![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সত্য লিখতে বাঁধা কই, বাঁধা এলে মানবো কেন?
আদিবাসী জনগণকে প্রাথমিক দিকে প্রথম জাতি, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, আদিম মানুষ, উপজাতি প্রভৃতি নামে চিহ্নিত করা হত। আদিবাসী শব্দটির প্রকৃত সংজ্ঞা ও তাদের অধিকার নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিতর্ক প্রচুর। জাতিসংঘের বিভিন্ন পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার পরেও আদিবাসীদের ব্যাপারে সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য কোন সংজ্ঞায় উপনীত হওয়া সম্ভব হয় নি। সাধারণত কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অণুপ্রবেশকারী বা দখলদার জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বে যারা বসবাস করত এবং এখনও করে; যাদের নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে; যারা নিজেদের আলাদা সামষ্টিক সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা সমাজে সংখ্যালঘু হিসেবে পরিগণিত, তারাই আদিবাসী। আদিবাসীদের উপজাতি হিসেবে সম্বোধন করা একেবারেই অনুচিত, কারণ তারা কোন জাতির অংশ নয় যে তাদের উপজাতি বলা যাবে। বরং তারা নিজেরাই এক একটি আলাদা জাতি।
বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহ:
বাংলাদেশে প্রায় ৪৫টির মত আদিবাসী জাতিসত্তার উপস্থিতির তথ্য জানা যায়। যার মধ্যে রয়েছে অহমিয়া, খিয়াং, খুমী, গুর্খা, চাক, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, পাংখো, বম, মারমা, ম্রো, লুসাই, কোচ, খাড়িয়া, গারো, ডালু, বানাই, হাজং, খাসিয়া, পাত্র, মণিপুরি, রাখাইন ওরাওঁ, কন্দ, কোল, গণ্ড, তুরি, পাহান, পাহাড়িয়া, বাগদি, বেদিয়া, ভূমিজ, মাহাতো, মাহালি, মালো, মুণ্ডা, মুরারী, মুষহর, রাই, রাউতিয়া, রাজোয়াড় ও সাঁওতাল। এই ৪৫টি বর্ণাঢ্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বসবাস আমাদের বাংলাদেশকে দিয়েছে বিশেষ মাত্রা, সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ। জনসংখ্যার দিক থেকে দেশের মোট জনসংখ্যার সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৪ শতাংশ হতে পারেন আদিবাসী মোট জনগোষ্ঠীরা।
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট:
প্রতি বছরের ৯ আগস্ট তারিখটি আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে সারাবিশ্বে পালিত হয়ে থাকে। জাতিসংঘ ঘোষিত এ দিবসটি ১৯৯৪ সাল থেকে সারাবিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি আদিবাসী পালন করে। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের উন্নয়ন ও সংরক্ষণ উপকমিশনের কর্মকর্তারা তাদের প্রথম সভায় আদিবাসী দিবস পালনের জন্য ৯ আগস্টকে বেছে নেয়। আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার, পরিবেশ উন্নয়ন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সুদৃঢ় করা ও গণসচেতনতা সৃষ্টি করাই বিশ্ব আদিবাসী দশক, বর্ষ ও দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য। বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশে প্রায় ৩০ কোটির অধিক আদিবাসী জনগণ বসবাস করে। এই অধিকারবঞ্চিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জাতিসংঘ প্রথমবারের মতো ১৯৯৩ সালকে 'আদিবাসী বর্ষ' ঘোষণা করে। পরের বছর (১৯৯৪) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রতিবছর '৯ আগস্ট'কে 'বিশ্ব আদিবাসী দিবস' হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ ছাড়া জাতিসংঘ ১৯৯৫-২০০৪ এবং ২০০৫-২০১৪ সালকে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় আদিবাসী দশক ঘোষণা করে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের আদিবাসীরাও দিবসটি বেসরকারি ভাবে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করে থাকে। তবে দীর্ঘ দিনেও আদিবাসীদের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। অধরা রয়ে গেছে অনেক সাধ। বিশ্বজুড়ে ১৯৯৪ সাল থেকে 'বিশ্ব আদিবাসী দিবস' উদযাপন শুরু হলেও ২০০১ সালে 'বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম' গঠনের পর থেকে বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে বৃহৎ পরিসরে দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে। তখন এ দিবসকে সামনে রেখে বিভিন্ন সময়ে সরকার প্রধানরা বাণী দিয়ে আদিবাসীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। ব্যাস ঐ পযর্ন্তই। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো আজ অবধি এইদেশের আদিবাসীরা তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করতেই সক্ষম হয়নি।
বাংলাদেশের আদিবাসীদের সবচেয়ে বিরাট অংশ বাস করে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিনটি পার্বত্য জেলায়। এ অঞ্চলের পাহাড়ি আদিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে ছিল অধিকারবঞ্চিত। একসময় এ পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীরা তাদের প্রাপ্য অধিকারের জন্য সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে চলা এ লড়াই অবশেষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শেষ হয়। ওইদিন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের জন্য একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা শান্তিচুক্তি নামে দেশ-বিদেশে পরিচিত। চুক্তির পর এ অঞ্চলের আদিবাসীরা স্থায়ী শান্তি, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির আশায় বুক বাঁধে, স্বপ্ন দেখে নতুনের। কিন্তু পার্বত্য আদিবাসীদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে, স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি।
দেশের বাকী আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস দেশে সমতলীয় অংশের উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে। উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, রংপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা জেলায়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিলেট বিভাগের জেলাগুলোতেই আদিবাসীদের বসবাস করতে দেখা যায়। নির্দিষ্ট কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠী আবার পটুয়াখালী এবং কক্সবাজার জেলায় বসবাস করেন।
আদিবাসীরা একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর হয়েও স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি এখনো। অত্যাচার, নিপীড়ন, হয়রানি আর দারিদ্র্যের শিকার হয়েছে বংশ পরম্পরায়। সাঁওতাল বিদ্রোহের (১৮৫৫-৫৭) দেড়শ বছরেরও বেশি সময় পরে সেই ঔপনিবেশিক আমলের মতো এখনো আদিবাসীদের বসতভিটা, নারীদের মান-সম্ভ্রম কেড়ে নেয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহ বা কার্পাস বিদ্রোহ(১৭৭৬-১৭৮৭), ময়মনসিংহের গারো জাগরণ(১৮২৫-২৭, ১৮৩২-৩৩, ১৮৩৭-৮২), তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭), হাজং বিদ্রোহসহ অনেক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায়। এখন সেইসব বিদ্রোহ সংঘটিত না হলেও পার্থক্য হচ্ছে আগে এ অত্যাচার ছিল বিদেশিদের দ্বারা আর এখন নিজ দেশের মানুষই এখন সেই লুটেরার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আদিবাসীরা হারিয়েছে তাদের নিজস্ব ভূমির অধিকার, সাঁওতালি সমাজের নানা দুষ্প্রাপ্য গাছ গাছালি, জঙ্গল, মালি, পাহাড়, জলাশয়। খনিজসম্পদ উত্তোলনের নামে দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে সাঁওতাল জনপদ উচ্ছেদ করা হয়েছে। নিজের সম্পদ রক্ষা করতে মেয়ে অলিফ্লে ও সরেনের মত নাম না জানা অনেক আদিবাসীকে জীবন দিতে হয়েছে। বাজেট কী অনেক আদিবাসী তা এখনো জানে না।
জাতিসংঘ আদিবাসীদের স্বীকৃতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করার পর কয়েক বছর দেশে সরকারীভাবে আদিবাসী দিবস পালন করা হলেও বিগত কয়েক বছর থেকে তা সরকারীভাবে পালন বন্ধ রয়েছে।
মূলত ২০০৮ সাল থেকেই এ দেশের আদিবাসীদের 'আদিবাসী' হিসেবে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা দেয়। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে একটি বিশেষ সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনকে ইঙ্গিত করা হয় তখন। ২০১০ সালে আদিবাসীদের মতামতের তোয়াক্কা না করে ১২ এপ্রিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ২০১০ আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের ধারা ২(২) এ বলা হয়েছে, 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী' অর্থ তফসিলে উল্লিখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও শ্রেণীর জনগণ'। একদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে কোন আদিবাসী নেই আবার একই আইনে বলা হচ্ছে, আদিবাসীরাই 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী'।
সম্প্রতি পার্বত্য জেলা প্রশাসক, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে 'বিশ্ব আদিবাসী দিবস' পালনে, যাতে কোন ধরনের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা করা না হয়। আদিবাসীদের 'আদিবাসী' হিসেবে অভিহিত না করা, 'আদিবাসী দিবস' পালনে সহায়তা না করার জন্য পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, পার্বত্য মন্ত্রণালয়গুলো রীতিমতো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।
তবুও পালিত হয় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস
এতকিছুর পরেও আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত হয় দেশের নানা স্থানে। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারসহ আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন, আদিবাসীদের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন, পৃথক ভূমি কমিশন গঠন, আইএলও কনভেনশন পুরোপুরি বাস্তবায়ন, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসন রাখা ইত্যাদি দাবিকে সামনে রেখে প্রতি বছর এই দেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করা হয়ে থাকে; নতুন আশায় বুক বাঁধেন খানিকটা পরিবর্তনের, রাষ্ট্র তাদের পুনরায় আপন সন্তানতূল্য মমতায় বুকে টেনে নেবে এমন আশায়।
©somewhere in net ltd.