নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লেখালেখি

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্মৃতিচারণঃ ওপরওয়ালা

২৭ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:২০

চাকরিজীবনে আমার কিছু অম্লমধুর অভিজ্ঞতার কথা শুনুন। চাকরিতে ঢোকার মাত্র কয়েক মাস পরে আমাদের এক কলিগ বললেন, ‘হেনা সাহেব, আপনারা ইয়ংম্যান। অফিস ডেকোরাম মানতে চান না। কিন্তু এটা তো সরকারি অফিস। নিয়ম কানুন মেনে না চললে আপনার সমস্যা হতে পারে।’

আর একজন বললেন, ‘ভাই, চাকরি মানে চাকরের কাজ। চাকরের কোন স্বাধীনতা থাকেনা। ওপরওয়ালা যা বলবে, বিনা প্রশ্নে তা মেনে চলতে হবে। সরকারি অফিসে দুটো অলিখিত রুল আছে। রুল নাম্বার ওয়ান-বস ইজ অলওয়েজ রাইট। রুল নাম্বার টু-ইফ ইউ থিংক দ্যাট বস ইজ নট রাইট, দেন প্লিজ সি রুল নাম্বার ওয়ান। চাকরি করতে চাইলে হাংকি পাংকি ছেড়ে রেগুলার হোন। না হলে কিন্তু খবর আছে।’

আর একজন সিনিয়র বড়ভাই মোস্তাইন বিল্লাহ সাহেব বললেন, ‘হেনা সাহেব, এদের কথা শুনে বিভ্রান্ত হবেন না। এই ডিপার্টমেন্টে নতুন যারা আসে, তাদেরকে এরা এভাবেই ভয় দেখায়। ওপরওয়ালারা নিজেরাই অফিস ডেকোরাম মানেনা। চাকরি যখন করছেন, তখন আস্তে ধীরে সবই বুঝতে পারবেন। আপনি তরতাজা শিক্ষিত যুবক। এদের কথা শুনে ঘাবড়াবেন কেন?’

এইরকম ভয় ভীতি আর সাহসের যোগানের মধ্যে কয়েক বছর কেটে গেল। তেমন কোন বিপদ আপদের দেখা পেলাম না। তবে এ্যাকাউন্টেন্ট হওয়ার পর আমার ঘাড়ের আশেপাশে বিপদের ঘণ্টা বাজতে লাগলো। অফিসারদের টি এ, ডি এ, বিল এবং ঠিকাদারদের বিলে নানারকম অনিয়ম। বরাদ্দকৃত বাজেটের অতিরিক্ত খরচ। ভুয়া ওভারটাইম বিল। উপযুক্ত বিল ভাউচারের অভাব। বিল পাস না করে আটকে দিলে ওপরওয়ালাদের ধমক আর ঠিকাদারদের হাত কচলানো প্রলোভন। আমি কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে এ্যাজ পার রুলস এ্যান্ড রেগুলেশনস কাজ করে যেতে লাগলাম।

প্রথম ধাক্কাটা এলো বদলী অর্ডারের মাধ্যমে। আমি বদলী হয়ে চলে গেলাম নতুন কর্মস্থলে। সেখানেও কম বেশি একই অবস্থা। আমিও আপোষহীন নেত্রীদের মতো অনড়। দুই বছরের মধ্যে সাত বার বদলী হলাম। মোস্তাইন বিল্লাহ সাহেবের সাথে দেখা করে বললাম, ‘বড়ভাই, আর তো পারি না।’
বিল্লাহ সাহেব হেসে বললেন, ‘এই বয়সে পারি না বললে চলবে? হেনা সাহেব, একটা কথা মনে রাখবেন। কুকুর যখন শেয়ালকে তাড়া করে, তখন শেয়াল একাই হাঁপায়না, কুকুরও হাঁপায়।’

আমি বিল্লাহ ভাইয়ের কথায় অনুপ্রানিত হয়ে পূর্ণ উদ্যমে মাথা উঁচু করে চাকরি করে যেতে থাকলাম। এরপর শুরু হল নানারকম শো কজ। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পারমিশন ছাড়া ছুটির সময় আমি স্টেশন (কর্মস্থল থেকে পাঁচ মাইল পর্যন্ত) ত্যাগ করলাম কেন? ট্রেনিং থেকে ফিরে কর্মস্থলে যোগদানের জন্য আমার দুই দিন ট্রানজিট পাওয়ার কথা, আমি তিন দিন ভোগ করলাম কেন? বাড়ি থেকে ছুটির দরখাস্ত পাঠানোর নিয়ম নেই, আমি তা’ পাঠালাম কেন? দরখাস্তে ডায়রিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, অথচ মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি কেন? আমাকে সিভিল সার্জেনের কাছে রেফার করা হল। চিঠি চালাচালি হতে হতে আমার ডায়রিয়া ভালো হয়ে গেল। সিভিল সার্জেন রিপোর্ট দিলেন, আমি সুস্থ। ওপরওয়ালাদের কাছে আমি মিথ্যেবাদী হয়ে গেলাম। পরদিন অফিসে গিয়ে ‘এবারকার মতো আপনাকে সতর্ক করিয়া দেওয়া হইল’ মর্মে একখানা চিঠি এবং আবার পাণ্ডব বিবর্জিত স্থানে বদলীর অর্ডার পেয়ে গেলাম। ওপরওয়ালাদের মনে কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!

ছুটির আবেদন করলে সরাসরি নাকচ। ইনক্রিমেন্ট, টাইম স্কেল, এরিয়ার বিল ইত্যাদি পাওনার ব্যাপারে প্রশাসনিক আদেশ জারির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা। প্রমোশনের ব্যাপারে অহেতুক গড়িমসি। এ সি আর যাচ্ছে তাই। সার্ভিস বই লালে লাল। এরকম নানা অত্যাচারে আমি জর্জরিত। তবে বিল্লাহ ভাইয়ের কথা একটুও ভুল ছিলনা। ওপরওয়ালাদের কাছে আমার উপস্থিতি ছিল মূর্তিমান আতংক। যত দ্রুত সম্ভব আমাকে বিদায় করতে পারলেই তারা বাঁচে।

এভাবে পঁচিশ বছর চাকরি করার পর ২০০৬ সালে পূর্ণ পেনশন ও গ্র্যাচুইটি নিয়ে আমি স্বেচ্ছা অবসরে গেলে আমার ওপরওয়ালারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ২০০৫ সালের শেষের দিকে আমার একটা হালকা হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল। তা নাহলে হয়তো আমার জন্য তাদেরকে আরও কিছুদিন ভুগতে হতো। এই পঁচিশ বছরে, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমি যতবার বদলী হয়েছি তার চেয়ে বেশি বার বদলী হওয়া লোক অন্ততঃ আমার ডিপার্টমেন্টে কেউ নেই। মন্দের ভালো একজন অফিসার আমার স্বেচ্ছা অবসরের কাগজপত্র প্রসেসিংয়ের সময় বলেছিলেন, ‘হেনা সাহেব, আপনি কেন স্বেচ্ছা অবসরে যাচ্ছেন তা’ আমি জানি। ওপরওয়ালাদের সাথে একটু মানিয়ে চললে আপনাকে এত হেনস্থা হতে হতোনা। আরও ছয় সাত বছর চাকরি করতে পারতেন।’

আমার বয়স তখন পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে। তবু পঁচিশ বছরের যুবকের মতো আমি সিনা টান করে বলেছিলাম, ‘এইসব মেরুদণ্ডহীন ওপরওয়ালাদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান একজন ওপরওয়ালা আছেন। তিনিই আমার সহায়। আপনার উপদেশ আপনার নিজের পকেটেই রেখে দিন। আমার কোন প্রয়োজন নাই।’
*********************************************************************************************************************
রি-পোস্ট

মন্তব্য ১৮ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (১৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৩

মোস্তফা সোহেল বলেছেন: এখন মনে হয় আপনার মত লোক একটাও খুজে পাওয়া যাবে না।
অনেক শুভ কামনা রইল আপনার জন্য। ভাল থাকবেন

২৭ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৫:৪০

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: না ভাই, নিশ্চয় সৎ লোক এখনো আছেন। তবে তাদের সংখ্যা দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে। একজন অসৎ লোকের দেখাদেখি একজন সৎ অথচ দুর্বল মনের লোকও দুর্নীতি করতে দ্বিধা বোধ করছেন না। এটা অশনি সংকেত।

ধন্যবাদ ভাই মোস্তফা সোহেল। ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

২| ২৭ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:৪২

বটপাকুড় বলেছেন: অনেক শ্রদ্ধা রইলো আপনারা প্রতি, আমাদের দেশের যে অবস্থা সেখানে সৎ থাকাটাই মনে হয় পাপ। অনেক কষ্টে দেশে সবাইকে ফেলে বিদেশে পরে রয়েছি, দেশে এখন ফিরে গেলে হয়তো বড় পজিশনে যাব, কিন্তু এতো বেশি অনৈতিক কাজ সহ্য কড়তে হবে সেটা পারবো না।

সারা জীবন বাবা বড় পজিশনে থেকে সৎ থাকার কারণে ব্যাংকের ডিজিএম থেকে অবসর নেওয়ার পর আমাদের কোন গাড়ী নেই। যদিও আমি বিদেশের শীর্ষ স্থানীয় একটা বিশ্ব বিদ্যালয়ে পিএইচডি করি, কিন্তু খারাপ লাগে যখন দেখি সৎ মানুষের জীবন টা শুধু না আর না এঁতে ভরা। আমি জানি শেষ বিচারের মালিক আল্লাহ ।

একটা বিষয় লক্ষ্য করবেন কি না জানি না। আগে যারা অসৎ ছিল, তাদের ব্যাপারে মানুষ আঙ্গুল তুলে দেখাতো। বলতো অসৎ লোক জনের ছেলে মেয়ে দের সাথে মিশবে না। এখন তো দেখি মানুষজনের গা সহা হয়ে গেছে। মানুষ জন আসলে টাকার পিছনে ছুটছে। কে অসৎ আর সৎ সেটা ভাবে না। তবে আমি আমার উপার্জন হালাল করে খাই। আজ পর্যন্ত কোন সততার সাথে কোন আপস করি নি। অনেক জায়গা থেকে সরে এসেছি, কিন্তু অসৎ হয়নি

২৭ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৫:৪৯

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: আপনাকে স্যালুট। কখনো সততার সাথে আপোষ করবেন না ভাই। কখনো হারাম উপার্জনের কথা মাথায় আনবেন না। অসৎ লোক আহার পায়, সৎ লোকও আহার পায়। তফাৎ শুধু এটুকুই যে, সৎ লোকেদের অসৎ লোকেদের মতো শান শওকত থাকে না। পঞ্চাশ, ষাট, একশো বছরের জীবনে এত শান শওকতের প্রয়োজন কী? তাও যদি সেই পঞ্চাশ, ষাট, একশো বছরের কোন গ্যারান্টি থাকতো!

ধন্যবাদ বটপাকুড়। ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

৩| ২৭ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:৪৯

সাধারন জন বলেছেন: মনের কোন এক কোনে আপনার জন্য তীব্র শ্রদ্ধাবোধ কাজ করছে। আপনার মত কর্মকর্তা যদি ৬০% ও থাকতো, দেশ অর্থনীতি এতদিনে সিঙ্গাপুরের সমান হয়ে যেতো।

২৭ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৫:৫৩

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: সৎ মানুষের প্রতি সৎ মানুষেরই শ্রদ্ধাবোধ থাকে। আর অসৎ মানুষ বলে, 'ব্যাটা পায়ে হেঁটে অফিসে যায়, আর বড় বড় কথা বলে!' হাঃ হাঃ হাঃ।

ধন্যবাদ ভাই সাধারন জন। ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

৪| ২৭ শে জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৬

বিজন রয় বলেছেন: প্রথম প্লাস।

আপনাকে এই জন্য ভাললাগে।

২৭ শে জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৫

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই বিজন রয়।

ভালো থাকুন। শুভেচ্ছা রইল।

৫| ২৭ শে জুন, ২০১৬ রাত ৯:০৮

সুমন কর বলেছেন: আপোশহীন হয়ে থাকাটা খুব কষ্টকর। এটা আমিও বুঝতে পারছি....তবুও আছি।

‘এইসব মেরুদণ্ডহীন ওপরওয়ালাদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান একজন ওপরওয়ালা আছেন। তিনিই আমার সহায়। আপনার উপদেশ আপনার নিজের পকেটেই রেখে দিন। আমার কোন প্রয়োজন নাই।’ --+।

২৮ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৭:৩৯

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই সুমন কর। সৎ থাকার চেষ্টা করা এবং সেই চেষ্টার মধ্যে যে কষ্ট আছে, সেটা অনুধাবন করতে পারাটাও সততার লক্ষন।
ভালো থাকুন। শুভেচ্ছা রইল।

৬| ২৭ শে জুন, ২০১৬ রাত ৯:৪২

মোঃ সাইফুল্লাহ শামীম বলেছেন: আমি নিজেও চাকুরীজীবী। অনেক লোভ এবং প্রলোভন এড়িয়ে ব্যাক্তিগত ভাবে সৎ থাকা খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু যারা পারে তারা অতিমানব। আপনার জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা।

২৮ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৭:৪৩

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই সাইফুল্লাহ শামীম। সকল প্রলোভনের উর্দ্ধে থেকে সৎ থাকার চেষ্টা করবেন, এই কামনা করি।

ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

৭| ২৮ শে জুন, ২০১৬ রাত ২:১৩

কালনী নদী বলেছেন: অনেক শ্রদ্ধা রইলো আপনারা প্রতি।

২৮ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৭:৪৫

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই কালনী নদী। শ্রদ্ধা ও সম্মান আপনার প্রতিও।

ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

৮| ২৮ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৮:০৪

চাঁদগাজী বলেছেন:




প্রামানিকের কোন খবর?

২৮ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৮:০৮

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: হাঁ ভাই, তিনি এখন ভালো আছেন। তবে শারিরীকভাবে খুব দুর্বল। খুব দ্রুতই তিনি ব্লগে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন।

ধন্যবাদ চাঁদগাজী। ভালো থাকুন। শুভেচ্ছা রইল।

৯| ২৮ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৯:২৬

হাসান মাহবুব বলেছেন: কুকুর যখন শেয়ালকে তাড়া করে, তখন শেয়াল একাই হাঁপায়না, কুকুরও হাঁপায়।

অসাধারণ বাণী।

'গল্প' গুলো আবার ফিরে আসুক অন্য কারো জীবনে। আবার। বারেবার।

শুভেচ্ছা।

২৮ শে জুন, ২০১৬ সকাল ১১:২০

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই হাসান মাহবুব।

ভালো থাকুন। শুভকামনা রইল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.