নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লেখালেখি

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ ঘুষ

২২ শে জুন, ২০১৪ সকাল ৭:৩১

ধরুন, চাকরি করতে করতে কোন কারণে আপনার চাকরি চলে গেল (আল্লাহ না করুন), তখন আপনি কী করবেন? আর একটা চাকরি জোগাড়ের চেষ্টা করবেন অথবা ব্যবসা বানিজ্য করার চেষ্টা করবেন। এই তো? নিশ্চয় কোন খারাপ কাজ করে রোজগারের চেষ্টা করবেন না। কেউ কেউ যে এমন খারাপ কাজ করেন না, তা’ নয়। অভাব অনটনে পড়ে ফেরেশতার মতো মানুষকেও আমি শয়তান হয়ে যেতে দেখেছি। কিন্তু আমার বন্ধু আব্দুর রউফ এই তিনটি কাজের একটিও না করে তিরিশ বছর বহাল তবিয়তে ছিল। কীভাবে, শুনবেন?

শুনুন তাহলে! আব্দুর রউফ রোড এ্যান্ড হাইওয়েজের সাব এ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ছিল। ঘুষ কেলেঙ্কারিতে তার চাকরি চলে যায়। সেটা খুব সম্ভবতঃ ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের সামরিক শাসনামলের ঘটনা। আব্দুর রউফ তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসে ওঠে। ব্যস্, চাকরি চলে যাওয়ার পর তাকে এই কষ্টটুকুই শুধু করতে হয়েছিল। বাঁকি জীবনে সে আর কিছুই করেনি।

শ্বশুর একই ডিপার্টমেন্টের রিটায়ার্ড এক্স এন। চাকরি জীবনে প্রচুর ঘুষ খেয়েছেন। শহরে পাঁচ তলা বাড়ি, ফ্ল্যাট, মার্কেট এসব করার পরেও তার টাকা শেষ হয় না। তিনি জামাইকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, মিলিটারি গভর্নমেন্ট চলে গেলে তিনি চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে ঘুষ দিয়ে আবার চাকরি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবেন। এমন সোনার ডিম পাড়া রাজহংসের মতো চাকরি এভাবে চলে যেতে দেওয়া যায় না। কিন্তু মিলিটারি গভর্নমেন্ট চলে যাওয়ার আগে তিনি নিজেই পরপারে চলে গেলেন। ফলে আব্দুর রউফের চাকরি আর হলো না। সে তখন শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে আর খায়।

তার একটি মাত্র শ্যালক। সে আবার যাচ্ছে তাই প্রতিবন্ধী। সারাদিন তার মুখ থেকে লালা ঝরে। বাথরুমের দরজা খোলা রেখে সে বড় কাজ করে। বয়স বারো তের বছর হলেও সে ছোট কাজ আটকে রাখতে পারে না। যখন তখন কাপড় চোপড় ভিজিয়ে ফেলে। শাশুড়ি প্যারালাইসিসের রোগী। আব্দুর রউফের পোয়াবারো। সে শ্বশুরের মার্কেট ও বাড়িভাড়া এবং ব্যাংকে জমানো টাকা পয়সা তুলে রাজকীয় হালে খরচ করতে থাকে। শ্বশুর শাশুড়ির কিছু উড়ো আত্মীয়স্বজন মাঝে মাঝে এসে ঝামেলা করে। আব্দুর রউফ স্ত্রীর সহযোগিতায় সেসব ঝামেলা পোশাক থেকে ধুলো ঝাড়ার মতো করে ঝেড়ে ফেলে দেয়। পোশাকের কিছু কিছু দাগ সহজে উঠতে চায় না। সেসব ক্ষেত্রে আব্দুর রউফ সনাতন ব্লিচিং পাউডার (অর্থাৎ, ঘুষ)–এর আশ্রয় নেয়। সে পুলিশকে ঘুষ দেয়। পুলিশ থানায় নিয়ে মার ধোর ও মামলার ভয় দেখানো থেরাপি প্রয়োগ করে। ফলে কঠিন দাগও পরিষ্কার হয়ে যায়।

আব্দুর রউফের শ্বশুর শাশুড়িকূলের আত্মীয়স্বজন গ্রামের লোক। তারা মামলা মোকদ্দমাকে যমের মতো ভয় করে। ‘ও হরি! ক্ষ্যামা দাও’-এই সাহস নিয়ে তারা আর শহরমুখো হওয়ার চেষ্টা করে না। তবে আব্দুর রউফের এক চাচাশ্বশুর ভীষণ টাউট। তার আবার বিদেশ যাওয়ার বাতিক। দীর্ঘ আট দশ বছর সে কাঁঠালের আঠার মতো আব্দুর রউফের পিছে লেগে রইল। আব্দুর রউফ নিজেও কম টাউট নয়। সে দুই লাখ টাকা খরচ করে ১৯৯৬ সালে চাচাশ্বশুরকে অবৈধ পথে সাইপ্রাসে পাঠিয়ে দিল। সেখান থেকে ফিরে আসা এত সহজ নয়। ধরা পড়ে ব্যাটা সাইপ্রাসের জেলে পচে মরুক!

তিরাশি সাল থেকে দু’হাজার সাল পর্যন্ত মোটামুটি এভাবেই চললো। শ্বশুরের জমানো টাকা শেষ হয়ে গেল। বাড়ি ও মার্কেটের ভাড়া দিয়ে আব্দুর রউফের রাজকীয় খাই-খরচায় কিছু টানাটানি হয়। এক বোতল ভদকা বা স্কচের দামই তো তিন হাজার (নাকি পাঁচ হাজার?) টাকা। তার ওপর তার জুয়া খেলার নেশা। টানাটানি হবে না কেন,বলুন? সে একে একে মার্কেটের দোকান গুলো বিক্রি করে দিতে লাগলো। ২০০৫ সালের দিকে পুরো মার্কেট সাফা হয়ে গেল। আব্দুর রউফ দেনার দায়ে শ্বশুরের পাঁচ তলা বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠলো।

এ বছর জানুয়ারি মাসে আব্দুর রউফের সাথে আমার দেখা হলো। সে সময় তার সাথে আমার যেসব কথাবার্তা হয়েছিল, তা’ এরকমঃ

‘এখনো তো তোমার শ্বশুরের ফ্ল্যাটেই আছো, নাকি?’

‘আরে না! ওটা কবে বেঁচে দিয়েছি!’

‘তাহলে কী নওগাঁ চলে গেছ?’ (আব্দুর রউফের দেশের বাড়ি নওগাঁ)

‘আরে না! সেখানে কী বাড়িঘর কিছু আছে নাকি? দু’কাঠা জমি নিয়ে আমার চার ভাইবোন রোজ মারামারি করে। সেখানে কী যাওয়ার উপায় আছে?’

‘তাহলে?’

‘তাহলে আবার কী? ভাড়া বাসায় আছি।’

‘বলো কী? তোমার এত টাকা পয়সা বিষয় সম্পত্তি উচ্ছন্নে গেল কীভাবে? তাস আর বোতল এখনো চলে নাকি?’

‘ছিঃ ছিঃ, কী যে বলো না! এই বুড়ো বয়সে ওসব পাপের কথা আর বলো না তো!’

‘তোমার ছেলেমেয়ে যেন কয়টা?’

‘দুই ছেলে, এক মেয়ে। আরে, ওই মেয়েটার জন্যেই তো আমি শেষ হয়ে গেলাম। মেয়ের বিয়ে দিয়ে এমন একটা জামাই পেয়েছে যে কী আর বলবো! কোন্ হাভাতে ঘরের পোলা, কে জানে? তাকে টাকা পয়সা দিতে দিতে আমি ফতুর হয়ে গেলাম।’

‘তা’ তোমার ছেলে দুটো এখন কী করে?’

‘বড়টা চাকরি করে, আর ছোটটা তো হেরোইন খেয়ে শেষ। এই হারামজাদা আমার আগেই ইন্নালিল্লাহ হবে।’

‘বলো কী? আহা! ছেলেটার এই দশা! তা’ তোমার বড় ছেলেটি কী চাকরি করে?’

‘ও চাকরির কথা আর বলো না। এত লেখাপড়া শিখে চাকরি করছে বীমা কোম্পানিতে।’

‘ভালো তো।’

‘কীসের ভালো? নিজের বউ ছেলের মুখে ভাত দিতে পারে না। চাকরিতে এক পয়সা ঘুষ নাই। ফকিরের ভিক্ষার মতো শুধু বেতন দিয়ে কী সংসার চলে?’

ভেবে দেখুন, আব্দুর রউফের ছেলের ঘুষ নাই। কী মর্মান্তিক! ১৯৮৩ থেকে ২০১৩-মাত্র ত্রিশ বছরে গনেশ উল্টে গেছে।

*********************************************

মন্তব্য ১৮ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ১২:০৮

মামুন রশিদ বলেছেন: এরেই বলে নির্মম বাস্তবতা । সময় ঠিকই তার প্রতিশোধ নিয়ে নেয় ।

২২ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ২:২১

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: একদম সঠিক উপলব্ধি। সময় ঠিকই তার প্রতিশোধ নিয়ে নেয়। অবৈধ পয়সার লোভে মানুষ সেটা উপলব্ধি করতে পারেনা। ফলে তার পরিণতি হয় আব্দুর রউফের মতো।

ধন্যবাদ, ভাই মামুন রশিদ।

২| ২২ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৩

আহসানের ব্লগ বলেছেন: ভাল লিখেছেন

২২ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ২:২২

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ, ভাই আহসানের ব্লগিং।

৩| ২২ শে জুন, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৬

ডি মুন বলেছেন: পোশাকের কিছু কিছু দাগ সহজে উঠতে চায় না। সেসব ক্ষেত্রে আব্দুর রউফ সনাতন ব্লিচিং পাউডার (অর্থাৎ, ঘুষ)–এর আশ্রয় নেয়। সে পুলিশকে ঘুষ দেয়। পুলিশ থানায় নিয়ে মার ধোর ও মামলার ভয় দেখানো থেরাপি প্রয়োগ করে। ফলে কঠিন দাগও পরিষ্কার হয়ে যায়।

গল্প ভালো লেগেছে। বর্ননাভঙ্গি চমৎকার ।

২২ শে জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:১৩

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ, ভাই ডি মুন। আমার আগের ও পরের লেখাগুলি পড়ার আমন্ত্রন রইল।

৪| ২২ শে জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩১

প্রবাসী পাঠক বলেছেন: যেমন কর্ম তেমন ফল।

২২ শে জুন, ২০১৪ রাত ৮:৩৩

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ, প্রবাসী পাঠক।

৫| ২২ শে জুন, ২০১৪ রাত ৯:১৬

জাফরুল মবীন বলেছেন: পাপ বাপকেও ছাড়ে না।নিউটনের তৃতীয় সূত্র শুধু পদার্থবিদ্যায় নয় জীবনের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।আশা করি আপনি ভালো আছেন হেনা ভাই।

২৩ শে জুন, ২০১৪ সকাল ৭:৩৫

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: আমি ভালো আছি। চমৎকার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, ভাই জাফরুল মবীন।

৬| ২২ শে জুন, ২০১৪ রাত ১১:১১

নীল জোসনা বলেছেন: মন খারাপ নিয়ে গল্পটা পড়তে বসেছিলাম । পড়ার পর মনে খুব শান্তি পাচ্ছি ।

বরাবরের মতোই ভালো লেখা ।

২৩ শে জুন, ২০১৪ সকাল ৭:৩৮

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: গল্পটি পড়ার পর আপনি মনে শান্তি পেয়েছেন জেনে আমারও ভালো লাগছে।

ধন্যবাদ, নীল জোসনা।

৭| ১৪ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ১১:৪০

নাভিদ কায়সার রায়ান বলেছেন: আমার কাছে সততার আরেক নাম মানসিক দৃঢ়টা। শুধু ঘুষ না খেলেই যে আপনি সৎ তা কিন্তু না। অফিসে ফাকি দেয়াটাও ওয়ান কাইন্ড অফ চুরি বলা যায়।
শ্বশুরের ঘুষের টাকা ভদ্রলোক এতো দ্রুত শেষ করেছেন বলে একটা মেডেল দাবি করতে পারেন। গল্পের এই জায়গাটা একটু দুর্বল লেগেছে। আরেকটু "কিছু একটা" দরকার ছিল বলে মনে হল।

১৪ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১২:০৫

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ, ভাই নাভিদ কায়সার রায়ান। আপনি ঠিকই বলেছেন। শুধু ঘুষ না খাওয়াটাই সৎ ব্যক্তির পরিচয় হতে পারে না। এ জন্য আমাদের ধর্মে (হাদিসে) আছে, "যে ব্যক্তি কর্মে, কথায় ও চিন্তায় সৎ নয়, সে প্রকৃতপক্ষে সৎ নয়'।
আব্দুর রউফের জুয়া খেলা ও মদ খাওয়ার নেশা ছিল, যা গল্পে উল্লেখ করা হয়েছে। জুয়া খেলা এমন একটা নেশা, যা মানুষকে রাতারাতি ফকির বানিয়ে দিতে পারে। অবাঙ্গালী উর্দুভাষীরা বলতো, "জুয়া, কাভি কিসিকো নেহি হুয়া'। আব্দুর রউফের ক্ষেত্রে তো ফকির হতে তবু ত্রিশ বছর সময় লেগেছে। আমার মনে হয়না যে, একজন পাঁড় জুয়াড়ির পক্ষে তার শ্বশুরের ধন সম্পদ উড়িয়ে দিয়ে ফকির হয়ে যাওয়ার জন্য ত্রিশ বছর খুব কম সময়।
গল্পটি পড়ে চমৎকার মন্তব্যের জন্য আবারো ধন্যবাদ।

৮| ০২ রা আগস্ট, ২০১৪ রাত ৮:৩১

মহামহোপাধ্যায় বলেছেন: সময়ের চাকা এভাবেই ঘোরে। দিন এভাবেই বদলায়। ভাল লাগলো।

০২ রা আগস্ট, ২০১৪ রাত ৯:১৫

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ, মহামহোপাধ্যায়।

৯| ০২ রা আগস্ট, ২০১৪ রাত ৯:১৮

ফেরারী আউট-ল বলেছেন: দারুন একটা গল্প। ভাললাগল।

০২ রা আগস্ট, ২০১৪ রাত ১০:৪৫

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ, ফেরারী আউট-ল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.