নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সংক্রান্তির সলতে। লেখক সম্পাদক ওয়েব প্রকাশক

শ্রীশুভ্র

ফ্রীল্যান্স লেখক

শ্রীশুভ্র › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাঙালির হোমটাস্ক

১৮ ই জুন, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৫৫




কবি বলেছিলেন, ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি’। কতদিন আগেই বলেছিলেন। কিন্তু যখন বলেছিলেন, এখন ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখতে পাই, কবি হয়তো একটু বেশি অভিমান করেই তাঁর সময়ে কথাটি বলেছিলেন। কারণ সেই একই সময়ে আরও এক মনীষী মহামতি গোখেলই কি বলেননি, “বাঙালি আজ যা ভাবে ভারত কাল তা ভাবে”? এখন একই সময়ে দুইজনের কথাই তো সার্বিক ভাবে ধ্রুব সত্য হতে পারে না। ইতিহাস সাক্ষী, আংশিক ভাবে দুইজনের কথাই সত্য ছিল সেই সময়ে। অধিকাংশ বাঙালিই কবি’র কথায় মানুষ হয়ে উঠতে না পারলেও, সেই একই কালপর্বে বাঙালিরই একটা অংশ গোটা ভারতে বাকি জাতিগুলির থেকে সব বিষয়ে এগিয়ে ছিল। এ ইতিহাসের সত্য। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক সময়কে অনেকদূরে পিছনে ফেলে রেখে আজকের এই একবিংশ শতকের প্রাক মধ্যপর্বে দাঁড়িয়ে বাঙালির দিকে তাকালে ঠিক কি দেখতে পাই আমরা? আজকে স্বাধীন ভারতে বাঙালির অবস্থান নিয়ে এই আলোচনা নয়। কিন্তু কোভিড পরবর্তী সময়ে পৌঁছিয়ে সমগ্র বিশ্বে এই যে একটা প্রচণ্ড টালমাটাল অবস্থা শুরু হয়ে গিয়েছে। তলায় তলায় চলতে থাকা যে ঠাণ্ডা যুদ্ধটা আজকে আর ততটা ঠাণ্ডা নেই। এক মেরু বিশ্ব বন্দোবস্ত তার সাম্রাজ্য এবং দাদাগিরি রক্ষা করতে যেভাবে এক একটি দেশের বিরুদ্ধে ছলে বলে কৌশলে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধ মৃত্য ধ্বংসের যজ্ঞ শুরু করে দিয়েছে। ঠিক সেই সময়ে বাঙালির অবস্থান কি? বাঙালি আজকে ঠিক কোন ভুমিকা পালন করছে? আজকেও কি বাঙালিকে দেখলে গোখেল তাঁর বলা কথাকেই মান্যতা দিতেন? জীবনের অন্তিম পর্বে পৌঁছানো রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যিক যাযাবর একটি প্রশ্ন করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলে, কবি তাঁর ‘সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে’ গানটি শেষ জীবনে লিখলে ঠিক কি লিখতেন। কবি তরুণ সাহিত্যিক যাযাবরের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘সার্থক’ শব্দটি কেটে দিতেন। ঠিক তেমনই আজকেও যদি সেই গোখেলের কাছেই জানতে চাওয়া হতো, এক শতাব্দী আগের মতো আজও কি তিনি একই রকম ভাবে বাঙালি সম্বন্ধে তাঁর সেই অবিস্মরণীয় উক্তিটির প্রতিধ্বনি করতে পারতেন? না’কি আজ তিনিও আমাদের কবির মতকেই সমর্থন করে কবি’র কথাটাই বলতেন, রেখছো বাঙালি করে মানুষ করনি।

মহামতি গোখেলও নেই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও নেই। কিন্তু আমরা রয়ে গিয়েছি। আমরা বাঙালি। ভাগ হতে হতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠীবদ্ধ স্থবির থেকে স্থবিরতর জীবে পরিণত হয়ে হয়ে। আমরা সত্যিই কি কবির কথা মতো মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি? না’কি সেই বাঙালিই রয়ে গিয়েছি। যে বাঙালি’র সম্বন্ধে কবির সেই হিমালয়সম অভিমানের সাক্ষী তাঁর সেই মহাবাণীটি। কিছুক্ষণের জন্য চোখবন্ধ করে শান্ত মনে ভাবাই হোক, আর চোখ খুলে স্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখাই হোক। ঠিক কোন বাঙালিকে দেখতে পাচ্ছি আজকে? বিশ্বকবি’র অভিমানে দেখা বাঙালিকে না’কি গোখেলের শ্রদ্ধার চোখে দেখা বাঙালিকে?

পরপর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আমাদের চোখের সামনেই ঘটতে শুরু করে দিল। আট বছর ধরে চলতে থাকা ইউক্রেনের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার শেষ উপায় হিসাবে পূর্ব ইউক্রেনের ডনবসের চারটি অঞ্চলের রাশিয়ার কাছে সাহায্য প্রার্থনায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাশিয়ার ইউক্রেনের বিরুদ্ধে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করার ঘটনা। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবরের হামাসের একদিনের হামলার জবাবে, গাজায় বিগত কুড়ি মাস ধরে চলতে থাকা শিশুঘাতি নারীঘাতি নরসংহারের ঘটনা। আন্তর্জাতিক পরিভাষায় যাকে জেনোসাইড বলে অভিহিত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে রাষ্ট্রপুঞ্জ গঠনের সময়ে বিশ্বের সকল দেশ যে বিষয়ে একমত হয়ে শপথ নিয়েছিল। ‘আর কখনো নয়’ বলে। এবং এই গত ১৩ই জুন কথা নেই বার্তা নেই দমাদম ইরানে ইজরায়েলের বোমাবর্ষণের সূত্র ধরে ইরান ইজরায়েলের শুরু হওয়া যুদ্ধের ঘটনা। প্রথম ঘটনায় একমেরু বিশ্বে ছড়ি ঘোরানো ওয়াশিংটন থেকে রুশ প্রসিডেন্টকে পুটলার বানিয়ে দেওয়া হলো। দ্বিতীয় ঘটনায় দখলদার জায়োনিস্টদের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে থাকা হামাসকে টেররিস্ট বানিয়ে দিয়ে গোটা গাজা অঞ্চলকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার কার্যক্রমকে ইজরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে চালিয়ে দেওয়া হলো। এবং সদ্যসদ্য শুরু হওয়া ইরানের বিরুদ্ধে ইঙ্গমার্কিন ইজরায়েলের যুদ্ধকে মৌলবাদ ধ্বংসের ভিতর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপনের শেষ প্রয়াস বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়ে গেল।

এবং আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। বিবিসি থেকে সিএনএন। দিল্লীর টিভি থেকে কলকাতার টিভি। খবরের কাগজ থেকে হোয়াটসাপ ইউনিভার্সিটি। দাঁড়ি কমা ফুলস্টপ অব্দি প্রথম থেকে শেষ, অক্ষরে ভাষায় ভাবে একটিই সিলেবাস। সারাদিন মুখস্থ কর। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় হোমটাস্ক করতে বসে যাও। বাঙালিকে আর পায় কে! না, রাশিয়া অনেকটাই দূরে। তাই পুটলার নিয়ে বাঙালিকে খুব একটা ব্যস্ত হতে দেখা যায়নি। ইউরোপ আমেরিকার মতোন ইউক্রেনের নীলহলুদ পতাকা নিয়ে রাস্তা দিয়ে দৌড়াতেও দেখা যায়নি। কিন্তু বাঙালি তো! তাই টিভি আর খবরের কাগজের আর হালের হোয়াটসাপের সিলেবাস মুখস্তে বাঙলির অসুবিধা হয়নি কোন। তারপর গাজায় প্রতিদিনের জোনোসাইড। বিবিসি সিএনএনের সিলেবাসে যেটি নেহাতই জঙ্গীনিধন কার্যক্রম মাত্র। বাঙালিকে তাই বিশেষ নড়েচড়ে বসতে হয়নি। মারা যাচ্ছে যাক। জঙ্গী হোক না হোক মুসলিম তো বটে। ওদের চারটি করে বিয়ে। কটা মারা গেলে ক্ষতি কি? সেই আফগানিস্তান ইরাক দিয়ে শুরু। লাদেন গেল সাদ্দাম গেল। গদ্দাফি শুদ্ধ লিবিয়াও গেল। এক দশক ধরে সিরিয়াও গেল। তাতে বাঙালির কি? নাহ, লাদেন থেকে সাদ্দাম, গদ্দাফি থেকে বাশার। আফগানিস্তান থেকে ইরাক। লিবিয়া থেকে সিরিয়া। ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির দাপটে বাঙালি বুঝে নিয়েছে কার পক্ষে থাকলে গায়ে ফোস্কাও পড়বে না। তাই বাঙালি পক্ষ বেছে নিতে এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করেনি। এবার যুদ্ধ ইরানে। আর ইরান মানেই তো নারীবিদ্বেষী ইসলামী মৌলবাদী শক্তি। সেই তালিবানদেরই মাসতুতু ভাইটাই গোত্রের। বিবিসি থেকে সিএনএন। দিল্লী থেকে কলকাতা। বাঙালি সিলেবাসটা পুরোটাই মুখস্থ করে নিয়েছে। একেবারে টপ টু বটম। না, বাঙালির ইউক্রেনের ইতিহাস জানার দরকার নেই। প্যালেস্টাইনের ইতিহাস জেনে বাঙালির কোন স্বার্থ পুরণ হবে? ইরানের ইতিহাস? তাতে বাঙালির কি এসে যায়? এখন টেকনোলজির যুগ। ইতিহাস নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে কেন? হ্যাঁ ইতিহাসের সিলেবাস যদি জানতেই হয়। বিবিসি আছে। সিএনএন আছে। দেশের টিভি, কাগজ, বুদ্ধিজীবী আছে। তারা সেই সিলেবাস বাঙালির কানের কাছে নামতা পড়ার মতো জপতে থাকবে না! ওতেই বাঙালির ইতিহাস জানা হয়ে যাবে। তারপর বিবিসি সিএনএন ইত্যাদির দেওয়া হোমটাস্ক নিয়ে ফস করে ফেসবুকে বসে গেলেই হলো। বাঙালি তার পাঠশালার মাস্টারমশাইয়ের সুবোধ ছাত্রছাত্রী তখন।

না, এটই বাঙালির একমাত্র ছবি ছিল না কোনদিনই। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেও নয়। তাঁর মৃত্যুর পরপরও নয়। চল্লিশের দশকেই আজকের বাঙালির পূর্বপুরুষেরা সুদূর ইউরোপে ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থানের বিরুদ্ধে বাংলার রাজপথেই গর্জে উঠেছিল একদিন। গড়ে তুলেছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণসংগ্রাম। সেই ইতিহাস বিস্মৃত হয়ে গিয়েছে আজকের বিবিসি সিএনএনের পাঠশালার বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা। সেদিনের পরাধীন ভারতবর্ষের বাঙালিরা মনেপ্রাণে অনেক বেশি স্বাধীন ছিল। বাঙালির একটা বড়ো অংশ। লেখাপড়ার সুবিধে প্রাপ্তদের একটা বড়ো অংশ। আজকে বাঙালির ঘরে ঘরে লেখাপড়া জানা বাঙালির সংখ্যা আনুপাতিক হারেও অনেক বেশি। সেই দিনের তুলনায়। কিন্তু আজকের বাঙালিরা বিবিসি সিএনএনের সুবোধ শিক্ষার্থী। তারা জানে কখন চোখ কান বুঁজে থাকতে হয়। কখন হাজার হাজার গর্ভবতী নারীদের উপরে প্রতিদিনের বোমাবর্ষণেও মুখে রা কাটতে নেই। কখন হাজার হাজার অনাথ শিশুদের কাটা হাত পায়ের ছটফটানি দেখেও উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে হয়। কখন একটা গোটা জনপদকে বোমারু বিমানে গুঁড়িয়ে দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলেও, কবিতা লিখে গান গেয়ে ছবি এঁকে নাটক সিনেমা দেখে বিনোদনের মজায় গা ভাসিয়ে থাকতে হয়। আবার কখন সময় হলেই খপ করে মাশা আমিনীর হিজাবকাহিনী মনে করে ইরানি নারীদের দুঃখ কল্পনা করে নিয়ে ফেসবুক জুড়ে বিবিসি সিএনএনের প্রোপাগাণ্ডায় নাচতে শুরু করে দিতে হয়। এখানেই আজকের বাঙালির সহজাত প্রতিভা। চরিত্রের স্বরূপ। স্বার্থের নোঙর! কিন্তু আজ থেকে নয় দশক আগেও বাঙালি সুদূর ইউরোপ জুড়ে ফ্যাসিবাদের জয়যাত্রার বিরুদ্ধে সঠিক সময়ে গর্জে উঠেছিল। সরব হয়েছিল নাৎসী সহ ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলির বিরুদ্ধে। সেই ইতিহাস আজও হারিয়ে যায়নি। অথচ আজকে যখন সেই ইউরোপ থেকে আমেরিকা, আফ্রিকা থেকে এশিয়া। দেশে দেশে, সাধারণ মানুষ প্যালেস্টাইনের পতকা হাতে নিয়ে প্যালেস্টাইনকে জায়োনিস্ট জনোয়ারদের হাত থেকে মুক্ত করার ডাক দিতে গর্জে উঠেছে রাজপথে, বাঙালি তখন যে যার চরকায় তেল দিতেই ব্যস্ত। এক একটা সভ্য দেশে মানুষ যখন গাজায় নারীঘাতি শিশুঘাতি হামলার দৃশ্যগুলি দেখতে দেখতে আর থাকতে পারেনি না ঘরে বসে, সেই সময়ে বাঙালি অপেক্ষা করছিল, ইজরায়েল কখন ইরানে বোমা ফেলবে বলে। ওয়ার ক্রিমিন্যাল নেতানিয়াহু কখন ইরানের জনগণকে ইরানের রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার আহ্বান জানাবে। ইরানের বর্তমান শাসককে গদি থেকে নামাতেই হবে। সেই মাশা আমিনির মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে না? ইরানে নারীরা সারাদিন ধরে অত্যচারিত হচ্ছে। ইরানে কোন গণতন্ত্র নাই। সেখানে ইসলাম জাঁকিয়ে বসে রয়েছে। ইসলামের মতো একটি মৌলবাদী ধর্মের এত রমরমা সেখানে। বাঙালির একটা তো দায় থেকে যায়, না’কি? ওয়ার ক্রিমিন্যাল নেতানিয়াহুর ডাক ইরানিরা উপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু বাঙালি পারে কি? বিবিসি সিএনএনের পাঠশালার দুর্নাম হয়ে যাবে না? এতদিনের এত কিছু শেখানো পড়ানো। এমন সুন্দর সিলেবাস। টপ টু বটম মুখস্থ করে নেওয়া বাঙালি চুপ করে বসে থাকতে পারে আর?

©শ্রীশুভ্র ১৮ই জুন ২০২৫

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই জুন, ২০২৫ রাত ৮:৪৭

জ্যাক স্মিথ বলেছেন: অনেক ভারী ভারী কথা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.