![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রকৃত নাম কালা চাঁদ, ডাক নাম রাজু। পিতা নয়ন চাঁদ রায়, রাজশাহী জিলার মান্দা থানার বীর জাওন গ্রামের অধিবাসী ও ভূঁইয়া ছিলেন এবং গৌড়ের সুলতানের অধীনে ফৌজদারী বিভাগে চাকরী করতেন। তিনি “এক টাকিয়া ভাদুরী” নামে পরিচিত সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের বংশধর। কালা চাঁদের শৈশবেই পিতা নয়ন চাঁদের মৃত্যু হলে মাতামহ কর্তৃক কালা চাঁদ লালিত-পালিত হন। মাতামহের তত্ত্বাবধানে কালা চাঁদ বাংলা ও ফার্সী ভাষা অধ্যয়ন করেন এবং অশ্বারোহণ ও অস্ত্রবিদ্যায় প্রশিক্ষণ লাভ করেন। বঙ্গের স্বাধীন আফগান সুলতান সুলায়মান কাররানী’র (৯৭২-৯৮০/১৫৬৪-৭২) দরবারে চাকরী প্রার্থী হলে সুলতান কালা চাঁদকে গৌড়ের ফৌজদার পদে নিযুক্ত করেন। কালা চাঁদ চাকরী গ্রহণের পূর্বে কি পরে ইসলাম গ্রহণ করেন, তা নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। তবে মনে হয় সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে ইসলামের সাম্যবাদ ও একত্ববাদে মুগ্ধ হয়ে উক্ত চাকরী লাভের অব্যবহিত পরেই কালা চাঁদ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
অতঃপর তিনি প্রতিমা পূজার ঘোর বিরোধী হয়ে উঠেন। উড়িষ্যা, কামরূপ, কোচবিহার ও অন্যান্য স্থানে বহু বিগ্রহ ও মন্দির ধ্বংস করে কালা চাঁদ হিন্দু জনগণের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেন। উল্লেখ্য যে, দিল্লীর সুলতান বাহলুল লোদীর ভাগ্নে মিয়াঁ মুহাম্মাদ ফারমুলীও বহু দেবমন্দির ধ্বংস করে কালাপাহাড় নামে খ্যাত হন। কালা চাঁদও তদ্রূপ হিন্দু জনগণের নিকট অভিহিত হতে থাকেন এবং ইতিহাসে কালা পাহাড় নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। এই উভয় কালা পাহাড়ের কার্যাবলী ও কার্যকালের মধ্যে পার্থক্য না করে কোন কোন লেখক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন।
বাঙ্গালার বীর গ্রন্থের লেখক শ্রী কালী প্রসন্ন দাস, গৌড়ের ইতিহাস গ্রন্থের লেখক রজনী কান্ত চক্রবর্তী ও অন্যান্য কতিপয় লেখক কালা পাহাড়ের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ সম্পর্কে কাল্পনিক কাহিনী রচনা করে, বিশেষত সুলায়মান কাররানীর কন্যার প্রণয়াসক্তির ভিত্তিহীন উপাখ্যান রচনা করে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বিকৃত করার প্রয়াস পেয়েছেন। কালা পাহাড়ের পূর্বে ও পরে বাংলার বহু উচ্চবংশীয় সম্ভ্রান্ত হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর পৌত্তলিকতা ও মূর্তি পূজাকে মহাপাপ মনে করতেন এবং মূর্তি ধ্বংস করাকে তারা পরম পুণ্যের কাজ বলে আন্তরিক বিশ্বাস পোষণ করতেন। উদাহরণস্বরূপ “অমৃত কুন্ড” নামক সংস্কৃত গ্রন্থে উল্লেখিত ভোজর ব্রাহ্মণ (Bhojar Brahmon) নামক বেদান্ত-পন্ডিত ও কামরূপের ব্রাহ্মণ পন্ডিত আম্বাভনাথের (Ambhevanath) ইসলাম গ্রহণ এবং বাংলার ইতিহাসে খ্যাত রাজা গণেশের পুত্র যদু এবং ঈসা খান মসনদে আলা’র পিতা কালিদাস গজদানীর ইসলাম গ্রহণের পর পৌত্তলিকতার ঘোর বিরোধিতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সুতরাং কালা পাহাড় প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে কিংবা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে মন্দির ও মূর্তি ধ্বংস করেন বলে যেসব উপাখ্যান রচনা করা হয়েছে তার মূলে কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
সুলায়মান কাররানীর উড়িষ্যা আক্রমণের কারণ সম্পর্কে সমসাময়িক সকল ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, উড়িষ্যার রাজা সুলায়মানের প্রতিদ্বন্ধী ইবরাহীম সূরকে আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করছিলেন। তদুপরি মুগল সম্রাটের জনৈক দূতকে সাদর সম্বর্ধনা জানিয়ে প্রয়োজনে বাংলা আক্রমণে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সুলায়মান কাররানী এসকল ষড়যন্ত্রের খবর পেয়ে স্বীয় পুত্র বায়যীদ এবং বীর সেনানী সিকান্দার উযবেকের নেতৃত্বে ১৫৬৭ খৃ. এক বিশাল বাহিনী উড়িষ্যা অভিযানে প্রেরণ করেন। যুদ্ধে আফগান বাহিনী জয়ী হয় এবং উড়িষ্যা সুলায়মানের অধিকারে আসে। তখন উত্তর উড়িষ্যার রাজধানী ভাজনগর থেকে একটি শক্তিশালী বাহিনী কালা পাহাড়ের নেতৃত্বে পুরীর জগন্নাথ মন্দির দখলের জন্য প্রেরিত হয়। কালা পাহাড় পুরী দখল করে জগন্নাথ মন্দির ধ্বংস করেন। পার্শ্ববর্তী এলাকার বহু মন্দিরও তিনি ধ্বংস করেন (History of Bengal, সম্পা. J. N. Sarkar, ২য় খ., ১৮৩-৪)।
কুচবিহার অভিযান সম্পর্কে বিভিন্ন ইতিহাসের বর্ণনা মতে কুচবিহারের রাজা বাংলার কয়েকটি এলাকা দখল করলে তাকে সমুচিত শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে উড়িষ্যা জয়ের পর সুলায়মান ১৫৬৮ খৃ. কুচবিহার আক্রমণ করেন এবং মুসলিম বাহিনী নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ধরে অগ্রসর হয়ে তেজপুর পর্যন্ত দখল করেন। কিন্তু অন্যান্য সূত্রানুযায়ী সুলায়মান স্বীয় সেনাপতি কালা পাহাড়ের নেতৃত্বে এক সৈন্যবাহিনী কুচবিহারে প্রেরণ করেন এবং এই বাহিনী কামাখ্যা, হাজো ও অন্যান্য স্থানের মন্দির ধ্বংস করে বাংলায় প্রত্যাবর্তন করে (History of Bengal, সম্পা. J. N. Sarkar, ২য় খ., ১৮৪-৫)।
সুলায়মান কাররানীর মৃত্যুর (১১ অক্টোবর, ১৫৭২) পর নানা বিপর্যয় অতিক্রম করে প্রথমে তার জেষ্ঠ্য পুত্র বায়যীদ খান (৯৮০/১৫৭২) এবং পরে কনিষ্ঠ পুত্র দাউদ খান (৯৮০-৮৪/১৫৭২-৭৬) বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। এই সময় মুগল সম্রাট আকবর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা হইতে আফগান কর্তৃত্বের অবসানের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। আফগানদের এই সংকটময় সময়ে কালা পাহাড় অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে আফগান বাহিনীর পক্ষে থেকে বিভিন্ন যুদ্ধে মুগল বাহিনীর মুকাবেলা করেন এবং বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় সক্রিয় থাকেন। তিনি জৌনপুর ও ঘোড়াঘাটে মুগল বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হন। কিন্তু রাজমহলের যুদ্ধে (জুলাই ১৫৭২ খৃ.) দাউদ খান পরাজিত, বন্দী ও নিহত হন এবং কালা পাহাড় যুদ্ধে আহত হয়ে পলায়ন করেন (History of Bengal, সম্পা. J. N. Sarkar, ২য় খ., ১৯৪-৫)। কোন কোন লেখকের মতে এই যুদ্ধে কালা পাহাড় আহত হয়ে মারা যান। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে প্রমাণিত হয় যে, বাংলার শেষ স্বাধীন আফগান সুলতান দাউদ খানের মৃত্যুর পর কালা পাহাড় মাসুম কাবুলীর বাহিনীতে যোগ দেন এবং মুগল শক্তির বিরুদ্ধে খন্ডযুদ্ধে সক্রিয় থাকেন। ২৭ মার্চ, ১৫৮৩; মাসুম কাবুলী রাজমহলের সন্নিকটে কাটিগাঙ্গে এক বিরাট বাহিনী মুগলদের প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে সমবেত করেন। এই আফগান নৌবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন সম্ভবত কালা পাহাড়। খান-ই আজমের নেতৃত্বাধীন মুগল বাহিনী এবং আফগান বাহিনী প্রায় একমাস যাবত পরস্পরের সাথে খন্ডযুদ্ধে লিপ্ত থাকে। অবশেষে ২৪ এপ্রিলের যুদ্ধে মুগল বাহিনী বিজয় লাভ করে। কালা পাহাড় যুদ্ধে আহত হয়ে ইন্তেকাল করেন (History of Bengal, সম্পা. J. N. Sarkar, ২য় খ., পৃ.-২০২)।
কালা পাহাড়ের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে সমসাময়িক সূত্রে বিশেষ কিছু উল্লেখ নেই। তবে তার বীরত্ব, রণকৌশল, স্বদেশপ্রেম ও পৌত্তলিকতা বিরোধী কার্যাবলীর বিপুল খ্যাতি আছে। প্রতিমা ভঙ্গকারী (বুতশিকান, Iconoclast) হিসাবে সমকালীন হিন্দু সমাজে নিন্দিত হইলেও পরবর্তীকালে বাঙ্গালী হিন্দু লেখকগণ কালা পাহাড়ের অসম সাহসিকতা, দেশপ্রেম ও শেষ জীবনে স্বধর্মত্যাগের জন্য অনুশোচনা ও গঙ্গাজলে দেহ বিসর্জনের বিষয়ে বহু কল্পকাহিনী রচনা করে তাকে নন্দিত করেন। সমসাময়িক সূত্রসমূহ হইতে ইহা নির্ভূলভাবে প্রমাণিত হয় যে, হিন্দু বংশোদ্ভূত ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী বাংলার কালা পাহাড় এবং আফগান বংশোদ্ভূত জন্ম-মুসলিম কালা পাহাড় দুইজন ভিন্ন ব্যক্তি। কাজেই আলোচ্য কালা পাহাড়কে আফগান কালা পাহাড় মনে করা যুক্তিযুক্ত হবেনা।
তথ্যসূত্র:
(১) গুলাম হুসায়ন সালীম, রিয়াদুস্ সালাতীন, কোলকাতা ১৮৯৮ খৃ. Bib. Indica sens; ইংরেজী অনুবাদ ‘আবদুস্ সালাম’; বাংলা অনুবাদ বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
(২) গুলাম হুসায়ন তাবাতাবাঈ, সিয়ারুল মুতাআখখিরীন, কোলকাতা ১৮৩৩ খৃ.; ইংরেজী অনুবাদ Raymond (Mustapha), পুনঃমুদ্রণ কোলকাতা ১৯০২ খৃ.; বাংলা অনুবাদ বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
(৩) মুহাম্মাদ কাসিম ফিরিশতাহ্, তারীখ-ই-ফিরিশতাহ্, উর্দূ অনুবাদ নওল কিশোর, লক্ষ্ণৌ ১৯৩৩ খৃ. ২য় খন্ড ৪৮৩-৮৫।
(৪) যদুনাথ সরকার সম্পাদিত The History of Bengal, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ৩য় সংস্করণ ১৯৭৬ খৃ. ২য় খন্ড, ১৮১-২০৩।
(৫) রমেশ চন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত বাংলাদেশের ইতিহাস (মধ্যযুগ), কোলকাতা ১৯৮৭ খৃ. ২য় খন্ড, ১১৭-৮।
(৬) রজনীকান্ত চক্রবর্তী, গৌড়ের ইতিহাস, মালদহ, ১ম সংস্করণ, ১৯০৯ খৃ.; ১৬৮-৮৮।
(৭) কালী প্রসন্ন দাশ, বাঙ্গালার বীর, ভারত বুক এজেন্সী, কোলকাতা, ১৩৩৭ বাংলা, ২য় খন্ড, ২৮-৪৬ (কিংবদন্তী অবলম্বনে কল্পকাহিনী)।
(৮) রাখাল দাশ বন্দোপাধ্যায়, বাঙ্গালার ইতিহাস, ২য় খন্ড, কোলকাতা ১৯১৭ খৃ.
(৯) বাংলা বিশ্বকোষ, ঢাকা ১৯৭৫ খৃ., ২য় খন্ড, ৯৯।
(১০) দুর্গাচরণ সান্যাল, বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস, এই গ্রন্থ সম্পর্কে ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেনঃ “দুর্গাচরণ সান্যাল বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থে কালা পাহাড় সম্বন্ধে যে বিবরণ দিয়াছেন তাহা সম্পূর্ণ কাল্পনিক, সত্যের বিন্দুমাত্রও তাহার মধ্যে নাই (বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, ২য় খন্ড, ১১৮, টীকা)। মজুমদারের মতে কালা পাহাড় জন্ম-মুসলিম আফগান (বাংলাদেশের ইতিহাস, মধ্যযুগ, ২য় খন্ড, ১১৭)।
প্রবন্ধটি ডঃ এ. কে. এম. আইয়ুব আলী রচিত, ইসলামী বিশ্বকোষ, সপ্তম খন্ড।
০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:২৩
সালাহউদ্দীন আহমদ বলেছেন: আপনার প্রোফাইলের ছবি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক অধ্যায়ের প্রতিবাদী প্রতিচ্ছবি।
২| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:২৫
অজানা আমি বলেছেন: অনেক অজানা তথ্য জানলাম
০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:২৫
সালাহউদ্দীন আহমদ বলেছেন: ধন্যবাদ।
৩| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১০:৪০
সুমিন শাওন বলেছেন: অসাধারন পোষ্ট, সোকেজে রাখলাম
০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১২:১৪
সালাহউদ্দীন আহমদ বলেছেন: কৃতিত্বটা আমার নয়। এটা এক শ্রদ্ধেয় লেখকের লেখা। আমি চলতি ভাষায় সামান্য পরিমার্জনা করেছি মাত্র।
৪| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৩:২০
নুভান বলেছেন: শোকেইসড
০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:৫০
সালাহউদ্দীন আহমদ বলেছেন:
ধন্যবাদ।
আপনি ভাই বন্দুক তাক করে আছেন কেন?
©somewhere in net ltd.
১|
০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ সকাল ১১:৪৪
সৌম্য বলেছেন: মন্দির ধ্বংস করা খারাপ কাজ।