![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আজকাল আমাদের দেশের সরকারদলীয় রাজনীতিবিদেরা তাদের কথাবার্তায় যে জিনিসটি সব সময় বলার চেষ্টা করেন তা হল, তারা দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে গেছেন। তারা নতুন নতুন রাস্তাঘাট, সেতু- ব্রিজ নির্মাণ করেছেন, দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করেছেন , জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি করেছেন, মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রভৃতি উন্নয়নের কথা তারা সকাল সন্ধ্যা জিকির এর ন্যায় বলে থাকেন।
কিন্তু তাদের মনে বড় দুঃখ , এত কিছু করার পরেও দেশের সাংবাদিক মহল, বুদ্ধিজীবী মহল, এমনকি দেশের জনগণের বিরাট একটি অংশ তাদেরকে শুধু পছন্দ করেন না তা নয় বরং মনে -প্রাণে তীব্র ঘৃণা করেন।
এর পেছনের কারণটা কি? এত উন্নয়নের পরেও দেশের অধিকাংশ জনগণ কেন তাদেরকে পছন্দ করেন না?
এর উত্তর খোঁজার জন্য আমরা একটি উদাহরন দিতে পারি। লিবিয়ার শাসক ছিলেন মোহাম্মার গাদ্দাফি। তিনি দীর্ঘ ৪২ বছর দেশ শাসন করেছেন। লিবিয়ার উন্নয়নের জন্য তিনি অনেক কিছু করেছেন।
শাসক হিসেবে জনগনকে কতটা সুবিধা দিতেন গাদ্দাফি তা ২০১৪ সালের নভেম্বরে কানাডাভিত্তিক গবেষণা ও গণমাধ্যম সংস্থা 'গ্লোবাল রিসার্চ' এর একটি রিপোর্টের মাধ্যমে আমরা তা জানতে পারি। সুবিধাগুলো নিম্নরূপ-
০১. প্রত্যেক লিবীয় নাগরিকের বাড়ি-ঘর থাকাকে একটি মৌলিক অধিকার বলে গণ্য করত গাদ্দাফি প্রশাসন।
০২. শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা ছিল সম্পুর্ণ ফ্রি। এমনকি কোন লিবীয় নাগরিক যদি দেশে কাঙিক্ষত চিকিৎসা বা শিক্ষা না পেতেন, সেক্ষেত্রে তাকে বিদেশে যাওয়ার অর্থ সরবরাহ করত রাষ্ট্র।
০৩. ফসল উৎপাদনের সুবিধার্থে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প ছিল লিবিয়াতে। এটাকে গাদ্দাফি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বলে বর্ণনা করতেন।
০৪. কেউ যদি খামার ব্যবসা করতে চাইতেন, তাহলে তাকে সরকারের পক্ষ থেকে বাড়ি,খামার, গবাদিপশু ও বীজ সরবরাহ করা হত।
০৫. কোন মহিলার ঘরে নবজাতক জন্ম নিলে মা ও বাচ্চার জন্য সরকার ৫ হাজার মার্কিন ডলার সরবরাহ করত।
০৬. বিনামূল্যে বিদ্যুত সুবিধা দেয়া হত সকল লিবীয়কে।
০৭. গাদ্দাফি শিক্ষার হার ৩৫ শতাংশ থেকে ৮৭ শতাংশে উন্নীত করেন; এর মধ্যে ২৫ শতাংশ লিবীয় নাগরিকের বিশ্ববিদ্যালয় সনদ ছিল।
০৮. লিবিয়ার রাষ্ট্রায়াত্ত একটি ব্যাংক থেকে শূন্য শতাংশ হারে ঋণ দেয়া হত এবং এর কোন বৈদিশিক ঋণ ছিলনা।
০৯. গাদ্দাফির শাসনামলে দেশটিতে পেট্রোলের দাম খুব কম ছিল, প্রতি লিটার দশমিক ১৪ ইউএস ডলার।
১০. 'গোল্ড দিনার' নামে পুরো আফ্রিকাতে একটি একক মুদ্রা চালু করতে চেয়েছিলেন গাদ্দাফি।
এছাড়া, তেল বিক্রি করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যে অর্থ আসত তা প্রত্যেক লিবীয় নাগরিকের ব্যাংক হিসেবে আনুপাতিক হারে চলে যেত। প্রত্যেক লিবীয় দম্পতিকে বিয়ের পর ৫০ হাজার ডলার'সহ নতুন বাসা কিনে দিত সরকার!
কিন্তু দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য এত কিছু করার পরও তার শেষ পরিণতি কি হয়েছিল তা আমরা সবাই জানি। এত উন্নয়নের পরেও কেন তাকে নির্মম লাঞ্ছনাকর পরিণতি ভোগ করতে হলো? এর কারণ যদি আমরা খুঁজতে যাই তাহলে খুব সহজেই আমরা বুঝতে পারবো মানুষ উন্নয়নের থেকে বেশি পছন্দ করেন স্বাধীন থাকতে। মানুষ চায় বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সে কারো কাছে জিম্মি থাকতে চাই না।
মোহাম্মার গাদ্দাফি তার দেশের জন্য অনেক উন্নয়ন করলেও, দেশের মানুষের কল্যাণার্থে অনেক সুযোগ- সুবিধা দিলেও তিনি কেড়ে নিয়েছিলেন মানুষের বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। তিনি তার সমালোচকদের সহ্য করতে পারতেন না। কেউ তার বিরোধিতা করলে বা সমালোচনা করলে তাকে নির্মম পরিণতির শিকার হতে হতো। আর তাই তার কোনো উন্নয়ন কর্মকান্ড তাকে শেষ রক্ষা করতে পারেনি।
আমাদের দেশেও আমরা যদি বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের দিকে তাকায় তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারি, তারা গাদ্দাফির শেষ পরিণতি থেকে কোন শিক্ষা নিতে পারেনি। তারা মুখে মুখে উন্নয়নের স্লোগান তুললেও কেড়ে নিয়েছে মানুষের বাক স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সরকারের সমালোচক বা বিরোধীদেরকে তারা মোটেও সহ্য করতে পারেন না। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে তারা জিম্মি করে রেখেছে।
শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভিন্ন আদর্শ থাকার কারণে হাজার হাজার মানুষকে কারাবরণ করতে হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের নামে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে, শত শত মানুষকে গুম করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে।
সরকার দলীয় কর্মী সমর্থক ছাড়া কেউই আজ শান্তিতে নেই। তাদেরকে ব্যবসা করতে হলে, চাকুরী করতে হলে বা নিজের বাড়িতে ঘুমাতে হলেও উৎকোচ দেওয়া লাগছে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের অথবা কিছু সরকারদলীয় তাবেদার পুলিশকে। সরকারি চাকুরিতে ভেরিফিকেশন করে বাদ দেয়া হচ্ছে বিরোধী মতাদর্শের কেউ থাকলে, বিশেষ করে নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে এই মাত্রাটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
আবার সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা হাজার অপরাধ করলেও তাদের বিচার হয় না। অনেক সময় দেখা যায় রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন শক্তিকে ব্যবহার করে তারা অন্যায় করে থাকেন। শুধু নিজেরা ভোট ডাকাতি করে তারা শান্তি পান না, পুলিশ এবং ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ভোট ডাকাতির কাজে তারা ব্যবহার করেন। বিরোধী মত দমনে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েন, আইন হাতে তুলে নেন অহরহ, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তারা যাতে নির্বিঘ্নে নির্যাতন চালাতে পারেন তার সুব্যবস্থা করে দেন সাথে থেকে।
এক কথায় বলতে গেলে শুধুমাত্র সরকারদলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থক ছাড়া গোটা বাংলাদেশের মানুষ আজ ৬৮ হাজার বর্গমাইলের কারাগারে বন্দী হয়ে আছে। অথচ যাদেরকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তারা আছেন আজ উন্নয়নের মহাসড়ক নিয়ে।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল দেশ এবং দেশের মানুষের উন্নয়নকল্পে যা করেছেন তার থেকে হাজার গুণ বেশি করেছিলেন লিবিয়ার মোহাম্মার গাদ্দাফি। কিন্তু গাদ্দাফির সে উন্নয়ন তাকে যেমন বাঁচতে দেয়নি, ঠিক সেখান থেকে শিক্ষা না নিলে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলও যে ভবিষ্যতে তাদের মেকি উন্নয়ন দিয়ে পার পেয়ে যাবেন তেমন কথা আমরা বলতে পারি না।
©somewhere in net ltd.