নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লেখালেখি

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ তিনি ভালো নেই

০৫ ই জুন, ২০১৪ সকাল ৯:৪৬

পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে সাধারণত কুশল বিনিময় হয় এইভাবেঃ-

‘ভাই, কেমন আছেন?’

‘জি, ভালো’ অথবা, ‘আপনাদের দোয়ায় ভালোই আছি’ অথবা, ‘আছি একরকম’ অথবা নিদেনপক্ষে, ‘এই আছি’।

কিন্তু চাকরি জীবনে আমার এক সাব অর্ডিনেট কলিগ মোস্তফা সাহেবের সাথে দেখা হলে তিনি সব সময় গম্ভীর মুখে একটাই উত্তর দিতেন, ‘ভালো নেই,স্যার।’

‘কেন? ভালো নেই কেন? কি হয়েছে?’

মোস্তফা সাহেবের সোজা সাপটা জবাব, ‘অফিসে আসার আগে বাড়িওয়ালার সাথে ঝগড়া করে এলাম।’

‘কেন,ঝগড়া কেন?’

‘যখন তখন বাড়িভাড়া বাড়ালে ঝগড়া হবে না তো কি বাড়িওয়ালার সাথে কোলাকুলি হবে? আপনি নিজের বাড়িতে থাকেন তো, স্যার। এসব ঝগড়াঝাঁটি কেন হয় আপনি বুঝবেন না।’

কথা ঠিক। মোস্তফা সাহেবের জ্বালা যন্ত্রণা হেনা সাহেব বুঝবে কিভাবে?

আর একদিন আমার অফিসের হেড ক্লার্ক ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞেস করায় মোস্তফা সাহেব বললেন, ‘ভালো নেই।’

‘কেন, কেন? কি হয়েছে ভাই?’

‘আমার স্ত্রী রাগারাগি করে তার বাপের বাড়ি চলে গেছে।’

‘বলেন কি! তা’ ভাবী সাহেবার সাথে রাগারাগি হল কেন?’

মোস্তফা সাহেবের চাঁছা ছোলা জবাব, ‘এতো আঁটি ভেঙে শাঁস দিতে পারবো না।’

আর একদিন অফিস ক্যান্টিনের ম্যানেজারের কুশল বিনিময়ের উত্তরে মোস্তফা সাহেব একই জবাব দিয়ে বললেন, তাঁর দুই ছেলে নাকি সিগারেট খাওয়া রপ্ত করে ফেলেছে। এরপর তারা গাঁজা খাবে, হেরোইন খাবে। এ অবস্থায় তাঁর পক্ষে ভালো থাকা সম্ভব না।

কথায় যুক্তি আছে। এই অবস্থায় ভালো থাকা যায় না। এরপর একদিন আমাদের এক শাখা অফিসের ইনচার্জ একই প্রশ্ন করায় মোস্তফা সাহেবের একই উত্তর, ‘ভালো নেই।’

জানা গেল, এবার তাঁর ভাল না থাকার কারণ কাজে গাফিলতির জন্য তাঁকে অফিস থেকে শো কজ করা হয়েছে। এমন শো কজ অবশ্য তাঁকে মাঝে মাঝেই করা হয়ে থাকে। তবে এবার অফিসিয়াল প্রসিডিংস শেষে তাঁকে শাস্তিস্বরূপ অন্য জেলায় বদলি করা হল। নানারকম তয় তদবির করে এক বছরের মধ্যেই তিনি আবার তাঁর আগের অফিসে ফিরে এলেন। তাঁর সাথে দেখা হলে আমি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি মোস্তফা সাহেব, কেমন আছেন?’

‘ভালো নেই, স্যার।’

আমি ভয়ে ভয়ে আর কিছু না বলে নিজের কাজে মন দিলাম। মোস্তফা সাহেব নিজে থেকেই জানালেন, তাঁর একমাত্র মেয়ে ঊর্মিলা এক নেশাখোর বেকার ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে। তিনি নিজের মনেই একটানা বক বক করে চললেন, ‘শুনেছি পাগলও নাকি নিজের ভালো বোঝে। নেশাখোর হোক আর হারামখোর হোক, হাঁড়ির তলার মতো কালো একটা মেয়েকে তার পছন্দ হল কিভাবে এক আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা। এই ছেলে নেশা খেয়ে বদ্ধ পাগল হয়ে গেছে। বদ্ধ পাগল না হলে কেউ গু খায়?’

একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। মোস্তফা সাহেব নিজেও ঘোর কৃষ্ণবর্ণের। সুতরাং, তাঁর কন্যার গায়ের রঙ যে হাঁড়ির তলার মতো কৃষ্ণবর্ণের হবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নাই। অফিসের এ্যাকাউন্টস শাখায় মোস্তফা সাহেবের কিছু এরিয়ার বিল পাওনা ছিল। বিল ড্র করার পরদিন তাঁর মুখে হাসি দেখতে পাওয়ার কথা। কিন্তু ‘ভাই কেমন আছেন?’, ‘মোস্তফা সাহেব কেমন আছেন?’, ‘স্যার কেমন আছেন?’ ইত্যাদি সহকর্মীদের সবার প্রশ্নে তাঁর গম্ভীর মুখে একটাই উত্তর, ‘ভালো না।’

বিল পাওয়ার পরেও ভালো না কেন? জানা গেল, মোস্তফা সাহেবের শ্যালক আবদুল্লাহ মোটর সাইকেল এ্যাকসিডেন্ট করে গত রাতে মারা গেছে। অফিসে হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। টেবিলে রাখা ফাইলপত্রের মধ্যে মাথা গুঁজে মোস্তফা সাহেব হাউ মাউ করে কাঁদছেন আর থেকে থেকে বুক চাপড়াচ্ছেন। সহকর্মীরা সবাই তাঁকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। এমনকি,আমিও। মৃত্যুর মতো করুণ বিষয়কে অবশ্যই সমবেদনা ও সহানুভূতির চোখে দেখা উচিৎ এবং মৃতের আত্মীয় স্বজনকে সান্ত্বনা দেওয়া উচিৎ। কিন্তু শ্যালকের মৃত্যুতে কোন দুলাভাইকে এমন বুক চাপড়ে কখনো কাঁদতে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। বিশেষ করে শ্যালক আবদুল্লাহ তার দুলাভাই মোস্তফা সাহেবের অনেক টাকা পয়সা নয় ছয় করেছে। দুলাভাইয়ের মোবাইলে ফ্লেক্সি করে দেবে বলে সে টাকা নিয়ে পালিয়েও গেছে। শ্যালকের এই সব নোংরা কাজের জন্য মোস্তফা সাহেবের মুখে বহুবার ‘ভালো নেই’ কথাটা শুনতে হয়েছে আমাদের। শালা-দুলাভাইয়ের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ ছিল অনেকদিন। আর সেই শ্যালকের মৃত্যুতে দুলাভাইয়ের এমন মাতম! সত্যি মোস্তফা সাহেব মহৎ হৃদয়ের মানুষ। শ্যালকের সব দু’নম্বরি কাজ ভুলে গিয়ে তার জন্য শোক প্রকাশ করছেন। দুনিয়ায় এমন মানুষ ক’টা আছে?

২০০৬ সালে অবসরে যাওয়ার সময় আমাকে অফিস থেকে ফেয়ারওয়েল দেওয়া হল। মোস্তফা সাহেব আমার সেকশনের স্টাফ হওয়ায় মানপত্র পড়া ও গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা তাঁকে দেওয়া হয়েছে। তিনি আমার গলায় মালা পরানোর সময় আমি মৃদু হেসে চুপি চুপি বললাম, ‘ভালো আছেন?’

মোস্তফা সাহেব আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বললেন, ‘না স্যার,ভালো নেই। বাজারে আগুন, অথচ অফিসে দুটো উল্টা পাল্টা পয়সা কামাইয়ের সুযোগ নেই। আপনি রিটায়ার করে বেঁচে গেলেন স্যার। এখন মাস গেলে পেনশন পাবেন, গ্র্যাচুইটির টাকা ব্যাংকে রেখে মাসে মাসে লাভ পাবেন, টুক টাক ব্যবসাও করতে পারবেন। আর আমরা? জাঙ্গিয়া কিনলে পায়জামার পয়সা নেই। ইজ্জত নিয়ে টানাটানি।’

এরপর গত পাঁচ বছরে মোস্তফা সাহেবের সাথে আমার দু’বার দেখা হয়েছে। ২০০৮ সালে একবার, আর এই এক সপ্তাহ আগে একবার। দু’বারই তিনি ভালো ছিলেন না। প্রথমবার তিনি ভালো ছিলেন না স্ত্রী বিয়োগের কারণে। আর দ্বিতীয়বার মানে এক সপ্তাহ আগে বাজারে দেখা হলে তিনি বললেন, ‘ভালো কি করে থাকবো, স্যার? গত বছর রিটায়ার করলাম। আর এ বছর সরকার চাকরির সময়সীমা আরও দু’বছর বাড়িয়ে দিল। কেন বাবা, এক বছর আগে বাড়ালে ক্ষতিটা কি ছিল? আরও দু’বছর চাকরি করতে পারতাম।’

আমি বললাম, ‘আপনি একা মানুষ। পেনশনের টাকায় বেশ তো চলে যাওয়ার কথা।’

জীবনে প্রথমবার মোস্তফা সাহেবের মুখে হাসি দেখলাম। কেমন যেন লাজুক লাজুক হাসি। বললেন, ‘স্যার যে কি বলেন না! একা হতে যাবো কেন? দ্বিতীয় পক্ষ ঘরে আছে না! বুড়ো বয়সে বিবি না থাকলে খুব সমস্যা। ঊর্মিলার মা ইন্তেকাল করার পর তাই..........।’

***************

(এই গল্পটি মাসিক উত্তর বার্তা পত্রিকার ডিসেম্বর/২০১২ সংখ্যায় প্রকাশিত। ব্লগার বন্ধুরা যারা পড়েননি, তাদের জন্য ব্লগে প্রকাশ করলাম।)

মন্তব্য ১৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১০:০২

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:

সুন্দর একটি গল্প সুপ্রিয় আবুহেনা ভাই।

শুভকামনা সব সময়ের জন্য।

০৫ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১০:০৬

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ, ভাই কাণ্ডারি অথর্ব।

শুভেচ্ছা রইল। ভালো থাকবেন।

২| ০৫ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১০:০৭

ঢাকাবাসী বলেছেন: সুন্দর গল্প!

০৫ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১০:১৭

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ, প্রিয় ঢাকাবাসী।
ভালো থাকবেন। শুভকামনা রইল।

৩| ০৫ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১০:১২

এন ইউ এমিল বলেছেন: বেচারার জন্য কষ্ট হলো

০৫ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১০:১৮

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ, ভাই এন ইউ এমিল।

শুভেচ্ছা রইল। ভালো থাকবেন।

৪| ০৫ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১১:০৮

এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত বলেছেন: গল্পটা পড়ে খুবই ভাল লাগল। আপনার এই গল্পটি পড়ে আমার মনে একটি প্রশ্ন জেগেছে, আর তা হল আসলেই কি আমরা ভাল আছি।

০৫ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১২:৫০

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ভাই আশিকুর রহমান, যদি আমাকে উত্তর দিতে বলেন, তাহলে বলবো, না, আমরা কেউ ভালো নেই।
গল্পটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা রইল।

৫| ০৫ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১২:৪২

মামুন রশিদ বলেছেন: ভালো থাকুক সবাই । গল্প ভালো লেগেছে ।

০৫ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১২:৫১

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ, ভাই মামুন রশিদ।

৬| ০৫ ই জুন, ২০১৪ রাত ৮:৫৯

হাসান মাহবুব বলেছেন: চমৎকার লেখার গাঁথুনি আপনার। শুরু করলে শেষ না করে উপায় নেই। তবে ফিনিশিংটা ঠিক গল্পের ফ্লো এর সাথে যায় না।

০৬ ই জুন, ২০১৪ সকাল ৮:৩৬

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: মূল্যবান মতামতের জন্য ধন্যবাদ, ভাই হাসান মাহবুব।

শুভেচ্ছা রইল। ভালো থাকুন।

৭| ০৭ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৫

শুঁটকি মাছ বলেছেন: ভালো থাকার প্রধান উপায় হল আত্মতুষ্টি। ওটা না থাকলে পৃথিবীর সব সুখ পায়ের কাছে এনে রাখলেও ভালো থাকা যায় না।

(কালকে কমেন্ট দিয়ে গেছিলাম। ঐটা মনে হয় সামু পাগলাটা হাপিস করে দিছে। আজকে আবার দিয়ে গেলাম।)

০৭ ই জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:০৯

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: সামু পাগলা মাঝে মাঝে এমন করে। হাঃ হাঃ হাঃ।

আপনি ঠিকই বলেছেন। ভালো থাকা নির্ভর করে নিজের ওপর। ধন্যবাদ, শুঁটকি মাছ।

৮| ০৮ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৪:৫৮

আর্টিফিসিয়াল বলেছেন: তবে গল্পটা ভালো হইছে.।.।.।.।.।।

০৮ ই জুন, ২০১৪ বিকাল ৫:২৪

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ, আর্টিফিসিয়াল।

৯| ১৭ ই জুন, ২০১৪ রাত ১২:১৩

এহসান সাবির বলেছেন: ভালো লেগেছে।

১৭ ই জুন, ২০১৪ ভোর ৬:৪২

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ, ভাই এহসান সাবির।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.