![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(ছবি গুগল থেকে নেয়া)
-- ভাইসাব কি প্রেম করছেন ?
নিস্তব্ধতার মাঝে অদ্ভূত এই প্রশ্ন শুনে ঘুরে তাকালাম, একটু দূরেই হতশ্রী অবস্থায় পড়ে আছে লোকটা। ছেড়া লুঙ্গি আর গায়ে সাদা গেঞ্জির অর্ধেকটা কালচে হয়ে আছে। কালচে জায়গাগুলো দেখে মনে হচ্ছে ছোপছোপ রক্তের লালচে রং শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে । মুখে বিশাল এক গোফ সাথে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, সবকিছু মিলিয়ে তাকে প্রাচ্যের কোনো শাসকের মতো লাগছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কিছুক্ষণ আগেই পুলিশের ডলা খেয়েছে। হাসি হাসি মুখ নিয়ে লোকটা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে !!! পাগল নাকি, দেখেতো খুনি জাতীয় কেউ বলে মনে হচ্ছে না। কিছুদিন আগে আমি " অর্পা" কে শুনিয়েছিলাম বিভিন্ন প্রজাতির রাক্ষসের কথা, মায়ামায়া চোখ মেলে আর গভীর মনোযোগ দিয়েই শুনেছিলো অর্পা। আমার বর্ণনা মতে, লোকটাকে কিছুটা 'গেছো' জাতীয় রাক্ষসের মতো লাগছে। অর্পা পাশে থাকলে অপলক তাকিয়ে দেখতো লোকটা কি কি করে। তিন বছর হতে চললো মেয়েটার, এখনো চোখের মাঝে রাজ্যের মায়া।
-- ভাইসাব কি আমার কথা হুনছেন !!
লোকটার কন্ঠে আগ্রহ দেখা যায়। আমি না শোনার ভান করে থাকি, একবার কিছু বললে এই লোক কি করবে তার ঠিক নেই। মাথার মাঝে ঘুরছে অর্পা, মেয়েটা কি আজও কাঁদতে কাঁদতে ঘুমালো ? মেয়েটা হয়েছে বাবা পাগল, কাঁধে মাথা রেখে অনেকক্ষণ হাঁটলে ঘুমাবে, যদি ভূলক্রমে কাঁচা ঘুমে তাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হয় শুরু করবে একটানা কান্না। অর্পিতার রাগী রাগী মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করছে খুব, এই কয়েকদিন আগেও অর্পাকে কাঁধে নিয়ে আমার ক্লান্তিহীন হাঁটার জন্য তার রাগী রাগী কথা শুনতে হয়েছে !! আমিও না শোনার ভান করে হাসি মুখ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আচ্ছা, আমার হাসির সাথে কি এই লোকটার হাসির মিল্ আছে ! ধুত্তোরি, কোথায় খুনি খুনি চেহারার লোকটার হাসি, তার সাথে কেনো আমার হাসির মিল থাকবে !! অনেকটা বিরক্তি নিয়েই লোকটার দিকে আবার তাকালাম, হয়তো তার হাসির সাথে আমার কোনো মিল্ খুঁজে পাই কিনা তাই দেখার মনের অদ্ভূত খেয়াল। আমার তাকানো দেখে লোকটা কিছুটা উত্সাহ পেয়ে আবার কথা বলা শুরু করে।
-- তিনখান হুরপরীর লগে আমার পিরীত হইছিলো।
এই শুনে আমার আগ্রহ নিমেষে উড়ে গুলো, লোকটা সম্ববত গাঁজাখোর। কথা বলার মাঝেই এরা নাকি প্রশান্তি খুঁজে পায়। আমি পুনরায় দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। নাহ, লোকটা বোধহয় আমার ফিরে বসা আধো আঁধারের মাঝে খেয়াল করেনি।
-- হেই, ছোট-কালে প্রথম হুরপরীর দেখা পাই, ভাঙ্গা কন্ঠে চালিয়ে যায় লোকটা।
-- ইশিরে, যদি একবার দেখাইতে পারতাম। এক্কেবারে ধবধবা সাদা হুরপরী !! থাকতো আমার বাসার লগেই, স্কুলে যাইবার লাগি রেডি হইয়া যহন বাইর হইতো, দেখলে কৈলজ্জাটা একেবারে থামি যাইতো। মায়ের লগি মাইনসের বাসায় কাম করতাম আমি। কপাল পোড়া সেই ছোট-কাল থেকেই, একবারও ওই মাইয়ার বাসায় মা কাম পাইলো না। একবারতো ঐ মাইয়া সাদা এক জামা পইরা বাহির হইলো, দেইখ্যা মনে হইলো যেন আসমান থাইকা নাইম্মা আইছে মেঘগুলান সাথে লইয়া !!
বাহ্, বেশ বলছে লোকটা; আসমান থেকে নামলো সাদা মেঘ পরা কোনো এক হুরপরী। কথাটা শুনেই আবার তার দিকে ফিরে তাকালাম, একমনে কেমন কথা বলে যাছে লোকটা। আমি আবার চিন্তায় ঢুব দিলাম। "হুরপরী' জিনিসটা কি ? জ্বিনদের মাঝে মেয়েদের নাকি পরী বলা হয়, হয়তো তাদের মাঝে সবচেয়ে সুন্দরীদের হুরপরী বলে !! কি হিজিবিজি চিন্তা মাথায় আসছে। অর্পিতাকে জিগ্গেস করলেই জানা যেতো। হাতের কাছে ফোন থাকলে এই মুহুর্তেই তাকে জিগ্গেস করতাম !!
আঁধো অন্ধকার এই রুমে ঢুকার আগেই আমার সমস্ত জিনিস রেখে এসেছি। কি চমত্কার ভাবে বললো " আপনার পকেটে যাই আছে তা এইখানে রাখুন" ......সুবোধ বালকের মতো পকেট থেকে রাজ্যের জিনিস বের করতে লাগলাম। চকলেটের ছোট্ট খালি প্যাকেটটা দেখে কিছুটা কৌতূহলই হলো ! পরমূহুর্তেই মনে পড়লো, অর্পা তার মায়ের মতো কোনো জিনিস এখানে-সেখানে ফেলবে না। চকলেটটা আমিই তাকে কিনে দিয়েছিলাম, ক্যান্ডিটা মুখে নিয়ে খালি প্যাকেটটা আমার হাতেই দিয়েছিলো। অথচ, ছোটবেলা আমি নিজে সবকিছু জমিয়ে রাখতাম, মিমি চকলেটের অসস্র প্যাকেট আমার কাছে জমানো ছিলো। রাস্তার মাঝে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম কয়েকটা, সেটাও ধুয়েমুছে জমা রেখেছিলাম আমার ছোট্ট টিনের কৌটায়। কি ছিলো না সেইখানে, রংপেন্সিল, শিরিষ কাগজ, স্ক্রু, প্রত্রিকা কাটা অনেকগুলো ছবি, স্টিকার, কোকের বোতলের কাক, খুচরো পয়সা আরো কতো গোপন জিনিস। মাকে যেদিন হারাই, সেদিনই আমার রাজ্যের ধন জমানো টিনের কৌটোটা হারিয়ে যায়। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন, ঘরভর্তি মানুষের ভিড়, তাদের মাঝেই কেউ হয়তো কৌটোটা নিয়ে সটকে পড়েছিলো। সেদিন বড্ড একা লাগছিলো আমার, আর একটু আগেই সেই একাকিত্বের পূনরায় দেখা পেলাম।
-- মাইয়া পড়তো কেল্লাস টেইন, ভাইসাব কি আমার কতা হুনছেন !!
বাস্তব জগতে ফিরে আসলাম মুহূর্তে, ফরাসী সম্রাট "গেছো রাক্ষস" আমায় তার হুরপুরীদের গল্প শোনাচ্ছে। আমার ক্ষনিকের নড়াচড়া দেখে লোকটা আবার শুরু করলো।
--খোদার কসম, দেইখতে এইক্কারে হইলদা পাতা !! বাতাসে চুলগুলান যহন উরতো, দেইখ্যা মনে হইতো হইলদা পাতা বাতাসে পঙ্খি হইয়া উড়াল দিবো।
কথাটা শেষকরেই বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো লোকটা, বারান্ধার বাতির আলোর খানিকটা এসে পড়েছে তার মুখে। জ্বলজ্বলে নুয়ে পড়া চোখ আর আক্ষেপ মিশানো মুখের অবঅয় দেখে মনে হচ্ছে, বারান্ধার লাইটের আলোর মাঝে তার হুরপুরীকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে লোকটা ! আচ্ছা, প্রথম হুরপরীটার কি হয়েছিলো ? এটা কয় নাম্বার হুরপরী ? মাথার মাঝে প্রশ্ন ঘুরছে, আমার কপাল কুচকানো দেখেই লোকটা বলে উঠলো
-- ট্রাকের হেলপার এর লগে কি মালিকের মাইয়ার বিয়া দেওন যায় ?
প্রশ্নটা কি আমাকেই করা !! আচ্ছা লোকটা এইখানেই বা কেনো !! ঢাকা শহরে অসংখ্য জেলখানার মাঝে তাকেও এই জেলে আসতে হলো !! আগে শুনতাম, শহরের প্রতিটা জেলখানা চোর-ডাকাতে ভর্তি, অথচ বিশাল এই বন্দী সেলে আমরা কেবল দুজনই !! কেবল একটি রাতই মাত্র, কাল সকালেই কোর্ট এ নিয়ে যাওয়ার কথা আমায়। অর্পিতা কি কাল সত্যিই আসবে, যদি আসে অর্পা কার কাছে থাকবে। অর্পার ঢাকাতেই দুজন খালা থাকে, কোনো এক বিচিত্র কারণে অর্পিতা তাদের কাউকেই সয্য করতে পারে না। আমার কাছে ভালো লেগেছিলো দুজনকেই, কেমন নতুন জামাই হিসেবে একটা আদর দেখিয়েছিলো সেবার।
-- যৌবন কি একলা কাটান যাই ? রাস্তার উপরে পিঠার দোকানে একবার দেখা হইলো তার লগে। ভাইসাব, শ্যামলা মাইয়া যে এত সুন্দর হইবার পারে না দেখলে বিশ্বাস হইবো না।
কিছুটা ভরা কন্ঠে বলে উঠে লোকটা। আচ্ছা, এই লোক দেখি আমাকে সব দেখাতে চাইছে ! অর্পাও মাঝে মাঝে এমন করে, এইতো সেদিন পিঁপড়ার দল সারি বেধে ডাইনিং টেবিলে মিষ্টির প্যাকেটের মাঝ থেকে কি যেনো খুঁজে বেড়াছিল্লো ! অর্পার কন্ঠের মাঝেও সেদিন উত্কন্ঠা দেখেছিলাম, যেনো এক্ষুনি না দেখলে পিঁপড়ারা দল বেধে হারিয়ে যাবে কোথাও।
-- ভাইসাব, বিবাহ করিয়া ভাবছিলাম, ঘরের ভিতর আসমান নিয়ে আসলাম। দিনের পর দিন হেই আসমান দেইখ্যা কাটাইছি।
সাদা কন্যা রঙিন ফুল
ধরতে গেলেই মিছে ভুল
নাকের মইধ্যে হইলদা ফুল
আসমান জুড়ে জলের ফুল।" ..............
লোকটার চোখের মাঝে আনন্দের একটা জোয়ার দেখা গেলো, আমিও একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখি তার আনন্দের খেলা। প্রথম যেদিন অর্পিতার সাথে আমার দেখা হয়, সেদিন ছিলো ঘোর বর্ষা, নীল্ রঙ্গা ছাতা নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো অর্পিতা। বাস থেকে নেমেই আমি এক দৌড়ে তার নীল্ ছাতার নিছে !! কি অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলো অর্পিতা, বিস্ময় ভরা সেই চোখ দেখেই আমি তার প্রথম প্রেমে পড়ি। তার বিস্ময় বাড়ানোর জন্য আমি খানিকটা হেসে বলে উঠলাম " আমি মগবাজার কাজী অফিস যাচ্ছি, খানিকটা এগোলেই আমি নেমে যাবো !! ভেজা জামায় আমার বিয়েটা ভেঙ্গেও যেতে পারে, দয়া করে খানিকটা পথ আমায় লিফট দিন। "
আমার জানা মতে, ঢাকা শহরের কোনো মেয়ে ঘোর বর্ষায় শাড়ি পড়ে ছাতা হাতে বৃষ্টির মাঝে হেঁটে বেড়ায় না। অর্পিতাকেই প্রথম দেখলাম বৃষ্টি হলে, সময় নিয়ে শাড়ি পড়বে, হাতে কয়েকটা চুড়ি, কপালে ছোট্ট একটা কালচে টিপ্, পায়ে সান্ডেল নিয়ে হনহন করে হেঁটে বেড়াবে। জ্যামে পড়ে বাসের জানালা দিয়ে প্রথমবার এই দৃশ্য দেখে পুরোই হতবাক হই আমি। অপূরুপ এক মেয়ে বৃষ্টির শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কিছুতেই সামলাতে পারলাম না নিজকে, বাস থামিয়ে এক ছুটে নীল্ ছাতা। যেখানে আমার কাছের বন্ধুরাও একই ছাতার নিচে আমায় লিফট দিতে ভয় পায়, সেইখানে সম্পূর্ণ অচেনা একটা ছেলেকে অর্পিতা লিফট দিতে রাজি হয়েছিলো। পরে অনেকবার তাকে জিগ্গেস করেছিলাম, এই অদ্ভূত কান্ডের পর কেন সম্পূর্ণ অজানা একটা ছেলেকে একই ছাতার নিচে লিফট দিতে রাজি হয়েছিলে ? অনেকবার জিগ্গেস করার কারণ ছিলো, আমার মনে হয়েছিলো সে একবার একরকম উত্তর দিবে। নাহ, প্রতিবারই অর্পিতা বলেছিলো " তোমার হাসিটা আমার ভালো লেগেছিলো আর তোমার চোখের মাঝে দেখেছিলাম রাজ্যের আনন্দ"!!
--হারামজাদা, পুরাই হারামি। একলা ছিলো না, সাথে নাহি আরো একটা ছিলো। আমি কিচ্ছু বুজবার পারি নাই। হেদিনের সহাল আছিলো পুরাই আন্ধার। ঝড়ের লগি আমার আসমানও কাঁনতেছিলো, হের কান্না দেইক্কা ঠিক থাকবার পারি নাই ভাইসাব।
লোকটার চোখে হঠাত করেই ঘৃণা আর ক্রোধ দেখতে পেলাম। কয়েকদিন আগে অর্পিতার চোখের মাঝেও আমি এই অগাধ ঘৃনা আর রাগের অদ্ভূত মিশ্রণ দেখেছিলাম। ঠিক সেদিনও ছিলো ঝুম বৃষ্টি, কাজ থেকে বাসায় আসার পর সোফার মাঝে একুশ-বাইশ বছরের অচেনা এক মেয়েকে বসে থাকতে দেখলাম। খাবার টেলিবের উপর ছড়ানো ছিলো অজস্র হাতে আঁকা মুখের পোর্ট্রেট। কোনোগুলো হিংস্র নেকড়ের আদলে, কোনোটি আবার বিষাক্ত সাপের ছোবলের আদলে, অনেকগুলো ছিলো শুধুই মুখের কালচে অবঅয়, সেইগুলো দেখতেই বেশি ভয়ঙ্কর ছিলো। কালো মুখের মাঝে লালচে রঙের ছোপ। দেখে মনে হচ্ছে, কোনো ভাম্পায়ার রক্ত চুষে খাচ্ছে নিজ মুখের !! সবগুলো পোর্ট্রেটের মাঝে একটাই মিল্, সবগুলোতে মুখের যে অবঅয় আঁকা হয়েছে সেটি দেখতে অবিকল আমার মতো !! নিজের ভয়ানক এই রূপ দেখে ফিরে আসলাম লিভিং রুমে, অচেনা মেয়েটি একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো আমার চোখের দিকে। মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম, ওই চোখগুলো আমার খুব চেনা ছিলো একসময়। তার ঠিক পাশেই বসে ছিলো অর্পিতা, তার লালচে চোখগুলের দৃষ্টি আমার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা ছিলো।
ন্যাচারাল হিস্ট্রি নিয়ে আমার নিজেরই তেমন জানাশোনা ছিলো না, এই বিষয়ে রুমমেট যখন টিউশানির কথা বললো, আমি না শোনার ভান করে শুয়ে ছিলাম। "৮-৯ বছরের বড়লোকের এক মেয়েকে হাতি, গরুর পরিচয় শিখাবি ?, কি পারবি না !!" আমি কোনো উত্তর না দিয়ে দার্শনিক ভঙ্গিতে পত্রিকা পড়তে লাগলাম। ন্যাচারাল হিস্ট্রির সাথে হাতি, গরুর কি সম্পর্ক এই নিয়ে বন্ধুকে জিগ্গেস করা ঠিক হবে কিনা মনে মনে ভাবছিলাম।ঠিক পরের মাস থেকেই আমার পঞ্চম টিউশানি শুরু। এই প্রথম কোনো মনোযোগী ছাত্রী পেলাম, মেয়েটির রূপ আর কথা বলার দক্ষতা আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করেছিলো। চটপটে হাসিখুশিতে ভরা এক মেয়ে, পৃথিবীর সবকিছুর প্রতি তার অসীম আগ্রহ। একদিন কথার মাঝে মেয়েটির হাত ধরেছিলাম আমি, সেদিন থেকেই খুব শান্ত হয়ে পড়ে মেয়েটি। এরপরের কয়েকটা দিন আমার ঘোরের মাঝে কেটেছিলো, একদিন প্রড়ন্ত বিকেলে মেয়েটির ভয় লাগা চোখের সামনেই দরজাটা ভিজিয়ে দিলাম। বিশাল বাড়িতে তেমন কোনো শব্দ হয়নি, কেবল ড্রয়িং রুম থেকে টিভির শব্দ আর বুয়ার নাক ডাকার শব্দ ছাড়া।
অর্পিতাকে কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না, মানিসিক বিকারগ্রস্ত এক মেয়ের কথায় কিছুই আসে যায় না। বললাম, আমার প্রেমের মাঝে বিন্দুমাত্র খাঁদ ছিলো না, পুরানো সময়কে পিছনে ফেলে সামনের দিনগুলোর স্বপ্ন দেখানোর কথাও বললাম। কিছুতেই ও আমাকে ক্ষমা করেনি, উল্টো বলেছিলো " যার মাঝে পশু বাস করে, তার কাছে আমার মেয়ে কোনদিনও সেফ না। " কথাগুলো সত্যিই আমাকে ছিড়ে খেলো।
-- দুইখান কোপ ভাইসাব, কাঁন্ধে আর বুকের মাঝে। বিশ্বাস করেন ভাইসাব, আমার বুকে একরত্তি সাহস নাই। হেদিন আন্ধাইরা রাইতে, রেল ইস্টিশনে আসমানরে দেইখ্যা কৈল্জ্জা কেঁইপ্পা উঠলো, দৌড় দিয়া ছুইটা গেলাম। ততক্ষণে সব শেষ, রামদা থেইক্কা চুইয়া চুইয়া রক্ত পরে। আমার আসমান যেন লাল রঙ্গা গঙ্গায় ডুব দিয়া আইছে, শাড়ির আঁচলা দিয়া রক্ত মুছতে মুছতে আমারে কইলো " খারাইয়া দেহেন কি ! পুলিস ডাহেন, আমারে দরাইয়া দেন। আজ আমি নিরচিন্তে ঘুমাইবার পারুম "
কান্না ভরা কন্ঠে সেদিন সোফায় বসে মেয়েটিও একই কথা বলেছিলো। শেষ দশটি বছর, প্রতি রাতে আমার হিংস্র থাবা তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে ! আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলাম, অর্পা মায়ের কাছ থেকে ছুটে আসতে চাইছিলো বারবার। অর্পিতা খুব শক্ত করে ধরে রেখেছিলো তাকে, যেনো তাকে ছাড়লেই বিষাক্ত কোনো সাপ এখনি ছোবল মারবে। এতগুলো বছর আমার মাঝে কোনো প্রায়চিত্ত ছিলো না, সেদিন অর্পার বুক ফাটানো কান্নাই আমায় নিয়ে এসেছিলো এই থানায়।
-- আসমানরে এদ্দিন খালি দেইখ্যাই গেছি, বুঝবার পারি নাই। কোনদিন ঠিকমতো কইবার পারি নাই ভাব-ভালোবাসার কথা। হেদিন যখন রামদা তার হাত থেকে লইয়্যা কইলাম, 'বাড়িত যেও আসমান, ঝড় আইবো এইট্টু বাইদ', তাকাইয়া আছিলো আমার আসমান। আমার দিহে খালি চাইয়্যা আছিলো, হেদিন বুঝলাম ভাব-ভালোবাসা কইতে নাই ভাইসাব, দেইখ্যা নিতে হয় "
ঘোলা চোখে বারান্ধার আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে লোকটা, নিচু গলায় একসূরে গেয়ে যায় :
"সাদা কন্যা রঙিন ফুল
ধরতে গেলেই মিচে ভুল
নাকের মইধ্যে হইলদা ফুল
আসমান জুড়ে জলের ফুল.....
এগিয়ে গেলাম আমি, পূর্ণ কন্ঠে বললাম আমি একটা ছোট মেয়েকে রেপ করেছি। আমার কথা শুনে লোকটা ভয়ে কুঁকড়ে যায়, অর্পিতার মতো তার চোখেও ঘৃণা আর অবিশ্বাসের সংমিশ্রন দেখতে পেলাম। আমার কাছ থেকে, লোকটা আরো দূরে সরে বসে। আমি হোহো করে হেসে উঠি, উচ্চস্বরে বলি " আমার মতো লক্ষ মানুষ হেঁটে বেড়াচ্ছে অসাধারণ সব মুখোশ পরে। পুরো ঢাকা শহরটাকেই যদি জেল বানাও, তবু আমাদের জায়গা হবে না। ভদ্র মানুষের বেশ ধরে, কাছের মানুষের রূপ নিয়ে এগিয়ে আসি আমরা। এই আমরাই থেকে যাবো এই শহরের সকল উচুনিচু দালানে, আর তোদের জায়গা হবে আস্তাকুঁড়ে। "
ক্ষনিকের নিস্তব্ধতা, এরপর একপ্রান্তে শোনা যায় মানুষ রুপী অন্য-মানুষের কাঁপা হাসির শব্দ আর অন্য প্রান্তে গুনগুন গান :
"সাদা কন্যা রঙিন ফুল
ধরতে গেলেই মিচে ভুল
নাকের মইধ্যে হইলদা ফুল
আসমান জুড়ে জলের ফুল। ..............
বারান্দার আলো মিশে গেছে বদ্ধ কক্ষের মাঝে, অদ্ভূত কোনো কারণে আলোকিত অংশটা এসে পড়েছে লোকটার গায়ে আর ঘাড় অন্ধকার মাঝে পড়ে আছে অন্য কারাবন্দী। এই যেনো আলো আঁধারের চিরন্তন খেলা।
©somewhere in net ltd.