নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ওয়াসেত সাহিন

ওয়াসেত সাহিন

পেশায় একজন প্রকৌশলী । গান শুনতে , বই পড়তে এবং বেড়াতে ভালবাসি ।

ওয়াসেত সাহিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্বপ্ন

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:০১

জসিমুদ্দিন দেখল শীতের প্রকোপ বেশি । দুই পাশের জানালার থাইয়ের শাটার টেনে দিল । সে জানালা বন্ধ করে ঘুমাতে পারে না । শীতকালেও না । তবে আজকের শীত অনেক তীব্র । বেশ কদিন ধরেই শৈত্যপ্রবাহ চলছে । বারটার দিকে রোদ উঠে ।

বিছানায় গিয়ে লেপটা টেনে নিয়েই জসিমুদ্দিনের মনটা খুশিতে ভরে উঠল । লেপে দারুন ওম । নিশ্চয়ই রেখা রোদে দিয়েছে । আহ কি আরাম ! জসিমুদ্দিন গলা চড়িয়ে ডাকল,’ এই রেখা , এতোক্ষণ করছ কি ? এসোতো ।‘

রেখা ডাইনিং রুমে ছিল । বলল,’ এইতো আসছি ।‘ কাজের মেয়েটাকে বাকী কাজ বুঝিয়ে দিয়ে সে এল ।

স্ত্রীর দিকে চেয়ে জসিমুদ্দিন উদাস হয়ে গেল । এখনো যথেষ্টই সুন্দর । হবে না কেন । এমনিতেই তার চেয়ে বার বছরের ছোট । তাছাড়া সংসারের বেশির ভাগ কাজই নিজের হাতে করে । কাজের মেয়ের উপর তেমন নির্ভর করতে চায় না । আর এখনতো প্রায় প্রতিদিনই হাঁটতে বের হয় ।

রেখার ভীষন বেড়ানোর শখ । বিয়ের পর যখন ঝামেলাহীন সংসার তেমন বেড়ানো হয়ে উঠেনি । কারন অর্থের অভাব । সংসার চালানো আর প্রতি মাসে গ্রামের বাড়ী বাবাকে টাকা পাঠাতেই হিমশিম অবস্থা । একবার কক্সবাজার নিয়ে গিয়েছিল । পরে ছেলে মেয়েরা বড় হবার পর গিয়েছিল জাফলং ।

বিয়ের বছর ঘুরতেই এল বড় মেয়ে নাদিয়া । তার দুবছর পর ফারিয়া । জীবন হয়ে উঠল ভীষন ব্যস্ত । দ্বিতীয় মেয়ের জন্মের পর একে একে অল্প সময়ের ব্যবধানে রেখার শশুর শাশুরী মারা গেল । রইল না কোন পিছুটান । জসিমুদ্দিনের চাকরীতে উন্নতি হল । হাতে বেশ টাকা জমল । কিন্তু সময় হল দুষ্প্রাপ্য । পিঠাপিঠি দু মেয়ের লালন পালন আর সংসারের সব কাজ সামলে রেখা পেলনা দম ফেলার ফুরসত । ফারিসা যখন ক্লাস টু এ পড়ে তখন জন্মাল রেখার সবর্কনিষ্ঠ সন্তান । এটি ছেলে । মারুফ । সন্তান মানুষ করাই হয়ে উঠল ওদের ধ্যান জ্ঞান । ওদের মানুষ করা , লেখা পরা শেখানো , স্কুল কলেজ, মেয়েদের বিয়ে দেয়া । সবই হল । পেরিয়ে গেল জীবনের সোনালী সময় । বড় মেয়ে নাদিয়া হাসবেন্ডের সাথে কানাডা থাকে । ছোটটিও গত মাসে স্বামীর সাথে আমেরিকা চলে গেছে । নিউইয়র্ক । মারুফ রংপুর মেডিক্যালে । ইন্টার্ণী করছে । রেখার এখন অখন্ড অবসর । তবে ছেলে মেয়েরা প্রায়ই ফোন করে । অনেক সময় কাটে ওদের সাথে কথা বলে ।

স্বামী স্ত্রী একসাথে হলে ফেলে আসা দিনের কথা উঠে । বিয়ের প্রথম দিকের কথা । সেই দূরন্ত আবেগময় দিন গুলি । তখন প্রাণ ছিল তাজা । তবে পকেট ছিল ফাঁকা । অনেক সাধ আহ্লাদ তাই পুরো করতে পারেনি । রেখার ঘুরে বেড়ানোর প্রবল ইচ্ছে হত । টাকার অভাবে মন মত ঘোরা ফেরা করা যায়নি । দেশের ভেতরে দু একটা জায়গায় ঘুরেছে বটে । তবে ঢাকা শহরের সব প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থানগুলো ওকে বার বার করে দেখিয়েছে জসিমুদ্দিন । লোকটা রেখাকে অনেক ভালবাসে । সে সরকারী ব্যবস্থায় দুবার বিদেশে গিয়েছে । একবার চায়না আর একবার থাইল্যান্ড । একা একা ঘুরে এসে তার মন খারাপ হয়েছে । চায়নার কুন্মিংএর গল্প করতে করতে বলেছে ,’ কি সুন্দর জায়গা । তোমাকে সাথে নিতে পারলে কি যে মজা হত !’

শুনে রেখারও চোখ চক চক করে উঠেছে । জসিমুদ্দিন বলেছে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে ছেলেকে কাজে লাগিয়ে তার রিটায়ারমেন্টের পর দুজন মিলে শুধু দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবে । সাংসারিক ব্যস্ততার মাঝে পড়ন্ত জীবনের স্বপ্নেই বিভোর থাকছে দুজন ।

সেই কাংখিত লগ্ন এসে গেছে প্রায় । ফারিসা চলে যাবার পরতো ওরা এমনিতেই একা হয়ে গেছে । এত বড় বাসাটায় ওরা দুজন । কাজের মেয়েটি অবশ্যি আছে । স্বামী স্ত্রীর কলকাকলী , স্মৃতিচারণ আর ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস । ভালই কাটছে সময় । রেখা রোজ সকালে এক ঘন্টা করে হাঁটে । জসিমুদ্দিন সকালে পেরে উঠেনা । সে হাঁটে বিকেলে । তবে মাঝে মাঝে দুজন এক সাথেও হাঁটে । রাতের বেলা দু জন পাশা পাশি বিছানায় শুয়ে টিভিতে সিরিয়াল দেখে । যৌবনের পছন্দের গান গুলো সংগ্রহ করে শুনে । বেশ কাটছে সময় । জসিমুদ্দিনের অবসরের সময় ঘনিয়ে এসেছে । সপ্তাহ দুই আছে । জিপি ফান্ডের টাকা গুলো পেলেই দুজনে মিলে প্রথমে যাবে ইন্ডিয়া । যতটা পারে ঘুরবে পুরোটা দেশ । প্ল্যান প্রগ্রাম সব ফাইনাল হয়ে গেছে । রেখার পাসপোর্টও তৈরী হয়ে গেছে । সেই খালি পাসপোর্ট রেখা বের করে উলটে পালটে দেখে । স্বপ্নের জাবর কাটে । এর কি যে মজা । যেদিন দুজনে প্লেনে উঠবে কেমন না জানি লাগবে । প্লেনে উঠার বিষয়ে রেখা ভীতি বোধ করে । জসিমুদ্দিন শুনে হাসতে হাসতে খুন হয়ে যায় দশা । সে বলে প্লেনই নাকি সবচেয়ে নিরাপদ । বাস ট্রেনের চেয়ে বহু গুনে ভাল । নিজের অজ্ঞতায় রেখা লজ্জাও পায় ।

জসিমুদ্দিনের এলপিআর শুরু হবার পর ব্যস্ততা কিছুটা বেড়েও গেছে । জিপি ফান্ডের টাকা তোলা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে । সেদিন সকালে স্বামী স্ত্রী একসাথে হাঁটতে যাবার কথা ছিল । সেরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই দুজন গত রাতে ঘুমিয়েছে । কিন্তু ঘুম থেকে উঠেই জিপি ফান্ডের বিষয়ে একাউন্টসের একজনের সাথে দেখা করার কথা মনে পড়ে গেল জসিমুদ্দিনের । তাকে বাসায় গিয়ে ধরতে হবে । অফিসে সে দারুন ব্যস্ত । কথা বলার সময়ই পায় না । রেখাকে একাই হাঁটতে বেরোতে হল ।

সকাল সাড়ে আটটায় একটা মোবাইল কল পেল জসিমুদ্দিন । অচেনা নম্বর । ঢাকা মেডিক্যাল থেকে কে যেন ফোন করেছে । ওকে দ্রুত যেতে বলছে । সে মেসেজ দিল তার স্ত্রী এক্সিডেন্ট করেছে । চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবী দুলে উঠল জসিমুদ্দিনের । চারপাশ অন্ধকার হয়ে এল । মাথা ঘুরে ফ্লোরে বসে পড়ল । নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল তার । মনে হচ্ছে সে হয়ত কোন দুস্বপ্ন দেখছে ।

কোন মতে ঢাকা মেডিক্যালে পৌঁছাল জসিমুদ্দিন । কেমন ঘোর ঘোর লাগছে তার । সময় স্তম্ভিত হয়ে থেমে আছে । মেডিক্যালের বারান্দায় জসিমুদ্দিনের প্রতিবেশী হাসান আর কাইয়ুম দাঁড়িয়ে আছে । থমথমে চেহারা । কি হয়েছে জসিমুদ্দিন যেন বুঝে উঠতে পারছেনা । অসহায় সকাতর চোখে একবার হাসান আর একবার কাইয়ুমের দিকে তাকাচ্ছে । হাসান এগিয়ে এসে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরল জসিমুদ্দিন কে । জসিমুদ্দিনের সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে । চেতনা অসার হয়ে আসতে চাইছে । গলা শুকিয়ে গেছে । অতি কষ্টে জিজ্ঞেস করল ,’ কি হয়েছে ভাই রেখার ? ও কোথায় ?’

হাসান কোন জবাব দিলনা । আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল জসিমুদ্দিনকে । জসিমুদ্দিন মূর্ছা গেল ।

একটা পুরনো প্রিন্টের চাদরে দেহটা আগাগোড়া ঢাকা । কে যেন মুখের উপর থেকে চাদরটা খানিক তুলল । ‘আহারে আহারে আমার সোনারে আহারে মানিকরে , তুই কি করলিরে তুই আমার কলিজাটা ফানা ফানা করে দিলিরে----‘ জসিমুদ্দিনের আহাজারি আর চিৎকারে বাতাস ভারী হল । আশে পাশে উপস্থিত সবার চোখে জল ঝরল । বারবার বেহুঁশ হচ্ছিল জসিমুদ্দিন । হুঁশ ফিরে পেলেই তার সেই সবর্স্ব হারানো আর্তনাদ । ‘আহারে কলিজারে কে তোকে এত বড় কষ্ট দিল রে , জান তুই কই গেলিরে----‘

নিরীহ একজন পথচারীকে পিষ্ট করে হয়ত নিবির্কার পথপরিক্রমায় ব্যস্ত রয়েছে সেই ঘাতক যান আর তার চালক । বেঁচে থাকা সঙ্গেএ পুরুষটির দূবির্সহ একাকী জীবন আর জগদ্দল পাথরের মত হাহাকার হয়ত সেই চালককে কোনদিনই স্পর্শ করবেনা ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.