নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

“ কাউকে জ্ঞান বিতরণের আগে জেনে নিও যে তার মধ্যে সেই জ্ঞানের পিপাসা আছে কি-না। অন্যথায় এ ধরণের জ্ঞান বিতরণ করা হবে এক ধরণের জবরদস্তি। জন্তুর সাথে জবরদস্তি করা যায়, মানুষের সাথে নয়। হিউম্যান উইল রিভল্ট। ” -আহমদ ছফা ।

আহমেদ রুহুল আমিন

“ মানূষের জীবনকাল মাত্র দুই দিনের যার একদিন যায় স্বপ্ন দেখতে- একদিন যায় স্বপ্ন ভাঙ্গতে ” ।

আহমেদ রুহুল আমিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

++++ স্মৃতিতে একাত্তুর +++++(**) - আহমেদ রুহুল আমিন ।

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১১:২৪

।। 'উশুম' ।।

কি কহিম বাও...দিনডা ছিল্
ডামাডোলের আসিমন /
চিন্তা সবার কি হবে আইজ
উধাও হাসি-খুশিমন ।
শরীর কাঁপে থর্ থরে
কুহাকাপে বাহারখান /
বুকে সবার আস্ত চাপে
দার্জিলিংয়ের পাহাড়খান ।
গরু - খাসি কইরছে সাবার
মোরগ-মুরগি যা ছিল্ /
'উশুমাতি' মুরগি কয়ডা
মরণ খোরাক তা ছিল্ ।
এলা বলে ওইলাও খাবে
আগত খাইছে আড়িয়াটা /
খামাখা মাইর খাইল আইজ
টাঙ্ঘা দাদা ‘দাড়িয়াটা’ ।
'ওই বেটা খান' বুঝিঝ কি তুই
বুঝিবো এর শেষটা /
'উশুম' দেছে হামার মনত
'উশুম' খাছে দেশটা... !!
কিছু শব্দ সংকেত : ( পঞ্চগড়/জলপাইগুড়ি অঞ্চলের স্থানীয় ভাষা ) উশুম- ডিমে তা'দেয়া- উম্ বা উষ্ণতা, কি কহিম বাও- কি বলব এই প্রজন্মের ছেলেদের, ডামাডোলের আসিমন - মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, কুহাকাপে বাহারখান -অতিরিক্ত ঠান্ডায় কাহিল অবস্থা ,মরণ খোরাক- মৃত্যুর আগে শেষ খাবার, টাঙ্ঘা-অতিশয় লম্বা, এলা- এখন, ওই বেটা 'খান'-পাকিস্তানী বা 'পাকসেনা', বুঝা পাবো- হারে হারে বুঝবে । হামার মনত- আমাদের মন/হৃদয়ে, দাড়িয়াটা- দাড়িওলা মুখের মানুষ বিশেষ ।
** বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এলেই মনে পড়ে যায় একাত্তুর , আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা । সেই স্মৃতি জাগানিয়া আমাদের শৈশবের দিনগুলোর কথা , যা কখনো ভোলার নয় !
- ১৯৭১ সালে পঞ্চাশ বছর আগে বাস্তবে দেখা ছিটেফোঁটা স্মৃতি নিয়ে লেখা আজকের এই পোস্ট :
- কতইবা হবে বয়স তখন...!
এই ছয়,সাত বা আট । শিক্ষক বাবার সচেতন মানসিকতায় তখনকার দিনে কমবয়সে ক্লাস থ্রি তে পড়া গ্রামীণ আবহে বেড়ে উঠা এক দুরন্ত কিশোর । মা-বাবার চোখ এড়িয়ে নিতান্তই ছুটে চলা । চোখের সামনে যা দেখি- মনের সেলুলয়েডে তা গেঁথে যায় কিংবা বলা চলে ফুল এইচডি শটে তা অটোমেটিক সেভ হয়ে যায় অযুত-নিযুত জিবি ধারণ ক্ষমতার মগজের এই স্মৃতিকোষে ।
- কিছু দৃশ্যপট
উনিশ’শো একাত্তুর ...............
আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে...সম্ভবত এপ্রিল মাস ।
আমার প্রিয় হলধর গ্রাম ।
পার্শ্বেই অমরখানা..... উত্তরবঙ্গে
পাকসেনাদের শেষ বিশাল ঘাঁটি ।
প্রায়শ:ই সেনাক্যাম্প থেকে ভীনদেশী জোয়ানেরা হানা দিতো আশপাশের গ্রামগুলোতে । তাদের অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে গ্রামের যুবক ও মহিলাদের মুক্ত এলাকায় পাঠিয়ে দিয়ে শুধুমাত্র শিশু-কিশোর ও বয়স্ক মুরব্বীরা বাড়িতে থাকতেন।
ওরা গ্রামের এমন কোন ঘরবাড়ি নেই যেখানে ওদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটেনি ।
আমাদের গবাদি পশু আর মুরগির খোয়ারগুলো ছিল ওদের রসনাতৃপ্তির নিত্য খোরাক যা একসময় শেষ হতে চলে। এমন একদিনের ঘটনা... । 'মুন্সীখান' নামের একজন অত্যন্ত বদমেজাজি স্বেচ্ছাচারী পাকসেনা হাবিলদার তার চার-পাঁচ জন জোয়ানকে সাথে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে সবাইকে আদেশের সুরে মোরগ- মুরগি ধরার কথা বলে । কিন্তু অবস্থা এমন বেগতিক যে, একমাত্র কয়েকটি 'ডিমে তা' দেয়া ( স্থানীয় ভাষায় 'উশুমাতি মুরগি' যা বাচ্চা দিবে ) মুরগি ব্যতীত অন্য কোন খাবার উপযোগী মোরগ-মুরগি ছিলনা ।'ডিমে তা'দেয়া ছাড়া বা উশুমাতি মুরগি ব্যতীত অন্য কোন মুরগি নেই'-এই বিষয়টি তাদের কোন মতেই বুঝানো যাচ্ছিলনা । ততক্ষণে একজন জোয়ান ঘরের ভিতর ঢুকে একটি উশমাতি মুরগি বের করে আনে । উশমাতি মুরগিটি ধরার সাথে সাথে কক্ কক্ করে সারা গ্রাম মাতিয়ে ফেলে এবং তার চিৎকারে অন্য সব উশুমাতি মুরগিগুলো চিৎকার করতে থাকে । এই অবস্থা দেখে মুন্সি খান তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে ' শালে বাঙালি ঝুট বাত বলতা হ্যায়' বলে অশ্লীল শব্দে গালিগালাজ করতে থাকে এবং সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে মেরে ফেলার জন্য রাইফেল তাক করে এবং আমার এক শিক্ষক দাদুকে রাইফেলের বাট দিয়ে পেটাতে থাকে । এই সময় আমার শিক্ষক বাবা ( যিনি ঘটনার সময় বাইরে ছিলেন, তিনি আরবী,উর্দু ও ফারসি ভাষা জানতেন ) বাইরে থেকে এসে পাকসেনাদের বুঝাতে সক্ষম হন এবং সেদিনের মতে সবাই রক্ষা পান । এই ঘটনাটির পরে আমরা সবাই আমাদের প্রিয় হলধর গ্রাম ছেড়ে মুক্তাঞ্চলে পাড়ি জমিয়েছিলাম । সেই বিভৎস স্মৃতি কখনো ভোলার নয় .....!!!
দৃশ্যপট-২ :
সেই উত্তাল মার্চ এর একসকাল বেলা- অমরখানা ইপিআর ক্যাম্প । ক্যাম্পের ননবেঙ্গলী হাবিলদারের মৃতদেহ ক্যাম্পের বাইরের লেট্রিনের ধারে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে .....।
ক্যাম্পের সামনে ইপিআর এর সাঁজোয়া যানে আনসার-মুক্তিফৌজদের মুখে 'জয়বাংলা' স্লোগান ।
ইন্ডিয়া-পুর্বপাকিস্তানের বোর্ডার খোলা ।
"শেখ মুজিব যুগ যুগ জিও, চারু মুজুমদার যুগ যুগ জিও,ইয়াহিয়া-ভুট্টো নিপাত যাক,এপার বাংলা- ওপার বাংলা -জয়বাংলা-জয়বাংলা" -জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি থেকে আসা টাইটফিট পোষাকে সজ্জিত তরুণ -তরুণীদের পঞ্চগড় -ঠাকুরগাঁও অভিমুখে ছুটে যাওয়া সাইকেল রেলীর সাথে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত জনপদ । মা-চাচিদের ব্যবহৃত সবুজ রঙ্গের মাহবুব শাড়ির আঁচলের সাথে কমলা রঙের ব্লাউজের টুকরো কাপড়ে হাতে তৈরি ততকালীণ পুর্বপাকিস্তানের ম্যাপের আদলে জয়বাংলার (বাংলাদেশের ) পতাকা প্রতিটি বাড়ির সামনে শোভা পাচ্ছে ।
দৃশ্যপট -৩ :
মফস্বল শহর পঞ্চগড়ের আকাশে কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী.... বোমা পড়ছে ....।। শহর পুড়ছে....গ্রাম-নগর জনপদ পুড়ছে.. .আতঙ্কিত মানুষ.....! মানুষের বহর ছুটছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বিভিন্ন এলাকায় .. !
পাকসেনাদের সাঁজোয়া বহর । প্রায় পাঁচশোর মতো সাঁজোয়া কনভয় জগদল থেকে বোর্ডবাজার পর্যন্ত দাড়িয়ে আছে । একে একে নামছে আর লাইন ধরে বনজঙ্গল খাল-বিল শুকনো মাটি মাড়িয়ে হাঁটছে অমরখানা ( বর্তমানের মুক্তাঞ্চল মোড়) এলাকা পর্যন্ত। প্রত্যেক পাকসেনার হাতে অস্ত্র , পিঠ-কোমড় বোচকায় মোড়ানো খাঁকি- মেটে রঙ্গের পোষাকে বেঢপ আকারের দেহে মানানসই। তাদের হাঁটাপথ যেন নুতন কোন রাস্তা তৈরি করছে ।
আমার ছোট্ট হলধর গ্রামের পশ্চিমে ছুটে চলা চাওয়াই নদীর ধার ঘেঁষে বিলের পাড়ে যুদ্ধের বোমা -গুলি থেকে বাঁচার রক্ষা কবচ কবরের আদলে বাংকার তৈরীর টাটকা সোদা-মাটির গন্ধ.... ! কিভাবে যেন শোনা-পাকসেনারা নদী পাড় হয়ে কোথাও যায়না, তাই রাতে বাড়িঘর ছেড়ে নদীর হাটুজল পেড়িয়ে অপরপাড়ের খইপাড়া গ্রামের বাপ-চাচাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের বাড়িতে অনেক পরিবারের এককাপড়ে আশ্রয় নেয়া । পরেরদিন সকাল বেলার আলোড়নসৃষ্টিকারী একটি খবর- গ্রাম জনপদ পেড়িয়ে চাওড় হয়ে মানুষকে আরো আতঙ্কিত করে তোলে আর তা হচ্ছে -
"পাকসেনাদের হাতে গুলিবিদ্ধ অমরখানা বোর্ড বাজারের ব্যবসায়ী আলামুদ্দীন পাইকারের ( এডভোকেট আজিজার রহমান আজুর পিতা) দৈবক্রমে বেঁচে যাওয়া ...!"
দৃশ্যপট-৪ :
গ্রামের ঠিক মাঝখানে একমাত্র পুকুর যার নাম স্থানীয় ভাষায় ‘বড়দিঘী’ নামে পরিচিত ।প্রতিদিন যথারীতি শাপলাফুল তোলার জন্য পুকুরে আমরা চার-পাঁচজন কিশোর হাঁসের আদলে দিঘির পানিতে পায়চারি করছি । এমন সময় বাড়ি থেকে খবর আসে আমাদেরকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাওয়ার জন্য । যথারীতি বাড়িতে গিয়েই বুঝতে পারি, দুপুরের মধ্যে আমাদেরকে বাড়িঘর ছেড়ে দুরে কোথাও চলে যেতে হবে । প্রচন্ড খুশি মনে বেমালুম খাওয়া-দাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে কখন রওয়ানা দিব বলে আমাদের কিশোর মন উথাল-পাথাল করতে থাকে । খাবারের জন্য মায়ের বেশ কবার তাড়ার পরও পরমানন্দে খাবার খেতে অস্বীকার করতে থাকি । অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আমরা সবাই বাড়ি ছেড়ে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হচ্ছি । গরুর গাড়িতে বোঝাই কিছুদিন চলার মতো চাল-ডাল, লবন-তেল সাংসারিক খাবার-দাবার ও অন্যান্য সামগ্রী । আমাদের পরিবারের( বাপ-চাচারাসহ চার-পাঁচ ভাইয়ের )পঞ্চাশ-ষাটটা গরু ২৫/৩০ জন নারীপূরুষ মিলে বাস্তুভিটে-ঘরত্যাগী এক কাফেলা পায়ে হেটে চলছি অজানা কোন গন্তব্যে । আমার একটা আদরের পোষমানা ধবল রংয়ের বিড়াল ছোট বস্তায় পুরে যেই পিঠের মধ্যে নিয়েছি অমনি জানপ্রাণ নিয়ে তা শব্দ করে নড়াচড়া শুরু করলে বাবার ধমক খেয়ে বস্তার মুখ খুলে দিতেই একলাফে বিড়ালটি জঙ্গলে পালিয়ে যায় । এতক্ষনে, ৪/৫ কিলো: পায়ে হাটার পর তীব্র ক্ষুধা অনুভব করতে থাকি । শেষ বিকেলে সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে মুক্তাঞ্চলের সর্দার পাড়ায় আমার বাবার এক শুভাকাংখী বন্ধু রহিম্বুল্লাহ চাচার বাড়িতে আশ্রয় নেই ।আজো মনে আছে, সন্ধ্যার অব্যবহিত ঠিক পরেই আলু ও শুকনো মরিচপোড়া আর লবণ দিয়ে মায়ের হাতের সেই ভাতের অমোঘ স্বাদ এখনো ভুলতে পারিনা… ! সেই বাড়িতে আমরা দুই মাসের মতো ছিলাম । মনে পড়ে, সেখানে জোৎস্না স্নাত রাতের বেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের পদচারনা, তাদের শলাপরামর্শ, বিশাল আঙ্গিনায় অনেক মানুষের উপস্থিতি, রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতারে ঘন ঘন গাওয়া আমাদের জাতীয় সঙ্গীত, চরমপত্র ও খবর শোনা এইভাবেই পেড়িয়ে যাচ্ছিল সেইসব যুদ্ধ পেরুনো দিনগুলো ..!
দৃশ্যপট-৫ :
পাকারাস্তার ফুটপাথ ধরে আমরা পাঁচ-ছয় জন শিশুকিশোর আনমনে হাঁটছি । কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টিতে রাস্তায় কাদাপানি জমেছে । হঠাৎ রাস্তায় লক্ষ্য করি, কামরাঙ্গা ফলের আদলে অপেক্ষাকৃত বড় সাইজের তার পেঁচানো লোহার বস্তু মাটিতে পোতা অবস্থায় বের হয়ে আছে । কাদামাটি লাগা বস্তুটি হাতে নিয়ে পার্শ্বের নর্দমায় ধোয়ার জন্য যেই ঘসাঘসি করছি অমনি ধোঁয়া উঠতে শুরু করে ! মুহূর্তেই সেখানে তা ফেলে দিয়ে চিৎকার দিয়ে রাস্তার উল্টোপার্শ্বের ডোবায় সবাই শুয়ে পড়ি । বিকট শব্দে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তা বিস্ফোরণ হলে কানে আঙুল গুঁজে কিছুক্ষণ বাদে সেই স্থান থেকে দৌড় দিয়ে গ্রামের ভিতরে নিরাপদ জায়গায় চলে যাই । ওদিকে ওই গ্রামের বাড়ির ভেতর থেকে 'আল্লাগো...পুলাগুলো মরলোগো..মহিলাকন্ঠে এমন কথা শুনতে পাই । কিছুক্ষণের মধ্যে পাকসেনাদের একটি জিপগাড়ি ওই এলাকায় এসে পাবলিককে মারধর করে সন্দেহভাজন কিছু মানুষকে ধরে নিয়ে যায় । আসলে এটি ছিল গেরিলা মুক্তিসেনাদের পাতানো একটি শক্তিশালি মাইন যা থেকে সেই যাত্রায় আমরা পাঁচ শিশুকিশোর দৈবক্রমে নিজবুদ্ধিবলে বেঁচে গিয়েছিলাম ।
দৃশ্যপট-৬ :
- পাকসেনাদের ছোড়া বোমার শব্দ । আমরা দুপুর বেলায় উচু ভিটের এক মসজিদের ধারে ২০/৩০ জন সবাই শুয়ে জান বাঁচানোর চেষ্টায় লিপ্ত ।মসজিদ সংলগ্ন ছোট্ট পুকুর । সৈন্যদের বোমা ছোড়ার সময় একটি শব্দ হয়- সেই শব্দ শুনতে পেলেই আমার এক বয়স্ক দাদু প্রতিবার ‘আল্লাহু আকবার’ বলে পুকুরে ঝাঁপ দেন ।তীব্র বেগে বোমা কাছাকাছি পড়ে বিস্ফোরণ হয়ে বোমার ছাড়া(গোলা)আশে পাশেই পড়তে থাকে । এই অবস্থা দীর্ঘ সময় চলতে থাকে এবং আমার সেই বয়স্ক দাদু প্রতিবারই পুকুরে ঝাঁপ দিতে থাকে । এত ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থাতেও এই দৃশ্য অবলোকন করে আমরা শিশু-কিশোরেরা সেই সময় হাসি আটকাতে পারিনি । সেই সময় বেশ কিছু গরু-ছাগলের মৃত্যুসহ ওই এলাকার এক ব্যবসায়ীর বৃদ্ধা মা বোমার আঘাতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন । এই ঘটনা মনে হলে আজো শরীরে শিহরণ জাগায় ….!!!
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
একটি বিশেষ স্মৃতি নিয়ে আমার মা'কে নিয়ে লেখা সেই দুঃসময়ের দুখের কাসিদা :
(**) এই কবিতাটি উনিশ'শো একাত্তুর- এ খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করা আমার বাস্তব জীবনের অনুভুতি নিয়ে আজ থেকে প্রায় ৩০/৩২ বছর আগে লেখা ৷ যে হায়েনা-পশুদের নিয়ে আমার তখনকার শিশুমনে ( আমার বয়স তখন ৭/৮ বছর হবে ) এই অনুভুতির জন্ম, তারা ছিল পাকিস্তানী হায়েনা ৷ আমার মনে আছে – ‘মুন্সি খান’ নামীয় একজন পাকসেনা হাবিলদার (যে অত্যন্ত অত্যাচারী ও বদমেজাজী , যে আমাদের শিশুদের দেখা পেলে উর্দু ভাষায় কি যেন বলতো এবং আমাদের মাঝে অনেকগুলো পাকিস্তানী পয়সা উপরে ছুড়ে মাড়তো এবং আমাদের পয়সা কুড়ানো দেখে একধরনের মজা পেত ) যে কিনা আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের কয়েকজন মহিলার সম্ভ্রমহানী করে ; সেই বিভৎস স্মৃতি-অনুভূতি নিয়ে আমরা কয়েকজন শিশু-কিশোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, এরপর সে আমাদের গ্রামে আসলে গ্রামের মধ্যে জঙ্গলের ভিতর পুরোনো কুয়া( স্থানীয় ভাষায় ‘বকাতী কুয়া' যার গভীরতা অনেক এবং সাপ-বিচ্ছুতে ভরপুর ; যেটি হিন্দুবাড়ির একটি পরিত্যক্ত ভিটায় অবস্থিত ) সেখানে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব ৷ পরবর্তীতে আমাদের সে প্লান আর বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়ে উঠেনি, কারণ , আমরা কয়েকদিন পরেই দুই-তিন ঘন্টার নোটিসে আমাদের প্রিয় গ্রাম ছেড়ে মুক্তাঞ্চলে পাড়ি জমিয়েছিলাম ৷ মনে আছে, আমাদের গ্রামের পার্শ্বে নদী পার হতেই দেখি আমার প্রিয় গ্রামখানি দাউ দাউ করে শত্রু সেনাদের দেয়া আগুনে জ্বলছে ৷ সেই বিভৎস স্মৃতি কখনো ভোলার নয়........ !!
।। দুরমুশ বচণ ।।(**)
- আহমেদ রুহুল আমিন ।
‘নিধুয়া পাথারে’ উড়া
অন্ধকার এলোচুলে,
সহস্র বছর ধরে ছুটছ তুমি
সম্ভ্রম বাঁচাবে বলে-
ও আমার বাংলা মাগো
ওমা বীরাঙ্গনা,
বুটপায়ে পিষ্টে দুরমুশ হলো
তোমার আঙ্গিনা-
ক্ষমা আমি করবোনা মাগো ওদের
- কিছুতেই ক্ষমা করবোনা ।।
যে আঁচল ঢেকে সন্তানেরে
মুখে তুলে দিতে 'স্তণ্য',
কাদা-ধুলো মাখা তা ঠোটের কোণে
মুখখানি তোমার আজ বিষন্ন ;
তোমার বদন ঘিরে উদ্যত কেন
হাজারো লক্ষ ফণা-
ক্ষমা আমি করেবানা মাগো ওদের
-কিছুতেই ক্ষমা করবোনা ।।
যে নিত্য সোহাগে উঠোন জুড়ে
হামাগুড়ি দেয় তোর বুকের মানিক,
কি যাদু বিনি এক সুতোর টানে
কোলে তুলে নিয়ে প্রাণ জুড়াও খানিক ;
সেই পরম মমতায় তোমার বুকে
ঘুমিয়ে পড়লো লাখো মুক্তিসেনা ;
ক্ষমা আমি করবোনা মাগো ওদের
-কিছুতেই ক্ষমা করবোনা ।।
তোমার পবিত্র কাবার কোলে যার
পড়েছে লোলুপ দৃষ্টি,
বিষমাখা খঞ্জর হেনে সেই চোখে
নামাবো অম্ল বৃস্টি ;
সেই শকুণ মুখেতে ছুঁড়ে মারি 'থু-থু'
বমনোচ্ছিস্ট ঘৃণা-
ক্ষমা আমি করবোনা মাগো ওদের
-কিছুতেই ক্ষমা করবোনা ।।
দূরমুখো মহা মুর্খরা তোমায়
করেছে প্রশ্নবিদ্ধ,
নরপশু ওরা একাত্তরের
হায়েনারই হস্তসিদ্ধ ।
জানি, তোমার উদার বুকে ঠাঁই তাদের
কোনদিনও'তো হবেনা ;
ক্ষমা আমি করবোনা মাগো ওদের
-কিছুতেই ক্ষমা করবোনা ।।
====≠=====================================
পঞ্চগড় জেলায় মুক্তিযুদ্ধ :
সীমান্ত পরিবেষ্টিত ও ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পঞ্চগড়ে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় জুড়ে সংঘটিত হয়েছে ব্যাপক যুদ্ধ।দেশের মোট ০৪টি মুক্তাঞ্চলের মধ্যে পঞ্চগড় জেলায় রয়েছে একটি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় এ মুক্তাঞ্চলটি যুদ্ধের গতি প্রকৃতি নির্ণয়ে ও পরিকল্পনা প্রণয়নে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখেছে।পঞ্চগড়ের ইতিহাসে ১৯৭১ সালে ১৭ই এপ্রিল একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিন পাক- বাহিনী দখল করে নেয় পঞ্চগড়। জ্বালিয়ে দেয় সাজানো গুছানো পঞ্চগড় শহর এবং হত্যাযজ্ঞ চালায় নির্বিচারে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পঞ্চগড় জেলা ৬নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সাব সেক্টরটির বে-সামরিক উপদেষ্টা হিসাবে দাযিত্ব পালন করেছিলেন তৎকালিন প্রাদেশিক পরিষদের সংসদ সদস্য এ্যাড.সিরাজুল ইসলাম ।
এ্যাড.সিরাজুল ইসলাম, এ্যাড.কমরউদ্দিন আহমেদ(এম এল এ), এ্যাড. মোশারফ হোসেন চৌধুরী (এম এল এ), কাজী হাবিবর রহমান, খোরশেদ আলম, আব্দুল জব্বার সহ প্রমুখের নেতৃত্বে সে সময় মুক্তিযোদ্ধারা সংঘঠিত হবার পর ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সময় এই এলাকায় ৭টি কোম্পানীর অধীনে ৪০টি মুক্তিযুদ্ধ ইউনিট পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধা কোম্পানী কমান্ডারদের মধ্যে মাহবুব আলমের নাম উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য কমান্ডাররা হলেন, মোঃ মতিয়ার রহমান, মোঃ তরিকুল ইসলাম,মোঃ মোকলেছার রহমান, মোঃ দুলাল হোসেন, আব্দুর রহমান এবং আব্দুল গণি। এ ছাড়া বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বি এল এফ) এর আঞ্চলিক কমান্ডার ছিলেন বিশিষ্ট ছাত্র নেতা নাজিম উদ্দীন আহমেদ।
১৯৭১ এর নভেম্বর মাসের ২৮ তারিখে মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনী পাক সেনাদের উপর বেশ জোরালো ভাবে আক্রমন করে বসে। সেদিনের সেই ঝড়ো আক্রমের মধ্যে দিয়েই ১৯৭১সালের ২৯শে নভেম্বর পাক হানাদারসেনাবাহিনী মুক্ত হয় এ অঞ্চল। সম্পূর্নভাবে স্বাধীনতার স্বাদ সেদিনই প্রথম পেয়ছিলো এই তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার অন্তর্গত এই থানাটির মানুষেরা ।(**)
জেলা প্রশাসন আয়োজিত মহান বিজয় দিবস ২০১৬ এর অনুষ্ঠানে পঞ্চগড় বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম স্টেডিয়ামে নির্দিষ্ট আসনে আসিন সমবেত পঞ্চগড়ের সুর্যসন্তানেরা.... যাঁরা একদিন জীবন বাজি রেখে এই এলাকায় আমাদের বিজয়ের সুর্য ছিনিয়ে এনেছিল .....তাঁদের কিয়দাংশ । হয়তো , এই প্রজন্ম তাঁদের আরো অল্প কিছুদিন চাক্ষুষ দেখতে পারবে ! এর মধ্যে বেশ কয়েকজন চেনামুখ পরপারে পাড়ি দিয়েছেন । বিশেষ করে, পঞ্চগড়ের সুপরিচিত মুখ সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা এস এম লিয়াকত আলী ছিলেন সর্বজনবিদিত একজন সম্মানী ব্যাক্তিত্ব । মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত তাঁর অস্ত্র ও গুলি রাখার ব্যাগটি ঢাকার সেগুনবাগিচাস্থ মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে তাঁর নামে সংরক্ষণ করা হয়েছে যা যুগে যুগে তাঁর বীরত্ব গাঁথা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম স্মরণ করবে। মহান বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীতে বিজয়ের এই দিনে তিনিসহ প্রয়াত সকল মুক্তিযোদ্ধাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি ।
'''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''”"""""""""""""""""""""""""""""""""
"ওঁদের চোখে এমন দিনের স্বপন ছিল-
ওঁদের মুখে ভাবনা ভাষা গোপন ছিল-
এদেশ, মাটি, মাতৃকতা ওঁদের বুকে ,
'জীবন বাজির অঙ্গীকার বীজ' বপণ ছিল ।।"
‘পঞ্চগড়ের মুক্তিযুদ্ধ’- তথ্য সূত্র : বাংলাদেশের উইকিপিডিয়া ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১:৩২

রাজীব নুর বলেছেন: পোষ্ট পড়ি নি। তবে ছবি গুলো মন দিয়ে দেখেছি।

২| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ৮:১০

আহমেদ রুহুল আমিন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ মন দিয়ে ছবিগুলো দেখার জন্য । তবে, একসময় পড়ে নিবেন জীবন থেকে নেয়া বাস্তব জীবনের গল্প জানার জন্য, যদি সময় এবং ধৈর্য্য থাকে ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.