নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ঢাকা ব্যুরো প্রধান, ফোকাসবাংলানিউজ http://www.focusbanglanews.com http://www.facebook.com/biplob1972

আহমেদ মাসুদ বিপ্লব

সত্য লিখতে বাঁধা কই, বাঁধা এলে মানবো কেন?

আহমেদ মাসুদ বিপ্লব › বিস্তারিত পোস্টঃ

সুদীর্ঘ দা’র রক্ত, বৌদির আর্তনাদ আর যুগযুগ’র উত্তর না পাওয়া এক প্রশ্ন : তবুও চিরতরে ইতি ঘটুক পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের

১৬ ই মে, ২০১৭ বিকাল ৪:৫৪

সেবার বাংলাদেশে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় রাজনীতির ময়দানে যখন একটা সংস্কার সংস্কার পাতানো খেলার আয়োজন চলছিল তখন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত দাবীদার আঞ্চলিক দলগুলোও তা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলনা। সংস্কারের বাতাস তাদের গায়েও দোলা লাগিয়েছিল। রাজার পাতানো খেলার মর্মার্থ সঠিকভাবে বুজতে পেরে বা না পেরেই তারাও মেতে উঠে সংস্কার খেলার আয়োজনে। যেমন আমরা বাংলাদেশীরা ক্রিকেট জগতে কেবলমাত্র ভারতের আইপিএল (ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ) দেখে বা আইপিএল জোয়ারে গা ভাসিয়েই সন্তুষ্ট ছিলামনা, নিজেদের নয়ন সুখের জন্য আয়োজন করেছি বিপিএল বা বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ- অনেকটা এমনই বলা যায় ব্যাপারটাকে। যাই হোক সে সময়ে পাহাড়ের আঞ্চলিক দল এখনকার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) দলটিতেও সংস্কার জোয়ারে ফাটল ধরে। তখন সন্তু লারমা সাহেবের একক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা পিসিজেএসএস’র কেন্দ্রীয় নেতা রূপায়ণ দেওয়ান ও সুধা সিন্ধু খীসাসহ ডজন খানেক নেতা দল থেকে বের হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) গঠন করেন যেটিকে এখন অনেকেই পিসিজেএসএস (সংস্কার) নামেও অভিহিত করে থাকেন। সেই থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

দূর্ভাগ্যক্রমে ১৯৯৭ইং সালের শেষ প্রান্তে এসে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনতার তখনকার একক আঞ্চলিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (যে দলের সামরিক শাখা হিসেবে শান্তিবাহিনী’র আবির্ভাব ঘটেছিল) এই দুই পক্ষের মাঝে সমঝোতার ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর শান্তির পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল যেন উল্টো অশান্তির এক নরক ভূমিতে পরিণত হয়ে পড়েছিল। দ্বি-মুখী অশান্তি আর ক্ষোভের অনলে সৃষ্ট ভয়ানক এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সেখানকার সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রাকে একরকম বিষময় করে তুলেছিল। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় হতেই জুম্মজাতির পূর্ণ অধিকারের নিশ্চয়তা না থাকায় সেটিকে মেনে নিতে রাজী ছিলেন না জনসংহতি সমিতির একটি পক্ষ। যার কারণে তখন দলটি ভেংগে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামে একটি বিদ্রোহী সংগঠন গড়ে উঠেছিল। আবার শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর কিছু সময় অতিবাহিত হতেই জনসংহতি সমিতিও দাবী তোলেন শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে বলে। ফলশ্রুতিতে শান্তির বদলে অশান্তির পরিমাণটাই যেন অধিক লক্ষনীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। তার উপর “গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়া” এর মত তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে দুই আঞ্চলিক দল পিসিজেএসএস এবং ইউপিডিএফ এর মধ্যে প্রায় সময়ই সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সেখানে দেখা দেয় “ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত” এর মত ভয়াবহ এক পরিস্থিতি। চুক্তি সাক্ষরের মাত্র ৪৭ দিন পর ১৯৯৮ সালের ১৮ জানুয়ারি রাঙামাটির জেলার নানিয়ারচর উপজেলাধীন কুতুকছড়ি এলাকায় চুক্তিবিরোধীদের প্রহারে নিহত হন চুক্তির পক্ষে থাকা জনসংহতির এক সমর্থক। এটাই ছিল সম্ভবত ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের অশুভ সূচনা। আগে যুদ্ধ হতো শান্তিবাহিনী বনাম সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর মাঝে, এবার তা হতে লাগলো জুম্ম বনাম জুম্মদের সাথে।

প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও পাহাড়ীদের তিনটি রাজনৈতিক দলই সশস্ত্র কর্মী পোষে। রয়েছে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী যারা নিজ নিজ দলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মূলতঃ আদর্শগত কারণের চাইতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধপূর্ণ মনোভাব গড়ে উঠেছিল। চাঁদাবাজি, অবৈধ অস্ত্রের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি নানাবিধ কারণে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত আঞ্চলিক দলগুলোর মাঝে দেখা দিয়েছিল। আর এই ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের শিকার হয়ে কত মায়ের বুক খালি, কত নারী যে বিধবা হয়েছিল আর কত সন্তান হয়েছিল পিতৃহারা তার সঠিক পরিসংখ্যান হয়তোবা কারোর কাছেই নেই! এই পরিস্থিতিতে কিছু জুম্ম নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা চিরতরে এই সংঘাতময় পরিস্থিতিকে বিদায় করতে চেয়েছিলেন। এমনকি চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় সহ পার্বত্য চট্টগ্রামে বয়জ্যেষ্ঠ মুরুব্বীরাও প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। আলাপ-আলোচনা, সভা-সমিতি, মানববন্ধন যাবতীয় আয়োজনের কমতি ছিলনা এই সংঘাত বন্ধের প্রচেষ্টায়। কিন্তু সফলতা এসেছিল খুব কম ক্ষেত্রেই। বরং উল্টা নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল এই প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে এমন অনেক নজির রয়েছে পাহাড়ের বুকে। তেমন এক সংঘাতেরই বলি হয়েছিলেন সুদীর্ঘ চাকমা। ইউপিডিএফ এর সাথে জেএসএস (এমএন লারমা) এর একটি অংশ যখন ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধকে মেনে নিয়ে কাজ করছিলো ঠিক তখনই সুদীর্ঘ চাকমার মত আরো অনেক নিবেদিত প্রাণ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন পাহাড়ের বুকে চিরতরে শান্তির অন্বেষণ করতে গিয়ে।

আমার খানিকটা, বলতে গেলে একেবারেই সামান্য পূর্ব পরিচিত সুদীর্ঘ চাকমা ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত এক তুখোড় কর্মী। নিজেকে কখনোই নেতা নয় একজন কর্মী বলে পরিচয় দিতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন সুদীর্ঘ দা। একসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছাত্র সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এর একজন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করলেও পরবর্তী সময়ে তিনি হয়ে উঠেন পিসিজেএসএস এর এমএন লারমা অংশের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। ১২ মার্চ, ২০১৩ সাল রোজ মঙ্গলবার দুপুর প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে রাঙামাটির লংগদু ও খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার মধ্যবর্তী দোজরপাড়া এলাকা হতে করল্ল্যাপাড়া এলাকায় পূর্ব নির্ধারিত দলীয় কর্মসূচীতে যোগদান করতে যাওয়ার পথে মধ্যপাড়া নামক এক গ্রামে আগে থেকেই উৎ পেতে থাকা আততায়ী দলের অতর্কিত হামলায় নিহত হন সুদীর্ঘ দা তার অন্যদুই সহযোদ্ধা সহকারে।

সুদীর্ঘ দা’ যখন নিহত হন তখন তার ঘরে বউ অরুমিতা চাকমা আর ‘চুগ চুগ’ নামে সাত-আট বছরের এক ছেলে সন্তান। অরুমিতা বৌদি হলেন অকালে স্বামীহারা আর বেচারা চুগ চুগ বাবাহারা। চুগ চুগ সুদীর্ঘ দা’র অত্যন্ত আদরের ধন, বুকের মানিক ছিলেন। সবচেয়ে অভাগা যে তার নাম ‘যুগ যুগ’, দাদার ছোট ছেলে। যুগ যুগ তখন বৌদির গর্ভে, পৃথিবীর আলো দেখবার আগেই যে সন্তান পিতৃহারা হয়ে যায় তার চেয়ে বড় দূর্ভাগা দুনিয়ার বুকে আর কে হতে পারে! এটা একজন সুদীর্ঘ চাকমা’র পরিবারের অবস্থা। এমন কত পরিবার যে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতের কারণে শোচনীয় পরিস্থিতির শিকার হয়ে দূর্বিসহ জীবনের মুখোমুখি পড়েছে তার কোন হিসাব নেই। একজন সুদীর্ঘ চাকমা’র কথা অনেকেরই পাশাপাশি আমিও বলছি, অথছ অনেকের তো বলবার মত সেই মানুষটিও নেই। কিংবা বলতে চাইলেও বলবার সাহস-সুযোগ করে উঠতে পারাটাই অনেক সময় হিমালয় পর্বত বিজয়ের চাইতেও কঠিন থেকে কঠিনতর অধ্যায় সমান হয়ে দাঁড়ায়। বলতে পারা, তুলে ধরাটাই অনেক ক্ষেত্রে নতুন সংঘাত আর প্রাণনাশের হুমকি অথবা রীতিমত কারণই হয়ে দাঁড়ায়।

অনেক কাঠ-খড় পোড়ানো আর রক্ত ঝরানোর পর অবশেষে সাম্প্রতিক সময়ে এসে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের মাঝে সমঝোতার কারণে আপাতত ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত অধ্যায়টি একটি স্থিতিশীল অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। দীর্ঘদিন মোটামুটি পাহাড়ের মাটিতে ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের বুকের রক্ত ঝরেনি। কিন্তু তবুও যেন স্বস্তি নেই তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ পাহাড়ী এমন কি বাঙালী জনগণের মাঝেও। আসলে একটা ভয় কাজ করে সবার ভিতর- এই সহাবস্থান কতদিন স্থায়ী হবে? চিরস্থায়ী আদৌ হবে কি? কারণ অতীতেও এমন অনেকবার দেখা গিয়েছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাঝেই হঠ্যাৎ করে পরিবেশ ঘোলাটে করে ফেলা হয়, আবার দেখা দেয় সংঘাত, হানাহানি, রক্তের হোলিখেলা। তাই সাধারণ সকলের চাওয়া একটাই, যেভাবেই হোক যেকোন মূল্যের বিনিময়েই হোক রক্তপাতহীন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানটা চিরস্থায়ী হয়ে উঠুক। দলগুলোর নেতা-কর্মীরা অতীতে অনেকবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন, কিন্তু এবার আর তার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক। এই সহাবস্থানটা দীর্ঘস্থায়ী নয়- বরং চিরস্থায়ী হয়ে উঠুক। আর সেটাই সকলের জন্য মঙ্গলজনক হবে সন্দেহ নেই। শুধু পাহাড়ই নয়, জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও এমনটাই প্রত্যাশা সকল বাংলাদেশী নাগরিকদের। আমার লেখার বিষয়বস্তু সুদীর্ঘ চাকমা দাদাকে নিয়ে হলেও এই একজন সুদীর্ঘ চাকমাই যেন আজ পুরো বাংলাদেশের একটি উদাহরণ, হোক তা জাতীয় কি আঞ্চলিক রাজনীতির অঙ্গনে।

সুদীর্ঘ দা’কে নিয়ে তার স্ত্রী অরুমিতা চাকমা বৌদি’র "আমার অতীত, আমার জীবন" শিরোনামে একটি স্মৃতিচারণমূলক লিখা আমার কাছে জমা ছিল। দাদা আর বৌদির আনন্দময় দিনগুলোর স্মৃতিময় কিছু অংশ এখানে ফুটে উঠেছে। সেটি এখানে উল্লেখ করলাম:

"আমার অতীত, আমার জীবন"

১২ই মার্চ ২০১৭ খ্রিঃ, আজ সুদীর্ঘ নেই ৪ বছর। আজকের দিনে সকাল ৮ টায় তার সাথে শেষ কথা হয়। সে বলেছিলো বিকাল বেলা বাড়িতে আসবে, আমার জন্য পাকাবেগুন আর শামুক নিয়ে আসবে। আমি অতি আগ্রহ নিয়ে খুশি মনে অফিসে চলে গেলাম। মনে মনে অস্থির ছিলাম রাত্রে পাকা বেগুন আর শামুক দিয়ে ভাত খাবো। কারন ছোট ছেলে তখন ৩ মাস ১৫ দিন আমার গর্ভে। জানা ছিলো না সেই কথাটাই তার সাথে শেষ কথা হবে। মানুষটা আসলে প্রতিরোধহীন প্রতিবাদহীন ভাবে থাকতে পারতো না। সমাজের জন্য প্রতিবাদ করা, আন্দোলন করার নেশাই ছিলো তার জীবনের লক্ষ্য। শাসকদের পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করার জন্য ছটফট করতো। তার চিন্তা চেতনা থাকতো সবসময় ক্রিয়াশীল শক্তির পক্ষে, অন্যায় অবিচারের বিপক্ষে। আমি দেখেছি যেকোন প্রোগ্রামে তার দায়িত্ব ছিলো অনেক। ছাত্রদের নিয়ে রাতভর ব্যানার লিখা, ফেষ্টুন লিখা, আরো কত ব্যস্ততা! তারুণ্যের উচ্ছ্বাসকে দেখেছি। আমার চায়ের হাড়ি চুলা থেকে নামতো না। তাদের পাশে বসে দেখতাম আর শুনতাম অনেক গভীরতম সমাজ পরিবর্তনের নীতিকথা। তাদেরকে রাতের খাবার খাওয়াতাম, ওরা বের হয়ে যত গভীর রাতে চিকা মারতে। আমি উৎকন্ঠায় থাকতাম কখন ফিরবে? কারন পরিস্থিতি তখন ভালো ছিল না, নানান বিপদের গন্ধ ছিল। তবুও ফিরে আসতো, চোখ মুখ জ্বলজ্বল করতো সবার। আমি বুঝতাম এই মাত্র তারা যে কাজ করে এসেছে সে কাজটি করে তাদের মধ্যে একটা আত্মতৃপ্তি কাজ করছে।

মনে পড়ে, যে কোন প্রোগ্রামের রাজপথে, কলেজ প্রাঙ্গণে শ্লোগানে শ্লোগানে সুদীর্ঘ'র শ্লোগান ছিলো দূর থেকে বহুদূরের আওয়াজ। আমার বিশ্বাস যারা তার সাথে ঐ শ্লোগান ধরেছিলো বা যারা শুনেছে এবং দেখেছে তারা এই জীবনে তাকে কখনো ভুলতে পারবে না। কত প্রাণবন্ত উচ্ছল, উজ্জ্বল ছিলো মানুষটা, কোথাও কখনো ক্লান্তি দেখিনি। সব কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে এসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করতো আমি শুনতাম। আদিবাসীদের আন্দোলনের ধারাকে বিকশিত করার জন্য এবং জনগনকে গণ আন্দোলনে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করতো। সে বলে, গণ বিচ্ছিন্ন আন্দোলন, জাতির অস্থিত্বকে রক্ষার জন্য এবং একটি নীতিনিষ্ঠ ও লড়াকু বিপ্লবী পার্টির জন্য হুমকি। তার জন্য কাজ করতে হবে আত্মত্যাগের মাধ্যমে, নিজেকে নিবেদিত ভাবে কর্মীদের কাছে তুলে ধরতে হবে। তৈরী করতে হবে নতুন প্রজন্ম আর তাই তার ছাত্রদের সাথে সম্পর্ক ছিলো অতি ঘনিষ্ট, একান্ত গভীর। সে তার চিন্তাধারার শক্তিকে মজবুত করার লক্ষ্যে কাজ করেছিল দৃঢ় প্রত্যয়ে। সমাজের এবং দলের অভ্যন্তরে শোধনবাদী, সংস্কারবাদী এবং সুবিধাবাদী প্রবনতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েই আজ সে শহীদ। সে ছিলো মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার আদর্শে দৃঢ় বিশ্বাসী। আমাকে বলতো, শোষন বৈষম্যের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে ভাঙ্গতে না পাড়লে নারীদের সন্মান সমাজে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

যখন সে বলে তার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করতো, আমি শুনতাম তার কথা মন দিয়ে আর ভাবতাম এই মানুষটাকে পেয়ে আমি সত্যিই ধন্য, গর্বিত। আমি যখন অফিস থেকে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম করার জন্য চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজতাম, তার কিছুক্ষণ পর সে তার গ্রীন টির কাপ হাতে নিয়ে আমাকে একটা কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলতো- ‘জানো অরু, শোষণ বৈষম্যের এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সমস্ত দিক দিয়ে মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে, সমাজ সভ্যতাকে ধ্বংস করছে সেখানে নারী পণ্য হয়ে আছে। শত অন্যায় অবিচার করেও এই ব্যবস্থা টিকে আছে, কাজ না করলে কি করে এই ব্যবস্থা উচ্ছেদ হবে? বিলুপ্তি হবে? কাজ করে যেতে হবে তোমাকে আমাকে সবাইকে। সমাজ পরিবর্তনের জন্য শোষিত নিপীড়িত মানুষকে নেতৃত্ব দিতে হলে চাই একটি সঠিক বিপ্লবী দল। আর সেটাই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভাব। সংগ্রাম ব্যতিত তোমার আমার মুক্তির পথ নেই, সংগ্রাম করে যেতেই হবে।’ আমি শুনতাম আর অবাক হয়ে ভাবতাম এই মানুষটার মধ্যে পরের জন্য এত অনুভব! সে কিভাবে শুধু আমার আর তার সন্তানদের জন্য নিজের সময়কে ব্যয় করবে। তাই কোনদিন তার কাছে আমার বৈষয়িক বিষয় নিয়ে কোন কথায় বলতাম না। যা ছিলো সেটা নিয়েই সুখি ছিলাম অফুরান।

স্বামী হিসেবে ছিলো নিখুঁত, কোন কিছু না চেয়ে বুঝে নিতো আমি কি চাই। অসুস্থ হলে পাশে বসে থাকতো আর ঘন ঘন হাতে আর পায়ে আকুপ্রেসারের যন্ত্র দিয়ে বিন্দুগুলি টিপে দিতো। ঔষধ হাতে নিয়ে সামনে দাড়িয়ে থাকতো, খাবার বানাতো নিজের হাতে। বড় ছেলে চুগচুগ অসুস্থ হলে প্রায় সারাটা রাত ছেলের মুখের দিকে চেয়ে থাকতো। আমাকে বলতো তুমি ঘুমাও তোমার কাল অফিস আছে- আমি জেগে আছি। চুগচুগ বুকের দুধ খেতে পায়নি, রাত্রে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে না শুনতে সে জেগে তার জন্য দুধ বানিয়ে খাইয়ে দিতো। ঢাকা, চট্টগ্রাম বা দেশের বাইরে গেলে নিজের জন্য কিছুই না কিনে আমার ও ছেলের জন্য নিয়ে আসতো ব্যাগভর্তি উপহার। দিনগুলি কি মধুর আর সুন্দর ছিলো। যখন সে কোথাও কাজে যেতো সেখান থেকে ফোন করে আমাকে জানাতো সেখানকার পরিবেশ আর খেতে খাওয়া মানুষদের কর্মজীবন সম্পর্কে। কোথাও কিছু দেখলে কিছু খেলে বলতো তোমরা আজ কি খাচ্ছো? প্রায় সন্ধ্যে বেলা বের হতাম তার হোন্ডা দিয়ে, অনেক দূর গিয়ে আবার ফিরতাম, ফিরার পথে কোথাও বসে চা খেতাম। সে ছিলো গল্পের ঝুড়ি। সে যখন কথা বলে মনে হয় তার মুখ হতে ফুল ঝরে পড়ছে। হাসি আর গল্পে গল্পে দিনগুলি কখন ফুড়িয়ে গেছে আমি জানতেও পারলাম না।

সেদিনের কথা মনে পড়লে আজো বুকে ব্যথা হয়, চুগচুগ যখন গর্ভে ছিলো আমার শীতের অতিথি পাখির মাংস খেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, তাকে যেই বলা সেই করা। রাঙ্গামাটি হতে ভোরে উঠে কতুকছড়ি বাজারে পুরো একদিন, নাওয়া নেই খাওয়া নেই চারটি অতিথি পাখি নিয়ে বিকেল বেলা ঘরে এসে হাজির। তাকে খেতে দিতে বললে সে বলে উঠলো- সেকি এখন খাবো কি এই দেখো কি এনেছি এগুলোকে ব্যবস্থা করে রান্না করবো তারপর তুমি খাবে আমি দেখবো এরপর আমি খাবো। সবই আজ স্মৃতি। তার কথা বলতে গেলেই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠে, চোখ ভরে যায় জলে। আমি হত বিহ্বল হয়ে আজো তাকিয়ে আছি তার ফিরে আসার অপেক্ষায়। যেখানে যাই যেদিকে তাকায় তার অনুপস্থিতি আমাকে তাড়া করে বেড়াই।

এখন ছোট ছেলে যুগযুগের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত। বাবা কেন চাঁদের কাছে গেলো? কেন ভগবান তাকে আমাদের কাছে আসতে দেয়না? বাবা কাঁদে না তোমার জন্য? আমাদের জন্য?
অরুমিতা চাকমা
১২/০৩/১৭

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.