![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সত্য লিখতে বাঁধা কই, বাঁধা এলে মানবো কেন?
নিঝুমদ্বীপ আর তার কেরফাবুড়ি
কল্পনায় চাঁদের বুড়ি’র গল্প তো সেই শৈশব থেকে আমরা সবাই কমবেশী শুনে আসছি। মায়ের কোলে বসে কত শুনেছি চাঁদের বুড়ি’র চরকা কাটার কাহিনী। কিন্তু সেতো শুধুমাত্রই কল্পনা। আজ যা শুনাবো তা কোন কল্পকাহিনী নয়, পুরোপুরি বাস্তব এক কাহিনী। নিঝুমদ্বীপ বাংলাদেশের একটি চমৎকার পর্যটন এলাকা তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত হাতিয়া উপজেলার নতুন ইউনিয়ণ পরিষদ নিঝুমদ্বীপ ভ্রমণপিয়াসীদের কাছে অতিপরিচিত হলেও সেই দ্বীপের এক কিংববদন্তী নারীর কথা অনেকেরই অজানা। নিঝুমদ্বীপ আর তার কেরফাবুড়ি এই অঞ্চলে একটি আলোচিত কাহিনী যা বাংলাদেশের অনেকের কাছেই অজানা। ১৯৭০ সালের ভয়ঙ্কর জলোচ্ছাস আর ঘূর্ণিঝড়ের কথা হয়তো এই প্রজন্মের অনেকেই বলতে পারবেনা। সেই প্রলঙ্করী জলোচ্ছাস আর ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে নিঝুমদ্বীপ আর তার কেরফাবুড়ি।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরগুনা ও ভোলাসহ দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় গোর্কি। ঘন্টায় প্রায় দেড়শ’ মাইল বেগের গতিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় ও ২০-৩০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে গোটা উপকূলীয় এলাকা পরিণত হয় এক বিরানভূমিতে। এতে মারা যায় অন্তত ১০ লাখ নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর। আহত এবং নিখোঁজ হয় আরও কয়েক লাখ মানুষ। লাখ লাখ গবাদিপশু ও ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। গাছপালা আর ফসলের ক্ষতি হয় ব্যাপক। অনেকগুলো চরাঞ্চল, দ্বীপ ও গ্রাম একেবারে জনশূন্য হয়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড়ের পর ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় দেখতে পাওয়া যায় লাশের স্তূপ। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ অন্যদিকে স্বজনহারা মানুষের কান্না। তখন শীতের সময় ছিল বলে তীব্র শীত এবং খাদ্যের অভাবে প্রকৃতির বিরূপ প্রতিশোধ থেকে বেঁচে থাকা উপদ্রুত অঞ্চলের বাকী মানুষদের জীবন হয়ে পড়ে ভীষণ দুর্বিষহ। এমনকি নদী-পুকুরের পানিও তারা খেতে পারেনি। কারণ সর্বত্র ছিল শুধু মানুষ আর গবাদি পশুর গলে যাওয়া পঁচা লাশ আর লাশ। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী দীর্ঘদিনেও কোথাও কোথাও পৌঁছেনি কোন ধরনের ত্রাণ। ফলে বেঁচে থাকা মানুষগুলো সময় কাটিয়েছে এক নিদারুণ যন্ত্রণায়। আজকের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অনেকটা অবাস্তব মনে হতে পারে, বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের কাছে গোটা বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হবে।
নিঝুমদ্বীপের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বাকী তিনপাশে মেঘনা। দিগন্তে দুধের মতই সাদারঙের ঝুরঝুরে বালি। জোয়ার ভাটা জড়িয়ে আছে এখানকার মানুষের জীবনের অংশ হয়ে। নোনা খালের তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা চরের মানুষের ক্ষেতে ক্ষেতে লবন জমে, লবনাক্ত ওই মাটিতে ফসল তেমন ভাল হয়না বলে নদীই তাদের ভরসা। সেই নদীর নানা রঙের স্রোতে চরে বেড়ায় নানা ধরণের মাছ। চেনা নদীর বাইরে যে অচেনা নদী আছে তাতে যে ঢেউ জাগে, তাতে যে ঘুর্ণি ওঠে সেখানে মরণ আছে। কেউ তাই ভুলে সেই পথ মাড়ায় না। এটা নদীর সাথে তাদের বোঝাপড়া। মৃত্যুকে সিথানে রেখে তারপরও নির্ভয়ে থাকে দ্বীপের মানুষগুলো, কারণ তাদের বেঁচে থাকার আকুতি আর নদীর প্রতি শ্রদ্ধা। নদী তার চলার পথে নোনা নখের আঁচড় ফেলে দ্বীপের মাটিতে। নদী আর দ্বীপের সহবাসে দ্বীপের মাটি গ্রহণ করে নদী হয় গর্ভবতী। জন্ম হয় নতুন চরের। নতুন চরে আবার বসতি গড়ে মানুষ, আবার নোনা জলের সাথে লড়াই করে বেচে থাকে তারা।
দ্বীপে সরকারী বনায়ন কর্মসূচীর আওতায় গড়ে উঠেছে হাজার হাজার একরের কেঁওড়া গাছের বাগান। কেঁওড়া গাছকে স্থানীয়ভাবে কেপড়া ডাকা হয়। কেপড়া থেকে কেরফা, তাই বাগানের নামও এখানে কেরফা বাগান। সেই বাগানে হরিণ আছে কয়েক হাজার, ঘুরে বেড়ায় তারা দ্বীপের বুকচিরে বয়ে যাওয়া খালের কূল ঘেঁষে যা এখন নিঝুমদ্বীপে বেড়াতে আসার প্রধান কারণ। কেঁওড়া বাগানে এখন বাণিজ্যিকভাবে মধূ আহরণ করা হয়। মোদ্দাকথা, কেঁওড়াবাগান ঘিরেই নিঝুমদ্বীপ আর তার মোহভরা রূপের হাতছানি। নিঝুমদ্বীপের এই কেঁওড়াকে আরো ঐতিহাসিক করে তুলেছে এই গাছের কারণে প্রাণে বেঁচে যাওয়া এক নারী, হালিমা খাতুন তার পিতা-মাতার দেয়া নাম হলেও সবার কাছে তিনি ছিলেন “কেরফাবুড়ি” নামে অধিক পরিচিত।
১৯৭০ সালের সেই প্রলয়সম জলোচ্ছাস আর ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে বাদ যায়নি নোয়াখালীর হাতিয়ার অন্তর্গত নতুন জেগে উঠা চর নিঝুমদ্বীপও। নতুন দ্বীপে তখন খুববেশী জনবসতি ছিলনা। সামান্য যে কয়টি পরিবার সেখানে বসতি গড়ে তুলেছিল জলোচ্ছাস আর ঘূর্ণির সেইরাতে তার প্রায় সবকয়টি প্রকৃতির শিকারে পরিণত হয়েছিল। দ্বীপের ঘরবাড়ি গবাদিপশুসহ কয়েকশ’ মানুষ ভেসে যায় বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের বুকে, একজন মহিলা বেঁচে যান ভাগ্যক্রমে। হালিমা খাতুন নামের ঐ মহিলা জলোচ্ছাসের পানিতে ভেসে যাবার সময় প্রচন্ড ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রায় ২০ ফুট উঁচু একটি কেঁওড়া গাছের মাথায় উঠে পড়েন। তার পরণের শাড়ীটি আঁটকে যায় কেঁওড়া গাছের ডালের সাথে, সাথে মাথার চুলও গাছের সাথে পেঁচিয়ে যাওয়ায় তিনিও আঁটকে পড়েন গাছের মধ্যে। ঝড় আর জলোচ্ছাস শেষ হলে হালিমা নেমে আসেন প্রায় ভূমিতেই লুটিয়ে যাওয়া ঐ কেঁওড়া গাছ থেকে। ইতিমধ্যেই বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয় পুরো এলাকা। মাটিতে পা ফেলেই আবিস্কার করেন তিনি ছাড়া আর কেউ এখানে নেই। সময় অতিবাহিত হলে আরো কয়েকজন জীবিত প্রাণের দেখা পান হালিমা। তারাও ভেসে যাওয়া থেকে কোন না কোনভাবে উদ্ধার হয়ে ফিরে এসেছেন। তারপর আবার সময় চলতে থাকে তার নিজের নিয়মে। নোয়াখালী শহর থেকে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে নিঝুমদ্বীপ পৌঁছায় রেডক্রসসহ আরো দুই একটি সংস্থার লোকজন। ত্রাণ সামগ্রী বিতরণকালে হালিমা খাতুনের বেচে যাওয়ার কাহিনী শুনে তাকে কেঁওড়াবুড়ি নামে অভিহিত করেন সংস্থার লোকেরা। সেই থেকে হালিমা খাতুন নিঝুমদ্বীপ ও তার আশপাশের এলাকায় কেঁওড়াবুড়ি নামেই পরিচিতি পেয়ে যান। পরবর্তীতে কেঁওড়াবুড়ি হালিমা খাতুনকে দেখতে এবং তার সাক্ষাতকার নিতে অনেক পর্যটক, সাংবাদিকসহ নানা পেশার লোক নিঝুমদ্বীপ আসতে থাকেন। ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়তে থাকে নিঝুমদ্বীপের এই কেঁওড়াবুড়ির কারণেই।
সেই কেঁওড়াবুড়ি হালিমা খাতুন আজ বেঁচে নেই। গত ১৯ এপ্রিল ২০১৭ তারিখ বুধবার সকাল ৮টায় নিঝুমদ্বীপের একটি গুচ্ছগ্রামে তার নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন (ইন্নালিল্লাহি অইন্নাইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যূকালে তার সঠিক বয়স কত ছিল তা সঠিক জানা না গেলেও কারো কারো মতে তার বয়স একশত বিশ থেকে ত্রিশের মধ্যেই ছিল। বুধবার দুপুর ২টায় নিঝুমদ্বীপের শতফুল জামে মসজিদ মাঠে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। হালিমা খাতুন ওরফে কেঁওড়াবুড়ি ওরফে কেরফাবুড়ি দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জননী ছিলেন। কেরফাবুড়ি বেঁচে না থাকলেও বেঁচে থাকবে আরো অনন্তকাল নিঝুমদ্বীপ। আর নিঝুমদ্বীপ যতদিন মানচিত্রে বহাল থাকবে ততদিন ‘নিঝুমদ্বীপ আর তার কেরফাবুড়ি’ কাহিনীও বেঁচে থাকবে মানুষের মুখে মুখে।
©somewhere in net ltd.