহাম্মদ। সঙ্গে থাকেন জিএস শহীদ, কামরুল ও পাভেল। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা সদরে দুটি হাসপাতালের খাদ্য, ওষুধ সরবরাহ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ, ভবন নির্মাণ, সংস্কার মেরামতসহ অন্যান্য কাজের একক নিয়ন্ত্রণ থাকে ভাতিজা সাদী মোহাম্মদের হাতে।
শিক্ষা প্রকৌশল বা ফ্যাসিলিটিজ বিভাগের কুমিল্লা অফিসের আগে নিয়ন্ত্রক ছিলেন কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক ভিপি ও বাহারের ঘনিষ্ঠজন জহিরুল ইসলাম মিন্টু। এগুলো নিয়ে অপর এমপির আপত্তি ও ক্ষোভের কারণে এখন বাহার নিজেই নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। অপর উপজেলাগুলোর কাজ তিনি ওই এলাকার এমপিদের জন্য সংরক্ষিত রাখছেন। আর নিজ আসন এলাকার কাজে বাহারকে সহযোগিতা করেন এরফানুল হক রিফাত, হাসান খসরু ও জহিরুল ইসলাম রিন্টু।
গণপূর্ত বিভাগে বাহারের অন্যতম খলিফা তার আপন ভাই কুতুবউদ্দিন হেলাল। তাদের অন্যতম সহযোগী ঠিকাদার মির্জা মো. কুরায়েশী ও হানিফ। তাদের মাধ্যমে যাবতীয় টেন্ডার, উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড কুমিল্লা অফিসের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন বাহারের ফুফাত ভাই আরফানুল হক রিফাত, বাহারের খলিফ সেন্টু, কামাল, ঠিকাদার লাভলু, তোফায়েল ও ফারুক ওরফে কালা ফারুক।
কুমিল্লা শহরের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গোমতী নদী কুমিল্লার প্রাণ। যদিও উজানে ত্রিপুরায় কয়েকটি বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় গোমতী এখন শীর্ণকায় খাল ও প্রকৃতির ক্ষত চিহ্নে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ গোমতীর বুকে পাওয়া যায় নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বালু। কোনো নিয়মনীতি না মেনে গোমতী থেকে অবাধে বালু তোলায় হুমকির মুখে কুমিল্লা শহর রক্ষা বাঁধ। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে যে হারে বালু তোলা হচ্ছে এতে করে বর্ষায় গোমতীর বাঁধ ভেঙে কুমিল্লা শহরসহ আশপাশের উপজেলাগুলো তলিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই ক্ষমতাসীনদের।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এসব বালুমহালের নিয়ন্ত্রক এমপি বাহারের ফুফাত ভাই আরফানুল হক রিফাত। কুমিল্লার পাঁচটি বালুমহাল থেকে দিনে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার বালু উত্তোলন হয়। কোনোরকম টেন্ডার ছাড়াই নামমাত্র রাজস্ব দিয়ে চলছে বালু উত্তোলন। গোমতীর বালুমহালগুলো থেকে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা বালু তোলা হচ্ছে। এর নামমাত্র অর্থ খাস কালেকশনের মাধ্যমে সরকারের কোষাগারে যাচ্ছে। অথচ টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই বালু উত্তোলন হলে সরকারের বছরে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করার সম্ভব হতো।
কুমিল্লা জেলা কেন্দ্রীয় কারাগারের ঠিকাদারি কাজসহ বিভিন্ন কাজ নিয়ন্ত্রক বাহার খলিফা কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নেতা গোলাম সারোয়ার শিপন। তার সঙ্গে বাহারের খলিফা হিসেবে কাজ করেন ঠিকাদার জাহেদ।
জেলা পরিষদ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে বাহারের খলিফা হিসেবে কাজ করেন সাবেক ছাত্রনেতা সরকার মাহমুদ জাবেদ। ভারতীয় সীমান্ত হয়ে চোরাকারবারি পণ্যের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন এমপির খলিফা হিসেবে পরিচিত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক জিএস শহীদ ওরফে চিকা শহীদ। এই চোরাকারবারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জিএস শহীদ এখন কোটি টাকার মালিক। অথচ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগেও তার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়।
এছাড়া শহরে বাহার বাহিনীর সক্রিয় ক্যাডার হিসেবে কাজ করে জহিরুল ইসলাম রিন্টু, সালেহ আহমেদ রাসেল, নাজমুল ইসলাম শাওন, সাইফুল ইসলাম, প্রিয়ম, কাইয়ুম খান বাবুল, জাবেদ, শাকিল, ফারুক, মুরাদ, শাহপরান, সাইফুল ইসলাম খোকন, শরিফুল ইসলাম, রনি, মো. রাসেল, রাজীব হাছান, জহিরুল ইসলাম রিন্টু, জসিম খান, শাহজাদা টুটুল, নাজমুল হাসান সোহাগ, জিলানী, লোকমান, নোমান, মাসুম, মিঠু, অনিক, অঞ্জন সরকারসহ বিশাল গ্রুপ। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বাহারের বিশাল বাহিনীর নেতৃত্ব দেন জহিরুল ইসলাম রিন্টু। অর্ধশতাধিক ক্যাডারের সশস্ত্র গ্রুপের কাজই হলো যারাই বাহারের বিরুদ্ধাচারণ করবে তাদের শায়েস্তা করা। এই বাহিনী এরআগে বেশ কয়েকজনকে শুধু মারধরই করেনি হাত পায়ের রগও কেটে দিয়েছে। এদের মধ্যে আওয়ামী দলীয় লোকজনও রয়েছে। জেলা যুবলীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক কবির হোসেন ভূঁইয়া, উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা আহাম্মেদ হোসেন, বরুড়া থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মিহির মজুমদার, অজিতগুহ কলেজ ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল হাসান মজুমদারসহ বিপুলসংখ্যক দলীয়কর্মী এ বাহিনীর নির্মমতার শিকার হয়েছে। যুবলীগ নেতা নুরুল ইসলাম আপেল হত্যাসহ বহু হত্যামামলা রয়েছে খলিফাদের বিরুদ্ধে।
বাহারের বড় ভাই মো. কুতুবউদ্দিন বলেন, তিনি ঠিকাদারি ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসা করছেন। সরকারি আমলা ও দলীয় লোকজনদের বড় একটি অংশ বাহার পরিবারের সুনাম নষ্ট করতে চাচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা তাদের পরিবারের সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য তাদের পরিবারের পেছনে লেগে আছে।
বাহারের ফুফাত ভাই আরফানুল হক রিফাত বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে দলীয়সহ বিভিন্ন জনের সঙ্গে তাদের বিরোধ হয়েছে। এসব কারণে তারা তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছড়ায়।
আকম বাহার আমার দেশ-কে বলেন, তার এলাকা কুমিল্লা সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো চলছে। এলাকায় কোনো সমস্যা নেই। কুমিল্লার আইনশৃঙ্খলা দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে খুবই ভালো। তিনি ঢাকার সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ঢাকার সাংবাদিকরা হুট করে কুমিল্লা গিয়েই বলে পরিস্থিতি খারাপ। কুমিল্লায় কোথাও কোনো চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাস্তানি নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, কুমিল্লায় কে, কি বলল সেগুলো জানার পর আমার সঙ্গে বসে সামনাসামনি কথা বলবেন। হুট করে ঢাকা থেকে টেলিফোন না করারও পরামর্শ দেন তিনি।
সুত্র -আমার দেশ
©somewhere in net ltd.