![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
“অর্থনৈতিক শুদ্ধতার পথে”—এই পথচলায় আমি খুঁজি এমন এক অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে ন্যায়, ভারসাম্য ও মানবিক মূল্যবোধ অটুট থাকে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে এক স্বচ্ছ, নীতিনিষ্ঠ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে দাঁড় করানোর চিন্তাই আমার লেখার মূল প্রেরণা। এই ব্লগে আপনি পাবেন সমসাময়িক অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর একটি শুদ্ধ ও দায়বদ্ধ বিশ্লেষণ—যার মূল উৎস শাশ্বত জ্ঞান ও নৈতিকতা।”
পূঁজিবাদ ও ড.ইউনুস
ড.ইউনুস একজন পূঁজিবাদী মানুষ। পূঁজিবাদে বিশ্বাসী। তবে মাঝে-মধ্যে কিছুটা সমালোচনাও করেন। অবশ্য কট্টর সমালোচনা নয়। পূঁজিবাদের কঠিন সমালোচক হিসাবে পরিচিত হল-সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ধারার মানুষ ও ইসলামী অর্থনীতির বিদ্ধানগণ। ড.ইউনুস পূঁজিবাদের আমূল পরিবর্তন নয়; বরং সংস্কারের কথা বলেন। তিনি মনে করে সমাজে পূঁজিবাদ থাকতে পারে। এতে অসুবিধা নেই। কিছুটা সংস্কার করে নিলেই হবে। সেই সংস্কার হবে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে।
অপরদিকে ইসলামী অর্থনীতি মনে করে-এটি সংস্কারযোগ্য নয়। পুরোপুরি পরিবর্তনযোগ্য। ইউনুস মনে করেন, পূঁজিবাদ সমাজে সম্পদের মালিকানায় বৈষম্য সৃষ্টি করে। সমাজের নিচের দিকের মানুষ বৈষম্যের শিকার হয়। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে সেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠি অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। সুতরাং পূঁজিবাদের পাশাপাশি সামাজিক ব্যবসার বিস্তার ঘটাতে পারলে অর্থনীতিতে আর সমস্যা থাকবে না।
তিনি লিখেছেন-‘পূঁজিবাদকে তো উন্নততর করাই যায়।’ (সামাজিক ব্যবসা, মুহাম্মদ ইউনুস, পৃ.১৫ )
অন্যত্র লিখেছেন-‘পূঁজিবাদ শাস্ত্রে একটি বিরাট শূণ্যতা আছে। এ শূন্যতা পূরণ করলে এটার একটা মৌলিক সংশোধন হতে পারে। আমি সামাজিক ব্যবসার তত্ত্ব দিয়ে এ শূন্যতা পূরণের প্রস্তাব দিয়েছি। এটা শুধু আমার মত। অন্য কারও প্রস্তাব থাকলে সেটিও আসুক’। (সামাজিক ব্যবসা, মুহাম্মদ ইউনুস, পৃ.৪৪,)
পূঁজিবাদ বাকি রেখে এর সাথে সামাজিক ব্যবসার সংযুক্তি কিভাবে হবে-তা আরও স্পষ্ট করেছেন নিম্নোক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে-
তিনি লিখেছেন-
‘একই সঙ্গে একজন উদ্যোক্তার দু’ধরনের বিনিয়োগ থাকতে পারে। এক ব্যবসায় তিনি ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়া অন্য কোনও বিষয় মাথায় স্থান দিবেন না। একই সঙ্গে তিনি এমন ব্যবসাও চালাতে পারন সামাজিক উপকারই যার মূখ্য কাজ’। (গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন পৃ.২০৬)
প্রচলিত পূঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাকে তিনি চলন্ত ট্রেনের ইঞ্জিনের সাথে তুলনা করেছেন। যেখানে শেষ সারির অর্থনৈতিক ইঞ্জিন সচলর রাখতে ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের প্রয়োজন হয়। ক্ষুদ্র ঋণ সমাজের শেষ সারির অর্থনৈতিক ইঞ্জিনকে চালু রাখে। তবে একই সাথে জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে সামনের দিকে অর্থনৈতিক ইঞ্জিন চালু থাকবে। পৃ.২০৮
অন্যত্র লিখেছেন-
‘আমি পূঁজিবাদের মূল বক্তব্যে বিশ্বাসী। একটি মূল বক্তব্য হল, অর্থনৈতিক পদ্ধতি সবসময় প্রতিযোগিতামূলক হবে। আরকটি মূল কথা হল, লাভকে উচ্চতম পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। তিনি আরও বলেন-পূঁজিবাদের উক্ত দুটি মূল বিষয়ে আমি পরিবর্তন আনতে চাই।
প্রথম যে পরিবর্তন আনতে চাই, তা হল-সব মানুষের মাঝেই উদ্যোক্ত হওয়ার ক্ষমতা লুকিয়ে আছে। শুধু পূঁজিবাদীরা উদ্যোক্ত হবে এমন নয়। দ্বিতীয় যে পরিবর্তন আনতে চাই তা হল, উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের ইচ্ছা সম্পৃক্ত। মুনাফার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের মূলনীতিকে সম্প্রসারিত করে আমি সামাজিক লক্ষ্যগুলিকেও এর মধ্যে স্থান দিতে চাই। তখন এরকম দাঁড়াবে-উদ্যোক্ত দুটি পৃথক লক্ষ্যের যোগফলকে সর্বোচ্চ সীমায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। তার মধ্যে একটি হবে মুনাফা। অন্যটি হবে সামাজিক মঙ্গল। শর্ত থাকবে-মুনাফা কখনও শূন্যের নীচে আসতে পারবে না। অর্থাৎ লোকসান দেয়া যাবে না। (গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন পৃ.২০৪-২০৫)
পূঁজিবাদ নিয়ে তার এই সংস্কার/সংশোধনমূলক চিন্তাকে সহজে এভাবে ব্যক্ত করা যায়-
পূঁজিবাদ কি আদতে সংস্কারযোগ্য?
পূঁজিবাদ আদতে সংস্কারযোগ্য নয়। এটি পুরোটাই পরিবর্তন করতে হবে। জন বিলামি ফস্টার (John Bellamy Foster) তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ Capitalism Has Failed — What Next?-এ লিখেছেন-
"It is capitalism’s undermining of the very basis of human existence that will eventually compel the world’s workers and peoples to seek new roads forward." অর্থাৎ, পুঁজিবাদ মানব অস্তিত্বের মৌলিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, এবং এ কারণেই মানুষকে নতুন পথ খুঁজে নিতে বাধ্য করবে ।
গত জানুয়ারী, ২০২২ ইং-এ-‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের’ (WEF)-এ প্রকাশিত ‘এ্যাডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারো মিটার’-এর বার্ষিক জরিপে বলা হয়েছে- বিশ্বের মানুষ কীভাবে পূঁজিবাদকে দেখে সেটা জানতে বিশ্বের ২৭টি দেশের ৩৪ হাজার জনের মধ্যে জরিপ চালানো হয়েছে। এতে পশ্চিমের উদার গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স থেকে শুরু করে চীন, রাশিয়ার মতো দেশের জনগণও এই জরিপে অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশই বলছেন-
Capitalism as it exists today does more harm than good in the world.
“বর্তমান বিশ্বে পূঁজিবাদ উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করছে।”
২১টি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনগণ বলেছে-
Centrally managed economies do a better job than free market economies"
"কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত অর্থনীতি মুক্তবাজারভিত্তিক অর্থনীতির তুলনায় ভালো কাজ করে।"(পৃ.২৩)
কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত অর্থনীতি যদিও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাকে বোঝায়, তবে এর মূল আবেদন হল-বর্তমান Liberated Capitalism থেকে বের হতে হবে। কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রন থাকতে হবে। পশ্চিমা বিশ্বে সেই নিয়ন্ত্রন থাকার জায়গা একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দর্শনে। তাদের সামনে ইসলামের অর্থনীতির ভারসাম্য নিয়ন্ত্রন তত্ত্ব নেই। তাই এর কথা বলতে পারেনি। আমাদের উচিত-ইসলামের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রন তত্ত্বে ফিরে আসা। পূঁজিবাদ সংস্কারযোগ্য নয়। একে পুরোপুরি বাদ দিতে হবে। ইসলামের অর্থনীতিতে ফিরে যেতে হবে। এ কথা পূঁজিবাদ বিশ্বেও এখন উচ্চারিত হচ্ছে-
‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের’ (WEF)এর বার্ষিক সম্মেলনে এর চেয়ারম্যান তার ভাষণে চলমান পূঁজিবাদ বিষয়ে মন্তব্য করতে যেয়ে বলেছেন- " Today we have reached a tipping point, which leaves us with only one choice: change or face the continued decline and misery."
আজ আমরা এমন এক বিন্দুতে এসে উপনীত হয়েছি, যার পরে আমাদের জন্য অর্থ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া কোনো পথ নেই। নচেৎ ক্রমাগত অধ্বঃপতনকে মেনে নেওয়াই হবে আমাদের নিয়তি।’
আল্লামা তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহ ২০১০ইং সনে অনুষ্ঠিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের’ (WEF) এর ভাষণে উক্ত বক্তব্য উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেছেন, যার সারকথা হল-
বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক পট পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। তবে ঠিক কোন পথে পরিবর্তন সাধিত হবে সেটা বিশ্বের মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সেই পথ হল- ইসলামী অর্থব্যবস্থা’ ।
২০১৩ সনে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামরন (David Cameron) লন্ডনে ‘ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ইকনোমিক ফোরাম’ (World Islamic Economic Forum (WIEF) কর্তৃক আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি তার বক্তব্যে মন্তব্য করেছিলেন-
Today our ambition is to go further still, I don't just want London to be a great capital of Islamic finance in the Western world, I want London to stand alongside Dubai and Kuala Lumpur as one of the great capitals of Islamic finance anywhere in the world.
অর্থাৎ আজ আমাদের স্বপ্ন ইসলামী ফাইন্যান্সে আরও অগ্রসর হওয়া। এ মুহূর্তে আমি শুধু এতটুকু বলবো না যে, পশ্চিমা বিশ্বে লন্ডন হয়ে উঠবে ইসলামী ফাইন্যান্সের বড় এক রাজধানী। বরং বলতে চাই, একদিন দুবাই ও কুয়ালালামপুরের মতোই আমাদের এই লন্ডন পুরো বিশ্বে ইসলামী ফাইন্যান্সের শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র ও রাজধানী হয়ে উঠবে।
অবাক ব্যাপার হল, এই বৃটেন ছিল এক সময় পূঁজিবাদের মূল উৎস ও কেন্দ্র। সময়ের পালাবদলে আজ সেখানেই ইসলামী অর্থনীতি ও ফাইন্যান্সের কথা হচ্ছে। একে বৃহৎ পরিসরে গ্রহণ করার জাতীয় প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। ইনশাআল্লাহ, এভাবেই একদিন পৃথিবীবাসীকে অর্থনীতিতে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নিতে হবে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়। ইসলাম শুধু অর্থনীতি নয়; সকল ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠবে। অতএব পূঁজিবাদকে সংস্কার নয়; জাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করুন।
(ড ইউনুসের কথিত ক্ষুদ্র ঋণ ও সামাজিক ব্যবসার নানা কথা ও দুর্বলতা জানতে এই ব্লগ অনুসরণ করতে পারেন-এখন থেকে নিয়মিত লেখা হবে। গত ৪ বছর এ বিষয়ে করা আমার গবেষণার সারসংক্ষেপ এখানে পাবেন।)
©somewhere in net ltd.