নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১০/১০/২০২৪
লানকাউই ডায়েরি
লানকাউই একেবারে নতুন একটা জায়গা আমার জন্য। এখানেই আয়রনম্যন এর মত কঠিন রেইসে উত্তীর্ণ হতে হবে। গত এক বছর থেকে যে প্রস্তুতি নিয়েছি তার ফাইনাল পরীক্ষা দুইদিন পরেই। লানকাউইতে নেমে হোটেলে গিয়ে আমাদের প্রধান কাজ হলো সাইকেল বাক্স থেকে বের করে এসেম্বেল করা। সাইকেল খুলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়ার পরে অনেক গোলমাল দেখা দেয়। নাহিদ রাফাত সবাই সাহায্য করেছে। ওদের কাছে দারুণ সব অত্যাধুনিক টুলস আছে। যদিও আমার সাইকেল খুব সাধারণ গোছের রোডবাইক। মুজাহিদ ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, তিনি লন্ডন থেকে সাইকেলটা এনে ঢাকা থেকে জামালপুর হয়ে সিলেট গিয়েছিলেন, এরপর যাবার সময় আমাকে দিয়ে যান। সেই সাইকেল ঠিকঠাক করে আয়রনম্যন এর জন্য প্রস্তুত করি।
আয়রনম্যন এর জন্য আমাদের আন্দামান সাগরে সাতরাতে হবে ১.৯কিলোমিটার, তাই এই সাগরে একটু রেকি করে দেখতে হবে। যেখানে রেইস শুরু হবে সেই জায়গাটা আমাদের হোটেল থেকে বেশখানিকটা দূরে। পেরদানা কোয়াই লাইটহাউজ এর পাশে কোক বিচ সেখান থেকে শুরূ হবে সাঁতার। 'দি ডানা লানকাউই' নামে বিশাল আলিশান এক রিসোর্টে আয়োকরা সব বন্দোবস্ত করেছে। বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগিরা সেখাও কেউ কেউ অবস্থান করেছে।
সকাল বেলা সাকলাইন ভাইয়ের ঠিক করা গাড়িতে আমরা চলে গেলাম সাগরের কাছে। তখনো আরো ৫দিন হাতে আছে। সাগরে দড়ি বয়া লাগানোর কাজ চলছে।সমুদ্রে সাতার কাটার অভিজ্ঞতা নতুন এমন কয়েকজনও রয়েছে আমাদের মধ্যে। তাই ঠিক হলো ৫০০ মিটার এর মত গিয়ে আবার ফিরে আসবো। পিযুজ কিছুটা সংকোচ করছিলো, রাফাত আর আতাউর ভাই এর জন্যও প্রথমবার, তবে তারা নেমে পড়লো নির্দিধায়। সবার আগে নাহিদ দেখলাম চোখের আড়াল হয়ে গেলো। সাগরে সাঁতার কাটতে বড় কলিজা লাগে। নতুন জায়গায় প্রথম কয়েক মিটার বেশ নার্ভাস লাগছিল। আজকে সমুদ্র কিছুটা উত্তাল, কারন সকাল থেকে বৃষ্টি হয়েছে। আর এখানে সূর্যের মূখ দেখা যায় সকাল ৭টার দিকে। এই সাগরে জেলিফিস ও আছে বলে শুনেছি। বাংলা চ্যানেলে জেলিফিশের এটাক এর কথা মনে পড়ে গেলো। সামনে একটা পাথুরে দ্বীপের মত দেখা যাচ্ছিলো, ভাবলাম।সেখানে গিয়ে পাড়ে উঠবো। পরে সাকলাইন ভাই সাবধান করে দিলো সেখানে নামলে হাত-পা ছিলে যাবে। আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। খুব আরাম করে আস্তে আস্তে সাঁতার কেটে বিচে উঠলাম। অন্যরকম এক অনুভূতি হলো। নাহিদকে এখনো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক্ক্ষণ পরে তাকে দেখা গেলো, সে সাঁতার এর পুরোটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। দেশে থাকতে ইমতিয়াজ ভাই, রিপন ভাইর যারা আয়রনম্যন একাধিকবার দিয়েছেন বার বার আমাদের বলে দিয়েছেন কোন প্রকার ওভার এক্সাইটেড হয়ে কিছু যেনো না করি। কোনভাবে ইঞ্জুরি হলে আর রক্ষে নেই। এমনকি খাওয়াদাওয়ার ব্যপারেও সতর্ক থাকতে হবে।
সাইকেলে ৯০কিমি পথ পাড়ি দিতে হবে সাঁতার শেষ করেই, তাই পূরো রাস্তাটা মাথায় থাকলে খুব ভালো হয়। আমরা পরদিন কিছুটা পাহাড়ি পথ সাইকেল চালিয়ে রেকি করলাম। কি সুন্দর মনোরম পরিবেশ। ঘন জঙ্গল আর সমুদ্রের কিনার দিয়ে কি দারূন মাখন রাস্তা। ডাউন হিলে খুব মজা পাচ্ছিলাম। কিন্তু চড়াইতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। গেয়ার পাল্টাতে গিয়ে হলো বিপত্তি, চেইনটা গেলো ছিড়ে। সবাই বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। এরপর আরো প্রায় ৫কিমি পথ ডাউন হিল আর হেটে এসে পথে এক দোকানে সবার সাথে দেখা। গ্রাব কল করে সাইকল নিয়ে গেলাম হোটেলে। ভাগ্য ভালো চেইনটা রেইসের আগে ছিড়লো নাহয় রেইসের দিন হলে বারোটা বেজে যেতো। প্রায় ৭০ রিংগিত দিয়ে নতুন চেইন কিনে সাইকেলে সেট করলাম। চেনাং ভিউ হোটেলে সুইমিংপুল ছিলো, সেখানেও আমরা প্রেকটিস করলাম। একা এবং সৌরভ দার সাথে রানিং করলাম। আমাদের কিট কালেকশন এর দিন চলে এসেছে। মসুরি এক্সিবিশন সেন্টার বিশাল আকারের, আমাদের চীন মৈত্রী এর থেকেও অনেক বড়। এখানে এক্সপোর আয়োজন করা হয়েছে এবং আজ রাতে ব্রিফিং ও ডিনার এর ব্যবস্থাও আছে সবার জন্য। সকালবেলা প্লান ছিলো ভোরে আমরা সুইমিং এ যাবো এবং ১.৯কিমি পুরা সুইমিং ট্রেকটা ঘুরে আসবো। এর আগে আমরা স্কুটি ভাড়া নিয়েছিলাম ৩০ রিংগিতে সারাদিন। সাইকেলের রুট ৯০কিমি রেকি করেছি, যেনো রাস্তাটা আমাদের মাথায় থাকে। সকালে রেডি হয়ে আমি আর নাহিদ, রাফাত আর আতাউর ভাই দুইটা বাইকে রউনা দিলাম। এয়ারপোর্ট পার হয়ে লানকাউই পুলিশ একাডেমি এর সামনে এসে নাহিদ বললো স্কুটির তেল শেষ হয়ে গেছে। ঝাকানি দিয়েও চলার চেষ্টা করা হলো তাও কাজ হলো না। রাফাত আমাদের আগে ছিল। আমি গতকাল মালয়শিয়ান সিম কিনেছিলাম, নাহিদ আমাকে কল দিতে বলল রাফাতকে। আমি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কল দিলাম। আতাউর ভাই ফোন রিসিভ করলে জানালাম আমাদের স্কুটির তেল শেষ হয়েছে আপনারা দাড়ান। ম্যপে তখন দেড় কিলোমিটার দূরত্ব দেখাচ্ছিলো পেট্রোল পাম্প। আমি কি মনে করে ফোনটা ব্যাগে না রেখে জ্যাকেট এর পকেটে রাখলাম এরপর বাইক ঠেলতে শুরু করলাম। ভেবেছিলাম রাফাত আর আতাউর ভাই ফিরে আসবে আমাদের কাছে। তাদের দেরি দেখে আমরা এগিয়ে যেতে থাকলাম। কিছুটা দুশ্চিন্তা, রাগ আর অস্থিরতায় আমাদের মাথা কাজ করছিলো না। কিছুক্ষণ আমি ঠেলছি কিছুক্ষণ নাহিদ ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে স্কুটি। ওদেরও দেখা নাই। হঠাৎ করে স্থানীয় একজন লোক বাইক চালিয়ে যাওয়ার পথে আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলো কি ঘটনা? এরপর কি মনে করে তিনি নাহিদকে তার বাইকে বসিয়ে আমাকে স্কুটির হ্যন্ডেল চেপে ধরতে বলল। এক পা দিয়ে ঠেলে নিয়ে গেলো প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরত্বে পেট্রোল পাম্পে। তাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যখন বিদায় দিলাম তখন টের পেলাম জ্যাকেট এর পকেটে মোবাইল ফোন আর নেই। মাথায় হাত দিয়ে স্কুটি ঘুরিয়ে পুরো রাস্তা আপ-ডাউন করলাম প্রায় ৪বার। কোথাও কিছু নেই। অথচ তখন রাস্তায় তেমন কোন মানুষজনও ছিলো না। এয়ারপোর্টে গিয়ে একজনের ফোন থেকে আমার লোকাল নাম্বারে কল দিলাম, দুইবার বাজলো কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করলোনা এরপরের বারে ফোন বন্ধ পাওয়া গেলো। তারমানে ফোন কারো হাতে চলে গেছে। রাস্তায় খুজেও আর যখন পাবোনা নিশ্চিত হলাম তখন থানায় গিয়ে রিপোর্ট লিখালাম। আমাদের সুইমিং আর করা হলো না। মুসরি সেন্টারে চলে গেলাম মন খারাপ করে। বিদেশে ফোন হারালে কত যে বিপদ হয়। সব ইনফরমেশন, নাম্বার, যোগাযোগ সবকিছু এক মুহুর্তে বন্ধ হয়ে গেলো। কিট গুলো কালেকশন করলাম। এরমধ্যে খবর পেলাম আমাদের বদর ভাই সাইকেল থেকে পড়ে এক্সিডেন্ট করেছেন। তিনি ফুল আয়রনম্যান এর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। প্রথম বিদেশ যাত্রা, ঘুম খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম সব মিলিয়ে বদর ভাই সামলে উঠতে পারেননি। পাহাড়ি পথ থেকে নামার সময় মাথা ঘুরিয়ে ছিটকে পড়ে যান। মাথায় এবং শরীরে বেশ আঘাত পান। আমরা হাসপাতালে ছুটে যাই তাকে দেখতে। টিমের সবাই ভারাক্রান্ত আর বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। আয়রনম্যান এর মত রেইসের আগে এমন দুর্ঘটনা সত্যি উদ্বেগজনক। হাসপাতালে মাথার কাটা অংশ সেলাই করে আর ওষুধপত্তর দিয়ে বদর ভাইকে কম্পিট রেস্টে থাকতে বলে দিলো। এরপর তাকে পরবর্তী দিনগুলো হোটেল রুমেই কাটাতে হয়েছে।
আবার রেইসের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ছোট ছোট জিনিসও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো। মানসিক চাপ বাড়তে শুরু করলো। কেউ কেউ বিগড়ে গেলো আবার কেউ চুপচাপ হয়ে গেলো। আমরা কয়েকজন বেশ আনন্দে সময় পার করেছি বলা যায়। টি-ওয়ান, টি -টু তে ব্যগগুলো রেখে আসলাম। সুইমিং থেকে উঠে টি-ওয়ান থেকে সাইকেলে যাওয়ার জন্য জিনিসপত্র নিতে হবে এবং সাইকেল শেষ করে টি-টু থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে রান শুরু করতে হবে। সব কিছুর খুব সুন্দর আয়োজন। পায়ে একটি অত্যাধুনিক চিপ পরিয়ে দেওয়া হবে যাতে পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে আপনাকে ট্রেক করা যাবে। আগেরদিন বিকালের মধ্যে সাইকেল জমা দিয়ে আসলাম। সবকিছু এখন খুব চরম উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কালকের আট ঘন্টা জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ সময় মনে হচ্ছে। গত এক বছরের সাধনার চরম পরীক্ষা আগামীকাল। এই কুরুক্ষেত্র ঠিকভাবে শেষ হলে এই যাত্রায় উতরে যাবো। সাকলাইন ভাই সবাইকে রাত ৮টার মধ্যে বিছানায় চলে যেতে বললো। ভোর সাড়ে তিনটায় এলার্ম বাজবে। যার যার মত খাওয়া দাওয়া করে বাথরুম সেরে ৫টায় বের হয়ে পড়তে হবে। কঠিন পরিশ্রম করলাম যুদ্ধ যেনো সহজ হয় সেই কামনা করে বিছানায় চলে গেলাম।
©somewhere in net ltd.