নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমৃদ্ধ আগামীর প্রত্যেয়

আনিসুর রহমান এরশাদ

আমি আমার দেশকে অত্যন্ত ভালবাসি ।

আনিসুর রহমান এরশাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ধর্ষিতা নারীর মানসিক বিপর্যস্ততা ও সামাজিক বঞ্চনা

২৪ শে জুলাই, ২০১০ রাত ১২:৫৪

সমাজ কাঠামোতে নারীর প্রতি বিরাজমান বৈষম্যমূলক সংস্কৃতি, রীতিনীতি, বিশ্বাস ও মূল্যবোধই তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে । প্রখ্যাত নারীবাদী ব্রাউন মিলার(১৯৭৬) বলেছেন, ধর্ষণ হচ্ছে পুরুষের নারীর ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। নারীর উপর ধর্ষণের প্রতিক্রিয়া দৈহিক, মানসিক এবং সামাজিক। ধর্ষণের ফলে নারী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরে এবং সামাজিকভাবে নানান বঞ্চনার মুখোমুখি হয়ে দারণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নারীর প্রতি যতো ধরনের সহিংসতা দেখা যায় তার মধ্যে ধর্ষণই হচ্ছে সবচেয়ে প্রচলিত, পুরনো এবং অসামাজিকভাবে কলঙ্কজনক। বর্তমানে নারী ও পুরুষের জৈবিক পার্থক্যকে পুঁজি করে নারীকে শোষণ করা হচ্ছে। পরিবার থেকে শুরু করে অফিস-আদালতে, কল-কারখানায় ও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে নারীকে নিপীড়ন করছে।

ধর্ষণের সমার্থক শব্দ অর্থে বলাৎকার,নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন বা জোরপূর্বক অভিগমন। নারীর প্রতি যতরকম নিপীড়ন, সহিংসতা দেখা যায় তার মধ্যে ধর্ষণ হচ্ছে সবচেয়ে পুরনো প্রচলিত ও সামাজিকভাবে নারীর জন্য কলঙ্কজনক। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও গবেষক হুমায়ুন আজাদ তার 'দ্বিতীয় লিঙ্গ' বইতে ধর্ষণ সম্পর্কে বলেছেন, 'ধর্ষণ হচ্ছে পুরুষ কর্তৃক বলপ্রয়োগে নারী সঙ্গম। বলপ্রয়োগে সঙ্গম হচ্ছে সেই সঙ্গম, যাতে নারীর স্পষ্ট বা প্রচ্ছন্ন সম্মতি নেই। ধর্ষণ পুরুষের এমন আচরণ, যা নারীকে তার সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার দেয় না। সাধারণভাবে ধর্ষণ বলা হয় নারীর 'ইজ্জতহানি' বা 'সম্মানহানিকে' অর্থাৎ নারীর অমতে নারীর 'ইজ্জত' বা 'সম্মানে' আঘাত হলো। কিন্তু নারী আন্দোলনে থেকে প্রশ্ন এসেছে এই 'ইজ্জত' বা 'সম্মান' আসলে কার? (রোন্তী কোপলান: ১৯৭৪)। প্রচলিত ভাবধারায় এই সম্মান মূলত: পুরুষেরই কেননা পুরুষই নারীর অভিভাবক স্বামী-রূপে, পিতা রূপে, ভাই রূপে। কাজেই কোনো নারীকে ধর্ষণ করা মানে হলো তার পুরুষ অভিভাবককে হেয় করা। এক্ষেত্রে নারীর উপর নিপীড়ন বা সহিংসতাকে যতটা না গুরুত্ব দেয়া হয়, তার চেয়ে সমাজে পুরুষ অভিভাবকের সম্মানকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

মেঘনা গুহ ঠাকুরতা নারী নিপীড়নের চূড়ান্ত পর্ব ধর্ষণকে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, নারীবাদী দৃষ্টিতে ধর্ষণ হচ্ছে নারীর প্রতি চরম সহিংসতা প্রদর্শনের নামান্তর। এই সহিংসতা আঘাত হানে তার দেহে, তার স্বাতন্ত্র্যতায়, তার সত্তায়, তার আত্মপরিচিতিতে, নিরাপত্তাজ্ঞানে ও মর্যাদাবোধে। আইনের নির্ধারিত সংজ্ঞায় ' পেনিট্রেশন বা পার্টলি পেনিট্রেশনকে রেপ বা ধর্ষণ বলে।' অর্থাৎ পুরুষাঙ্গ যদি নারীর যৌনাঙ্গে আংশিক বা পুরোপুরি প্রবেশ করে তবেই আইনের বিচারে ধর্ষণ হয়েছে বলে ধরা হবে।

বাংলাদেশের নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। সামপ্রতিক সময়ে দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর দিকে তাকালেই দেখা যায় যে, বিভিন্ন বয়সের নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে এলাকার বখাটে ছেলেদের দ্বারা, এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা, এমনকি তার নিকটাত্মীয়ের দ্বারা। তবে ধর্ষণই তার শেষ পরিণতি হয়-এরপরও তার উপর চলে নানান নির্যাতন। অনেক সময় ধর্ষিতা কোথাও বিচার চেয়েও পায় না কিংবা চায়তেই পারে না। এভাবেই ধর্ষণের চেহারা যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা আমরা অনেকেই জানি না। কিন্তু বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

অথচ ধর্ষণ আর দশটা অপরাধ থেকে ভিন্ন। ধর্ষিতা নারীকে সামাজিকভাবে খুবই বিব্রতকর অবস্থার মুখে পড়তে হয়। বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনার পেছনে মূলত দুটি নিয়ামক কাজ করে। একটি হচ্ছে পিতৃতন্ত্র, অপরটি সামাজিক অসমতা। জানুয়ারি হতে সেপ্টেম্বর, ২০০০ এই নয় মাসে ৪ শতাধিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করার পর পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৯১-১৯৯৪ এ ধর্ষণের মামলা হয়েছে ১ হাজার ৭২৩ টি। ১৯৯৬-১৯৯৯ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮ হাজার ১৩৭ টি। (ইত্তেফাক ৮.১০.২০০০)

১৯৯৬ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গণমাধ্যমে রিপোর্টটি ৮৩ টি নির্যাতনের মাঝে ৪৭.৬৭% ধর্ষণ ও গণধর্ষণ বলা হয়। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই ধর্ষণের ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। এ ধরনের ঘটনা থেকে শিশুরা পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না। সমাজের নিম্নস্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে। সমাজে ধর্ষণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নারীর বিরুদ্ধে প্রবল যৌনাত্মক নিপীড়ন, নির্যাতন ও অত্যাচারের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ধর্ষণের মাধ্যমে।

নারীর প্রতি চূড়ান্ত নির্যাতন হল ধর্ষণ। যখন একজন নারী ধর্ষিত হয় তখন ঐ নির্দিষ্ট ঘটনাতেই এটা সীমাবদ্ধ থাকে না। সমাজের সকলে মিলে এর দায়ভার নারীর উপর চাপিয়ে দেয় এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্তি্বকভাবে ধর্ষিতাকে বারবার ধর্ষণ করা হয়। বিভিন্ন মানবাধিকার ও নারী সংগঠনের জরিপে দেখা গেছে কেবলমাত্র ২০০২ সালেই ধর্ষণের পর খুন হয়েছে ৮৩ জন। অন্য একটি সূত্র থেকে জানা যায়, এদেশে ১৩-১৮ বছরের কিশোরী ধর্ষণের ঘটনার ৫৭% ই হয় গণধর্ষণ। এসব ধর্ষিতাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশে (৮%) শেষ পরিণতি হয় মৃতু্য।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বিলস এর এক সমীক্ষা রিপোর্টে জানা গেছে ২০০৪ সালে সারাদেশে ৫৭ জন কর্মজীবী নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। (আজকের কাগজ, ১৭ জানুয়ারি ২০০৫)

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, জানুয়ারিতে ৫১ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এছাড়া বরিশালে ৬ টি জেলায় ২০০৪ সালের মে মাসে থেকে ২০০৫ এর এপ্রিল পর্যন্ত ১৩ টি ধর্ষণের চেষ্টা ঘটেছে। (জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক, সংবাদ এবং ভোরের কাগজ, ফেব্রুয়ারি-জুলাই ২০০৫)। ২০০৪ সালের নভেম্বর মাসে ১০৮ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। (জনকণ্ঠ, ১ জানুয়ারি ২০০৫)







২০০৪ সালের (জানুয়ারি-মার্চ) সংবাদত্রে প্রকাশিত ধর্ষণের সংখ্যা ২২০ টি।

জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২০০৩ ধর্ষণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মোট ধর্ষণের ঘটনা ১৩৮১ টি এবং ধর্ষণজনিত মৃতু্যর সংখ্যা ১৪৩ টি।

ধর্ষণ শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয় পৃথিবীর অনেক দেশেরই সমস্যা। বিশ্বে প্রতি ৬ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিতা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৫ জন পূর্ণ বয়স্ক নারীর একজন এবং প্রতি ৬ মিনিটে এক নারী ধর্ষিত হয়। প্রতিবছর জ্ঞাত ধর্ষণের সংখ্যা ১৩০,০০০। মেঙ্েিকাতে প্রতি ৫-১৫ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয়। প্রতিবছর জ্ঞাত ধর্ষণের ঘটনা ২০,০০০; নৌকায় ভাসমান ভিয়েতনামী উদ্বাস্তু নারীদের ৩৯ ভাগ সাগরে অপহৃত ও ধর্ষিত হয়্ কলম্বিয়ায় প্রতি ১০ জন নারীর একজন ধর্ষিত হয়্ দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রতি ১.৫ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয়। প্রতিবছর ধর্ষণের শিকার হয় প্রায় ৩ লাখ ৮৬ হাজার নারী। বিশ্বে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ বিভিন্ন বয়েসী নারী ধর্ষিত হয়। বলকান যুদ্ধের সময় বসনিয়া-হার্জেগাভিনয় ২০ হাজারেরও বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয়। রুয়াণ্ডায় ১৯৯৪ এপ্রিল থেকে ১৯৯৫ এপ্রিল পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার নারী ও মেয়ের সংখ্যা ১৫ হাজার ৭ শ আড়াই লাখের বেশি।

আমরা বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকেই বিশ্লেষণ বা বক্তব্য দাঁড় করাতে সচেষ্ট থাকবো এই গবেষণাপত্রে। ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসেই দেশে প্রায় ১২ শ বিভিন্ন বয়সী নারী ধর্ষণ বা গণধর্ষণের শিকার হয়।



সরাসরি সংগৃহীত একটি কেইসে দেখা যায়, স্বপ্না তখন দশম শ্রেণীতে পড়ত। যশোরের চৌগাছা থানার ধুলিয়ানি হাইস্কুলে। স্বপ্নার দারিদ্র্য পরিবার। শিশির ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। অশ্লীল বিনোদনে মেতে থাকে। খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে। পড়াশুনা ও ছেড়ে দিয়েছে। বেকার ঘুরে বেড়ায়। ধূমপান করে প্রকাশ্যেই, মাদকেরও অভ্যাস আছে। তবে সে বখাটে হলেও মামা চেয়ারম্যান হওয়ায় কেউ তেমন কিছু বলার সাহস পায় না। শিশির স্বপ্নাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। এতে স্বপ্না হতচকিয়ে যায় এবং ভয়ে দ্রুত বাসায় ফেরে। তবে বাসার কাউকে কিছু বলেনি। পরদিন স্কুলে যাবার পথে শিশিরের সাথে দেখা। সে বলে, 'আমি তোমাকে ভালবাসি'। শিশিরের সাথে তার আরো অনেক বন্ধুরা ছিল। স্বপ্না জোর গলায় বলে 'আমি তোকে ঘৃণা করি'। ঘটনা এভাবেই এগুতে থাকে। শিশির প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের ক্ষোভে এবং বন্ধুদের সামনে অপমানিত হবার লজ্জায় ক্রোধে ফেটে পড়ে। সামাজিক প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা দেখাবার জিদ চেপে বসে। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। ২০০৫ সাল। স্কুল থেকে ফেরার পথে শিশিরের নেতৃত্বে উৎপেতে থাকা কয়েকজন এক সাথে স্বপ্নাকে ধরে ফেলে। মুখ বেঁধে ধর্ষণ করে। ক্ষেতের মাঝে ফেলে রাখে। পরে কে একজন এ অবস্থায় তাকে দেখে উদ্ধার করে বাড়ি পেঁৗছে দেয়। স্বপ্না তখন মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। একবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিল। কথা কম বলত, চুপচাপ থাকত, কাজেকর্মে প্রাণচঞ্চলতা ছিল না। হীনমন্যতায় ভুগত, পড়াশুনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। কথাবার্তায় আত্মবিশ্বাসের অভাব লক্ষ করা যেত। নিজেকে গুটিয়ে রাখত। সামাজিকভাবে নানা বিড়ম্বনার মুখোমুখি হয়ে একেবারে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল। 'নষ্ট মেয়ে' 'বিয়ে হবে না'-ইত্যাদি মন্তব্য শুনে তার যন্ত্রণা আরো বাড়ত। গ্রামীণ শালিসে উল্টো স্বপ্নাকে দোষারোপ করা হয়। নানান দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে অবশেষে আইনের আশ্রয়ও নেয় নি। স্বপ্নার এক চাচা ঢাকায় থাকেন। তিনি স্বপ্নাকে ঢাকায় বাসায় এনে রাখেন। তিনি ও তার স্ত্রী উভয়েই উচ্চশিক্ষিত। তারা স্বপ্নাকে উৎসাহিত করেন, সাহস যোগান। তাদের উৎসাহে অনুপ্রেরণায় স্বপ্না পড়াশুনা চালাতে থাকে এবং গ্রামের স্কুল থেকেই এসএসসি পরীক্ষায় এ গ্রেড পেয়ে পাশ করে। পরে চাচার বাসায় থেকেই এইচএসসি পাশ করেন। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছেন। স্বপ্নার ভাই সুমন আমার ক্লাসমেট ছিল। সে খুব হাসিখুশি, প্রাণবন্ত থাকত সব সময়। কিন্তু হঠাৎ কদিন তার খুব মন খারাপ, মনমরা দেখতাম। পরে অনেক জিজ্ঞাসার পর স্বপ্না সংক্রান্ত এই ঘটনাটা জানতে পারি। (ছদ্মনাম ব্যাবহার করা হয়েছে)

কেইসকে বিশেস্নষণ করলে স্পষ্ট হয়, শ্রেণী বৈষম্য নারী ধর্ষণের অন্যতম কারণ। স্বপ্নার দরিদ্রতা ও শিশিরের ক্ষমতার সম্পর্ককে ধর্ষণের সাথে সম্পৃক্ত করে দেখা যায়। শুধু আমাদের দেশেই নয় মেঙ্েিকা, ক্যামেরুন, পেরু, চিলি এবং আরব দেশগুলোতে যাদের সামাজিক প্রতিপত্তি বেশি তারা বিত্তহীন নারীদের ধর্ষণ করে বেশি।

'শিশির অশ্লীল বিনোদনে মেতে থাকে।' বর্তমানে ইন্টারনেট বা হিন্দি ও ইংরেজি ছবির রেপ সিনগুলো কিশোর-কিশোরীদের মনের পর্দায় যৌন আকাঙ্ক্ষার উদ্রেক করে। এই যৌন আকাঙ্ক্ষাটি যৌন সংসর্গ ঘটাতে প্ররোচিত করে। চলচ্চিত্র দর্শকদের মধ্যে যে সম্মোহন ছড়ায় তা জমা হয়, গ্রথিত হয় তাদের স্নায়ুজালে; অতঃপর তার ক্রিয়া চলে ছবিঘরের বাইরেও।

'শিশির পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে।' মনোবিজ্ঞানী হোলির মতে, ''কালচারাল ব্যাকগ্রাউণ্ডটা বড় ফ্যাক্টর ধর্ষনের জন্য সন্দেহ নেই। মানুষ শরীরের ক্ষুধার চেয়ে মনের পিপাসাকে গুরুত্ব দেয় বেশি। যৌনতার কাজে এগুলোর আগে মানুষের যেসব স্তর আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো শিক্ষা বা সংস্কৃতির দিকটা। তবে কিছু জৈবিক কারণও দায়ী। যে পুরুষের শরীরে খুব বেশি হরমোন ক্ষরণ হয়, যাকে অতি সক্রিয় বলা হয়, সেই পুরুষের যৌন ইচ্ছা বেশি হতে পারে। সুপ্রারোনাল গ্র্যাণ্ডের কর্টেকস থেকে অতি মাত্রায় হরমোন নিঃসৃত যদি হয় বা পিটুইটারি গ্ল্যাণ্ড যদি ফেল করে তাহলেও পুরুষের যৌনক্ষুধা অস্বাভাবিক ধরনের বেশি হয়। আর এই ধরনের পুরুষের যদি শিক্ষা বা সংস্কৃতির ভিতটা জোরালো না থাকে তাহলে মুহূর্তের উত্তেজনায় সে ধর্ষণকারী হয়ে উঠতে পারে।'

'তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। স্কুল থেকে ফেরার পথে...'। বিশিষ্ট অপরাধ বিজ্ঞানী ড. উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, 'বিশেষ সময়ে, বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে অনেকেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধর্ষণ করে ফেলেছেন। অথচ সুস্থ মাথায় ভাবলে এটা একটা অস্বাভাবিক কাজ। এসব ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক যৌন ক্ষুধা, সুযোগ, পরিস্থিতি সবই কারণ।'

'...সামাজিক প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা দেখানোর জিদ চেপে বসে।' সমাজবিজ্ঞানী মেলিনোস্কি বলেন, 'ধর্ষণ অবশ্য তাৎক্ষণিক আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু নেক সময়েই এটা বিকৃত কামের একটা রূপ। এটা হতে পারে সামাজিক প্রতিপত্তি এবং ক্ষমতা দেখাবার আনন্দ। যার জন্য গণধর্ষণ হয়। কোনো সামাজিক শ্রেণী তার থেকে দুর্বল শ্রেণীর ওপর ক্ষমতা দেখাবার জন্য এই কাজ করে।

'...বেকার ঘুরে বেড়ায়। মাদকেরও অভ্যাস আছে।' আর মাদকদ্রব্য ও বেকারত্বের অভিশাপ নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উস্কে দেয়। স্বপ্নার ধর্ষণের পরের যে আচরণ তার মনস্তাত্তি্বক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ধর্ষণের ঘটনা ঘটার ফলে তার মনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছিল। এর ফলে তার মধ্যে বিভ্রম বা ভিলু্যশণ (ঋধষংব ৎবষরপ) মনোরোগের লক্ষণ দেখা যায়। তার মধ্যে আত্মপীড়ন বা সেলফ টরচারিং অ্যাটিচু্যড দেখা যায়। ফলে বিষণ্নতা তাকে পেয়ে বসেছিল।এসব ছাড়াও আরো কিছু সমস্যা যেমন-হীনমন্যতাবোধ, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, সকল পুরুষের প্রতি অযৌক্তিক ঘৃণাবোধ ইত্যাদি ধর্ষণ প্রসূত মনোরোগ স্বপ্নার মাঝে দেখা যায় ধর্ষণ পরবর্তী সময়ে। যা তার মনস্তাত্তি্বক বিপর্যস্ততাকে নির্দেশ করে।

'সামাজিকভাবে নানান বিড়ম্বনার মুখোমুখি হয়ে...'স্বপ্না ঘটনার জন্য কোনোভাবেই দায়ী নয়। অথচ তার ওপর সামাজিক কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা চলে, সামাজিক গঞ্জনা সইতে হয়। পরিবারের কাছেও সে হয়ে পড়ে বিশেষ করুণার পাত্রী। সামাজিক বঞ্চনা তার আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত হানে ও মর্যাদাহানি ঘটায় ও নিজের প্রতি আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে। সামাজিক দিকের কথা চিন্তা করে এ গ্লানি নিরবে সয়ে যাওয়া এবং ধীরে ধীরে নিজের মাঝে এই নেতিবাচক অভিজ্ঞতাকে লালন করা ব্যক্তিত্বে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। এর ফলে সৃষ্ট মানসিক সমস্যা আর সামাজিক সমস্যা ডেকে আনে। সমাজ ব্যবস্থা এ ধরণের ঘটনার জন্যে বহুলাংশে দায়ী । তাই তো নির্যাতনকারী শিশিরের কোনো শাস্তি হয় না, গ্রাম্য সালিশে নির্যাতিত নারী স্বপ্নাকেই আরও বেশি লাঞ্ছনা ও অপমানের মুখোমুখি হতে হয়। তাকেই দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চলে নির্যাতনের কারণ হিসেবে।

নারী প্রতিনিয়ত ঘরে বাইরে এমনকি কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে (চৌধুরী, ২০০১)। নারীর যৌন হয়রানির শিকার হওয়া, ধর্ষিত হওয়া কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে বাসের জন্য অপেক্ষা করাই খারাপ লক্ষণ এবং তখন তাকে 'চরিত্রহীন' কিংবা 'খারাপ মেয়ে' নামকরণ করা হয়। স্বপ্নার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় নি।

আরো কিছু কেইস ও উপাত্ত বিশেস্নষণ করলে দেখা যায়, গত ১৩ আগস্ট ২০০৫ সাল দৈনিক প্রথম আলোর একটি রিপোর্ট ছিল এরকম-'পাবনায় চেয়ারম্যান ও পুলিশের সালিশে ধর্ষিতাকে একঘরে, ধর্ষক নির্দোষ' এই রিপোর্টে জানা যায়, পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলায় চাঁদপুর গ্রামে গত ৪ আগস্ট রাতে এক স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার সালিশে মেয়েটাকেই দোষী সাব্যস্ত করে একঘরে করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। জানা যায়, ফরিদপুর পৌরসভার উত্তর টিয়াপাড়ার সন্ত্রাসী সোহেল রানা দশম শ্রেণীর এক স্কুল ছাত্রীকে দীর্ঘদিন ধরে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। মেয়েটি এতে রাজি না হওয়ায় তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করা হয়। অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে মেয়েটির স্কুলে যাওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ করলে ক্ষিপ্ত সোহেল রানা দলবল নিয়ে মেয়েটির বাড়ি গিয়ে সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। মেয়েটির পরিবার ও এলাকাবাসীর দাবি, চেয়ারম্যান ও পুলিশ ধর্ষকের পরিবার থেকে মোটা অংকের টাকা খেয়ে সালিশে তাদের একঘরে হওয়ার রায় দেয়। এই সালিশেই পুলিশ মামলা না নেয়ার ঘোষণা দেয়। এমনকি আদালতে মামলা করলে গ্রাম থেকে উচ্ছেদের হুমকি দিয়েছে পরিবারটিকে।

সাধারণত পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে নারীর ধর্ষণ ঘটলে তারা সহজেই পার পেয়ে যায়। দিনাজপুরের ইয়াসমিনের ধর্ষণ ও হত্যাকারী পুলিশদের বিচারের জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। চট্টগ্রামে ধর্ষিত সীমার ধর্ষক ও হত্যাকারীরাও পার পেয়ে গেছে। আদালত প্রাঙ্গণে ধর্ষিত হয়েছে শিশু তানিয়া। এখনো তার কোনো সুরাহা হয়নি। কিছুদিন আগে সেনাকতর্ৃক নারী ধর্ষিত হয়েছে। পুলিশের ব্যারাকে পাওয়া গেছে যুবতীর লাশ। (৩.১২.০০ বাংলাবাজার)

উপরিউক্ত রিপোর্ট দুটি বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থার দুটি খণ্ড চিত্র। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নানা বয়সী নারী। অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু কন্যারাও ধর্ষণ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, স্কুলের শিক্ষক এমনকি প্রধান শিক্ষক, কলেজ-মাদরাসার শিক্ষকও ছাত্রী ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য ঘটনা ঘটিয়েছেন। ধর্ষণকারী যখন হয় সামাজিকভাবে প্রভাবশালী কেউ। যেমন-ডাক্তার, অ্যাডভোকেট, সেনাসদস্য, ইউপি চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক কোনো নেতা তখন প্রতিকারের প্রত্যাশাটও পরিণত হয় দুরাশায়। আর দুষ্টের দমনের দায়িত্ব যাদের ওপর ন্যস্ত, আইনের পোশাকধারী সেই পুলিশ যখন অপরাধ দমনের পরিবর্তে ধর্ষণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন এই সমাজকে ধিক্কার দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।

সমাজের শিক্ষিত ও কথিত উঁচু শ্রেণীর মানুষ যেমন অবতীর্ণ হয় ধর্ষকের ভূমিকায় তেমনি এই তালিকায় আছে সন্ত্রাসী , বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার বেকার ও ভবঘুরেরাও। ধর্ষণ শুধু অপরিচিতদের মাধ্যমেই হয় না। অতিপরিচিত, ঘনিষ্ঠজন এমনকি পরম শ্রদ্ধেয়(!) আত্মীয়ের দ্বারাও ধর্ষনের ঘটনা ঘটে। কে, কখন ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে তা আগে ভাগেই বলা যায় না। সে জন্য নারীকে সব সময় উদ্বেগ ও আতঙ্কের মধ্যে কাটাতে হয়। কোথায় এবং কার কাছে সে নিরাপদ তা সে জানে না। ধর্ষিতা যদি দরিদ্র পরিবারের হয় এবং তাকে সমর্থন করার মত কেউ না থাকে তাহলে তাদের দীর্ঘসময়ের জন্য চিকিৎসাহীন অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। অনেক সময়ের কেস যদি গুরুতর না হয়, সচেতনতার অভাব এবং ভিকটিমের বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থা থাকে ডাক্তারের কাছে যেতে বাঁধা দেয়। এর অর্থ এই যে প্রকৃতপক্ষে সংঘটিত ধর্ষণের মধ্যে অর্ধেকের কম আদালত পর্যন্ত যায়।

ধর্ষিতা মৃতু্যর মুখ থেকে বেঁচে আসে এক অর্তে মৃতু্যমুখী হয়েই বেঁচে থাকে। দৈহিকভাবে নারীর ক্ষতিসাধণ হয় তার উপর পাশবিক নির্যাতনের ফলে; যেমন-প্রবল রক্তপাত, সন্তান প্রসবে জটিলতা, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাত, যৌন ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত শরীল এবং তার ফলে ভবিষ্যতে সন্তান ধারণে অক্ষম হওয়া। এছাড়া সময়মত সুচিকিৎসার অভাব নারীকে নির্ঘাত পঙ্গুত্ব কিংবা মৃতু্যর দিকেও ঠেলে দিতে পারে।

ধর্ষিতা নারী এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। স্বাভাবিক চলাফেরা জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। সারাক্ষণ একটা ভয় বা নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি তার উপর বিভীষিকার মতো চেপে বসে। বাবা মা তার পড়াশোনা বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। অনেক সম্ভাবনার বীজ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। কখনো কখনো আইনী ব্যবস্থা নিতে গিয়ে বিফল হতে হয় দুর্নীতিপরায়ন এবং প্রভাবশালীদৈর মদদপুষ্ট পুলিশের কারণে। আইনের সহায়তা নিতে গিয়ে আরো বেশি দুর্ভোগ নেমে আসে তার জীবনে। পরিণতিতে নারীর যে মানসিক বিপর্যয় দেখা দেয় তার প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী। ধর্ষিতা নারীর স্বাভাবিক চলাফেরা ও জীবনযাপন ব্যাহত হয়। মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশায়, রাস্তায় নিঃশঙ্কচিত্তে চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। নির্যাতিত মেয়েটি নিজেকে ঘরের কোনে বন্দি করে ফেলে।

সমাজব্যবস্থা আমাদের মনোভাব গঠন করে। মনোভাব(ধঃঃরঃঁফব) হচ্ছে মানুষের ব্যাবহার বা আচরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। পারিপাশ্বর্িক পরিবেশের অনেক উপাদানই মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করে। একজন মানুষের মনোভাবের প্রকাশ ঘটে তার বিভিন্ন আচরণগত প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে। ধর্ষিতা নারীর প্রতি সমাজের মানুষের যে মনোভাব ও আচরণ তার সাথে সমাজের পুরো ব্যবস্থাটার যোগসূত্র তীব্র।

সমাজের পরিবারে একটি শিশু নারীর প্রতি অশ্রদ্ধা নিয়ে বড় হয়। সে নারীকে অবমাননা করতে বরং সাহসী হয়ে উঠে। এভাবেই সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা গ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ার অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। ধর্ষিতা নারী চরম সহিংসতার শিকার হবার পরও আরো মানসিক নির্যাতনের পাত্র হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। সামাজিকভাবে অপদস্ত হওয়ার কারণে বা দৈহিক ও মানসিক দিক দিয়ে অপদস্ত হওয়ার কারনে ব্যক্তি বিশেষ আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ধর্ষিতা নারীর জন্য ধর্ষনের সহিংসতা শারীরিক বা মানসিক আঘাত এমন অমানবিক অবস্থার সৃষ্টি করে যা তাকে অস্থির করে তোলে। এক্ষেত্রে কতগুলো কারণ বিদ্যমান মৌলিক কারণের পর্যায়ভুক্ত হচ্ছে, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও পিতৃতান্ত্রিক ও সমাজকাঠামো এবং তাৎক্ষনিক কারনের মধ্যে রয়েছে প্রতিশোধ, পুরুষাধীপত্য এবং নারীর আত্মবিশ্বাসের অভাব।

সমাজের নেতিবাচক মূল্যাবোধ দ্বারা আরোপিত নিপীড়নের অনুশীলন ও তাকে চিরস্থায়ী করে রাখার ব্যবস্থাই পুরুষকে নারী নির্যাতনের দিকে ধাবিত করে। অনেক ক্ষেত্রেই নিজ পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব তাকে প্রত্যাখ্যান করে। এটাই তাকে বেশি পীড়া দেয়। ফলে তার মানসিক অবস্থা আরও বিপদসঙ্কুল হয়ে যায়। তাই এক সময় সে নিজ পরিবার ও সমাজকে প্রত্যাখ্যান করে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়।

নারীকে একটি যৌন পণ্য ছাড়া আর কিছু মনে না করার ধারণা থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা সংঘটিত হয়। সামপ্রতিককালে নারীর প্রতি সহিংসতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যা নারীর মানবাধিকার আর মৌলিক স্বাধীনতা উপভোগের পথে বাধা হয়ে ওঠে এবং তাকে ক্ষতিগ্রসত্দ করে। এমনকি নিশ্চিহ্ন করে ফেলে।

ধর্ষিতা নারী যখন ধর্ষিতা হওয়ার অভিযোগ করে সমাজ তার অভিযোগ আমলই দিতে চায় না। এক্ষেত্রে ধর্ষিত নারীই সমাজে হয় প্রতিপন্ন হয়ে থাকে। ব্রাউন মিলার বলেছেন, নারীকে যখণ যৌন বস্তুতে নামিয়ে আনা হয় তখন ধর্ষণ বাড়ে,কমে না- এর ফলশ্রুতি এ সমাজে আমরা দেখতে পাই।

সমাজের যে আইনী কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা তা ধর্ষিতা নারীর সমস্যার সমাধান তো নয়ই, সংকটকে আরো বাড়িয়ে তোলে। ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দিনাজপুরে ইয়াসমিন নামে পনের বছরের এক কিশোরীকে ভোর রাতে একদল পুলিশ নিরাপদে বাড়ি পেঁৗছে দেয়ার নাম করে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভ্যানে তুলে নিয়ে ধর্ষণ ও হত্যা করে রাস্তায় লাশ ফেলে দেয়। এই বর্বর ও পৈশাচিক ঘটনার প্রতিবাদে দিনাজপুরবাসী ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদী জনতাকে শান্ত করতে শেষ পর্যন্ত পুলিশকে গুলি চালাতে হয়। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান অন্তত ৭ জন। আমাদের দেশে ধর্ষিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত ইয়াসমিনের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। তাদের প্রতিকারহীন বোবা কান্নায় চারদিকের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি ও শিথিল মূল্যবোধের কারনে নারী নির্যাতনের মামলাগুলো অনেকক্ষেত্রেই যথাযোগ্য গুরুত্বের সঙ্গে থানায় গ্রহণ করা হয় না। নির্যাতনকারী যদি প্রভাবশালী হয় তাহলে মামলা না নেয়া, ভিকটিমকে অযথা হয়রানি করার ঘটনা প্রায়ই ঘটে, যদিও বা মামলা নেয়া হয় তো ভালোভাবে তদন্ত করা হয় না। ধর্ষিতা নারীর ন্যায়বিচার পাওয়ার পথটি এতো দুরূহ যে বিচারের বাণী অধিকাংশে ক্ষেত্রে নীরবে নিভৃতে কাঁদে। ধর্ষণের সঠিক, সহজ, দ্রুত ও কঠোর বিচার হলে নির্যাতনের পরিমাণ কিছুটা হলেও হ্রাস পেতো বলে ধারণা করা হয়।

সমাজে ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনাই গোপন করে যাওয়া হয়। ফলে থানায় ধর্ষণের অভিযোগ খুবই কম আসে। আইনি প্রক্রিয়াটিও নারীর জন্য খুব সহায়ক নয়। সে জন্য অনেক মামলাই আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার মতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্যে অনেকেই যেতে চায় না। আবার পরিবার থেকেও কখনো কখনো নিরুসাহিত করা হয়। থানায় যাওয়া, মেডিক্যাল পরীক্ষা করানো, আদালতে দাঁড়ানো, সবটাই নারীর জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এ অসহনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে অনেকেই চায় না। আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়াকে অনেকেই দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হওয়ার শামিল বলে মনে করেন। এই অবস্থায় একদিকে যেমন ধর্ষণকারী সহজে রেহাহই পেয়ে যায়, অন্যদিকে তেমনি সমাজে জন্ম নেয় আরেকটি ধর্ষণের সম্ভাবনা। সমাজ ব্যবস্থা ধর্ষিতা নারীকে যাতে মানবীয়ভাবে বিপর্যস্ততার মুখোমুখি না করে, সেক্ষেত্রে সম্মিলিত প্রয়াস, সামাজিক প্রতিরোধ ও সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।



ধর্ষণ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের পদক্ষেপসমূহ:

১. ঘটনার যথাযথ বিচার করা, বিচারাধীন মামলায় দীর্ঘসূত্রিতা হ্রাস করে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করা ও রায় দ্রুত বাস্তবায়ন করা।

২. ধর্ষিতাদের জন্য পৃথক, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত সেল, মনিটরিং সেল ও চাঞ্চল্যকর মামলার ক্ষেত্রে বিশেষ ট্রাইবু্যনালের ব্যবস্থা ও তদন্ত কাজে উধর্্বতন কর্তৃপক্ষের তদারকীর ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৩. বিচারকার্য ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের সততার সাথে দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করা।

৪. ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, ডাক্তার, তদন্ত কর্মকর্তাদের মামলার প্রয়োজনে সাক্ষ্য প্রদানের ব্যবস্থা করা ও সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

৫. আক্রান্তদের সুচিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসকের জন্য জরুরী ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করা ও দ্রুত চিকিৎসার জন্য ধর্ষিতাদের হাতের নাগালে সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা।

৬. জনগণকে সচেতন করার লক্ষে বেতার ও টেলিভিশনসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক মাধ্যম ও প্রিন্টিং মিডিয়াতে ধর্ষণকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান এবং ধর্ষিতাদের ভয়াবহ ভোগান্তির চিত্র জনসমক্ষে তুলে ধরা।

৭. ধর্ষিতা তার পরিবারের সহযোগিতা কল্পে অপরাধী সনাক্ত করা, থানায় সোপর্দ করতে সহায়তা ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে মানসিকভাবে সুস্থ করে তুলতে পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশিদেরকে মানবিক গুণাবলী নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য সচেতন করে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৮. শিক্ষার প্রাথমিক স্তরেই যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত আইন সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা ফলপ্রসূ হবে।

৯. ধর্ষিতাদের আইনী সহায়তা, চিকিৎসা, চিকিৎসা-পরবর্তী পুনর্বাসনকল্পে তথা বিভিন্ন আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত করার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সরকারকে আরো উদ্যোগী হতে হবে। অন্যদিকে বেসরকারি পর্যায়ে আরো বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে।

১০. ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

১১. ধর্ষন আইনসহ পারিবারিক আইনসমূহ সংশোধনের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। সেই সাথে যাতে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হয় সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

১২. সবার মাঝে নৈতিক শিৰা ছড়ায়ে দিতে সকল পর্যায়ে কাংখিত উদ্যোগ গ্রহণ।

ধর্ষিতা নারী শারীরিক ও মানসিকভাবেই নির্যাতিত শুধু নয়, সামাজিকতায় ভীষণভাবে আঘাত হানে। এক্ষেত্রে সমাজব্যবস্থা অবশ্যই দায়ী। 'সমাজ' ও 'রাষ্ট্র' কেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। নারীকে শুধু ব্যক্তিগত কৌশল, সচেতনতা কিংবা সরাসরি প্রতিরোধই নয় নিজেকে রক্ষার সাথে সাথে সমষ্টিগতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ। আমাদের দেশে কতো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও বলা যায় যে, এ ধরনের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। ধর্ষণের শিকার অনেক মেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকে লেখাপড়া ছাড়ছে, ঘরমুখী হয়ে পড়ছে। যাতে অসংখ্য মেয়ের জীবন বিপন্ন হয়ে না পড়ে সে জন্য তাদের সামগ্রিক অগ্রগতির স্বার্থেই ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। আর পরিবারের সদস্যদেরও উচিত, মেয়েকে দায়ী না করে তার পাশে দাঁড়িয়ে মানসিক শক্তি যোগানো। পরিবারের সমর্থন পেলে এসব মেয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হবে না এবং আত্মহত্যা করতে উদ্যত হবে না।

ধর্ষণের মুলোৎপাটনের জন্য সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সজাগ করতে হবে এর বিরুদ্ধে; কারণ এর উৎপত্তিস্থল এই সমাজই। নির্যাতনের প্রতিকারের জন্য সাধারণ মানুষের মন-মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে এবং এইসব ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে প্রবল সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে প্রতিরোধ গড়ে না উঠলে শুধু আইন দিয়ে এসব ঠেকানো যাবে না। ধর্ষণতুল্য ঘৃণিত দ্বিতীয় আর কোনো অপরাধ নেই। এ অপকাজের নায়ক হিসেবে পুরুষেরাই এগিয়ে আছে। এমন অপকাজ করেও পুরুষেরা কখনো এর জন্য সেই অর্থে ভোগান্তিতে পড়ে না। ধর্ষণের ঘটনাটি নিয়ে ধর্ষিত নারীর ব্যাখ্যা আমরা সাধারন শুনতেও পাই না। আমরা চাই, প্রচলিত মূল্যবোধ পরিবর্তন হবে, নির্যাতিতাকে নয়, নির্যাতনকারীকে নিন্দা করা হবে। এজন্য ধর্মের চেতনাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই বিশ্বশান্তি, প্রগতি ও উন্নয়নের পথে অন্তরায় এ সমস্যা দূরীভূত হবে ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-৪

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে জুলাই, ২০১০ রাত ২:২৭

ঋষিক বলেছেন:

১১ ই নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৩৯

আনিসুর রহমান এরশাদ বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.