![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
স্বপ্নসারথী..নতুন যুগের পথ চেয়ে আছি। বর্তমানে কাজ করছি একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিময় হারে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। অভিজ্ঞতা, এমনকি তত্ত্ব অনুসারে একটি দেশের মুদ্রার বিনিময় হারে অবমূল্যায়ন হলে বিশ্ববাজারে এর পণ্যমূল্য হ্রাস পায়। স্থিতিস্থাপকতা (ইলাস্টিসিটি) বিধিমতে সে দেশের রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ বাড়তে থাকে। ফলে মূল্যস্ফীতি হয় এবং ওই দেশের রপ্তানি মূল্য বেড়ে যায় এবং স্বাভাবিক নিয়মে রপ্তানি কমে যায়। বিনিময় হার আবার সাবেক জায়গায় ফিরে আসে। এ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সঠিক বিনিময় হার নির্ধারণকে প্রাইস স্পেশি ম্যাকানিজম বলা হয়। তবে বর্তমানে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের জন্য প্রেক্ষিত ভিন্ন। কাগজে-কলমে উন্মুক্ত বহির্বাণিজ্যের কথা থাকলেও এতে আমদানি শুল্ক, কোটা ইত্যাদি নানা ধরনের বাধা বিরাজমান থাকে। তা ছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্যে 'ক্ষুদ্র দেশ' অর্থাৎ চলমান পণ্যমূল্যেই রপ্তানি করতে বাধ্য থাকে বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশ, যার মোট রপ্তানি বাজারের অংশ অকিঞ্চিৎকর থাকে। সরবরাহে স্থিতিস্থাপকতার অভাবে চাহিদা বাড়লেও রপ্তানি বাড়ানোর অসুবিধা দেখা দিতে পারে।
ওপরে বর্ণিত প্রেক্ষিতের কথা স্মরণে রেখে সমসাময়িক বিশ্বে বাংলাদেশের টাকার মূল্যমান ও দেশটির রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহে এর প্রভাব কী হতে পারে তা ভেবে দেখা দরকার। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রেমিট্যান্সে চমৎকার প্রবৃদ্ধি, অব্যাহত রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও আমদানি খরচে খানিকটা ভাটা দেখা দেওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে থাকে। আবার ২০১০-১১ অর্থবছরে নানা অব্যবস্থা ও প্রকৃতির নিয়মে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কে পৌঁছে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষায় 'সংযত মুদ্রানীতি' গ্রহণ করে। ফলে মুদ্রা সরবরাহ কমে যায় এবং মূল্যস্ফীতি বর্তমানে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে ৭.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। সঙ্গে স্বাভাবিক কারণে বিনিয়োগে যে পরিমাণ প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে কম হয়েছে, বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্যে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার মতো ৭ শতাংশ না হলেও ৬.৫ শতাংশে স্থিতি লাভ করবে। এর একটি কারণ আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে গ্রামবাংলায় 'অফ ফার্ম' কর্মকাণ্ডে এখন প্রচণ্ড শক্তি। তবু আমদানি খরচ কমে যাওয়া, অব্যাহত রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং প্রায় লক্ষ্যমাত্রায় রপ্তানি আয় অর্জিত হওয়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভাণ্ডার বাড়তে থাকে। এর অপরিহার্য পরিণতিতে টাকার মূল্যমান বাড়তে থাকে। গত এক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা কিনেও টাকার মূল্যমান বৃদ্ধি ঠেকাতে পারেনি বরং রিজার্ভ আরো বৃদ্ধি পেয়ে টাকার মূল্যমান বৃদ্ধিতে আরো শক্তি যুক্ত হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে নিকট-ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কা। কিন্তু কেন?
একটি দেশের স্থানীয় মুদ্রার মান (মূল্য) যদি বৈদেশিক মুদ্রার তুলনায় বেড়ে যায় (পুনর্মূল্যায়ন) তাহলে ওই দেশ থেকে পাঠানো রপ্তানি পণ্যের মূল্য বৈদেশিক মুদ্রায় বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ একজন বিদেশি আমদানিকারক যদি বাংলাদেশের ৮০ টাকা মূল্যের পণ্য আমদানি করেন তবে এক বছর আগে তাকে এক মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হতো। এখন টাকার মূল্যমান বেড়ে এক ডলারের মূল্য হয়েছে ৭৭.৫০ টাকা। তাহলে সেই আমদানিকারক এখন এক ডলার ভাঙিয়ে মাত্র ৭৭.৫০ টাকা পাবেন; আশি টাকার পণ্য কিনতে তাহলে তাঁকে প্রায় এক ডলার চার সেন্ট খরচ করতে হবে। স্থিতিস্থাপকতার নিয়মে টাকার মূল্যমান বৃদ্ধি রপ্তানি আয় কমাতে প্রায় বাধ্য। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের একজন রপ্তানিকারক এক বছর আগে এক ডলারের পণ্য রপ্তানি করে পেতেন ৮০ টাকা। এখন টাকার মূল্যমান বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি একই পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করে পাবেন ৭৭.৫০ টাকা। দেশে রপ্তানি-আমদানি পণ্যের মূল্য বেশি হওয়ায় অন্যান্য দেশ এখানে বেশি বিক্রি করতে চাইবে। আমদানি বাড়বে যদি বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়ছে না। তাই আমদানি খরচ বাড়ছে না।
অনুরূপভাবে টাকার মূল্যমান বৃদ্ধি বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহের ক্ষতি করতে পারে। কারণ আমাদের যেসব ভাই-বোন অক্লান্ত পরিশ্রমে বিদেশে কাজ করে অনেকটা দেশপ্রেম ও পোষ্যপালনের তাগিদে নিজভূমে বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্স পাঠান, তাঁদের কিন্তু উপকারভোগীর নির্দিষ্ট পরিমাণের টাকা পাওয়ার জন্য এক বছর আগের তুলনায় বেশি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশান্তর করতে হবে। তার উপকারভোগী পোষ্যের জন্য এক বছর আগে এক ডলারে ৮০ টাকা পাঠালেই চলত; টাকার মূল্যমান বৃদ্ধির ফলে বর্তমানে প্রায় এক ডলার চার সেন্ট খরচ করে সেই ৮০ টাকা পাঠাতে হবে। তাই তিনি হুন্ডি তথা মানি লন্ডারিংয়ের চোরাপথে ৯৮ সেন্টে ৮০ টাকা পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ টাকাটা মার যাওয়ার ঝুঁকিও তাঁর থেকেই যাবে। টাকার মূল্যমান বৃদ্ধি তাই রেমিট্যান্স প্রবাহের ক্ষতি করতেই পারে।
বাংলাদেশের রপ্তানির ৭৫ বা ৮০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার রপ্তানি থেকে। এ ক্ষেত্রে গণচীন (৩৭ শতাংশ বাজারাংশ), বাংলাদেশ (৫ শতাংশ বাজারাংশ) ও ভারত (শতকরা ৪.৮ ভাগ বাজারাংশ) বিশ্ববাজারে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে। গণচীন বলছে, অস্বাভাবিক মজুরি বৃদ্ধির কারণে তৈরি পোশাক ও শ্রমঘন নিটওয়্যার থেকে তারা হাত গুটিয়ে ফেলবে (অন্য কারণ অবশ্য মূল ধনঘন অতিশয় উচ্চমূল্য সংযোজন পণ্যে যাওয়ার আগ্রহ)। রানা প্লাজায় সর্বনাশা মানুষ সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের আগ পর্যন্ত তাবৎ বড় ক্রেতা বলাবলি করতেন যে চীনের পরিবর্তে তারা বাংলাদেশ থেকেই তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার কিনবেন। চমৎকার নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখে তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যারের রপ্তানিকারকরা নূ্যনতম মজুরি দিয়ে যে হ্রাসকৃত মূল্যে এখনো রপ্তানি করেন, তার ফলে একজন উন্নত দেশের ক্রেতা ২০ বছর আগে যে খরচে এক সেট তৈরি পোশাক কিনতেন, তা দিয়ে এখন তিন সেট কিনতে পারেন। সেই সুবিশাল সুবিধায় বাদ সেধেছে নিকৃষ্টতম মানের ভবনে, সংবেদনশীলতা বিবর্জিত কর্মপরিবেশে, মজুরি বৃদ্ধিতে চরম অনীহা, তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যারের বিশেষ করে সিংহভাগ মহিলা শ্রমজীবী মা-বোনের ছেলেমেয়ের দেখাশোনা ও শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি না করে, যাতায়াত, চিকিৎসা ও বাসস্থান বিষয়ে অনেক মালিকের উদাসীনতার কারণে এবং চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্রের কারণে শ্রমিকদের ভাঙচুরের ফলে সৃষ্ট অস্থিরতা-উত্তেজনায়।
এ ক্ষেত্রের প্রতিযোগী দেশসমূহ, বিশেষ করে ভারত সজ্ঞানে চীনের ছেড়ে দেওয়া বাজারের অংশের, সম্ভব হলে সবটিই দখল করতে চায়। সে লক্ষ্যে তারা কয়েকটি বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। একটি পাঁচ সালা পরিকল্পনাধীনে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে বিপুল সম্প্রসারণ করতে কাজ শুরু করেছে। ১২টি নতুন অ্যাপারেল পার্ক ও ৪০টি ইন্টিগ্রেটেড টেক্সটাইল পার্ক স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। তৈরি পোশাকসামগ্রীর বিচিত্রতা বাড়ানো হচ্ছে। ৭০ লাখ নতুন তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকের কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা ছাড়া ভারতীয় রুপিকে এখন সর্বকালের সর্বনিম্ন মূল্যমানে (ইন্ডিয়ান রুপি ফলস টু লাইফটাইম ল : দ্য ডেইলি স্টার ৭,৭.২০১৩) বিপুল হ্রাস এক মার্কিন ডলার=৬০.৭৬ ইন্ডিয়ান রুপি ঘটানো হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে টাকার মূল্যমান বাড়তে দেওয়া হয়েছে। এক বছর আগেও যেখানে ভারতীয় রুপি=১.৬ বাংলাদেশ টাকা ছিল; এখন সেটি এক ভারতীয় রুপি=১.৩ বাংলাদেশ টাকা। এর দুটো প্রধান ক্ষতি। ভারতীয় পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে কমে গেল, তারা বেশি বেশি রপ্তানি করতে পারার সক্ষমতা অর্জন করে নিল। আর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার পণ্যের রপ্তানি মূল্য বেড়ে গেল এবং নতুন বাজার দখল করা তো দূরের কথা, বর্তমান বাজার ধরে রাখাই সমস্যা হতে পারে। পরিতাপের বিষয় হলো এই যে শাসককুলসহ নীতিনির্ধারকদের অনেকেই টাকার মূল্যমান বৃদ্ধিকে শক্তিমান অর্থনীতির প্রমাণ হিসেবে ধরে নিচ্ছেন এবং তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। আসলে কিন্তু টাকার বিনিময় হারকে সাবেক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে না পারলে রপ্তানি আয়ে ও রেমিট্যান্স প্রবাহে বিরাট ধস আসতেই পারে। নীতিনির্ধারকদের তাই তত্ত্বীয় ও অভিজ্ঞতার আলোকে বস্তুনিষ্ঠ বিনিময় হার নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমত নীতি-কৌশলে পরিবর্তন এনে আমদানি বৃদ্ধি করাতে হবে; যাতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় জমে না থেকে ব্যবহার হয়ে যায় (উদ্বৃত্ত কারেন্ট অ্যাকাউন্ট অতি উত্তম বলে যদি নীতিনির্ধারকরা ঘোষণা দেন, তাহলে মুশকিল হতে পারে বৈকি!) এবং আমদানি খরচ ও রপ্তানি আয়ের ঘাটতির কারণে টাকার অবমূল্যায়নের স্বাভাবিক ধারা যেন ফিরে আসে ও বজায় থাকে। দ্বিতীয়ত, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি পরিহার করে কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ করে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা দরকার। যাতে নতুন নতুন প্রকল্পে আমদানি খরচসহ ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এতে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে এবং কর্মসংস্থান তথা দারিদ্র্য নিরসনে ইতিবাচক ফল লাভ হবে। কিছু মূল্যস্ফীতি হতে পারে বৈকি। রেমিট্যান্স প্রবাহের মূল্যবান সংগ্রহ যেন কেবল বৈদেশিক বাণিজ্যের নেতিবাচক ভারসাম্য (প্রায় ৯-১০ বিলিয়ন ডলার) ও দৃশ্যমান ভোগে খরচ না হয় এবং অন্তত অংশবিশেষ যাতে বিনিয়োগযোগ্য ইকুইটিতে রূপান্তরিত হয়, তার কৌশলিক উপায় বের করতে হবে। ২০২০ সালে ৪০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করা যেতে পারে। তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যারের বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্রকে এগিয়ে নিতে সবাই মিলে হিংসা, বিদ্বেষ, ঔদ্ধত্য ভুলে সর্বজনে কল্যাণপ্রসূ একটি নীতিমালা অবিলম্বে বের করতে হবে। স্থানীয় মূল্য সংযোজন বৃদ্ধি, উৎপাদন ও রপ্তানি প্রসারে সাহসী, উদ্ভাবনী, সময়োপযোগী ও কার্যকর নীতিমালা বাস্তবায়ন করা এখনই জরুরি হয়ে পড়েছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
প্রেসিডেন্ট: ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
©somewhere in net ltd.
১|
০৯ ই জুলাই, ২০১৩ দুপুর ২:৫৪
অবাক েরাবট বলেছেন: Always PLUS for this kind of article