![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সত্য লিখতে বাঁধা কই, বাঁধা এলে মানবো কেন?
আজ ৩০ জুন, ঐতিহাসিক ব্রিটিশবিরোধী সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস। ১৮৫৫ সালে ভারতের বর্তমান ঝাড়খন্ড রাজ্যের সাঁওতাল পরগনার সদর শহর বারহাইত থেকে আধমাইল দূরে ভাগনাডিহি গ্রামের এক দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারের চার ভাই সিধু মুর্মু, কানু মুর্মু, চাঁদ মুর্মু, ভায়রো মুর্মু এবং দুই বোন ফুল মুর্মু ও জান মুর্মুদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সাঁওতাল গণসংগ্রাম ঐক্যবদ্ধ করেছিল নিপীড়িত আদিবাসীদের।
সিধু, কানু, ভায়রো, চাঁদ চারভাই নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসে। সিধু-কানু জানত আদিবাসীদের জাগিয়ে তুলতে হলে ধর্মের গান গাইতে হবে। তাই তারা প্রচার করত, তারা ঠাকুরের নির্দেশ পেয়েছে। ১৮৫৫ সালের ১৫ জুন সিধু-কানু গ্রামে গ্রামে সাঁওতালদের কাছে ‘গিরা’ পাঠাল। ‘গিরা’ সাঁওতালদের কাছে ধর্মীয় আহবান, জাতির একতার ডাক। পাহাড়-পর্বত-অরণ্যব্যাপী একই সুর ওঠে ‘দোলা দোমেলা দোমেলা, দেলা লগন লগন দেলা ভগনাডিহি’ অর্থাৎ চল চল, দলে দলে চল, ভগনাডিহি চল। নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, মাঠ-ঘাট ডিঙিয়ে সাঁওতালরা তীর, ধনুক, টাঙ্গি, কুড়াল, ধামসা, মাদল, বাঁশি নিয়ে ভগনাডিহি গ্রামে সিধু-কানুর পাশে এসে দাঁড়ায়। সিধু ও কানু সাঁওতালদের আদি কাহিনী শোনায়। সেই হিহিড়ি পিপিড়ি, চায়-চম্পা, সাতভুই, শিখরভুই হাজারীবাগ হয়ে দামিন-ই-কোহতে বনবাদড়ে কেটে পাহাড় ভেঙে কেমন করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাদের পূর্বপুরুষরা আবাদি জমি তৈরি করেছিল এবং কেমন করে জমিদার নায়েব গোমস্তা, পুলিশ, মহাজন সাঁওতালদের জমি দখল করছে, ফসল লুট করছে, ফসলের জমিতে গরু-ঘোড়া-হাতি দিয়ে ফসল নষ্ট করছে, ঋণের জালে আবদ্ধ করে ক্রীতদাস বানিয়েছে, শান্ত-নিরীহ সাঁওতালদের জেলে পুরে নির্যাতন করে হত্যা করছে।
রেলপথে সাহেবরা কীভাবে সাঁওতাল নারীর ইজ্জত নষ্ট করছে, মাঝি-মোড়লদের লাঠিপেটা করছে এ কাহিনী বর্ণনা শেষে সিধু-কানু সবাইকে বলেন, সব উৎপীড়নকারীকে উচ্ছেদ করে সাঁওতালদের স্বাধীন জীবন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাদের এই আহবানে সাঁওতাল বিদ্রোহীরা জমিদার মহাজনদের হত্যা করে তাদের ধন-সম্পদ লুট করে সাঁওতাল বিদ্রোহীদের রণশক্তি বৃদ্ধির কাজে ব্যয় করতে লাগল। নীলকুঠি ধ্বংস করে আগুন জ্বালিয়ে দিল। অনেক জমিদার-মহাজন পালিয়ে যায়। অনেকে সিধু- কানুর কাছে প্রাণভিক্ষা চায়। তাদের ক্ষমা করা হয় কিন্তু হিসাবের খাতা, দলিলপত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়।
ঐতিহাসিকভাবে সাঁওতালরা শ্রেণী নিপীড়নের বিরুদ্ধে বারবার রুখে দাঁড়ালেও ১৮৫৫ সালের বিদ্রোহকেই কেবল সাঁওতাল জনগণ 'হুল' হিসেবে রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত করেন। 'হুল' কেবল নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা এবং বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহই ছিল না, এটি একই কায়দায় বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামোকে ফানা ফানা করে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক ও মনোজাগতিক মুক্তির আহ্বানও ছিল। কার্ল মার্কস তার 'Notes on Indian History'-এ সাঁওতাল বিদ্রোহকে 'গেরিলা যুদ্ধ' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
সাঁওতাল বিদ্রোহের মহান নেতা কানুকে ইংরেজ উপনিবেশবাদীরা ফাঁসি দেয় ১৮৫৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী ৷ তাঁর বয়স তখন মাত্র ছত্রিশ বছর৷ ব্রিটিশবিরোধী এই বিদ্রোহে 'পঞ্চাশ হাজার বিদ্রোহী সাঁওতালের মধ্যে পঁচিশ হাজার যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন৷'
ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে কানু নির্ভীক কণ্ঠে ঘোষণা করেন, 'ছ বছরের মধ্যে আমি আবার আসব, আবার সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলব৷' পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে তাঁর দেহটি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে রাখার পরে, সেটিকে নামিয়ে এনে পুড়িয়ে ফেলা হয়৷
আজ ১৬২ বছর পর আবার দেখা দিয়েছে সিধু-কানুদের প্রয়োজনীয়তা। আজো সাঁওতালদের জমি দখল হয়, তাদের বাড়ী-ঘর আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আর সেটি হয় সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের শাসক গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায়।
©somewhere in net ltd.