![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রিয়ার মনটা আজ খুব ফুরফুরে । মুখে লাবণ্যময় একটা হাসি ফুটিয়ে আর্টস্ ফ্যাকাল্টির ঝুপড়িতে বসে আছে প্রায় আধ ঘণ্টা । রাহাতের জন্য অপেক্ষা করছে । অন্য দিন হলে মুখে হাসি তো দূরের কথা , পাংশু মুখে রক্তচক্ষু নিয়ে ফুলে ফেঁপে একাকার হয়ে যেত । সত্যি বলতে কি মেয়েটার মধ্যে বিন্দুমাত্রও ধৈর্য নেই । দশটা মিনিট অপেক্ষা করানোর অপরাধে রাহাতকে এক হাজার একটা ঝাড়ি খেতে হতো । তাতেই বেচারার সারাদিনের খাওয়া হয়ে যেত । আজ রিয়ার জন্মদিন । আর তাই বলেই রক্ষে । কথা আছে রাহাত আজ ওকে একটা স্পেশাল জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবে । সারপ্রাইজের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা বসে আছে রিয়া । পরনে নীল রঙের শাড়ি , চিকন পাড়ের । শাড়ির রঙের সাথে মিলিয়ে নীল রঙের চুড়িও পড়েছে , আর কানের দুলও।
রিয়া ঝুপড়ির একপাশে একটা বেঞ্চে বসে আছে । পাশে একদল ছেলেমেয়ে টুল চাপড়িয়ে ধেড়ে গলায় সমানে গেয়ে যাচ্ছে একের পর এক গান । রিয়ার ধৈর্যের বাঁধ প্রায় ভেঙ্গেই যাচ্ছিল । হাতের সরু চেইনের ঘড়িটার দিকে রূক্ষ দৃষ্টিতে তাকালো । চোখ তুলতেই মুখের লাবণ্য আবার ফিরে এল । হালকা অভিমান মিশিয়ে কোমল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আজকের দিনেও কি দেরি করতে হয় ?’ ‘হ্যাপি বার্থডে রিয়া !’ রাহাতের দরদভরা কণ্ঠ শুনে রিয়ার মুখের হাসিরেখা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হল । ‘সরি রিয়া ! দেরি হয়ে গেল । তিমুর বিশেষ একটা কাজে আটকা পড়েছিলাম ।’ তিমু নামটা শুনতেই রিয়ার মুখের সব লাবণ্য উবে গেল । ‘আজও তিমু ! এই তিমু তিমু নামটা শুনতে শুনতে আমার কানটা পচে গেল ! পারলে সাথে নিয়েই আসতে ?’ বিরক্তিতে রিয়ার মুখমণ্ডল পাংশুটে হয়ে গেছে । রাহাত কিছু বলার আগেই সাদামাটা একটা হাসি নিয়ে আড়াল থেকে বেড়িয়ে এল তিমু, ‘শুভ জন্মদিন রিয়া !’ তিমুকে দেখামাত্র প্রায় উন্মাদের মত লাফিয়ে উঠল রিয়া, ‘ওকে সাথে আনতে বলেছে কে তোমায় ? ও কি আমাদের সাথে ডেট এ যাবে না কি ? কি পেয়েছে তুমি ? আমার কোন কথাই শোন না কেন ? তুমি কি বুঝে ওকে সাথে এনেছ ? হুম ?’
রিয়ার অমন চিৎকার চেঁচামেচিতে হতভম্ব হয়ে গেল রাহাত । পাশের বেঞ্চে বসা ছেলেগুলো পর্যন্ত ওদের হাই ভলিউম পারফর্মেন্স থামিয়ে দিল । ঘটনার আকস্মিকতাই সবাই হা ! করুণ চোখে রাহাত ওকে বোঝাতে লাগল, ‘প্লিজ রিয়া ! আমার কথাটা আগে শোন - ’ ‘না তোমার কোন কথাই আমার শোনার ইচ্ছা নেই । থাক তুমি তোমার প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে । দু’জন মিলে আমার বার্থডে সেলিব্রেট করগে । আমি চললাম -’ বলেই হন হন করে রিয়া হাঁটতে শুরু করল । ‘রিয়া ! রিয়া ! শোন প্লিজ্ - ’ রাহাতের করুণ কণ্ঠস্বর ওকে থামাতে পারল না । ছলছল চোখে তিমুর দিকে তাকাতেই লজ্জিত কণ্ঠে তিমু বলল, ‘সরি দোস্ত ! আমার আসাটা আসলে ঠিক হয় নি ।’ ‘হয়েছে তোকে আর সাফাই গাইতে হবে না । যা ভাগ্ - আমার ভাল লাগছে না ।’ বলেই বেঞ্চে বসে পড়ল রাহাত । বিষাদে ওর মুখখানা নীলবর্ণ হয়ে গেল । ‘গিফ্ট টা দিবি না ?’ তিমু উৎসুকভাবে বলে উঠল । ‘নিয়ে ড্রেনে ছুঁড়ে ফেল্গে । দূর হবি ?’ রাহাতের রক্তচক্ষু দেখে তিমু আর অপেক্ষা করল না । নীরবে প্রস্থান করল ।
সবেমাত্র গোসল সেরে চুলে তোয়ালে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে রিয়া ওর বিছানায় বসছিল । এমন সময় একটা বক্স আর একটা ছোট খাম ওর চোখে পড়ল । ‘বুয়া ! বুয়া - এখানে এগুলো কে এনে রেখেছে ? কি এগুলো ? ’ ভেতর থেকে বুয়ার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো , ‘আপামণি, একটা ছেলে আসছিল । বলে আপনার বন্ধু । আপনি গোসল করছেন শুনে আর বসল না । যাওয়ার আগে ওগুলো আপনাকে দিতে বলে গেল ।’ ‘হুম্ ’ বলে বিষণ্ণ চোখে তাকালো বক্স আর খামটার দিকে । খামটা হাতে নিয়ে দেখল ওখানে তিমুর নাম লেখা । লেখাটা পড়তেই ক্রোধে ফেটে পড়ল রিয়া । সাথে সাথে ছুঁড়ে মারল ডাস্টবিনে । সাথের বক্সটাও ছুঁড়তে যাচ্ছিল । কিন্তু রাহাতের নাম দেখে থেমে গেল । নিজেকে কিছুটা সামলে নিল । রাগে ওর চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করছিল ।
প্রায় তিনদিন হতে চলল রাহাত তিমুর সাথে কথা বলে না । তিমু তবু গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে । রাহাত ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করে । অদ্ভুত রকমের তিমু ছেলেটি । এতটুকু বিষাদ গ্রাস করে না ওকে । স্মীতহাস্যে বলে, ‘দোস্ত, আর ক’দিন আমার সাথে কথা না বলে থাকবি ? তুই ও না রিয়ার মত একদম ছেলে মানুষটি ! পাগল !’ রাহাত বরাবরই ওর কথায় বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে পাশ কেটে চলে যায় । তবুও তিমুর মুখের সাদামাটা হাসির রেখাটি ম্লান হয় না কখনো ।
(২)
দিনটি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারী । সবাই ফ্যাকাল্টি গেছে শহীদ মিনারে ফুল দিতে । রিয়ার শরীর ভালো লাগছিল না । তাই যায় নি ও । কানে হেডফোন লাগিয়ে ইজি চেয়ারে গা এলিয়া গান শুনছিল । হঠাৎ চেঁচামেচির শব্দে সচকিত হল । দরজায় খুব জোরে জোরে কারা যেন আঘাত করছিল । তড়িৎ গতিতে গিয়ে দরজা খুলতেই ওদের ক্লাসের বেশ কিছু ছেলে হুট করে ঢুকে পড়ল । অন্তু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘রিয়া এক্ষুণি আমাদের সাথে যেতে হবে । তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও ।’ বিমর্ষ চেহারাগুলো দেখে বিস্ময়ের সাথে রিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘কেন ? কি হয়েছে ? সবাইকে অমন দেখাচ্ছে কেন ?’ ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল, ‘শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার সময় ছাত্রলীগ আর ছাত্রশিবিরে মারামারি লেগেছিল । গণ্ডগোলটা হঠাৎ খুব বড় হয়ে গেল । আমরা মারামারির মাঝে পড়ে যাই - ’ বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল ছেলেটি । ‘কি হল ? থামলে কেন ? শেষ কর ! তারপর কি হয়েছে ? রাহাত কই ? হুম ? রাহাতের কিছু হয়নি তো ?’ রিয়ার সর্বাঙ্গে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল । কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, ‘কি হল ? চুপ কেন সবাই ? আরে কথা বল না কেন তোমরা ?’ রিয়ার কণ্ঠস্বর ক্রমে ভারী হয়ে এল । দু’চোখ ছলছল করতে লাগল । ‘রাহাত হাস্পাতালে - ’ অন্তু কথাটা শেষ না করতেই রিয়া ছুটতে আরম্ভ করল । সবাই ওর পিছু পিছু ছুটল ।
অশ্রুসিক্ত রিয়া যখন পাগলের মত ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে ঢুকছিল পথেই রাহাতকে দেখতে পেল । রক্তে ভিজে ওর সাদা শার্টটা লাল হয়ে গেছে । ছুটে গিয়ে রিয়া ওকে জড়িয়ে ধরল । ‘কি হয়েছে তোমার ? কি হয়েছে ? এত রক্ত ঝরছে কেন ?’ কান্নায় রিয়ার কথাগুলো আটকে যাচ্ছিল মুখের ভেতর । রাহাত ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘শান্ত হও রিয়া ! শান্ত হও ! আমার কিচ্ছু হয়নি । আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তিমু আজ মরতে বসেছে - ’ কথাটা শেষ করতে পারল না রাহাত । কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল । মুহূর্তেই রিয়া পাথরের মূর্তির মত নিশ্চল হয়ে গেল । কাঁদতে কাঁদতে রাহাত রিয়াকে জড়িয়ে ধরল । রিয়া নড়তে পারছিল না । কে যেন ওর শরীরটাকে অসাড় করে দিয়েছিল ।
ঐদিন সারারাত ওরা হাসপাতালে না ঘুমিয়ে কাটায় । পরদিন সবাইকে একবারে দাফন-কাফন শেষে বাড়ি ফিরতে হল । বেলা গড়াতেই রাহাত রিয়াকে ওর বাসায় পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেল । ক্লান্ত বিষণ্ণ রিয়া রুমে এসে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল । ওর ভেতরটা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গিয়েছিল । অদ্ভুত একটা জ্বালায় ভেতরটা পুড়ছিল । গভীর একটা দীর্ঘশ্বাসে ওর রুমটা ভারী হয়ে উঠল । মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল । এভাবে কতক্ষণ যে ছিল সে নিজেও জানে না । হঠাৎ চেতনা আসতেই উঠে বসল । সেদিনের সেই খামটার কথা মনে পড়ল । মনে পড়তেই ডাস্টবিনের দিকে ছুটে গেল । হন্নে হয়ে খামটা খুঁজতে লাগল । অবশেষে পেলও । খামটা ছিঁড়ে ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো পেল । ওতে লেখা ছিল -
“ বন্ধু মানে খোলা আকাশ -
বন্ধু মানে মুক্তি ,
বন্ধু মানে সবসময়
পাশে থাকার চুক্তি ।।
শুভ জন্মদিন রিয়া । আমাকে যতই দূরে সরাতে চাও না কেন আমি সবসময়ই তোমাদের পাশে থাকব । কি রাগ লাগছে খুব, না ? হা-হা ! কোন লাভ নেই । আমি নাছোড়বান্দা । তোমাদের ছাড়ছি না ।
- তিমু । ”
©somewhere in net ltd.
১|
০৫ ই নভেম্বর, ২০১২ রাত ১০:২১
মিত্র বলেছেন: বন্ধুরা এমন ই। ভালো লাগলো।