নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কয়েক দিন আগে ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র অশনি সংকেত দেখেছিলাম। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই নামের একটি অসমাপ্ত উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য রচনা এবং পরিচালনা করেছেন ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের এক গুণী নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। তেতাল্লিশের মন্বন্তর এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ বাংলার আর্থ-সামাজিক পটপরিবর্তন ছিলো এই ছবির মূল বিষয়। ছবিটির পটভূমি ১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত বৃহত্তর বাংলা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার সেনাবাহিনীর জন্য অতিরিক্ত খাদ্য সংগ্রহ করলে বাংলার গ্রামীণ অঞ্চলে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ফলে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হন।
এই দুর্ভিক্ষ কিভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছিল তা-ই এই ছবির মূল উপজীব্য। বাংলার একটি ছোট্ট গ্রামে গঙ্গাচরণ নামে এক শিক্ষিত ব্রাহ্মণ সস্ত্রীক এসে বসতি স্থাপন করে। নতুন গাঁ ব্রাহ্মণবিহীন, সেই সুযোগে ধূর্ত গঙ্গাচরণ সেখানকার প্রধান পুরোহিত হয়ে টোল খোলার পরিকল্পনা করতে থাকেন। সরল গ্রামবাসীরাও নিজেদের মধ্যে একজন ব্রাহ্মণকে পেয়ে খুশি হয়ে ওঠে। তাঁর স্ত্রী অনঙ্গ নিজের মধুর ও স্নেহশীলা স্বভাবের জন্য অচিরেই গ্রাম্যবধূদের ভালবাসা অর্জন করে।
দুর্ভিক্ষে গ্রামে খাদ্যের সংকট দেখা যায়। যুদ্ধের কারণে বাজারে চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে চাল হয়ে যায় দুষ্প্রাপ্য। বুদ্ধিমান গঙ্গাচরণ নিজের জন্য কিছু চাল সংগ্রহ করে নেয়। প্রথমদিকে খাবার সংগ্রহ করতে পারলেও তাতে শেষরক্ষা হয় না। অনঙ্গ যখন কায়িক শ্রমের মাধ্যমে কিছু উপার্জনের কথা চিন্তা করতে শুরু করে, তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও গঙ্গাচরণকে সম্মতি দিতে হয়। অনঙ্গ অন্যান্য গ্রাম্যবধূদের সঙ্গে কাজ করতে যায়। এই সময় যদু নামে এক পোড়ামুখ গ্রাম্য যুবক গ্রামের বউ ছুটকিকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে ছুটকি তাকে প্রত্যাখ্যান করে। অনঙ্গ তার সোনার বালার বদলে গঙ্গাচরণকে কিছু চাল নিয়ে আসতে বলে। গঙ্গাচরণ চলে গেলে, ছুটকি ও অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে অনঙ্গ আলু তুলতে যায়। কিন্তু অনঙ্গ কায়িক শ্রমে অভ্যস্থ নয়। সে একটি ফুল দেখে আলু ফেলে সেই দিকে ছুটে যায়। এই সময় একটি লোক ছুটকিতে তুলে নিয়ে যেতে চাইলে, আলু তোলার হাতা দিয়ে আঘাত করে ছুটকি তাকে খুন করে। পরে ছুটকি পেটের জ্বালায় সেই পোড়ামুখ লোকটির সঙ্গে পালিয়ে যায়।
এই সময় একটি তথাকথিত নিচু জাতের মহিলা মারা গেলে, গঙ্গাচরণ মানবিকতার খাতিরে তাঁর ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ত্যাগ করে সেই মহিলার সৎকার করে। খাদ্যের অভাবে গ্রামে লোক মারা গেলে গ্রামবাসী গ্রাম ছেড়ে যাওয়া শুরু করে। এই দুর্ভিক্ষের কারণে বাংলায় লাখ লাখ লোক মারা যায় এবং যা মানবসৃষ্ট মন্বন্তর নামে পরিচিতি লাভ করে। ছবির শেষে অন্তঃসত্ত্বা অনঙ্গকে নিয়ে গঙ্গাচরণ ও অন্যান্য গ্রামবাসীরা গ্রামত্যাগ করে। শেষে ১৯৪৩ সালের মনুষ্যসৃষ্ট সেই স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর খতিয়ান দেখিয়ে ছবি সমাপ্ত হয়।
দুর্ভিক্ষের সময় হাজার হাজার কাজ-হীন, আশ্রয়-হীন মানুষ মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে উপনীত। হয়তো অনেকেই কিছু দিনের মধ্যে মারা যাবে। রাস্তায় পড়ে থাকে মৃতদেহগুলো। এরকম একটা পরিস্থিতিতেও গ্রামে একজন অতিথিকে উদারতার সাথে গ্রহণ করা হয়; বিশেষ করে অতিথিটি যদি শহর থেকে এসে থাকেন। এখনও আপনি গ্রামে যান, যে-কোনো বাড়ীতে ওরা আপনাকে খাওয়াবে। এক ঘন্টার মধ্যে সেখানে আপনার এক বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তাদের নিজেদের সামর্থ খুব সামান্যই কিন্তু একজন অতিথি তাদের কাছে ঈশ্বরতূল্য। এটাই ভারতীয়দের ধর্ম।
অশনি সংকেতে একজন বৃদ্ধলোকের মধ্য দিয়ে দূর্ভিক্ষের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছে। তার স্ত্রী বলছেন, ‘আমরা অবশ্যই তাকে একবেলা খাওয়াবো’। তার স্বামীটি বেশ চালাকির আশ্রয় নেয়, কিন্তু তার মধ্যে ক্রমশঃ পরিবর্তন আসছিলো। সে বলে, ‘না, ও একজন ফকির। আমি জানি সে ভিক্ষা করার জন্য এসেছে, আমাদের খুব সতর্ক থাকা দরকার; অবশ্যই আগে নিজেদের খাবার নিয়ে চিন্তা করা উচিত’। স্ত্রী বলে, ‘না, দরকার নাই। আমি দু’বেলা না খেয়ে থাকবো, তাও চলো ওকে একবেলা খাওয়াই।’ স্বামীটি একই সাথে একজন পুরোহিত, স্কুল শিক্ষক এবং ডাক্তার। সে কোনো-কিছুই বিশেষ জানতো না। কিন্তু গরিব কৃষকদের গ্রামে একমাত্র ব্রাক্ষ্মণ হিসেবে তার মর্যাদা ছিলো।
সে কলেরায় আক্রান্ত রোগী ঝাড়তে যাবার আগে স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান বিষয়ক বই দেখে এবং ঝাড়-ফুঁকের অনুষ্ঠানও প্রচলিত রীতিতেই সম্পাদন করে। শেষে যেন কথার ছলেই সে নদীর পানি বা মাছি বসা খাবার খেতে নিষেধ করে। প্রগতি বলুন বা বিজ্ঞান বলুন সে একভাবে তা বিশ্বাস করে। শুরুতে সে একজন অসাধু ব্যক্তি ছিল। কারণ সে গ্রামের এইসব গরীব মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিতো। শেষে যখন দূর্ভিক্ষে এক অস্পৃশ্য নারী মারা যায় এবং কেউ তাকে ছুতে পর্যন্ত নারাজ, তখন এ-ব্রাক্ষ্মণ স্বামীটি ঘোষণা করে ‘আমি যাব, এর জন্য কিছু করতেই হবে। আমি নিজে মৃতের শেষকৃত্যানুষ্ঠান করবো’। সুতরাং শেষ দিকে এসে এ-সব কুসংস্কার থেকে সে নিজে মুক্ত হয় এবং কাজটা করতে পারে। মানবতা তার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।
তৎকালীন বাংলায় গ্রামীণ দারিদ্র্য ও কৃষকের দুর্গতির জন্য যেমন ছিলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আংশিকভাবে দায়ী, তেমনি কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টিকারী বণিক সমাজ ও শাসকগোষ্ঠীর হঠকারিতাও ছিল বহুলাংশে। আর মনুষ্যসৃষ্ট সেই দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপট নাকি ছিল রাজনৈতিক। বলা হয়ে থাকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অতিরিক্ত মুনাফার লোভে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বাজার থেকে উধাও করে দিয়ে এই ঘটনাকে খাদ্যসঙ্কট বলে চালানো হয়েছিল। নিরীহ মানুষকে ক্ষুধার্ত রেখে খাদ্যদ্রব্য উধাও করার পিছনে ছিলো ক্ষমতা লোভীদের প্রত্যক্ষ মদদ আর ষড়যন্ত্র। সেই সময়ে দুর্ভিক্ষের আঘাতে জর্জরিত সেই মানুষগুলো ছিল প্রতিবাদী। তাদের বুকে ছিল অসীম সাহস।
প্রতিবাদী মানুষগুলো গড়ে তুলেছিল আন্দোলন। তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪০ এর দশকে সংগঠিত সেই আন্দোলনে ভূমিহীন, গরীব ও মাঝারি কৃষকরা অংশগ্রহণ করেছিলো। অংশগ্রহণ করেছিল চাষীরাও। তারা সংগঠিত হয়েছিলো নিজেদের পাওনা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে। সেই প্রতিবাদী আন্দোলন ছিলো অনেক বেশি সংগঠিত ও শক্তিশালী। কিন্তু বড় দুর্ভাগ্য, পরবর্তী সময়ে তারাই ছিলো দুর্ভিক্ষের সারি সারি লাশ। কারণ, এই সাধারণ মানুষগুলোর সামনে তাদের শত্রু দৃশ্যমান ছিলো না। তারা ছিল নিতান্তই সাধারণ। তাই প্রতিবাদী হয়েও, রাস্তায় পড়ে মরা ছাড়া এই মানুষগুলোর আর কোনো উপায় ছিলো না।
০৭ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৪২
আনিসুর রহমান এরশাদ বলেছেন: আপনার ভাল লেগেছে জেনে আমারও ভাল লাগলো।
আপনাকে ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৫১
কাফী হাসান বলেছেন: ভালো লাগলো +