নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শাহাবুদ্দিন শুভ

শাহাবুিদ্দন শুভ

শাহাবুদ্দিন শুভ লেখালেখির নেশাটা ছাড়তে পারিনি। তাই এক সময় জড়িয়ে গেলাম সাংবাদিকতায়। কাজ করেছি দেশ ও দেশের বাহিরের পত্রিকাতে। আর এখন পুরোপুরি একজন ব্যাংকার স্বত্ব সংরক্ষিত e-mail- [email protected] ০০৮৮ ০১৭১৬ ১৫৯২৮০ e-mail- [email protected] +৮৮ ০১৭১৬১৫৯২৮০

শাহাবুিদ্দন শুভ › বিস্তারিত পোস্টঃ

সিলেট বিভাগের পরিবহন নৈরাজ্য: হবিগঞ্জ এক্সপ্রেস

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ১১:৪০


শাহাবুদ্দিন শুভ:: বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবহন খাতে নানা অনিয়ম ও একচেটিয়া আধিপত্যের চিত্র আমরা প্রায়ই দেখি। তবে সিলেট-হবিগঞ্জ রুটে যে পরিবহন নৈরাজ্য চলছে, তা দীর্ঘদিন ধরে যাত্রীদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষ করে হবিগঞ্জ এক্সপ্রেস নামে একটি পরিবহন সংস্থা এ রুটে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে, যেখানে অন্য কোনো বাস সার্ভিস টিকতে পারেনি বা টিকে থাকার সুযোগ পায়নি। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বহুবার নতুন বাস সার্ভিস চালু করার চেষ্টা করা হলেও, নানা কৌশলে তা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে।

এই পরিস্থিতি শুধু যাত্রীসাধারণের জন্য নয়, বরং সিলেট বিভাগের সমগ্র যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্যই একটি বড় সংকট। যাত্রীসেবা, ভাড়ার স্বচ্ছতা, যাতায়াতের সুবিধা, এমনকি পরিবহন নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতির পেছনে মূল কারণ কী? কেন সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না? এই নিয়েই আজকের বিশ্লেষণ।

হবিগঞ্জ এক্সপ্রেসের একচেটিয়া আধিপত্য: হবিগঞ্জ এক্সপ্রেস শুধু একটি বাস কোম্পানির নাম নয়, এটি এক ধরনের পরিবহন সিন্ডিকেট হিসেবে কাজ করছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে শুধু একটি নির্দিষ্ট রুট নয়, বরং পুরো সিলেট বিভাগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়কও আছে। বিশেষ করে হবিগঞ্জ-শায়েস্তাগঞ্জ-আউশকান্দি-শেরপুর,শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার হয়ে সিলেট যাওয়ার প্রধান রুটটি তাদের একক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

যখন ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বাইপাস চালু হয়, তখন অনেকে ধারণা করেছিলেন যে এই রুটে নতুন বাস চালু হবে, প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং যাত্রীসেবা উন্নত হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, হবিগঞ্জ এক্সপ্রেস কোনো প্রতিযোগী তৈরি হতে দেয়নি। এই রুটে নতুন কোনো বাস চালু হলেই বিভিন্নভাবে তা প্রতিহত করা হয়। কখনো হুমকি, কখনো ফিজিক্যাল আক্রমণ, আবার কখনো রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নতুন প্রতিযোগীদের নির্মূল করা হয়। এমনকি সরকারি বিআরটিসি বাস চালু করার চেষ্টা হলেও, হবিগঞ্জ এক্সপ্রেসের সিন্ডিকেটের কারণে সেটি সফল হয়নি।

বিআরটিসি বাস চলাচল শুরু ও ব্যর্থতা : ০৫ জুলাই ২০২০ সালের রোজ রবিবার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারী, অতিরিক্ত সচিব ও বিআরটিসির তৎকালীন চেয়ারম্যান মোঃ এহছানে এলাহী ও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আনোয়ার হোসেন চৌধুরী নিয়ে সিলেটের উন্নয়ণ বিষয়ক আলোচনার আয়োজন করা হয় সিলেটপিডিয়াতে। সেখানে সিলেটপিডিয়ার পক্ষ থেকে সঞ্চালক হিসেবে বিআরটিসি চেয়ারম্যানের কাছে হবিগঞ্জ এক্সপ্রেস বাসের নৈরাজ্য নিয়ে প্রশ্ন করে বিআরটিসি বাস চলাচলের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে কথা বললে তিনি সিলেটপিডিয়াকে আশ্বস্ত করেন যে এই রোডে তিনি বাস চলাচলের উদ্যোগ নিবেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২২ ডিসেম্বর ২০২০ থেকে বিআরটিসি বাস চলাচল শুরু হয়। কিন্তু এটি বেশিদিন টেকেনি। হবিগঞ্জ এক্সপ্রেসের মালিক-শ্রমিকরা বিআরটিসির কাউন্টার ভাঙচুর করে, চালকদের ভয় দেখিয়ে এবং স্টাফদের মারধর করে তাদের কার্যক্রম ব্যাহত করে। ফলে কিছুদিনের মধ্যে বিআরটিসি বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়

প্রতিযোগিদের দমন
:: হবিগঞ্জ-সিলেট রুটে হবিগঞ্জ সুপার এক্সপ্রেস নামে একটি কোম্পানি বেশ কয়েকটি বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু হবিগঞ্জ এক্সপ্রেসের প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা এই রুটে টিকতে পারেনি। তাদের গাড়িগুলো ভাঙচুর করা হয় এবং হবিগঞ্জ শহরে ঢুকতে বিভিন্নভাবে বাধা সৃষ্টি করা হয়। এতে করে হবিগঞ্জ এক্সপ্রেসের সাহস আরও বেড়ে যায়। এমনকি ২২ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে সরকারি বিআরটিসি বাস চলাচল শুরু করলেও, একইভাবে বাস চলাচল বন্ধ করার জন্য তারা যা যা করা দরকার, সবই করে। নিচের দুটি খবর থেকে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে:

বিডিনিউজ২৪, ২৫ নভেম্বর তাদের খবরে উল্লেখ করেন, ‘‘গত ২৬ অক্টোবর সংগঠন দুইটির নেতৃবৃন্দকে নিয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ প্রশাসনের বৈঠক হয়।’’ মন্ত্রী ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপেও এই রুটে কোনো বাস চলতে পারেনি বা চলতে দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে যখন বিআরটিসি বাস চলাচল শুরু করে, তখন তা চলতে দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন কাউন্টার ভাঙচুর, স্টাফদের মারধর করে হবিগঞ্জ এক্সপ্রেসের লোকজন।

সিলেটটুডে, ২৯ ডিসেম্বর ২০২০** খবরে উল্লেখ করেন, সোমবার বিকেল চারটা থেকে আড়াই ঘণ্টা সিলেট বিভাগীয় কমিশনার মো. মশিউর রহমানের সভাপতিত্বে সিলেট বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ, সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে পরিবহন শ্রমিক-মালিক সমিতি ও পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। ‘‘পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা সিলেট-শ্রীমঙ্গল ও হবিগঞ্জ সড়কে পর্যাপ্ত বাস রয়েছে বলে জানান। সেই সঙ্গে বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ বাস মালিক সমিতি ও শ্রমিক সংগঠনকে কোনোভাবে অবহিত না করেই হুট করেই এই দুই রুটে ১২টি বাস নামানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বিআরটিসি ইচ্ছে করলেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।’’ কত বড় একটি জঘন্য কথা—এই রোডে তাদের বাস আছে বলে তারা চলতে দিতে চায় না। এই রোড কি তাহলে মগের মুল্লুক?

জনদুর্ভোগ: এই একচেটিয়া ব্যবস্থার ফলে যাত্রীদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বাসের সংখ্যা কম থাকায় যাত্রীদের দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময় বাসে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে যায়, যার ফলে যাত্রীদের অস্বস্তিকর যাত্রা করতে হয়। পাশাপাশি একক সার্ভিস থাকায় গাড়ির বডি থেকে শুরু করে সিটের অবস্থা খুবই খারাপ। এমনকি সিটে বসে থাকার সময় লোহার কোনো অংশ পেছন দিয়ে ঢুকে যেতে দেখা যায়। সিটের কোনো কাপড় থাকে না, ময়লা এবং দুর্গন্ধযুক্ত। এছাড়াও বাসের সেবার মানও অনেক সময় নিম্নমুখী থাকে।

সিলেট থেকে হবিগঞ্জের দিকে যাওয়ার সময় শেরপুর, আউশকান্দি এবং পানিউন্দা বাজারে কেউ নামতে চাইলে তাদেরকে উঠতে দেওয়া হয় না এবং বলা হয় টিকেট নাই। এ নিয়ে কাউন্টারে এবং বাসের মধ্যে প্রায়ই মারামারি হয়। যদি কেউ শেরপুর, আউশকান্দি কিংবা পানিউন্দা যেতে চান, তাদেরকে হবিগঞ্জের টিকেট কেটে এই অল্প দূরত্ব যেতে হয়। যেহেতু এই রোডে আর কোনো বাস চলতে দেওয়া হয় না, তাই বাসের স্টাফ থেকে শুরু করে সবাই এই রুটের যাত্রীদের সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করে থাকে।



সরকারি উদ্যোগ ও ব্যর্থতা:: সরকারি পর্যায়ে এই সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেগুলো সফল হয়নি। বিআরটিসি বাস চালু করার চেষ্টা করলেও তারা হবিগঞ্জ এক্সপ্রেসের চাপে টিকতে পারেনি। সরকারি পর্যায়ে আরো কঠোর নজরদারি এবং ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন এই সমস্যা সমাধানের জন্য।



সম্ভাব্য সমাধান:: এই সমস্যা সমাধানের জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:

১. প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি: সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আরো বাস চালু করার ব্যবস্থা করতে হবে। এই রুটে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করলে যাত্রীদের সুবিধা হবে এবং সেবার মানও উন্নত হবে।

২. কঠোর নজরদারি: এই রুটে একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখার জন্য যে সকল অবৈধ কার্যকলাপ চালানো হয়, তার বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারি ও ব্যবস্থা নিতে হবে।

৩. যাত্রীদের সচেতনতা: যাত্রীদেরও এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। যাত্রীরা যদি একত্রিত হয়ে তাদের দাবি জানান, তাহলে এই সমস্যা সমাধানের পথ সুগম হতে পারে।

৪. সরকারি হস্তক্ষেপ: সরকারকে এই বিষয়ে আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে এবং এই রুটে পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

সিলেট-হবিগঞ্জ রুটে পরিবহন নৈরাজ্য দূর করে যাত্রীদের সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সরকার, পরিবহন সংস্থা এবং যাত্রীদের সমন্বিত উদ্যোগেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

সিলেট-হবিগঞ্জ রুটের পরিবহন নৈরাজ্য শুধু একটি বাস কোম্পানির আধিপত্য নয়, এটি প্রশাসনিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং আইনের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। যদি সরকার ও প্রশাসন সত্যিই যাত্রীদের স্বার্থ রক্ষায় উদ্যোগী হয়, তবে এই সংকট সমাধান সম্ভব। জনগণের চাপে এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই রুটে ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। তবে এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন না আসায় প্রশ্ন থেকেই যায়—এই নৈরাজ্য কি চিরস্থায়ী হবে, নাকি একদিন এর অবসান ঘটবে?

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.