নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

--“সুহে থাকতে ভূতে কিলায়” মেন্টাল হসপিটাল--

রবিনের প্রান "বাংলাদেশ"

E-mail : [email protected]

রবিনের প্রান "বাংলাদেশ" › বিস্তারিত পোস্টঃ

ধর্ম ও শ্রেণীহীন সমাজ–প্রাণেশ সমাদ্দার

১৩ ই নভেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৩২



আমাদের দেশে ঐতিহ্যানুগামী সমাজ অর্থাৎ পুরাতন সামাজিক সংস্থাগুলির যে কত শক্তি, তা বৃটিশ শাসনের ষাট বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও ধর্মবৈষম্য, জাতিভেদ, উচ্চ-নীচ বর্ণভেদ প্রভৃতির সদম্ভ আত্মপ্রকাশে বুঝতে পারছি। কাজেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই সমস্ত সংস্থার লৌহ প্রাচীরে প্রতিহত হয়ে বাংলার নবজাগরণের আদর্শ কীভাবে শতধা হয়ে গেছে তা সহজেই অনুমেয়।



বস্তুত ‘ধর্মই’ যখন সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে আমাদের মত ঐতিহ্যমুখী সমাজে, তখন ধর্ম সংস্কারের প্রসঙ্গই প্রথমে তোলা যাক। আজন্ম ধর্মীয় সংস্কার (যা আমলে কুসংস্কার) আচারবিচার, বাহ্য অনুষ্ঠান, পৌত্তলিকতা ও বহুদেবতাবাদ হিন্দু সমাজ ও হিন্দুধর্মকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে দেখে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় মধ্যভাগে রাজা রামমোহন গভীর বেদনা বোধ করেছিলেন; সেই সঙ্গে তিনি খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারও মিশনারীদের মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন। হিন্দু সমাজ ও ধর্মের সঙ্কট তিনি তাঁর দূরদৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন। তাই প্রাচীন উপনিষদ ও তন্ত্রশাস্ত্র অনুসারে বাহ্যনুষ্ঠান বাদ দিয়ে একেশ্বর ব্রহ্মের উপাসনা প্রবর্তনে সচেষ্ট হন।



তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে হিন্দুধর্মের উৎসমুখ সন্ধান করলে সেখানে ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ নিরাকার স্বরূপের সন্ধান পাওয়া যাবে। যুগে যুগে ঐতিহাসিক সঙ্কটকালে শ্রেষ্ঠ ধর্মসংস্কারকদের পথই অনুসরণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছিল। এর দুটি কারণ- প্রথম কারণ, ব্রাহ্মসমাজের গৃহের ভিতরেই স্থাপত্য থেকে আরম্ভ করে, সাপ্তাহিক উপাসনা, উপাসনা পদ্ধতি প্রভৃতি সবকিছুর উপর খ্রিস্টধর্মের প্রভাব ছিল প্রত্যক্ষ। হিন্দু দেবদেবীর মন্দিরে, নগরে ও পল্লীতে, যে সহজ-সরল পূজা পদ্ধতি বিদ্যমান, সেখানে intellectual বা বুদ্ধিযুক্তি সর্বস্ব প্রথা কখনোই সর্বজন গ্রাহ্য হতে পারে না। দ্বিতীয় কারণ, উপাসনালয় ভবন থেকে নিরপেক্ষ যুক্তি ও বুদ্ধির সুতীক্ষèবান নিক্ষেপ করে কোন জনসমাজে ধর্মসংস্কার করা যায় না। তা যদি যেত তাহলে গৌতমবুদ্ধ থেকে কবীর, দাদু, নানক, শ্রীচৈতন্য, প্রভৃতি সকলেই হিন্দুধর্মের কাঠামো বদলিয়ে ফেলতে পারতেন। রাজপুত্র গৌতমবুদ্ধ প্রথম থেকেই কার্যত নিরীশ্বরবাদী ছিলেন। যদিও তাঁর অনুসারীগণ গৌতমবুদ্ধের এই অভিমতকে ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারেননি।



তাছাড়া রামমোহনের ব্রাহ্মসমাজ তাঁর কয়েকজন মাত্র সহগামীর মধ্যে সীমিত ছিল, যাদের অধিকাংশই ছিলেন নব্যবণিক, জমিদার ও কলকাতাকেন্দ্রিক নতুন রাজা মহারাজা। এদের পক্ষে ব্রহ্মোপসনার মর্ম বোঝা সম্ভব তো ছিলই না, হিন্দুধর্মের (প্রচলিত) সত্ত্বায় আঘাত করা কার্যত তাদের স্বার্থের বিরোধী ছিল। রামমোহন স্বদেশ ত্যাগ করা মাত্র এরা আবার ‘খাঁটি হিন্দু’ (অনেকে গোময় ভক্ষণে প্রায়শ্চিত্ত করে) হয়ে উঠেন। বস্তুত ব্রাহ্মধর্ম তাদের শ্রেণী স্বার্থের বিরোধী ছিল। দ্বারকানাথের বদান্যতায় ব্রাহ্মসমাজের অস্তিত্ব বজায় থাকে বটে, কিন্তু তার শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের আদর্শ বিলীন হয়ে যায়। দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ‘ব্রাহ্মসমাজ’কে ‘ব্রাহ্মধর্মের’ রূপ দেন। তাঁর ভাষায় “পূর্বে ব্রাহ্মসমাজ ছিল, এখন ব্রাহ্মধর্ম হইল”। কিন্তু হিন্দুত্বের বিশাল পরিসীমার মধ্যে “ব্রাহ্মধর্ম” আর একটি সম্প্রদায় রূপে হিন্দুসমাজ ধীরে ধীরে আত্মস্থ করে ফেলে। শুধু অতি সংকীর্ণ সীমানার মধ্যে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ ছাড়া তার আর কোন অস্তিত্ব রইল না।



প্রায় সমসাময়িক যুগে ব্রাহ্ম কেশব চন্দ্র ছিলেন বলিষ্ট প্রগতিশীল আদর্শে আদর্শবান। স্ত্রী শিক্ষা, অসবর্ণবিবাহ, বিশেষ বিবাহ আইন (১৮৭২) প্রভৃতি দ্বারা তিনি ব্রাহ্মসমাজ তথা বাঙ্গালী সমাজকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন- কিন্তু যে চোরাবালির ভূমি আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল, নিজেই তাতে ডুবে গেলেন। হিন্দুধর্মের ‘সনাতন সত্তা’ গুরুবাদ, অবতারবাদ তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এই সময়ে মঞ্চে আসেন ব্রাহ্ম-হিন্দু রাজনারায়ণ বসু। তাঁর লেখা Brahmism is Hinduism ব্রাহ্মসমাজের কফিনে প্রায় শেষ পেরেক এঁটে দিল। নরেন দত্ত (বিবেকানন্দ) হিন্দু সমাজের ও ধর্মের বিজয় পতাকা উড়ালেন। অবশ্য তাঁদের revivalist বক্তব্যের লক্ষ্য ছিল হিন্দুধর্মের কিছুটা সংস্কার সাধন; তাঁদের ধারণা ছিল যে, প্রাচীন হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু সমাজ-রাষ্ট্রের মধ্যে আধুনিক যুগের সমস্ত প্রগতিশীল ভাবাদর্শ নিহিত আছে- সাম্য, গণতন্ত্র, স্ত্রীশিক্ষা, নরনারীর সমঅধিকার ইত্যাদি- তার জন্য ‘বাইরে’ থেকে কোন আদর্শ আমদানি করা অর্থহীন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আরো এগিয়ে বললেন, গীতাতেই সাম্যবাদ রয়েছে- যার প্রভাব এখনও বহু উচ্চশিক্ষিত হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছে। এঁদের মধ্যে ঐতিহাসিক, সমাজবিজ্ঞানী, সমাজনেতা, এমনকি রাজনৈতিক নেতাও রয়েছেন।



ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও এই বোধ জাগ্রত ও কার্যকর। বিশেষ করে বাংলাদেশে। নবী ও ইসলাম ধর্মের মূল গ্রন্থের বাইরে কোনও ‘জ্ঞান’ নাই। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার কমিউনিস্ট পতাকা হাতে নিয়ে মার্ক্সবাদের নামাবলী গায়ে দিয়ে ‘বড়’ দলের লেজুর হয়ে সংসদে ঢোকার সুযোগ খুঁজছেন- যে সংসদীয় রাজনীতি প্রকৃত মার্কসবাদীরা শুরুতেই বর্জন করেছেন।



আমাদের দেশের এই অদ্ভুত ধ্যানধারণা সম্পর্কে গুনার মিরডাল তাঁর এশিয়ান ড্রামা গ্রন্থে একটি সুন্দর মন্তব্য করেছেন: ‘This may be good tactics, but it is bad Sociology’।



তাই দেখা যাচ্ছে ধর্মের পুরাতন প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা কাঠামো যেন ক্রমে আরও শক্তিশালী হচ্ছে। অথচ একযুগে য়ুরোপিয়ান এলিটের আদর্শপুষ্ট হয়ে এ দেশের শিক্ষিত এলিট গড়ে উঠেছিল। আদর্শের বীজ থেকে অঙ্কুর এবং অঙ্কুর থেকে গাছ ফল ফুল হবার মত দেশের মানুষের মাটি তৈরি হয়নি। তার কারণ তার উপযুক্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ রচিত হয়নি।



এ পরিবেশ ভিন্ন দেশে ভিন্নভাবে হতে পারে; রাশিয়া, চীন, কিউবা, নেপালের পরিবেশ ভিন্ন; ভিন্ন ভারতে ও বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর যে সংবিধান রচিত হয়, সেখানে শ্রেণী-বিলোপ ও জনগণের সমানাধিকারের কোনও আশ্বাস নেই। এ কাজ সম্পূর্ণ হতে পারে ধর্মীয় সংস্কারের মধ্য দিয়ে নয়, একটি সফল বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। সেই অভ্যুত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে বিপ্লবী শক্তি সমূহের দ্বারা গঠিত একটি বিপ্লবী সরকারের পক্ষেই সম্ভব সকল প্রকার ধর্মীয় সংস্কার বর্জন করে জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এই জনগণতন্ত্রে ধর্মের কোনও ভূমিকা থাকবে না। তেমন এক রাষ্ট্রে অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে ধর্ম বিশ্বাস বা কথিত ঈশ্বর-বিরোধিতার স্বাধীনতা থাকবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আর কোনও পন্থা নাই।



এস ওয়াজেদ আলীর ভাষায় : “আমি রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনও অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ আছে বলে বিশ্বাস করি না। নিছক ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও সাধনার উপর ধর্মের পূর্তি ও পুষ্টি বলা যায়। …ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক না করলে ধর্ম একটি ব্যবসায়ে পরিণত হয়.. যার মানেই হলো ধর্মের মৃত্যু। কেননা সে অবস্থায় ধর্মের নামে যে সব জিগির ছাড়া হয়, সেগুলি প্রকৃত পক্ষে ধর্মের বুলি নয়, স্বার্থের উদ্বোধন।”







[সংস্কৃতি, এপ্রিল ১৯৯৮ সংখ্যা থেকে দ্রোহ ছোট কাগজে প্রকাশিত]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.