নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রতিনিয়ত নিজেকে শেখার চেষ্টা করছি :)

আলামিন মোহাম্মদ

১৯৮৮ সালের বন্যার কথা বলছি। নভেম্বর মাস কিন্তু এখনো বন্যার পানি পুরোপুরি সরে যায়নি। বন্যায় রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে গেছে। সেই সময় টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামের চান মিয়া খুবই চিন্তিত হয়ে আছেন। বাড়িতে পুরুষ ব্যক্তি বলতে একমাত্র সে। তার অনেক দায়িত্ব কারণ তার ভাগনির সন্তান হবে যেকোন মুহুর্তে ব্যথা উঠে যেতে পারে। আশেপাশে কোথাও ডাক্তার নেই, দাই একমাত্র ভরসা। দাইকে খবর দিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি একবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন আরেকবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছেন যদি হাসপাতালে নিতে হয় তাহলে তো মহা বিপদ। ভাগনির স্বামীও সাথে নাই। ঢাকায় কাজে গেছে। দুপুর গড়িয়ে সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে। এমন সময় রসুই ঘর থেকে একটি বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসলো। পুত্র সন্তান হয়েছে আজান দেয়া লাগবে। কিন্তু আলাদা করে আজান দেয়া লাগে নাই। আসরে নামাজের জন্য আহবান করা চারদিকের সকল মসজিদের আজান যেন নতুন ভুমিষ্ট শিশুকে বরণ করে নিল। চান মিয়া আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালেন। সন্তানের পিতাকে খবর জানানো দরকার। ঢাকায় গিয়ে চান মিয়া সন্তানের বাবাকে খুঁজে পেলেন না। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বাড়ির প্রতিবেশীকে খবর দিয়ে রাখলেন যাতে বাড়িতে আসা মাত্র টাঙ্গাইলে চলে যায়। পুত্র সন্তান হয়েছে আর পিতা কিনা দূরে তা কি করে হয়? এক সপ্তাহ পর শিশুর পিতা বাড়িতে আসলো এবং পুত্র সন্তানের খবর শুনেই টাঙ্গাইলের পানে ছুটলেন। শিশু পুত্রকে দেখতে চাইলেন কিন্তু গ্রাম্য রেওয়াজ বাধা হয়ে দাঁড়ালো।স্বর্ণ দিয়ে শিশু পুত্রের মুখ দেখতে হবে। শিশুর পিতার তখন এত সামর্থ্য ছিল না স্বর্ণ কেনার। তাহলে কি উপায়? স্বর্ণ ও হলুদ একই ধরনের ধরা হয়। তখন একটি হলুদের টুকরো হাতে নিয়ে শিশুর হাতে দিলেন। সেটি ছিল শিশুর প্রথম উপহার। সেই উপহারটিকে যত্ন সহকারে তার নানী সিকায় তুলে রাখলেন। এভাবে চলে যেতে থাকলো দিন মাস বছর। এভাবে যখন শিশুর আঠারো বছর পূর্ণ হল তখন শিশুর নানী তার হাতে একটি শীর্ণ ও শুকিয়ে যাওয়া একটি হলুদ তুলে দিলেন এবং সেদিনের কথাগুলো পুনব্যক্ত করলেন। ১৮ বছর আগের প্রথম উপহার পাওয়া সেই হলুদ এখন সযত্নে আছে দেখে সেই কিশোরবালক অনেক পুলকিত হল। এরপর লজ্জা পেল যখন সে নানীর বাসনার কথা জানতে পারলো। বাসনা অনুযায়ী এই হলুদ দিয়েই নাতির গায়ে হলুদ দিতে চান। গত ১০ নভেম্বর ২০১২ সেই কিশোরবালক ২৪ বছর অতিক্রম করে ২৫ এ পা দেয়। আজো সেই কিশোরবালক তার নানীর ইচ্ছা পুরণ করতে পারে নাই। আর সেই কিশোরবালক হচ্ছে এই আলামিন মোহাম্মদ

আলামিন মোহাম্মদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাসর !

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:২০

মিরপুর ইন্ডোর স্টেডিয়াম এর সামনে একটি টঙ এর দোকান আছে। দোকানটি বাতেন মামার চায়ের দোকান নামে অধিক পরিচিত। আজ ১৫ বছর ধরে তিনি এখানে চা বিক্রি করে চলেছেন। আড্ডাবাজ তরুণ-তরুণিদের কাছে জায়গাটা বেশ পছন্দের জায়গা। ইন্ডোর স্টেডিয়াম এর প্রধান ফটকের সামনে বেদির মত একটু উচু প্রাচীর আছে। তরুণ-তরুণীরা সেখানে বসে আড্ডা দেয় আর বাতেন মামার চা খায়। একটি কথা প্রচলিত আছে- ছেলেটি বাদাম ছিলে দিত, আর মেয়েটি তা চিবাতো। ছেলেটির বাদাম শেষ হয়ে গেল আর মেয়েটি নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। পর্তুগীজরা বঙ্গদেশের জন্য ‘বাদাম’ নামক যে খাবার এনেছিল এই দেশের কপোত-কপোতিদের কাছে তা অনেক আদরের খাবারের নাম। তবে পর্তুগীজদের বাদাম বাতেন মামার চায়ের দোকানে অচল। ব্রিটিশদের শেখানো চা এখানকার কপোত-কপোতিদের কাছে আদরের নাম। আর চা শেষ হয়ে গেলেও মেয়েটি এখানে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় না। চা শেষ হবার সাথে সাথেই বাতেন মামা আরেক কাপ চা তাদের সামনে তুলে ধরে। এইভাবে বাতেন মামা তার দোকান চালিয়ে যাচ্ছেন। সন্ধ্যার সময় শুরু হয় আর তা শেষ হয় রাত ১১ টার দিকে। এখানে যে শুধু কপোত-কপোতিরা যায় তা ভুল। এখানে তিন ধরনের মানুষদের আড্ডা হয়। এক-কপোত-কপোতিদের, দুই-বেকার ছেলেদের, তিন-প্রাক্তন আড্ডাবাজ যারা একসময় এখানে নিয়মিত আড্ডা দিত। এভাবেই চলছে গত ১৫টি বছর।

আমিও বাতেন মামার দোকানে এখন নিয়মিত আড্ডা দেই। কৌতুহলী পাঠকদের একটি বিষয় শুরুতেই পরিষ্কার করে দেই তা হল আমি কপোত-কপোতিদের দলে নই বেকারদের দলে। আমি সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে আড্ডা দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরে আড্ডা দেবার জায়গা আমার বিশেষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকে যাবার পর সময় কাটছিল না। তখন ফেইসবুকে মুন নামে এক ছেলের সাথে পরিচয় হয়। ফেইসবুকের বাতচিতের মাধ্যমে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং একদিন দেখা করতে যাই। আর সেদিন দেখা করতে গিয়েই বাতেন মামার সাথে পরিচয় হয় এবং মুনের অন্যান্য বন্ধুদের সাথে পরিচয় হয়। মুনের বন্ধুদের দেখে ভালো লাগে আর বাতেন মামার চাও মন্দ নয় আর বেকার ছেলেরা আড্ডার পাশাপাশি ফ্রি ফ্রি সুন্দরি কপোতিদের দেখে সময় কাটাতে পারবে সেটাও মন্দ নয়। আমিও বাতেন মামার দোকানের নিয়মিত যাওয়া শুরু করলাম। মুনের বন্ধুদের সাথে রাজনীতি,অর্থনীতি, প্রেমনীতি সহ সব নীতি নিয়েই আলোচনা হত। সন্ধ্যার দিকে যেতাম আর বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১১ টা বেজে যেত। রাত ৯ টার দিকে দোকানে একটু ভিড় কমে যেত। তবে আমরা যেহেতু বেকারদের দলে তাই আমরা দোকান বন্ধ না করা পর্যন্ত বসে বসে আড্ডা দিতাম। রাত ৯ টার পর দোকানে ভিড় কমে যেত বলে বাতেন মামাও আমাদের আড্ডায় যোগ দিত। ওনার গল্পের বিষয় বস্তু প্রায়ই থাকত ওনার দোকানে আসা নানান ধরনের কপোত-কপোতিদের নিয়ে। বাতেন মামার বয়স চল্লিশ এর কাছাকাছি। মাথার চুল কমে যাচ্ছে তাই বয়স একটু বেশি মনে হয়। বয়স বেশি মনে হলেও তার আচরণে বয়স্কদের কোন প্রভাব নেই। বেশ রসিক আর ঠাট্টা মসকরা করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি এখানে চায়ের দোকান দেন। তখন এখানে আর কোন চায়ের দোকান ছিল না। তিনি একাই ব্যবসা করতেন। তবে এখন আশে-পাশে আরও কিছু চায়ের দোকান আছে। তবে সব দোকানের নাম ছাপিয়ে বাতেন মামার চায়ের দোকান এখানে অধিক পরিচিত।



একদিন আমি, মুন এবং মুনের কিছু বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছি। রাত ৯ টা বেজে গেছে। বাতেন মামাও আমাদের সাথে আড্ডায় যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাদের শোনাচ্ছিলেন- এক কপোত-কপোতিদের পালিয়ে বিয়ের সাক্ষী তিনি কিভাবে হয়েছিলেন, পরে কি ঘটনা ঘটলো তা নিয়ে। তিনি এই পর্যন্ত অনেক বিয়ের সাক্ষী হয়েছেন যেসব প্রেমের শুরুটা এখানে হয়েছিল। ঠিক তখন স্যুট টাই পরা এক লোক আসলো। বাতেন মামা ঐ লোকটিকে দেখে টঙ এর দোকান থেকে নেমে আসলেন আর চিৎকার করে বললেন- আরে ফারুক মামা যে! কতদিন পর দেখা। আমাদের দেখি ভুলে গেলেন? বলেই বাতেন মামা সেই ফারুক নামের লোকটিকে বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করলেন। আমরা সবাই সেই আলিঙ্গনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর সবাই বুঝতে পারলাম-এই ফারুক নামের লোকটি এখানে আসা তিন নম্বর ক্যাটাগরির লোক যিনি একসময় এখানে নিয়মিত আসতেন। আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছি আর লোকটিকে দেখছি। বাতেন মামার একটি স্বভাব হচ্ছে যারা প্রাক্তন তাদের কাছ থেকে তিনি চায়ের কোন বিল রাখেন না। জোর করে দিতে চাইলেও তিনি রাখেন না। ফারুক সাহেব এক কাপ চা খেলেন আর চায়ের বিল দেয়া নিয়ে কিছুক্ষণ বাক্য বিনিময় করে ব্যর্থ হয়ে বাতেন মামার সাথে মোলাকাত করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। বাতেন মামা ফারুক সাহেবের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইলেন এরপর হঠাৎ করে মুখ অনেক গোমরা করে ফেললেন। ওনার হাসিমাখা মুখ হঠাৎ করে গোমরা হয়ে যাবার কারণে আমরা বেশ কৌতুহলী হয়ে উঠলাম। আমরা উপযাচক হয়ে জিজ্ঞেস করবার আগেই বাতেন মামা বলে উঠলেন- ফারুক মামা বুয়েটের কত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বুয়েটের নাম শুনে আমাদের সাথে থাকা মুনের বন্ধু কামরুল বলে উঠল- এই ভাই বুয়েটে পড়ত তাহলে আমার সাথে পরিচয় করে দিবেন না মামা? আমিও তো বুয়েটে পড়ি। বাতেন মামা কামরুলের কথা না শুনেই বলে যেতে লাগলেন- এই ফারুক মামা আমার এখানে আড্ডা দেয়ার উদ্দেশে আসত না। একা একা বসে থাকত আর কি জানি ভাবত। আমার এখানে কেউ একা আসে না সবাই সাথে করে কাউকে নিয়ে আসে আর আড্ডা দেয়। এই ফারুক মামা একা আসত আর চুপ-চাপ বসে থাকত। আমি যখন রাত ১১ টার দিকে দোকান বন্ধ করতাম তখন সে চলে যেত। বাতেন মামার চোখ কেমন যেন অশ্রুসিক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমরা বুঝতে পারলাম বাতেন মামা অতীত স্মৃতিতে চলে গেছেন। আমাদের মধ্যে অনেক কৌতুহলী প্রশ্ন জাগলেও আমরা বাতেন মামার কথায় কোন বাম হাত না ঢুকিয়ে তাকেই তার মত করে বলার সুযোগ দিলাম।



বাতেন মামার দৃষ্টি স্থির। মনে হচ্ছে তার চোখের সামনে কোন ভিডিও ভাসছে যা আমরা দেখতে পারছি না তাই তিনি তা মুখে বলে আমাদের শোনাচ্ছেন। আজ ১৫ বছর ধরে এখানে চা বিক্রি করছি। কত মামাদের পছন্দের মানুষের সাথে যুগলবন্দী করে দিলাম। ২০০৩ এর দিকে মোবাইল ফোনের এত প্রসার ছিল না। এই আমি ছিলাম তখনকার প্রেমের চিঠির ডাক পিয়ন। মামীরা আমার কাছে চিঠি দিয়ে যেত পরে আমি তা মামাদের দিয়ে দিতাম। কত মামাদের বিয়েতে সাক্ষী হলাম। কিন্তু ফারুক মামার ক্ষেত্রে আমি কিছুই করতে পারলাম না। ওনার মত প্রেমিক পুরুষ আমি আমার জীবনে অনেক কমই দেখেছি। বর্তমানের প্রেম হচ্ছে ফ্যাশনের মত। ফ্যাশন যেমন দুই দিন পর পর পরিবর্তণ হয়। আজকাল কার পোলাপান প্রেম করে ফ্যাশনের জন্য। আজকে অমুক মেয়ের সাথে প্রেম করে তারপর তার মধু খেয়ে ফ্যাশন পরিবর্তণের মত অন্য মেয়ের সাথে লাইনঘাট করে। সেখানে ফারুক মামার মত প্রেমিক সবার আদর্শ হওয়া উচিত। তার কাছ থেকে শেখা উচিত প্রেম কাকে বলে।



আমরা চেয়েছিলাম বাতেন মামার কথার মধ্যে বাম হাত ঢোকাবো না। আমাদের আড্ডার মধ্যে মুন হচ্ছে বেশ ভালোই প্রেমিক পুরুষ। প্রেম বিষয়ে তার আগ্রহ আছে বেশ। তাই সে অধৈর্য্য হয়ে বাতেন মামাকে বলে উঠল- মামা, রাত হয়ে গেছে। আপনি যেভাবে ভূমিকা টানছেন তাহলে এই গল্প সারা রাতেও শেষ হবে না। আপনি শুরু থেকে সুন্দরভাবে বলে যেতে থাকেন আর গল্পের ডালপালা বাড়ানোর দরকার নেই। আমরাও প্রেমের গল্প শোনার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলাম। তাই মুনের কথায় আমরাও সায় দিলাম। মুন আবার বলে উঠল- মামা, আমাদের সবাইকে আরেক কাপ চা দেন তারপর যতটা সম্ভব ডালপালা কম করা যায় সেভাবে গল্পটা বলেন। আমরা শুনি। বাতেন মামা- চা বানাচ্ছেন আর চায়ের কাপের দিকে তার স্থির দৃষ্টি নিবব্ধ করে আবার বলা শুরু করলেন।

ফারুক মামার সাথে পরিচয় হয় ২০০৯ এর দিকে। তখন সে বুয়েটে পড়ত। মিরপুর ডিওএইচএসে টিউশনি করাতে এখানে তখন প্রায়ই আসত। তখন তার চোখে চশমা ছিল, চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করা থাকত। এই মামাকে তখন চিনতাম না। আমার দোকানে টিউশনি যাবার পথে চা খেয়ে চলে যেত। কিন্তু সে আমার নজরে আসে যখন সে নিয়মিত আসা শুরু করলো আর চুপচাপ এখানে বসে থাকত। আমি তিনদিন খেয়াল করলাম। ৪র্থ দিনের মাথায় আমি ফারুক মামার পরিচয় জানতে চাইলাম। কেন সে চুপচাপ বসে থাকে তা জানতে চাইলাম। ঐ মামা আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দিল। সেই হাসির অর্থ হল সে কিছু বলতে চাইছে না। আমি তখন ঝড়ে বক মারার মত করে বললাম- আপনার এই বাতেন মামা কত মানুষের লাইনঘাট করে দিল। এখন না মোবাইলের যুগ কিন্তু কয়েক বছর আগে এই আমার কাছে বস্তায় বস্তায় চিঠি আসত। আমার এই চায়ের দোকান ছিল প্রেমিক পুরুষদের কাছে পোস্ট অফিসের মত। প্রেমের ঘটনা হলে বলেন দেখেন লাইন ঘাট করে দেই। প্রেম শব্দটা শুনে ঐ মামা মনে হয় একটু নরম হল। ওনার মুখ দিয়ে কথা বের হইলো। সে আমার সম্পর্কে জানতে চাইলো। কত বছর ধরে দোকানদারি করছি এইসব। আমিও জানতে চাইলাম ঐ মামা সম্পর্কে। ঐ মামার ভালো নাম মুহম্মদ ফারুক আব্দুল্লাহ। বুয়েটের সোহরাওয়ার্দী হলে থাকে। সেই হল থেকে এখানে টিউশনী করাতে আসে। পরিচয় পর্বের পর ফারুক মামা একটু সহজ হল। তারপর আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম- আপনি এখানে চুপচাপ বসে থাকেন কেন? তখন সে বলল- আমি একজনকে খুজতেছি। আমি ফারুক মামার কথা শুনে হেসে দিলাম। কাউকে খুঁজলে এইভাবে চুপচাপ বসে থাকলে হবে? আমি এখানে ১৫ বছর ধরে দোকানদারি করছি। এই এলাকার সবাইকে চিনি। আমাকে বলেন কাকে খুঁজছেন? ফারুক মামা একটু ইতস্তত করে বলল- একটি মেয়েকে খুঁজছি। তার এই কথা শুনে আমি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলাম। আমার হাসি মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল যখন দেখলাম- ফারুক মামার চোখ কেমন যেন ছলছল। আমি হাসিয়ে থামিয়ে বললাম- মামা, এই মামার কাছে কিছু বলতে লজ্জা পাইয়েন না। আপনার মামীর সাথে ৬ বছর প্রেম করে পরে পালিয়ে বিয়ে করেছি। সেই প্রেমের ইতিহাস অনেক। অন্যদিন শোনাবোনি। প্রেমের ক্ষেত্রে এই বাতেন মামা এক পা আগ বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার এই কথা শুনে ফারুক মামা হয়ত আরও একটু সহজ হল। সে আস্তে আস্তে বলে উঠল- আপনার এখানে তো অনেক মেয়েই চা খেতে আসে। আনিকা নামে কাউকে কি চিনেন? আমি বলে উঠলাম- কয়ে বাত নেহি। আনিকাকে কালকের মধ্যে আপনাকে খুঁজে এনে দিব। আমার এই কথা শুনে ফারুক মামার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। তখন আমি ফারুক মামাকে জিজ্ঞেস করলাম- এই আনিকা মেয়েটা কে? তখন সে বলল- সে চিনে না। আমি তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- মামা ঝেড়ে কাশেন তো। আপনার কেস শুনি। তখন ফারুক মামা বেশ সহজভাবেই বলা শুরু করলো।

আমি আপনাদের এই এলাকায় সপ্তাহে তিন দিন আসি। যাওয়ার পথে আপনার এইখান থেকে চা খেয়ে যাই। গত সপ্তাহে যখন চা খেতে আসলাম- তখন দেখি দুইটা মেয়ে আপনার দোকান থেকে একটু দূরে বসে চা খাচ্ছে আর গল্প করছে। ঐ দুইটা মেয়ের মধ্যে একজনের নাম আনিকা আর আরেকজনের নাম আফি। আনিকা নামের মেয়েটি শাড়ি পরে ছিল। ছাই রঙ এর একটি টাঙ্গাইলের শাড়ি। ওর চুলগুলো ছিল অনেক লম্বা। আজকালকার মেয়েরা চুল এত লম্বা কেউ রাখে না। সে যখন হাসি দিচ্ছিলো তার গালে টোল পড়ছিল। সেই টোল পরা হাসিতে এত যাদু ছিল যে শুধু মনে হচ্ছিল এক পলকে তাকিয়ে থাকি। ছোট ছোট চুমুক দিয়ে চা খাচ্ছিল আর আফির সাথে গল্প করছিল। তার সেই টোল পরা মুখের আমি প্রেমে পরে গেছি। তাকে সেদিন দেখার পর থেকে আমার রাতে আর ঘুম হয়নি। চোখবন্ধ করলেই আনিকা হেসে উঠছে। এরপর চোখ খুলে তাকে দেখার চেষ্টা করি। সে মাথার চুলে হাত রেখে তার চুলগুলো ঘারের একপাশে এনে রাখছে আর চুলে হাত বুলিয়ে আফির সাথে কথা বলে যাচ্ছে আর হাসি দিয়ে উঠছে। বাতেন মামা, আমি এই মেয়ের প্রেমে পরে গেছি। সেদিন সাহস করে কথা বলতে পারি নাই। তাকে আবার দেখতে পাবো সেই আশায় এখানে বসে থাকি।

বাতেন মামা এতক্ষণ পর কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- ঐ মেয়েদের চিনেন না, তাহলে তাদের নাম জানলেন কি করে? তখন ফারুক বলে উঠল- তারা যখন চায়ের বিল দিতে আসলো তখন বিল দেয়া নিয়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। আফি বলছে- আনিকা, খবরদার তুই বিল দিবি না। আর আনিকা বলছে- আফি তোকে একটা চড় দিবো, আমিই বিল দিবো। তাদের সেই হাতাহাতিও আমার চোখে এখনো ভাসে। বাতেন মামা, একটু দীর্ঘ শ্ব্বাস ছেঁড়ে বললেন- প্রথম দেখায় প্রেম। কঠিন কেস। চিন্তা নিয়েন না। এই এলাকার সব মেয়েদের চেনা আছে। কালকে আইসেন। সব খবর এনে দিব।



রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। বাসায় ফেরা দরকার। কিন্তু ফারুক ভাইয়ের গল্প এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে বাকিটা না শুনে উঠতে মনে চাইছে না। একদিন বাসায় ফিরতে একটু না হয় দেরি হল, সমস্যা কি তাতে? আমার চিন্তাধারার সাথে মুনের বন্ধুরাও যে একমত হল তা বোঝা যাচ্ছে কারণ তাদের মধ্যে বাসায় ফেরার কোন লক্ষণ দেখতে পাচ্ছিলাম না। আর গল্প শোনার ব্যাপারে মুনের আগ্রহ বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছিল। সে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো- প্রথম দর্শনে প্রেম! এইসব হয় নাকি আজকাল। চেনা নাই, জানা নাই, একটি মেয়ের হাসি দেখে তার প্রেমে পড়ে যাওয়া। অদ্ভুত! তো ফারুক ভাই কি আনিকার দেখা পেয়েছিল? মুনের প্রশ্নের উত্তরে বাতেন মামা বলে উঠলেন- না, আর দেখা পায় নাই। আমাদের সাথে থাকা মুনের বন্ধু তাহমীদ বলে উঠল- তাহলে তো গল্প শেষ। একটি মেয়েকে চলার পথে ভালো লেগেছিল এরপর আর দেখা পায় নাই, দুইদিন পর সেই ঘটনা এমনিতেই ভুলে যাওয়া যাবে কারণ, রাস্তায় চলার পথে আমাদের অনেক মেয়েকেই ভালো লাগে। বাতেন মামা বলে উঠলেন- গল্প শেষ হয় নাই। গল্প সবে মাত্র শুরু হল। গল্পের সবে মাত্র শুরু শুনে মুন আরও আগ্রহী হয়ে উঠল। সে বলে উঠল- মামা, যত সংক্ষেপে পারেন পুরো গল্প বলেন। এই গল্প না শুনে উঠলে আজ রাতে আমার ঘুম আসবে না। রাত হয়ে গেছে। আপনি দোকান বন্ধ করেন। তারপর চলেন বসে বসে সেই গল্প শুনি।

আকাশে দশমী চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে গেল। চাঁদের আলো গাছের পাতা ভেদ করে ঘুটঘুটে অন্ধকারকে আবছা অন্ধকার করে দিচ্ছে। পরিবেশটা হঠাৎ করে কেমন যেন গল্প শোনার পরিবেশ হয়ে উঠল। বাতেন মামা, আমাদের মধ্যে মনি হয়ে ফারুক ভাইয়ের ১ম দর্শনে প্রেমের কাহিনী শোনাচ্ছেন। আমি, মুন, কামরুল, তাহমীদ আমরা এই চারজন বাতেন মামার সামনে বসে আছি। তিনি গল্পবলা শুরু করলেন-

আমি আমার পরিচিত সব জায়গায় খোঁজ লাগালাম- আনিকা নামে কোন মেয়েকে চিনে কিনা। কিন্তু কেউ কোন খোঁজ দিতে পারলো না। ফারুক মামা বলেছিল- আনিকা শাড়ি পরে ছিল। এর দ্বারা অনুমান করা যায় আনিকা আফির বাসায় বেড়াতে এসেছিল। আমি আফির খোঁজ করলাম কিন্তু তারও খোঁজ পেলাম না। পরের দিন সন্ধ্যা হতেই ফারুক মামা অনেক আগ্রহ নিয়ে আমার কাছে এল। তার সেই আগ্রহমাখা মুখ দেখে আমার দুঃখের খবরটা দিতে অনেক খারাপ লাগলো। যখন তাকে বললাম- খুঁজে পাই নাই তখন সে অনেক আশাহত হল। চোখটা কেমন যেন ভেজা ভেজা হয়ে এল। সে বলল- তাহলে আমি এখানে বসে বসে অপেক্ষা করতে থাকি। হৃদয়ের টানে আমার বিশ্বাস সে অবশ্যই এখানে চা খেতে আসবে। কারণ আনিকা চায়ের বিল দেয়ার সময় বলেছিল- চা টা অনেক জোস হয়েছে। আবার খেতে আসবে। আমি সেই আশায় আছি আনিকা আবার কবে সেই জোশ চা খেতে আসবে। বাতেন মামা আপনি জানেন না, ক্যাম্পাসে অনেক মেয়েই আমার কাছে ফিরতে চায়। আমি কাউকেই পাত্তা দেই না। কত মেয়ে আমাকে পাবার জন্য কত কিছু করলো আমি সেগুলোতে গা ভাসাই না। আমি আমার মনের মত একজনকে খুঁজছিলাম। যার মধ্যে অভিনয় থাকবে না। সব কিছু হবে জীবন্ত। আনিকা মেয়েটির হাসি এত জীবন্ত যে সেই টোল পড়া হাসি দেখে আমি সারা রাত কাটিয়ে দিতে পারবো। ওর হাসির মধ্যে প্রাণ আছে। হাসির মধ্যে কেমন যেন লজ্জা লজ্জা একটা ভাব আছে। আমি এই মেয়েকে ভালোবেসে জয় করতে চাই। কিন্তু ওরে কি আমি আর খুঁজে পাবো? আমি তখন বলে উঠলাম- আজকাল ফেইসবুকের যুগ। আপনি ফেইসবুকেও একটু খুঁজে দেখেন। ঐ মেয়ে হয়ত ফেইসবুকেও আছে। সে তখন বলল- মামা, এই কাজ আমি অনেক আগেই করেছি। আমার পরিচিত সব ক্যাম্পাসে খোঁজ লাগিয়েছি। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাই নাই। তাই তো এখানে বসে থাকি। আনিকা বলেছিল- সে আপনার দোকানে আবার আসবে এই চা খেতে। আমি তখন বললাম- আমার দোকানে কোন অপরিচিত মেয়ে আসলেই আমি নাম জিজ্ঞেস করি। এই কাজ চালিয়ে যাব। আপনি টেনশন নিয়েন না। ইনশা আল্লাহ একদিন না একদিন অবশ্যই তাকে খুঁজে পাবেন। কিন্তু মামা, আপনি যদি এখানে এভাবে বসে থাকেন তাহলে আপনার পড়াশোনা চঙে উঠব। আপনি এভাবে বসে থাইকেন না। টিউশনিতে যান। তখন ফারুক মামা বলল- আমি টিউশনি ছেঁড়ে দিয়েছি। যেহেতু বলেছে আবার আসবে তাহলে কিছুদিন এখানে বসে থাকি। আমি তখন বললাম- মামা, আপনি আসলেই অনেক অদ্ভুত। আপনার প্রেমিক আমি কোথাও দেখি নাই। লাইলী-মজনুর প্রেম কাহিনী শুনেছি আজ আপনাকে দেখে সেই প্রেম দেখার সৌভাগ্য হল। আপনি দেখি লাইলী-মজনুর প্রেমকাহিনীকেও হার মানিয়ে ছাড়বেন। তখন ফারুক মামা বলল- সেই প্রেমের মত হইলো কোথায় মামা? লাইলী তার মজনুকে চিনত। দুইজন দুজনাকে ভালোবাসত। এখানে আমি আনিকাকে ভালবাসি। আনিকা তো আমাকে ভালোবাসে না। সে তো আমাকেই চিনেই না ভালোবাসা তো দূরের কথা। তখন আমি বললাম- ধরেন, আনিকার দেখা পেলেন কিন্তু জানলেন তার একটি প্রেম আছে তখন? ফারুক মামা বললেন- প্রেম হচ্ছে জয় করার জিনিস। জোর করে আদায় করার জিনিস না। আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস আছে যে আমি প্রেমের পরীক্ষায় জয়ী হব আর এই আত্মবিশ্বাসের জন্ম এমনি এমনি হয়নি। আমার পিছনে যেসব মেয়েরা ঘুরত তারাই বলেছে আমি অনেক আদর্শবান প্রেমিক হব। আর একজন মেয়ে কখনোই চাবে না এমন একজনকে হারাতে যে তাকে অনেক ভালোবাসে আর তার প্রেমের পরীক্ষায় জয়ী হয়। আমি তখন বললাম- দোয়া করি আপনি আপনার প্রেমিকাকে খুঁজে পান।



প্রকৃতি সূক্ষ্ম খেলা খেলতে পছন্দ করে। এত সাধনার পর যখন কেউ কিছু পায় না তখন প্রার্থণা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। আমি বড়ই সৌভাগ্যবান যে, ফারুক মামার মত একজন প্রেমিক পুরুষের দেখা পেয়েছি। আজকালকার ছেলেরা প্রেমিকার সব কিছু পেয়েও তাকে ভালোবাসতে পারে না, সন্তুষ্ট হতে পারে না। সেখানে ফারুক মামা শুধু মাত্র তার ঐ হাসি দেখে তার প্রেমে পড়ে গেছে তাকে আরেকবার খুঁজে পাবে এই আশায় এই আমার দোকানে ছয়টি মাস এখানে বসে ছিল। আনিকার সেই হাসি তার চোখে সবসময় ভাসত। আনিকাকে খোঁজার জন্য একটি সেমিষ্টার ড্রপ দিল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমার দোকানে চলে আসত। চুপ-চাপ বসে থাকত। আমার নিজের কাছে অনেক খারাপ লাগত। বোঝাতাম যে তাকে মনে হয় আর খুঁজে পাবেন না। একটি মেয়ের জন্য যে ছয়টি মাস বসে থাকতে পারে তার ভালোবাসা খাঁটি না হয়ে যেতে পারে না। আমি ফারুক মামাকে বলেছিলাম- আপনি যদি আনিকাকে খুঁজে পান আর সে যদি আপনার ভালোবাসাকে প্রত্যাখান করে তাহলে আমাকে বইলেন- আমি আনিকার পায়ে ধরবো। তাকে বুঝাবো আপনি তাকে কত ভালোবাসেন। আমার কথা শুনে ফারুক মামার চোখ অশ্রুসজল হয়ে যেত।



এইভাবে ছয়মাস বসে থেকেও যখন ফারুক মামা আনিকার খোঁজ পেল না তখন হঠাৎ করে সে উধাও হয়ে গেল। আমার দোকানে আর আসে না। আমি ভাবলাম- আনিকার ভূত হয়ত মাথা থেকে নেমেছে, পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছে। ছয়মাস পর হঠাৎ করে সে হাজির। দিনটি ছিল ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১০, আগের মত চোখে সেই কালো ফ্রেমের চশমা, সেই প্রাণবন্ত হাসি, সেই ব্যাক ব্রাশ চুল। শুধু দুই আঙুলের চিপায় একটি সিগারেট এটাই শুধু পরিবর্তণ। ছয়মাস পর ফারুক মামাকে দেখে আমি দোকান থেকে নেমে তার সাথে মোলাকাত করলাম। সে একটি কেক নিয়ে এসেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম- মামা, কেক কিসের জন্য? তখন সে বলল- মামা, আজকের এই দিনে আমি আনিকাকে ১ম দেখি। আজ আমাদের ১ম দর্শন দিবস। আপনার দোকানেই যেহেতু ওরে প্রথম দেখি তাই আপনাকে নিয়েই কেকটা কাটতে চাই। তার কথা শুনে আমার চোখে পানি চলে আসলো। আমি দুই হাত উপরে তুলে খোদার কাছে অভিযোগ করলাম- খোদা, কেন তুমি এত নিষ্ঠুর খেলা খেল? ফারুক মামার অনুরোধে দোকান বন্ধ করে তার সেই কেক কাটলাম। তিনি আমাকে রেস্তোরাঁয় খাওয়ালেন। এইভাবে ২০১১,২০১২ সালেও তিনি কেক নিয়ে হাজির। ১১ই সেপ্টেম্বর আমার দোকান খোলা রাখা বন্ধ। এইদিন ফারুক মামার সাথে কেক কাটি আর রেস্তোয় খাই আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আনিকাকে খুঁজি। কিন্তু ২০১৩ সালে এসে ঘটলো অন্যকাহিনী। ফারুক মামা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন- আনিকাকে না খুঁজে পেলে তিনি আর বিয়েই করবেন না। কিন্তু তিনি তার কথায় অনড় থাকতে পারলেন না। বাসায় বিয়ের কথা উঠলেই তিনি তা এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু ২০১৩ সালে ফারুক মামার বাবা হঠাৎ করে স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। আর তখনই ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল।



গাছ কাঁটার সময় কাঠুরিয়া যদি ঠিক জায়গায় কোপটি না দিতে পারে তাহলে তার সেই গাছ কাটতে সারাদিন পার হয়ে যাবে। আর ঠিক জায়গায় যদি কোপটি পড়ে তাহলে অল্প সময়ের ভেতর গাছটি কেটে ফেলতে পারবে। অনেকে বলে সম্পর্ক করতে সময় প্রয়োজন কিন্তু আমি বলি খাপে খাপে সব কিছু মিলে গেলে সময় কোন বিষয় না। দক্ষ কাঠুরিয়ার মত বুঝতে হবে ঠিক কোথায় কোপটি মারতে হবে। আনিকার হাসির মধ্যে সেই সঠিক কোপটি ছিল যা দিয়ে ফারুক মামার প্রেমের গাছকে দুই মিনিটেই কুপোকাত করে দিয়েছে। তিনি আনিকাকেই নিজের বউ হিসেবে কল্পনা করতেন। নিজের মনের কুঠিরে আনিকা ছাড়া অন্য কোন মেয়ের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল। বিয়ের কাগজ ছিল সেই মনের কুঠির হস্তান্তরের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র কিন্তু এমনিতে তার সাথে মনের মিলন অনেক আগেই হয়ে গেছে। মনের বাসর যেখানে হয়ে গেছে সেখানে শারিরীক বাসর সামাজিকতা মাত্র। ফারুক মামা আমার কাছে বন্ধুর মতই তার সব অনুভূতি আমার কাছে ভাগাভাগি করত। কিন্তু ২০১৩ সালে তার বাবা হঠাৎ করে স্ট্রোক করে। ডাক্তার তাকে উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছেন। ফারুক মামার বাবা ছেলের বউ এর মুখ দেখে মারা যেতে চান। আনিকা ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না এই কথা বললে তার বাবা উত্তেজিত হয়ে যাবেন এই ভয়ে ফারুক মামা রাজি হয়ে যান। ফারুক মামা বিয়েতে রাজি হলেও একটা শর্ত জুড়ে দেন যে, বিয়েতে কোন অনুষ্ঠান করা যাবে না। সে কোন মেয়ের ছবি দেখবে না। তার কথা মতই বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা হয়।

২০১৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে ফারুক মামা আমার দোকানে আসলো। তার চোখ লাল হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক দিন ধরে ঘুমাচ্ছেন না। আমাকে দোকান বন্ধ করে তার সাথে একটু যেতে বলল কি জানি কথা আছে। আমি তার কথা মত দোকান বন্ধ করে গেলাম। তিনি আমাকে বললেন- এই ১১ সেপ্টেম্বর আনিকার মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে। বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে আমি বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছি। তিনি ছলছল চোখে বললেন- মামা, মনে মনে কত কথা সাজিয়েছিলাম। যে কথাগুলো আনিকাকে বাসর রাতে শোনাবো। সারা রাত গল্প করবো। তাকে নিয়ে একটি গান বেঁধেছি। সেই গান তাকে বাসর রাতে শোনাবো। তার সাথে আমার শারীরিক বাসর না হলেও মনের বাসর অনেক আগেই হয়ে গেছে। এখন এই মনের কুঠিরে অন্য মেয়েকে কিভাবে জায়গা দিবো মামা বলতে পারেন? এই ১১ সেপ্টেম্বর আমি এলমা নামে একটি মেয়ের সাথে বাসর করবো কিন্তু এখানে আনিকার থাকার কথা ছিল। এলমা নাম শুনে আমি জিজ্ঞেস করলাম- এলমা টা কে? তিনি বললেন- ওর সাথেই আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে। বাবা মাই পছন্দ করেছে। আমি মেয়ে দেখি নাই। আর মেয়ে দেখে কি হবে? এই বিয়ে হচ্ছে বাবাকে বাঁচানো জন্য। মা এলমার ছবি আমার দিকে দিয়ে বলেছিল- এলমার ছবিটা দেখ, এই মেয়ের হাসিটা কত সুন্দর! আমি সেই কথা শুনে মনে মনে বলেছিলাম- কোন মেয়ের হাসি আনিকার মত প্রাণবন্ত না। আমি মাকে বললাম- কোন ছবি দেখতে হবে না। তোমরা যেখানেই বিয়ে দিবে সেখানেই বিয়ে করবো। ফারুক মামার কথা শুনে আমার নিজেরই চোখে পানি চলে আসলো। যে ১১ সেপ্টেম্বর কেক কেটে ১ম দর্শন দিবস পালিত হত সেই ১১ সেপ্টেম্বর বিয়ে করে আনিকার মৃত্যু ঘটানো হবে। আমাকে দাওয়াত দেয়া হল তার বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য।

বিয়ে অনেক আনন্দের বিষয়। বাড়ির সবার মধ্যে আনন্দ খেলা করছে। শুধু আমার আর ফারুক মামার মধ্যে আনন্দ নেই। বিয়ে পড়ানোর সময় মেয়েরা কবুল বলতে দেরি করে আর কাঁদে। সব নিয়ম ভেঙ্গে ফারুক মামা যখন কবুল বলতে দেরি করছিল আর তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল তখন তার কষ্ট বুঝতে আমার বাকি রইলো না। কত ভালোবাসা সে আনিকার জন্য জমা করে রেখেছিল মনের কুঠিরে। আজ কেউ তাকে বেঁধে তার মনের কুঠিরে হামলা করে সব ভালোবাসা ডাকাতি করে নিচ্ছে। আজ রাতে তার বাসর হবে। সব ছেলেরাই উত্তেজিত থাকে। কিন্তু তার ভেতর কোন উত্তেজনা কাজ করছে না।

রাত ২ টার সময় সে বাসর ঘরে ঢুকলো। তার হাতে একটি সিগারেট। সারা খাটে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। ফুলের মালা দিয়ে সারা ঘর সাজানো। খাটের মাঝখানে মাথা নিচু করে লাল জরোয়া পরা বউ বসে আছে। এলমা মেয়েটিকে কি আনিকার কথা বলে দিবে? সে তাকে শারীরিক তৃপ্তি দিতে পারবে কিন্তু এই মন দিতে পারবে না। এই কথা কি এলমাকে বলে দিবে? এই চিন্তায় বিভোর হয়ে ফারুক মামা সিগারেট টেনেই যাচ্ছেন। তখন হঠাৎ করে মোবাইল বেজে উঠলো। ফারুক মামা মোবাইলের দিকে তাকাতেই দেখে এলমার ফোন এসেছে। ফারুক মামার মধ্যে কোন কৌতূহল কাজ করছে না। তিনি সিগারেট টেনেই যাচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎ করে সে সিগারেটের ছ্যাক খেল একটি শব্দ শুনে। সেই শব্দ তার কানে এমন ভাবে বিঁধল যে জ্বলন্ত সিগারেট তার ঠোঁট থেকে তার হাতের উপর কখন পরলো তিনি টেরই পান নাই। এক লাফে সে খাটের উপর গেল। এলমা যখন ফোন ধরে দুইটি শব্দ বললো- হ্যালো আফি। সেই আফি শব্দ শুনেই ফারুক মামা এক লাফে এলমার কাছে গেলেন তার ঘোমটা টেনে নামালেন। আর তখনই সপ্তম আশ্চর্যের মত তিনি আনিকাকে আবিষ্কার করলেন। তিনি সাথে সাথেই প্রশ্ন করলেন- তোমার নাম কি? এলমা বেশ হতচকিয়ে গেছে। সে আস্তে আস্তে বললো- আনিকা জাহান এলমা। তখনই ফারুক মামা আবিষ্কার করলেন- বিয়ে পড়ানোর সময় যখন কনের নাম বলা হচ্ছিল তিনি তাতে মনোযোগ দেন নাই। কোন কিছু না শুনেই কবুল বলে ফেলেছেন। এলমাই হচ্ছে আনিকা। ফারুক মামা জোরে জোরে হেসে উঠলেন। আর এলমা বেশ ভ্যাবাচ্যাক খেয়ে গেল। সে আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল যখন ফারুক মামা হঠাৎ করে গান গাওয়া শুরু করলো যে গান সে আনিকার জন্য বেঁধেছিল।



আনিকা আর ফারুক ভাইয়ের বাসরের গল্প শুনতে শুনতে কল্পনার জগতে চলে গিয়েছিলাম আমরা। আমাদের মধ্যে মুন গল্পের ঘোরে এতই আচ্ছন ছিল যে বাসর রাতে যখন ফারুক আর আনিকার মিলন হয় তখন সে বিজয় উল্লাস হিসেবে ইয়েস ইয়েস বলে উঠে। তার ইয়েসের শব্দ শুনে আমাদের ঘোর কাটে। মুন বায়নার মত করে বলে- বাতেন মামা, আনিকাকে দেখতে চাই। তার প্রাণবন্ত হাসি দেখতে চাই। আমরাও সায় দিয়ে বললাম- ফারুক ভাই আর আনিকা ভাবীকে একদিন দেখতে যাওয়া যেতে পারে। তাকে অন্তত অভিনন্দন জানানো উচিত।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ২:৩৭

আজীব ০০৭ বলেছেন: ভালোই লিখেছেন............................।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.