নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যে মানুষ টার আশা ছিল কবি হবার, তাইতো আজও স্বপ্ন দেখে শিকল ভাঙ্গার, বাকি জীবন বাউল হয়ে পথে হাটার ।

তানভীর আহমেদ সম্রাট

যদিও এখন শীতকাল, তাই বলে কি বসন্ত খুব বেশী দূরে!

তানভীর আহমেদ সম্রাট › বিস্তারিত পোস্টঃ

১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিষয়ে কিছু কথা-

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৮


যদিও মুক্তিযুদ্ধ একটি মিমাংসিত ইস্যু, এরপরেও মহান মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে স্বাধীনতাবিরোধীরা সুকৌশলে, ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যার বিতর্কের হিসেবের মতো, পাকিস্থান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলেই ক্ষমা করে পাকিস্থানিদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিলো বলে অপপ্রচার চালায়। পাকিস্থানও ইদানিং সিমলা চুক্তির কথা বলে প্রকৃত সত্যকে বিকৃত করছে আর অজ্ঞতার কারনে “বাকশালের” মতো এই বিষয়টাতেও আমরা কিছু না বলতে পেরে চুপ করে থাকছি। আর একে তৎকালীন আওয়ামীলীগের আরো একটি ভুল ভেবে মেনে নিচ্ছি। তার চেয়ে চলুন আসলে প্রকৃত ঘটনা কি ঘটেছিলো সেটা জানার চেষ্টা করি। সকল অন্ধকার দূর হোক, সত্যের জয় হোক...


১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার পরেই, ১৯৭১-এর ২০ ডিসেম্বরে ক্ষমতায় বসে ভুট্টো দেখলেন, তার ক্ষমতা ধরে রাখা সহজ নয়। ‘জাতশত্রু’ ভারতের কাছে হেরে এবং আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানের তখন করুণ দশা। ভুট্টো জাতিসংঘে দাবি তোলে ভারতকে দ্রুত তার ৯৩ হাজার সেনাকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ তখন গোঁ ধরে বসে আছে; যুদ্ধাপরাধের জন্য তারা পাকিস্তানী সেনাদের বিচার করবে। সে উদ্দেশ্যে যুদ্ধাপরাধী সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যদের এক তালিকাও বাংলাদেশ তৈরি করে। ভুট্টোর জন্য তখন প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল সে বিচার ঠেকানো এবং যুদ্ধাপরাধীসহ সব বন্দীকে দেশে ফিরিয়ে নেয়া।
মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একেএম কামরুজ্জামান ১৯৭১-এর ২৭ ডিসেম্বরে ঘোষণা দেন যে, ‘বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ৩০জন শীর্ষস্থানীয় পাকিস্তানী সরকারী কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে এবং গণহত্যায় সহযোগিতার জন্য অচিরেই তাদের বিচার হবে।’

’৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে। সে অনুযায়ী বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াও শুরু হয়। বাংলাদেশ সরকার বাহাত্তরের ২৯ মার্চ ঘোষণা করে যে, জেনারেল নিয়াজী, রাও ফরমান আলীসহ ১১০০ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা হবে। সেজন্য একটি প্রস্তাবনাও উপস্থাপন করা হয়। যাতে শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর বিচারে দেশী-বিদেশী জুরি নিয়োগ এবং অন্যদের জন্য শুধু দেশীয় জুরি নিয়োগের উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের সংগৃহীত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালের ১৪ জুন ভারত সরকার নিয়াজীসহ প্রাথমিকভাবে ১৫০ যুদ্ধবন্দীকে বিচারের জন্য বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তরে রাজি হয়। ১৯৭২ সালের ১৯ জুন বঙ্গবন্ধু পুনরায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলার মাটিতেই তাদের বিচার হবে।

১৯৭২ সালের ২৮ জুন থেকে ৩ জুলাই ভারতের শৈলশহর সিমলায় অনুষ্ঠিত হয় ইন্দিরা-ভুট্টো বৈঠক। দুই দেশের মধ্যে অতীতের সমস্ত সংঘর্ষ ও যুদ্ধংদেহী মনোভাবের অবসান ঘটিয়ে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সঙ্কল্প ব্যক্ত করে ইন্দিরা ও ভুট্টো এক চুক্তি সই করেন। এটাই ‘সিমলা চুক্তি’ নামে খ্যাত। সামরিক ও রাজনৈতিক নানা দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নিয়ে বৈঠকে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশের স্বীকৃতি বা যুদ্ধবন্দী ফেরত নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। চুক্তিতে কাশ্মীর সীমান্তসহ দ্বিপাক্ষিক কতিপয় বিষয়, যেমন পাকিস্তানের যে অঞ্চল ভারত দখল করেছে, তা ছেড়ে দেয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়।

সিমলা চুক্তির পর পরই বঙ্গবন্ধু মন্তব্য করেন যে, ‘বাংলাদেশের মাটিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে।’ প্রতিবাদ জানায় ভুট্টো, ‘পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের বিচার করার কোন অধিকার বাংলাদেশের নেই। কারণ পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে ভারতীয় বাহিনীর কাছে।’ তখন ভারত সরকার বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘প্রকৃত সত্য এই যে, পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে। আর সে কারণেই যুদ্ধবন্দীদের প্রশ্নে যে কোন সিদ্ধান্ত ভারত ও বাংলাদেশের মতৈক্যের ভিত্তিতেই গৃহীত হবে।’
এদিকে বাংলাদেশে তখন আটকে পড়া বাঙালীদের ফিরিয়ে আনতে তাদের আত্মীয় স্বজন ঢাকা সহ সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। প্রয়োজনে যুদ্ধাপরাধীদের বিনিময়ে তাদের ফিরিয়ে আনার দাবী জানাতে থাকে। অপরদিকে হানাদার বাহিনীর নিসংসতায় নিহত শহীদ পরিবারগুলো সারাদেশে সভা সমাবেশ করতে থাকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে। এর ভিতরেই বাংলাদেশ সরকার দালাল আইন জারি করে। চীনপন্থী দল, উপদল ও গ্রুপ এবং মাওলানা ভাসানী এই আইন বাতিলের দাবী জানাতে থাকে। তারা এই আইনে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবেনা বলে সভা-সমাবেশ এবং মিছিলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করতে থাকে। অপরদিকে মুজাফফর ন্যাপ, সিপিবি সহ কয়েকটি দল আটকে পড়া পাকিস্থানিদের দ্রুত পাকিস্থানে ফিরত পাঠানোর দাবী জানাতে থাকে। একটিবার চিন্তা করে দেখুন বঙ্গবন্ধুকে সে সময় কি কঠিন অবস্থার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছিলো ! কোন প্রকার বিদেশী সাহায্য ছাড়া পুরপুরি ধ্বংস প্রাপ্ত একটা দেশ, তার মধ্যে দেশের ভিতরে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে চাপিয়ে দেয়া এতো এতো সমস্যা!
ভুট্টো বুঝতে পারে আটকে পড়া বাঙালীদের ফেরত নিতে শেখ মুজিব চাপের মধ্যে আছে তাই বঙ্গবন্ধুকে বেকায়দায় ফেলতে ভোট্ট পাকিস্থানে আটকেপড়া কয়েকশ বাঙালীকে গ্রেপ্তার করেন গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে। উদ্দেশ্য বন্দী বিনিময়ে বাধ্য করা।

যুদ্ধবন্দীদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য পাকিস্তান সরকার সে দেশে আটকে পড়া ৪ লাখ বাঙালীকে তখন ‘জিম্মি’ করে। বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশকারী সন্দেহে বহুজনকে বন্দীশালায় আটকে রাখে। প্রায় ১৬ হাজার বাঙালী সরকারী কর্মকর্তা, যাদের একাত্তরেই চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল, তাদের পাকিস্তান ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পাকিস্তান সেখানে আটকেপড়া বাঙালীদের পরিবারসহ অমানবিক পরিবেশে বন্দীদশায় রাখে। অনেক বাঙালী আফগানিস্তানের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে দেশে আসার পথে মারা যান। যারা আফগানিস্তান হয়ে পালিয়ে আসছিলেন, সেই সব বাঙালীকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ভুট্টো সরকার মাথাপিছু এক হাজার রুপী পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। বাঙালীবিদ্বেষী অনেক পাকিস্তানী অসত্য অভিযোগ এনে প্রতিবেশী অনেক বাঙালীকে পরিবারসহ ধরিয়ে দেয়। যাদের পুলিশী নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে.
এদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডাইম ভারত সফরে এসে ইন্দিরা গান্ধীকে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পরামর্শ দেন। ইন্দিরা অবশ্য সরাসরি জানিয়ে দেন, বাংলাদেশের মতামত অগ্রাহ্য করে ভারত একতরফাভাবে কিছু করতে পারে না, করবেও না। ইন্দিরা জানতেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে শেখ মুজিব দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের প্রথম তালিকায় ১৫০০ পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যের নাম প্রকাশ করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী যথাযথ তথ্য প্রমাণ হাজির করার ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকায় তালিকা কমিয়ে আনে। শেষে তা দাঁড়ায় ১৯৫ জনে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গঠিত বাংলাদেশের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি এই তালিকা করে। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে যুদ্ধবন্দী বিষয়ে প্রথম আইন পাস করা হয়।

১৯৭২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভুট্টো ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় প্রদত্ত এক সাক্ষাতকারে উল্লেখ করেন, ‘কয়েক শ’ পাকিস্তানী বন্দীকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করার জন্য রেখে বাকিদের ছেড়ে দেয়া হলে তার আপত্তি নেই। কিন্তু ১৯৭৩ সালে ভুট্টো তার মত পরিবর্তন করে বলেন, ‘পাকিস্তানী বন্দীদের বিচার করা হলে সে আটকেপড়া বাঙালীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ (হু কিল্ড মুজিব, এএল খতিব)। ১৯৭২ সালের নবেম্বরে ভারতে আটক পাকিস্তানী সেনাপরিবারের প্রায় ৬ হাজার সদস্যকে মুক্তি দেয়। বিপরীতে পাকিস্তানও আটকেপড়া ১০ হাজার বাঙালী নারী ও শিশুর একটি দলকে বাংলাদেশে প্রত্যাবাসনে সম্মত হয়। কিন্তু পাকিস্তানে আটক অধিকাংশ বাঙালীর কী হবে, সে নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে বাংলাদেশের। যুদ্ধবন্দী ও আটকেপড়া বাঙালীদের বিনিময় নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতার আড়ালে চাপা পড়ে যেতে থাকে আটকেপড়া পাকিস্তানী তথা বিহারিদের ফেরত যাওয়ার বিষয়টি। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন এদের শরণার্থী হিসেবে মর্যাদা দেয়। এরা যেসব ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়, তা জেনেভা ক্যাম্প নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। প্রায় ৬ লাখ বিহারি পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে সে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত হয়। এদের একটা অংশ ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মিরপুর দখল করে রেখেছিল। আল শামস বাহিনীর সদস্যও ছিল এরা।

এদিকে ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানী হানাদাররা বাংলাদেশে গণহত্যায় লিপ্ত, তখন যেসব মুসলিম দেশ এসবেরও প্রতিবাদ করেনি, সেই তারাই ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর জন্য গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করে। বিশেষত, মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলো। এর মধ্যে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালীদের ভাগ্যের সঙ্গে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের ভাগ্য বিজড়িত হয়ে পড়ে। তখন ১৭ এপ্রিল, ১৯৭৩ সালে টানা চারদিনের আলোচনা শেষে বাংলাদেশ ও ভারতে যৌথ ঘোষণায় যুগপৎ প্রত্যাবাসনের প্রস্তাব রেখে বলে, যুদ্ধবন্দী, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আটক সব নাগরিককে একযোগে নিজ নিজ দেশে পাঠানো হবে। তার আগে তিনটি দেশ নাগরিকদের ৭টি ক্যাটাগরি প্রণয়ন করেছিল। এই তালিকায় আটকেপড়া বাঙালী ও বিহারি ছাড়াও পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধাপরাধীরা অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাকিস্তান এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেনি। তাই প্রস্তাব আনা হয়, ভারত সেদেশে আটক প্রায় ১০ হাজার বন্দীকে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করবে। বিনিময়ে পাকিস্তান সেদেশে আটকে থাকা বাঙালীদের মধ্যে দু’লাখকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে। এছাড়া বাংলাদেশে আটক প্রায় দু’লাখ ৬৩ হাজার অবাঙালী তথা বিহারিকেও পাকিস্তান ফেরত নেবে। তারপরও বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি হতে সরে আসেনি। এমনকি অভিযুক্ত পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের এই প্রত্যাবাসন প্রস্তাবের বাইরে রাখে। যুগপৎ এই প্রত্যাবাসনে ভুট্টো সায় দিলেও মাত্র ৫০ হাজার বিহারিকে ফেরত নিতে রাজি হয়। তবে ভুট্টো বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাদের বিচারের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। সদম্ভে ঘোষণা করে, ‘বাংলাদেশ যদি অভিযুক্ত পাকিস্তানীদের বিচার করে, তাহলে তিনি পাকিস্তানে আটক বাংলাদেশের নাগরিকদের একই রকম ট্রাইব্যুনালে বিচার করবেন।’
১৯৭৩ সালের ২৭ মে নিউইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ভুট্টো বলেন, ‘বাঙালীদের এখানে বিচার করার দাবি জনগণ করবে। আমরা জানি বাঙালীরা যুদ্ধের সময় তথ্য পাচার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হবে। কতজনের বিচার করা হবে, তা এখনই বলতে পারছি না। বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানী সেনাদের বিচার করে, তাহলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ক্যু’র মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সরকারের পতন ঘটাবে এবং দুই দেশের পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাবে।

ভুট্টোর এসব বাগাড়ম্বরের প্রতিবাদ করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৩ সালের ৭ জুন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ভোলা সম্ভব নয়। এই হত্যা, ধর্ষণ, লুটের কথা জানতে হবে। যুদ্ধ শেষের মাত্র তিন দিন আগে তারা আমার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। তারা প্রায় ২ লাখ নারীকে নির্যাতন করেছে, এমনকি ১৩ বছরের মেয়েকেও। আমি এই বিচার প্রতিশোধের জন্য করছি না। আমি এটা করছি মানবতার জন্য। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে বাঙালীদের বিচারের হুমকির প্রতিবাদ করে বলেন, ‘এটা অবিশ্বাস্য। এই মানুষগুলো চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, সরকারী ও সামরিক কর্মকর্তা; যারা বাংলাদেশে ফেরত আসতে চায়, ওরা কী অপরাধ করেছে? এটা ভুট্টোর কী ধরনের প্রতিহিংসাপরায়ণতা।’

১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই বাংলাদেশের নয়া সংবিধানের প্রথম সংশোধনী আনা হয়। এতে ৪৭(৩) ধারা সংযুক্ত করা হয়। যাতে ‘গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্রবাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারিত্বে সোপর্দ কিংবা দ-দান করার বিধান’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০ জুলাই জারি করা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩। এর ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাদের জন্য পাকিস্তানী সেনা এবং দেশীয় যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, আলবদরদের বিচারের ব্যবস্থা নেয়ার পথ সহজ হয়।

এদিকে পাকিস্তানী সেনাদের বিচারের বিপরীতে চীনের অবস্থান ভারতকে বিপাকে ফেলে। চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে ভারত তখন আগ্রহী নয় পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণেই। আন্তর্জাতিকভাবে যেমন, তেমনি অভ্যন্তরীণভাবেও ইন্দিরা সরকারের ওপর চাপ তৈরি হতে থাকে। যাতে ভারত দ্রুত সব যুদ্ধবন্দীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সিমলা চুক্তির সূত্র ধরে ভারত-পাকিস্তান দু’দফা বৈঠকে বসে। ১৯৭৩-এর জুলাইয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে এবং আগস্টে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ইন্দিরার বিশেষ উপদেষ্টা পিএন হাকসার এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনার পর একটি চুক্তি সই হয়। ভারতে আটক থাকা পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী, পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালী এবং বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানী নাগরিকদের স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এই লোক বিনিময় শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বাকি ১৯৫ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর বিষয় চূড়ান্ত করবে। কিন্তু বাংলাদেশকে আলোচনায় না রাখায় দুটি বৈঠকে চুক্তি জোরালো হয়ে উঠতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, একমাত্র সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ এ ধরনের কোন আলোচনায় বসতে পারে।

এদিকে বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্য পদ ঠেকাতে, ‘পাকিস্তানী ১৯৫ যুদ্ধবন্দীর বিচারের সিদ্ধান্ত বাতিল না করা পর্যন্ত পাকিস্তান ও চীন বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্য প্রাপ্তির বিরোধিতা করে যাবে বলে বিবৃতি প্রদান করে।

১৯৭৩ সালের ২৮ আগস্ট যে দিল্লী চুক্তি সই হয়, তাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে বাংলাদেশকে ছাড় দিতে হয়। চুক্তিতে বলা হয়, পাকিস্তান বাঙালী ‘গুপ্তচরদের’ বিচার করবে না। আর যে ১৯৫ যুদ্ধাপরাধী বাংলাদেশ চিহ্নিত করেছে তাদের বিচার হবে এবং বাংলাদেশেই হবে। তবে এ ব্যাপারে যদি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে, তবেই তা হবে। বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে তাদের দৃঢ় অবস্থানের কথা এরপরও উল্লেখ করতে থাকে। কিন্তু, এই চুক্তির ফলে একতরফাভাবে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ আর থাকেনি। দিল্লী চুক্তি স্পষ্ট করেছিল, যুদ্ধাপরাধীদের আর বিচার হচ্ছে না। কারণ, পাকিস্তান এ প্রশ্নে কখনই বাংলাদেশের সঙ্গে সহমত ঘোষণা করতে চায় না। দিল্লী চুক্তিকে পাকিস্তানী সংবাদপত্রে উপমহাদেশে নতুন সম্পর্কের সূচনা করবে বলে অভিমত জানায়। নিউইয়র্ক টাইমসের ২ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় বলা হয়, নতুন সম্পর্ক হয়ত এখনই শুরু হচ্ছে না। কিন্তু এ কথায় কোন ভুল নেই যে, এই তিন দেশের মধ্যে সম্পর্ক নতুন মোড় নিচ্ছে।
১৯৭৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আলজিরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনকালে সৌদি বাদশাহর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বৈঠক করেন। বাদশাহ ফয়সল দাম্ভিকতার সঙ্গে শর্তারোপ করেন যে, বাংলাদেশকে সৌদি আরবের স্বীকৃতি পেতে হলে দেশটির নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ রাখতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত হলো, অবিলম্বে সমস্ত পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু বাদশাহকে কড়া জবাব দিয়ে যুদ্ধবন্দী সম্পর্কে বলেন, ‘এটা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিষয়”।

১৯৭৩-এর ২৮ আগস্ট দিল্লীতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈঠকটি হয় বাংলাদেশের সম্মতিতেই। বৈঠকে উভয় দেশ, ‘দিল্লী চুক্তি’ সই করে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে যুগপৎ প্রত্যাবাসন নিয়ে উভয়পক্ষ সম্মত হয়। অপরদিকে শর্তারোপ করা হয়, পাকিস্তান গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে আটক বাঙালীদের বিচার করবে না। তবে বাংলাদেশ সেদেশে ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর যে বিচার করতে চায় সে বিষয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ঐকমত্য হলেই তবে বিচার হবে। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তার সরকারের দৃঢ়তার কথা বিভিন্ন পর্যায়ে তখনও বিবৃত করেছেন। কিন্তু এই চুক্তির ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে। ১৯৭৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার নামে প্রথম সপ্তাহেই ১৪৬৮ বাঙালী এবং ১ হাজার ৩শ’ ৮ পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীর প্রত্যাবাসন ঘটে। বাংলাদেশ ১৯৫ যুদ্ধাপরাধী ফেরত না দেয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় পাকিস্তান দুই শতাধিক বাঙালীকে পণবন্দী হিসেবে জিম্মি করে রাখে। এসব সিদ্ধান্তের আগে ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে ভুট্টো একটি নতুন প্রস্তাবও রেখেছিল। এতে বলা হয়েছিল, ‘পাকিস্তান তার যে কোন যুদ্ধবন্দীর বিচার ঢাকায় অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে, কারণ অভিযুক্ত অপরাধ পাকিস্তানের একটি অংশেই ঘটেছে। সুতরাং পাকিস্তান নিজে বিচার বিভাগীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এদের বিচারে আগ্রহী। যা আন্তর্জাতিক আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে।’ (পাকিস্তান এ্যাফেয়ার্স, ১ মে ১৯৭৩)। কিন্তু টিক্কা খান পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রধান থাকাবস্থায় এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচারে পাকিস্তানী প্রস্তাবে সন্দেহ পোষণ করে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশে যে বিচার করা সম্ভব হবে না তা বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পারেন। কারণ তখন আটকেপড়া নির্যাতিতসহ সাধারণ বাঙালীদের দেশে ফেরত আনা জরুরী হয়ে পড়েছে অথচ এই বাঙালীদের ভাগ্য জড়িয়ে গেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে। এক দোটানায় পড়ে যায় বাংলাদেশ। তথাপি যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়ার আগে পাকিস্তানের কাছে চারটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায়। প্রথমত, যুদ্ধাপরাধের জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া, দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যতে পাকিস্তানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ খোলা রাখা এবং তৃতীয়ত, সৌদি আরব, মধ্যপ্রাচ্য, চীনসহ অন্যান্য দেশে পাকিস্তানের বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা বন্ধ করা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দান। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ১৯৭৩ সালের ১০ জুলাই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রশ্নে শর্তসাপেক্ষে ভুট্টোকে একক ক্ষমতা তুলে দেয়া হয়। ভুট্টো সংসদে বলেন, ‘পাকিস্তানী সেনাদের বিচারের দাবি পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত কোন স্বীকৃতি নয়।’
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ভাষণে বলেন, ‘১৯৫ যুদ্ধবন্দীর মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানে ফেরত না পাঠানো পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবের শর্ত অপূর্ণই থেকে যাবে। আর জাতিসংঘের প্রস্তাব বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের প্রশ্নই ওঠে না।’ এর ১২ দিন পর ৩ অক্টোবর চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী চিয়ান জিয়ান হুয়া অধিবেশনে বলেন, ‘জাতিসংঘের প্রস্তাব কার্যকরী করার পরেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করতে পারে। তার আগে কোনক্রমেই নয়।’
দিল্লীতে ১৯৭৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক বসে। বৈঠক শেষে তিন দেশীয় প্রতিনিধিরা এক যুক্ত ঘোষণায় বলেন, উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে তোলার স্বার্থে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাতিল করে দেয়া হবে। অবশ্য এই যুক্ত ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক রেডক্রসের তত্ত্বাবধানে পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের প্রথম দলটি ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা পৌঁছে। কিন্তু এরপর প্রত্যাবাসন থেমে যায়। পাকিস্তান এ ব্যাপারে টালবাহানা শুরু করে অথচ যুক্ত ঘোষণায় ত্রিমুখী লোক বিনিময় যুগপৎ পরিচালিত হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ২২ অক্টোবর টোকিওতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে প্রতিটি বাঙালী ফেরত নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী নাগরিকদের বিপুলসংখ্যককেই পাকিস্তান নিচ্ছে না।’ এর ক’দিন পরই ভুট্টো ঘোষণা করেন যে, ‘পাকিস্তান বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী নাগরিক বিহারিদের ফেরত নেবে না।’ অথচ প্রায় পাঁচ লাখ বিহারির মধ্যে অধিকাংশই পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে সে দেশে ফেরত যেতে আগ্রহী। বাংলাদেশের পক্ষে এদের ভরণ-পোষণ ভারবাহী হয়ে দাঁড়ায় গোড়াতেই।
১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনকালে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী ও আটকেপড়া বাঙালীদের সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু ও ভুট্টোর মধ্যে প্রাথমিক আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধু বৈঠক চলাকালে সাংবাদিকদের জানান, ‘পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বাঙালীদের দেশে ফেরাসহ অনেক বিষয়ে কথা বলার প্রয়োজন হবে। এই সম্মেলন শুরুর আগে অর্থাৎ ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছি। আল্লাহর নামে এবং দেশের জনগণের পক্ষ থেকে এই ঘোষণা করছি।... আমি বলছি না যে, এটি আমি পছন্দ করছি। আমি বলছি না আমার হৃদয় আনন্দিত। এটি আমার জন্য একটি আনন্দের দিন নয়, কিন্তু বাস্তবতাকে আমরা বদলাতে পারব না।’ ভুট্টোর ঘোষণার আগের রাত অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সৌদি আরব, মিসর, ইন্দোনেশিয়াসহ ৩৭টি মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে উভয় দেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোন প্রতিশ্রুতি ছাড়াই পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায়ে সমর্থন হয়। তবে বাংলাদেশ তখনও ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর বিচার থেকে সরে আসার কোন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি। তবে বিষয়টি সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান শীঘ্রই আলোচনায় বসবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অবশেষে দিল্লীতে তিন দেশ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনায় বসে। ১৯৭৪ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৈঠক করেন। বৈঠকের শুরুতে বাংলাদেশ একাত্তরের ঘটনার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনার ওপর চাপ দেন। ড. কামাল হোসেনের আহ্বানে আজিজ আহমদ তার সরকারের পক্ষ থেকে স্রেফ ‘দুঃখ’ প্রকাশ করেন। যা যৌথ ঘোষণার শেষে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভারতের শরণ সিংহ এ জন্য ক্ষমা চাওয়ার কথা বলেছিলেন। ৬ এপ্রিল বাংলাদেশ ঘোষণা করেন, পাকিস্তান যদি তার একাত্তরের কৃতকর্মের জন্য জনসম্মুখে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং অবাঙালী বিহারিদের প্রত্যাবাসনসহ পাকিস্তানের সম্পদ বণ্টনে রাজি হয়, তাহলেই শুধু ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীর ওপর আনীত অভিযোগ তুলে নেয়া যায়।
তবে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তানের ওই সব বন্দী যে মাত্রাতিরিক্ত ও বহুধা অপরাধ করেছে, তা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবনা এবং আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত এবং এই ১৯৫ পাকিস্তানী বন্দী যে ধরনের অপরাধ করেছে, সে ধরনের অপরাধের অপরাধীদের দায়ী করে আইনের মুখোমুখি করার বিষয়ে সর্বজনীন ক্ষমতা রয়েছে।
চুক্তিতে আরো বলা হয়, স্বীকৃতিদানের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে বাংলাদেশ সফর করবেন এবং বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইবেন। বাংলাদেশ সম্মত হয় যে, ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীকে দিল্লী চুক্তির অধীন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ফেরত পাঠানো যেতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ১৯৫ জনকে ক্ষমা করেছে, তা বলেনি। শুধু ভারত থেকে পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার কথা বলেছে।
১৯৭৪ সালের ১১ এপ্রিল নিউইয়র্ক টাইমস শিরোনাম করেছিল, ‘বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা।’ সাংবাদিক বার্নার্ড উইনরবের লিখেছেন, ‘যদিও পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা সরাসরি ছিল না, যতটা সরাসরি বাংলাদেশ দাবি করেছিল। কিন্তু ভারতীয় ও বাংলাদেশী কর্মকর্তারা মনে করেন, পাকিস্তান এ কথা স্বীকার করেছে যে, তাদের সেনাবাহিনীর কেউ কেউ মাত্রাতিরিক্ত কাজ করেছে। এমনকি পাকিস্তান যে এই চুক্তি সই করে তাও এক ধরনের ক্ষমা প্রার্থনা বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ এই ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে ‘গণহত্যা’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফেরত যাওয়ার বিষয়ে আপত্তি প্রত্যাহার করলেও গণহত্যার অপরাধের জন্য ক্ষমা করেনি। কারণ চুক্তির ১৩ ধারায় বাংলাদেশের ভাষ্য ছিল, পাকিস্তানী বন্দীরা যে ধরনের অপরাধ করেছে, সে ধরনের অপরাধের অপরাধীদের দায়ী করে আইনের মুখোমুখি করার বিষয়ে সর্বজনীন ঐকমত্য রয়েছে। বাংলাদেশ বিচার ঢাকায় হবে বলে যে ঘোষণা দিয়েছিল, তা থেকে সরে এলেও পাকিস্তানের আদালতে বা আন্তর্জাতিক আদালতে এদের বিচার হবে চুক্তি অনুযায়ী তাই আশা করেছিল। তথাপিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি বাংলাদেশ অব্যাহত রাখে…

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:০৯

কেউ নেই বলে নয় বলেছেন: ত্রি-পাক্ষিক সমঝোতা চুক্তির টেক্সট পড়লে এটাই অনে হয় পাকিস্তান ক্ষমাই চেয়েছিলো। তবে সেটা ছিলো সাময়িক কৌশলী পদক্ষেপ। এরপরে ভোল পালটানো বাংলাদেশ ভালোই দেখছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কিছুই করবার নেই আর আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া ছাড়া আর এদেশীয় দোসরদের বিচার করবার পদক্ষেপ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া। আটকে পরা বাংগালী আর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের কারনে পরিস্থিতি এমন ছিলো যে সরকার অনেক নীতির সাথেই সমঝোতা করতে বাধ্য হয়।

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:১৫

তানভীর আহমেদ সম্রাট বলেছেন: যথাযথ বলেছেন। বাংলাদেশের সেসময় সত্যিই কোন উপায় ছিলোনা। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই।

২| ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:১৮

পথিকের পাঁচালী বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ । ১৯৫ জন পাকিস্তানী কে ছেড়ে দেবার জন্য অনেকেই বঙ্ঘবন্ধুকে দোষারোপ করেন। আপনার পোস্টের মাধ্যমে তৎকালীন প্রেক্ষিত , ঘটনাবলি বিস্তারিত জানতে পারলাম । কিন্তু কি অবলীলায় কতিপয় নব্য ইতিহাসবিদরা অর্বাচীনের মত মন্তব্য করে যায় ।

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:২৭

তানভীর আহমেদ সম্রাট বলেছেন: ভাই, সত্য চিরকালই সত্য। মিথ্যা দিয়ে হয়তো কিছুদিন মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাখা যায় কিন্তু সত্যকে মুছে ফেলা যায়না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.