![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ইতিহাস পড়ি না, জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশকে প্রতিদিন যেভাবে দেখেছি, সেটাই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস।
দিনের বেলা বাবা অফিস থেকে ফিরে, মধ্যাহ্নভোজন সেরে শেষ দুপুরে একটু ঘুমুতেন। ওই সময়টা ওনার শোবার ঘরে আমাদের যাওয়া ছিলো বারণ। একেবারে কারফিউ জারি থাকতো সেসময়টা।
বাবার দোষটাই দেই কি করে! আমাদের ভাই বোনদের সেই সময়টাতেই যেনো সমস্ত কাজ পড়ে যেতো ওই ঘরে যাবার! আর যতই সন্তর্পণে যেতাম, হাত পা যেনো কথাই শুনতে চাইতো না! কিংবা যেনো অন্য কারো হাত পা নিয়ে ঢুকতাম, যা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকতো না! দরজার পাল্লাটাকে যেখানে নিঃশব্দে খোলার পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে, দেখা গেলো ‘ইয়াও’ করে শব্দ করে উঠলো। ড্রয়ারগুলো যেনো তখনই তাদের মসৃণতা হারিয়ে ফেলতো এবং খুলতে, বন্ধ করতে একটুতেই গান গেয়ে উঠতো! কোনও একট পা হটাত যেন একটু লম্বা হয়ে যেতো আর নিজের অজান্তে আশে পাশের স্যান্ডেল জুতা একটা কিছু পেলে সরসর শব্দ করে পাঠিয়ে দিতো খাটের নীচে।
তারপর যা হবার তাই।‘কে রে ওখানে’ হেঁকে উঠতেন বাবা। যা কারফিউতে গোলাগুলি চলার মত ভীতির সঞ্চার করতো আমাদের মনে।
বাবার শোবার ঘর নিয়ে আরেকটা কারণে আমার মনের অন্তঃস্থলে একটা সুতীব্র আকর্ষণ ছিল। সেটা সৃষ্টি হয়েছিলো অপেক্ষাকৃত কম বয়সে সেই ঘরে থাকার অধিকার হারিয়ে ফেলায়। আমার ১৮ মাস বয়সে ছোট ভাইটি যোগ দিলো আমাদের পরিবারে। এর আগে বিছানায় অবস্থান ছিল বড় ভাইয়ের, মা-বাবার আর আমার। পাঁচজনের স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় বড় ভাইকে সরিয়ে দেয়া হল পাশের রুমে। তার একা থাকাটা ভালো দেখায়না বিধায় কপাল পুড়লো আমারও। একটা অব্যক্ত কষ্ট রয়ে গেলো মনে।
হটাত একদিন বাবা মা’র ছুটাছুটিতে বুঝলাম, আমার নাকি জবরদস্ত জ্বর হয়েছে। সেই সূত্রে ঠাঁই হোল বাবার শোবার ঘরে। সে কি আদর, বাবার এবং মা’র। ভেবেছিলাম এভাবেই কেটে যাবে দিন। একদিন ঘুম ভেঙ্গে দেখি বড় ভাইয়ের সাথে শুয়ে। শুনলাম ভাল হয়ে গেছি। সেই থেকে জ্বর হওয়া আমার জন্য ছিলো একটা অতীব আকর্ষণীয় ব্যাপার।
রাগী বাবা থাকলে একটা বড়ো ফায়দা অর্জন হয়। ধরাকে সরা জ্ঞান করার আস্থা প্রাপ্তি ঘটে। বাবার আশ্রয়ে নিজেদেরকে খুব নিরাপদ বোধ করতাম আমরা সবসময়য়। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাবতেই পারিনি বাবা আমাদের কোন ক্ষতি বরদাশত করবেন। সেই জন্য নিঃশঙ্কায় কেটে গেছে দিন। অথচ ভাবলে এখনও গা শিওরে উঠে, কিভাবে মরতে মরতে কয়েকবার বেঁচে গেছি আমরা, নিশ্চিত পিতৃহীন হবার সম্ভাবনা থেকে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে ফিরে পেয়েছি আমাদের বাবাকে।
বয়স বাড়তে থাকলো আমাদের আর অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগলাম, আমাদের কারফিউদাতা বাবা কিভাবে আমাদের বন্ধু হয়ে যেতে লাগলেন। বয়ঃসন্ধিকালে দোকানে নিয়ে কিনে দিলেন আন্ডারওয়ার, লুকিয়ে ভ্রাতৃত্রয়কে তাস খেলতে দেখে একদিন ড্রয়িংরুমে ডেকে নিজে খেলায় যোগ দিলেন আর মা’কে বললেন সবাইকে চা পরিবেশন করতে। সেই দিন থেকে তাস খেলা আমাদের ঘরে আর নিষিদ্ধ রইলো না আর আমরাও বিনিময়ে জীবনে এই খেলার অপব্যবহার করার কথা ভাবতেই পারিনি।
অতঃপর LPR এ গেলেন বাবা। সদা প্রাণচঞ্চল বাবা রাতারাতি যেন বুড়ো হয়ে গেলেন। জানতাম বাবার হাই ব্লাড প্রেশার রয়েছে। কিন্তু কোনোদিন তাঁকে শঙ্কিত দেখিনি। কোনদিন শয্যাশায়ী থাকেননি। দেখিনি আমাদেরকে শঙ্কায় ফেলতে। সেই বাবা অবসরে যেতে না যেতেই স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন। আমাদেরকে কোন প্রস্তুতির সুযোগ না নিয়ে ছেড়ে গেলেন এই দুনিয়া।
তিন দেশ থেকে পড়িমরি ছুটে এলাম মানসিকভাবে বিধ্বস্ত আমরা তিন ভাই। বারডেমের হিমঘর থেকে গ্রহণ করলাম বাবার মরদেহ। পায়ের দিকে ধরার সৌভাগ্য হোল আমার। মনে মনে বললাম, বাবা মাফ করে দিও, তোমার সামনে থাকতে পারিনি। হয়তো ছেলেদের সামনে দেখলে নিজের দায়িত্বের কথা স্মরণ করে আরো কিছু দিন বেঁচে থাকার আগ্রহবোধ করতে।
তোমার কাছে মাফ নেয়া হলোনা বাবা, ছোট থাকতে তোমার ড্রয়ার থেকে সিকি এবং আধূলিগুলো আমিই সরাতাম বাবা, যাতে আমার মাটির ব্যাংকটা, অন্য সবার আগে ভরে ওঠে। তুমি নিশ্চয়ই সব বুঝতে বাবা ব্যাংকটা অতো তাড়াতাড়ি ভারী হয়ে যেতে দেখে কিন্তু আমাকে বুঝতে দাওনি তা। হ্যাঁ বাবা, খাবার ঘরের মিটসেফটা ধরে আমি ঝুলে পড়েছিলাম বলেই ওটা পড়ে গিয়েছিলো আর সংসারের সব কাঁচের জিনিস চুরমার হয়ে গিয়েছিলো। মারবে ভয়ে সেদিন সত্য কথাটা বলতে পারিনি বাবা আর তুমিও কিচ্ছু বলনি আমাকে। মা’কে বলতে শুনেছি মিটসেফটা যে আমার গায়ের উপর পড়েনি সেজন্যে তুমি খুব সন্তুষ্ট ছিলে এবং কৃতজ্ঞতার নামাজও পড়েছিলে। কিন্তু আমার যে সত্য কথাটা বলা হলোনা বাবা!
গ্রামের বাড়িতে আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে বাবাকে সমাহিত করার ব্যবস্থা হলো। আমার এক জেঠাতো ভাই, কোরানে হাফেজ, মসজিদে ইমামতি করেন, বললাম ভাই, ওনাকে কবরে নামানোর কাজটায় আপনি নেতৃত্ব দিবেন কিন্তু। মনে মনে ভাবলাম কাজটা ভালভাবে সম্পন্ন হবে তাহলে। উনি বোধহয় দায়িত্ব থেকে রেহাই চাইলেন শরীর ভালো না থাকার কারণে।
আমার গায়ে তখন যেন জ্বর। ঠিক যেন বাবার ঘরে শোবার সুযোগ প্রাপ্তির জ্বর। একলাফে নেমে গেলাম খোঁড়া কবরের গভীরে। ভাইয়েরাও নেমে এলো সাথে সাথে। যত্নের সাথে বাবাকে নামিয়ে শুইয়ে দিলাম তাঁর নতুন ঘরে। কি শান্তি! বাবার ঘরে একসঙ্গে আমরা ভ্রাতৃত্রয়। বাবা শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছেন। উচ্চ রক্তচাপ তাঁকে আর ছুঁতে পারছে না একটুও। উপর থেকে তাড়া আসছে ফিরে যাবার। মন চাইছে আরেকটু থাকি, অনেকক্ষণ থাকি। মনে মনে বাবাকে বললাম, বাবা তোমার ঘরে এসেছি আমরা, তোমার ঘুমের ব্যাঘাত করছি, একটু কষে বকে দাওনা বাবা!
৩০ শে জুন, ২০১৩ সকাল ১১:৫১
খন্দকার আলমগীর হোসেন বলেছেন: পড়েছেন বলে অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।
২| ৩০ শে জুন, ২০১৩ সকাল ১০:১৫
অক্ষি বলেছেন: পৃথিবীর সব বাবা এমন সন্তান জন্ম দিন। আলহামদুলিল্লাহ।
৩০ শে জুন, ২০১৩ সকাল ১১:৫৭
খন্দকার আলমগীর হোসেন বলেছেন: সন্তানের কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করেছি মাত্র। আলহামদুলিল্লাহ।
৩| ৩০ শে জুন, ২০১৩ সকাল ১০:৪৮
পরের তরে বলেছেন: ভাই কি মন্তব্য করব??? লিখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি।
৩০ শে জুন, ২০১৩ সকাল ১১:৫৮
খন্দকার আলমগীর হোসেন বলেছেন: ভালো থাকুন ভাই।
৪| ৩০ শে জুন, ২০১৩ সকাল ১১:০৬
ইরফান আহমেদ বর্ষণ বলেছেন: আপনার বাবার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি
৩০ শে জুন, ২০১৩ দুপুর ১২:০০
খন্দকার আলমগীর হোসেন বলেছেন: আমীন। আপনাকে শুভকামনা।
©somewhere in net ltd.
১|
৩০ শে জুন, ২০১৩ সকাল ৯:২২
এস এইচ খান বলেছেন: অসাধারণ! +