নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনিমেষ রহমান

অনিমেষ রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

শহিদী কারবালা

১০ ই ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:২৫



ছেলেবেলায় কোনো এক জৈষ্ঠ্যের দুপুর। নিঝুম চারিদিক। খাঁ খাঁ রোদ। কেউ কেউ পুকুরঘাটে আর আমি যথারীতি দৌঁড় ঝাপ কিংবা বৈশাখের মেলা থেকে কেনা ছুরি দিয়ে আম কাটার চেষ্টা করতেছি। এই সময় আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিলো দাদাজানের বাঁধানো কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকা। দাদাজানের কবর ছিলো বাড়ির দক্ষিনপাশে। আর মাঠ ছিলো প্রায় খালি। টুক টাক ক্ষিরা কিংবা বাঙ্গি ক্ষেত। কবরের পাশে বসে থাকতে খুব আরাম লাগতো। কারন একেতো কবর ছিলো খুব পরিচ্ছন্ন আর ছিলো বিভিন্ন রকম সুন্দর গাছ-গাছালিতে ভর্তি। চমতকার একটা বকুলগাছে ছিলো সেখানে। আর কখনো ভোর বেলায় গিয়ে দেখতাম-বকুল ফুলে ছেয়ে আছে সারা কবরস্থান। কি সুন্দর! আর মিষ্টি একটা গন্ধ। তেমনি একদিনে আমি কবরস্থানে বসে আছি। দুপুর গড়িয়ে গেছে। নিরব-নিথর চারদিক। দেখলাম একজন মানুষ দক্ষিনের মাঠ দিয়ে এগিয়ে আসছেন। কাঁধে একটা কাপড়ের পুটলি। খুব ধীরে ধীরে হেঁটে আসছেন। খুব কাছে আসতেই দেখলাম খুব সাধারন একজন মানুষ। বোতাম ছেঁড়া হাফ শার্ট আর লুঙ্গি একটু উপরে পরা। আর খালি পা।

-খোকা এইটা তোমাদের বাড়ী?

-জ্বী।

-বাড়ীতে যাইয়া বলো-মহররমের জারী গান শোনাতে বয়াতি এসেছে।

আমি চলে গেলাম আম্মার কাছে। দেখি মা-চাচীরা লাইন ধরে বসে কাকি দিয়া চুল আছড়াচ্ছে আর নারিকেল তেল দিচ্ছেন। আমি হাপাতে হাঁপাতে বল্লামঃ মহররমের জারী শোনাতে বয়াতি আসছে।

বড় চাচী বল্লেনঃ কাছারী ঘরে মাষ্টার রে বলো বয়াতিরে বসতে দিতে।

বয়াতি বসে আছেন। একটু পরে বড় চাচা-মেজো চাচা-সেজো চাচা আর আমরা সবাই বাড়ির কাছারির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর বাহির বাড়িকে পৃথক করা বেড়ার পিছনে বাড়ীর সব মা-চাচীরাসব সহ মহিলারা দাঁড়ালেন-পর্দা করে। বয়াতি খুব ধীরে সুস্থে বের করলেন উনার ঝোলা থেকে শুধু মন্দিরা। আস্তে আস্তে টুং টাং করে বাজাচ্ছেন আর হাঁটছেন আবার ফিরছেন। মনে হচ্ছে-কাল্পনিক একটা মঞ্চ। টান দিলেন তাঁর জারি গানেঃ



এই মতে কাসিম আলী বিচার না করিল,

আশি হাজার সৈন্য কেটে খালাস করে দিলো।



আমি মায়ের আঁচল ধরে দাঁড়ানো। দেখলাম বড় চাচার চোখ টল-মলো। আর মা চাচীরা চখের পানি মুছছেন। অবাক হয়ে শুনছিলাম।আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। কি এমন কাহিনী সবাই এভাবে চোখের পানি ফেলছে। বয়াতি গেয়ে চলেছেনঃ



ঘোড়া চলে ধুলা ঊড়ে-উড়ে পাহাড় নদী,

চলো আমরা যুদ্ধে যাইমু পাখি হইতাম যদি।



বয়াতির চোখ বন্ধ। শুধু একবার সামনে একবার পিছনে ফিরে চললেন। আর গেয়ে যাচ্ছেন দরদ দিয়ে। কারবালার জারি। সেই প্রথম আমার মনে ঢুকে পড়লো কারবালা। একে একে জয়নাল আবেদিন কিংবা দুলদুল ঘোড়া। আমি আসলেই সত্য মিথ্যা ভাবছিলামনা। ভাবছিলাম শুধু বিভতসতার কথা! কিভাবে কারবালার তীরে পানি পানি করছে নারী-শিশু কিংবা আহত মানুষেরা। এক গ্রামের অশিক্ষিত একজন গরীব বয়াতি কি ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করেন আর হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা সামনে নিয়ে আসলেন। জৈষ্ঠ্যের সেই দুপুরে সেই বয়াতি দিয়ে দিয়েছিলো সুর। করুন মন্দিরার টুং টাং ধুম্রজাল। গল্প এখানে শেষ হলে ভালো হতো। সেই বয়াতি গান শেষ করলে আমার রাশভারি বড় চাচা বল্লেনঃ বয়াতি বাংলাদেশে যে আমাদের হাজার হাজার কাশেম শহীদ হইলো তাগোরে লইয়া জারি গান বান্ধো নাই?

-আমি লেখা পড়া জানিনা; উস্তাদ যা শিখাইছে তা দিয়াই জীবন চালাই।

বড় চাচা দরাজ গলায় গেয়ে উঠলেনঃ



পাখি কান্দে-পশু কান্দে-কান্দে নদীর পানি,

ফিরাইয়া দাও ফিরাইয়া দাও-আমার কাশেমেরে আনি।



অবাক কান্ড! রাশভারি বড় চাচা কি করতেছে? কে সেই কাশেম? কাশেম ছিলো তাঁর বড় পুত্র। যাকে ৭১ নিয়ে গিয়েছিলো জীবনের অপরপারে।

১৯৭১ এর সেদিন অন্যদিনের মতোই ছিলো। কাশেম গিয়েছিলো যুদ্ধে। ট্রেনিং শেষে একবার কাশেম ফিরেছিলো মাকে দেখতে। শিং মাছের ঝোল আর আলুর তরকারি খুব ভালোবাসতেন। মা বললেন খেয়ে যাস বাবা!

-না মা যাইতে হইবো, রাতে রাতে ফিরতে হবে কোরেশমুনশী বাজার-ফেনী ক্রস করে চোত্তাখোলা।

না কাশেমের ফেরা হয়নি; রাস্তায় দেখা হয়ে গেলো নিজ গ্রামের কিছু রাজাকার-আল বদরদের সাথে। সাথে ছিলো টহলরত পাকবাহিনী। খুব কাছে থেকে গুলি করে হত্যা করা হলো কাশেমকে। তারপর ফেলে রাখা হলো লাশ পরেরদিন সাপ্তাহিক হাটে। যেনো সাধারন মানুষ বুঝে-মুক্তি’র সংগ্রামে যোগ দেওয়া কত বড় অপরাধ আর কত বিভতস তার শাস্তি! সেই অখ্যাত হাটের শিমুল তুলা গাছের নীচেই দাফন হয় শহীদ কাশেমের। এখোনো সেই শিমুলতুলা গাছ আর শহীদ কাশেম শুয়ে আছে সেই মাটিতে। এই মাটিতে ৭১ এর নয় মাসে রচিত হয়েছিলো অসংখ্য কারবালার ঘটনা। আর শহীদদের জীবিত স্বজনদের কাছে তো প্রতিদিন কারবালা।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ২:১৯

আব্দুর রহ্‌মান বলেছেন: ভাই চমৎকার লেখা। চালিয়ে যান।

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ২:৪৭

অনিমেষ রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ আব্দুর রহমান ভাই!
সাথে থাকার জন্য।

২| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৩:০৩

আব্দুর রহ্‌মান বলেছেন: ভাই আমার লেইটেস্ট ব্লগে আপনার কমেন্ট এর উপর ১টা রিপ্লাই দিছি। পারলে উকি দিয়া আইসেন।

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৩:০৬

অনিমেষ রহমান বলেছেন: হুম গুরু আমিও দেখে আসলাম।
ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।

৩| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১২ ভোর ৬:৩৬

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: ৩য় ভালোলাগা ভ্রাতা +++++++++

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:১১

অনিমেষ রহমান বলেছেন: অপুর্ন আছেন কেমন ভাই?
ধন্যবাদ!

৪| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ৯:৩৮

আজ আমি কোথাও যাবো না বলেছেন: ভাল লাগলো দাদা।
আপনাকে ধইন্যা।

৫| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৫৪

অনিমেষ রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ!!
:)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.