![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দরজার কপাটে কিল পড়ছে অনবরত।
সুপুষ্ট দশ বারখানি হাত ক্রমাগত পিটিয়ে যাচ্ছে দরজা। চিৎকার হল্লা চলছে সমানে। আশেপাশে জমে উঠেছে উৎসাহী জনগণের ভিড়। তবে সেই জনগণ শুধুই নিস্তব্ধ পুতুল। জানি, তারা শুধুই নীরব দর্শক। দেখবে শুনবে বুঝবে তারপর ভুলে যাবে।
আমি আমার প্রিয় ইজি চেয়ারটাতে এলিয়ে পড়ে আছি।
চশমাটা কোথায় রাখলাম মনে করতে পারছি না। চশমা ছাড়া তেমন দেখতে পাই না আজকাল। তাই বেশ অসহায় বোধ করতে থাকি সেটার অনুপস্হিতিতে। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক হাতড়ে ক্ষান্ত দিলাম। কিছুই যখন করার নেই তাই মাথাটা চেয়ারে এলিয়ে চোখ বুজলাম।
আর চোখ বুজতেই চোখে ভেসে উঠল অতি স্পষ্ট একটা মুখ।
একজন ঋজু দীর্ঘকায় পুরুষ যেন তাকালেন আমার দিকে। একবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিলেন যেন। কিঞ্চিত হাসির রেখা ছুঁইয়ে ঠোঁটে বললেন-
গেলাম, আর দিয়ে গেলাম একটা দেশ। আগলে রাখিস।
সেদিনটাও এমনি ছিল।
ওই দরজাটারই ওপাশে ক্রমাগত আছড়ে পরছিল বেশ কয়েকজোড়া শক্ত হাত!
দেশ তখন স্বাধীন হবে হবে প্রায়্। চারিদিক থেকে আসছিল একের পর এক এলাকার স্বধীনতার খবর। এক একটা খবর আসে আর ওই দীর্ঘকায় পুরুষটির হাসি আরও খানিক চওড়া হয়।
সে পুরুষটি আমার বাবা।
প্রতিটা খবরই আসতো আর আমরা ঘরে যেন পালন করতাম উৎসব। তখন আর বয়স কতই বা আমার! আট কি নয়। কতটাই বা বুঝি তখন।
তবু বাবা বোঝাতেন আমায়, ধর তোর খুব প্রিয় একটা জিনিস কেউ কেড়ে নিয়ে গেল তোর কাছ থেকে। কেমন লাগবে?
আমি বললাম রাগ হবে।
তিনি সোৎসাহে বললেন, তখন কি করবি তুই?
ওর কাছ থেকে কেড়ে আনব, কিছু না বুঝেই বলেছিলাম সেদিন।
বাবা আমাকে কাছে টেনে বলেছিলেন, শোন বাবা এটাই হল স্বাধীনতা। বাংলাদেশ আর এর মাটি বাতাস সবই আমাদের পরম প্রিয়্। অথচ ওই পাক মিলিটারী দল কেড়ে নিতে চায় আমাদের এইসব অধিকারগুলি। কেড়ে দাবিয়ে রাখতে চায় আমাদের স্বাধীনতা।তাই আমরা লড়ছি ওদের গ্রাস থেকে আমাদের মাকে উদ্ধারের জন্য।
ছোট বয়সে অতটা না বুঝলেও বলতে শিখেছিলাম বাবার দৌলতে-
বীর বাঙালি অস্ত্র ধর,
বাংলাদেশ স্বাধীন কর।
বাবা ছিলেন স্হানীয় স্বাস্হ্য কমপ্লেক্সের একজন সিনিয়র ডাক্তার।
সহকর্মীরা কে যে কখন কোনদিকে ভারতে সটকে পড়েছে তাও বোঝা যোয়নি। বাবা দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা একবারের জন্যও ভাবেননি। তার প্রিয় অস্ত্রগুলো নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সংগ্রামে।
তার ডাক্তারী ব্যাগখানাই ছিল তার অস্ত্র। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেরই ঘরে লুকিয়ে সেবা করতেন বাবা। তখন বাবার চোখেমুখে খেলা করত এক অন্যরকম উল্লাস।
সেটাই বোধহয় হল তার কাল।
পুরো জাতি তখন স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখার নেশায় আচ্ছন্ন। জয় এলো বলে।
১৪ই ডিসেম্বর।
যে দিনটার কথা আজ এই বয়সেও ভুলিনি আমি। ঘরের দরজায় ক্রমাগত আঘাত। বাবা নির্ভীক। মাকে বললেন, ভেতরে যাও।
আর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন শেষ কথাটি। যা আজও আমার কানে ব্যথা নয় গর্ব সাথে করে গোঙায়-
গেলাম, আর দিয়ে গেলাম একটা দেশ। আগলে রাখিস।
দৃপ্ত পায়ে বাবা গিয়ে দরজা খুললেন। জনা পনেরো মানুষ। সবার সামনে হামিদ চাচা। এলাকার চেয়ারম্যান। যুদ্ধের আগেও দেখেছিলাম বাবাকে দেখে সালাম দিতেন ওই চাচা হাত তুলে। আর আজ প্রথমেই বাবার কলার জাপটে ধরে বললেন, আয় হারামজাদা, তোকে স্বাধীন বাংলা দেখাই।
দেখলাম বাবাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। ছুটে গেলাম আমি।
আর তখনই একজন তুলে আমাকে ছুঁড়ে দিল দেয়ালে। মাথা ঠুকে গেল দেয়ারে আর সংজ্ঞা হারালাম আমি।
জ্ঞান হারানোর সময়ও আবছা চোখে দেখলাম দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে গর্বোদ্ধত একটা ঋজু দীর্ঘ ছায়া।
সেদিনের পর সেই ছায়া আর কখনোই দেখিনি আমি।
দরজার বাইরে আওয়াজ বাড়ছে।
আমি খানিকটা আনমনা হয়ে কিছুক্ষণ ওই আওয়াজটা শুনলাম। সেদিনের সাথে কি ভীষণ মিল!
ওই দেয়ালের সাথে আঘাতে আমার চোখটা বেশ ক্ষতিগ্রস্হ হয়। তাই চোখে এখন হাই পাওয়ারের চশমা ছাড়া মোটামুটি কিছুই দেখিনা আমি।
তবে সেটার একটা অনুভূতি আছে আলাদা।চশমা ছাড়া যখন চোখে ঝাপসা দেখি তখনই মনে পড়ে সেই দৃপ্ত দীর্ঘ ছায়া। যেন এখনো বলছে আমাকে-
গেলাম, আর দিয়ে গেলাম একটা দেশ। আগলে রাখিস।
আমি তখন আমার অস্ত্র তুলে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
আমার অস্ত্র আমার কলম। কলমের আঁচড়ে আমি তুলে ধরি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকানো যত নষ্টামি, অনাচার আর দুর্নীতির যত ফাঁক-ফোঁকর। মুখোশ টেনে খুলি রাজনীতির আড়ালের যত নষ্ট পিশাচদের।
সেই হামিদ চেয়ারম্যান আজ মন্ত্রীর আসনে। আমার চোখ ভেসে আসে জলে। রক্তে টগবগ করে ফোটে দাবানলের ফুলকি। আর আমি লিখে চলি অবিরাম অনন্ত।
সেই লেখারই ফসল বাইরের ওই করাঘাত।
ওরা এসে গেছে। জানতাম আসবে একদিন। সময়ের চাকা ঘুরে আবার ফিরে এসেছে সেই একই জায়গায় একই সময়।
১৪ই ডিসেম্বর আজ। আজ আরেকবার এসেছে ওরা সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে।
সেদিন অনেক ভয় পেয়েছিলাম ছোট্ট আমি।
আজ বাবার জায়গায় দাঁড়িয়ে যেন তার তেজ ভর করল শরীরে। কোন ভয়ের ছিঁটেফোঁটাও টের পেলাম না বুকের গলি-ঘুঁপচি খুঁজেও।
আমি দৃপ্ত কন্ঠে ডাকলাম আমার সন্তানকে।
সূর্য, সূর্য… এদিকে আয়। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল ও।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম সস্নেহে আর বললাম-
গেলাম, আর দিয়ে গেলাম একটা ধ্বংসপ্রায় দেশ। পারলে গড়ে নিস নিজের মত করে। আগলে রাখিস।
ঝাপসা চোখে টলতে টলতে এগিয়ে দরজা খুললাম। না দেখেও বুঝতে পারলাম কারা এরা। হামিদের দুই ছেলে ও তার সঙ্গী-সাথী এরা।
নিমেষে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল মেঝেতে। পড়েই খেয়াল করলাম নিজের ছায়া।
সেই দৃপ্ত দীর্ঘকায় ঋজু ছায়া!
ঝাপসা চোখে উম্মত্ত ধারালো অস্ত্রটা শরীরে নেমে আসতে দেখলাম,
আর ফিসফিসিয়ে বললাম-
গেলাম, আর দিয়ে গেলাম একটা দেশ। বাংলা, তুমি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হও।
আদ্যোপান্ত অণুগল্প “১০”
।।সা।ত।কা।হ।ন।।
০১ লা মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১২:৫২
অংকনের সাতকাহন বলেছেন: ধন্যবাদ ।
২| ০১ লা মার্চ, ২০১৩ বিকাল ৩:১৬
স্বপনবাজ বলেছেন: বাস্তবতাও এমনি
০১ লা মার্চ, ২০১৩ রাত ৯:৫৫
অংকনের সাতকাহন বলেছেন: হুমম :-(
©somewhere in net ltd.
১|
০১ লা মার্চ, ২০১৩ দুপুর ১২:২৫
মামুন রশিদ বলেছেন: সুন্দর, ভালো লেগেছে ।