![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কুরবানীর মাংস বিলানো হচ্ছে। দশ/বারো' বছরের পরী ও তার মা বসেছে লাইন ধরে, দু'জনের থালা আর ব্যাগ নিয়ে। করোনা'র কারণে ঘরে ঘরে গিয়ে আর কুরবাণীর মাংস নিতে দেয় না, সব বন্ধ । তাই পথের একধারে ফাঁকা জায়গায় সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে সারি বেঁধে বসে। মাঝে মাঝে লোকজন আসছে, কুরবাণীর মাংস নিয়ে । তারপর সবার সারি করে রাখা ডিশ, হাঁড়ি পাতিলে এক এক করে তুলে দেয়।
ওরা সেই সকাল থেকেই এসেছে, নইলে ভাল জায়গা পেত না। বসেছে একদম প্রথম দিকে। পরী তার থালা মাংসে ভরলেই পাশে আর একটি ব্যাগে রেখে দেয়। বিকেল পর্যন্ত ব্যাগের অর্ধেকটা ভরেছে। নেবার লোকও তো অনেক। মাংস দিচ্ছে সবাই। নানা জনের নানান ছাঁদের , নানান জাতের মাংস, হাড্ডিওয়ালা, কচি গরু, বুড়া গরু সব একসাথে । একজন কসাই মত লোক বড় এক বালতিতে মাংস নিয়ে এলেন। সবাই ভাবলো এবার বেশি বেশি পাবে । তাতেও কি, এক টুকরার বেশি কেউ পায় না। পরীর দিকে চেয়ে লোকটা কি ভেবে জানি ওকে কয়েক টুকরা বেশি দিল। তার মধ্যে কয়েকটা একদম নরম, হাড্ডি ছাড়াই। পরী বেজায় খুশী । এইটায় কাবাব হবে, মাংস বেশি, হাড় কম।
কাবাবের কথা সে শুনেছে বুলার কাছে । সে বস্তিতেই তাদের কাছাকাছিই থাকে। গেল রোজার সময় সে বড় একটা হোটেল সেরাটনে ইফতার করছিল। কারা জানি তাকে 'পথশিশু' হিসেবে নিয়ে যায় । অনেক লোক টিভি ক্যামেরা ,সাংবাদিক, কত কি খাবার । পরীকে সে গল্প করছিল-, 'জানস্ কত্ত খাবার। এক লগে আর কত খামু। সব মজার২ খাবার , তয় আমার সবচেয়ে ভাল লাগছিল কাবাব'।
- কাবাব কিরে ?
- কাঠির মইধ্যে নরম তুলতুইল্যা মাংস, আগুনে পুড়ায়। কী যে স্বাদ আর সুন্দর গন্ধ। তয় একটু ঝাল বেশি। গোটা খাইতে পারি নাই।'
- বাড়িতে লইয়া আইতি ।
- ঘরে নিতে দেয় না । নইলে তোর লাইগ্যাও আনতাম ।
বুলার সেই কথাগুলা ভাবতে২ পরী হাসে । ও ঝাল খেতে পারে না। কিন্তু তার কোন অসুবিধা নাই। সে পাইলে পুরাটাই খাইত। এক সময় পরী ওই মাংসের টুকরো গুলোয় হাত বুলাতে২ মাকে বললে,
- 'মা , এইগুলার কাবাব হয় ?'
মা অবাক হয়ে কি বলবে, ভেবে পেল না। ভাবলেশহীন মুখে শুধু বলে,
- 'আমি কি কাবাব বানাই ?
- নরম মাংস গুলান দিয়া মশলা দিয়া আগুনে পুড়ায়, জান মা ঝাল একটু বেশি দিতে হয় ,তয় মজা হয় খুব' ।
মাংস দিতে আসা লোকগুলো বিলি করতে ২ আলাপ করছে ,কেমন করে গরু কিনেছে ,কোন হাটে দাম বেশি, কিনতে গিয়ে কি মুশকিলে পড়ছিল করোনার জন্য। পরীর কানে আসে। ভাবে,তাগো কত পয়সা, কত খাবার, আরাম..,
- 'আরে ভাই, এইবার যা গরুর দাম।
- করোনার জন্য ইন্ডিয়ার গরু আসে নাই , সেই কারণে মনে হয়।
- আরে না । সরকার লক ডাউন করছে। গরুও লক। তারপরেও তো লোকে আনছে। সারা বছর পালছে ,না বেচলে খাবে কি? কুরবানী তো শুধু উৎসব না, বিশাল অর্থনীতি, এইবার ৩০ লাখ গরু ও ৫৫ লাখ খাশি কুরবানি হইছে। ১০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হবে-
- পরে কত দিয়ে কিনলেন?
- এই তো, চাইছিল দেড় লাখ, এক'এ ছাড়ল। পরের দিকে তো আর কেনার লোকও নাই।
- তাই। আমারটা অবশ্য বড়, অস্ট্রেলিয়ান, আড়াই লাখ। আমার তো লোকজনও বেশি, তবে বিলাইও । শুধু আমার লন্ডনে থাকা মেয়েটার জন্য কিছু রাইখে দিতে হয়। ওখানে তো এইসব পায় না। বলে কুরবাণীর মাংসের টেস্টই আলাদা। সেই জন্য আবার একটা আলাদা ডীপ ফ্রীজ কিনলাম।
- ঠিকই কইরছেন। ফতোয়া শুনছেন না, 'কুরবানীর মাংস বিলাইতে হবে এমন কোন দলিল নাই ,সবটাই রাখা যায়' ।
- না না এইটা ঠিক না । এইসব একেকজন একেক রকম বলে ।
- তা ঠিক । তবে আমি বিলাই । তিনভাগ করি ,একভাগ নিজের , একভাগ আত্মীয়সজন,আর একভাগ গরীব মানুষ । বছরে এই একটা দিনই তো, সবাই ভাগ করে খাবে ।
-ইসলামে দেখেন কত সুন্দর নিয়ম করছে। শুধু বড়লোক খাবে তা হবে না। সব গরীব মানুষেরও দিতে হবে, তাদেরও তো খাইতে দিল্ চায়, ঠিক কি না কন?
- ঠিক, ঠিক । মানে এইটা একটা সাম্যের ব্যবস্থা বুঝলেন না, সমতা । তা ছাড়া অনেক নেকীও হয়। সবাই এই একটা দিন প্রাণ ভরে খাউক......।
পরীর খিদেও পেয়েছে । কখন যে মা ফিরবে ঘরে । সেই ভোরেই এসেছে। কখন রাঁধবে আর কখন খাবে। হায়! ঘরের কথা ভাবলেই ওই দালান গুলার দিকে তাকায়,আর তাদের তো সেই ঝুপড়ী। একসময় সন্ধ্যে হয়ে রাতও হয়। লোকজন আসা কমে গেছে। অপেক্ষায় ঘুম পেয়ে যায় পরীর। খিদেয় আর অবসাদে ঘুমিয়েই পড়বে যেন । হঠাৎ মা ডাকলো,
'পরী উঠ,ব্যাগ নে চল। আর কেউ আইব না মনে হয়, চল'।
দু'জনেই মাংসের দুই ব্যাগ নিয়ে হাঁটা দিল,পরীর নাকে মাংসের ঘ্রাণ, মা রান্নার ব্যবস্থা করবে । সে বসে বসে ভাল মাংস গুলো আলাদা করেছে। বালতিওয়ালা লোকটা ওইগুলো দিছিল ।
'মা জানো, ওই ড্রেনের পাশে বিহারীর দোকানে কাবাব বানায় কয়লার আগুনে । মা, আমি এই নরম মাংসগুলা বাইচ্ছা রাখছি,তুমি বানায় দিবা?'
কিন্তু ওর মা কথা গুলো শুনলো কি না বোঝা গেল না। কারণ তার কথার উত্তর না দিয়ে বাজারের দিকে যেতে থাকে। হঠাৎ একটা অজানা আশঙ্কায় পরী এবার মা’কে জিজ্ঞেস করল,
-কই যাও মা? ওইটা তো বাজারের রাস্তা ।
- হ ,বাজারের দিকেই যাই। মাংস গুলা বেচন লাগব না ?
সেকি ! সেই কখন থেকে কষ্ট করে মাংসগুলো যোগাড় করেছে, ভাল নরম মাংসগুলো বেছে ২ আলাদা করলো,আর মা এখন সব বেচে দেবে? হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল পরীর।
- মা বেইচবা ক্যান।, আমরা মাংস খামু না ? আমার ভুখ লাগছে। ঘরে চলো।‘
সে মা'র আঁচল ধরে টানতে থাকে। কিন্তু মা তার কোন কথার উত্তর না দিয়ে বাজারে সোজা ‘মনির হোটেল’ এর দিকে চলেছে। হোটেল মালিকের সাথে দরদাম করাতে নিশ্চিত বুঝল, মা মাংস গুলো আর তাদের ঘরে নিয়ে যাবে না, রাখবে না । তবুও জেদ ধরলো,
- মা মাংস বেইচ্চা দিবি্, আমরা খামু না,তুই রানবি না?’ এবার মা'র যেন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গলো।
- চুপ কর। অভাগী। তোর ঘরে কোন চুলা আছে যে রানবি। চাল নাই চুলা নাই আবার মাংস খাবার সাধ'।
দরদাম ঠিক হলে মা’র ব্যাগটা প্রথমে ওজন করলো। পরীর ব্যাগটা ওর হাতে ছিল , এবার বুকের মধ্যে নিয়ে আঁকড়ে ধরল। ওতে নরম মাংসের টুকরা গুলো আলাদা করে রাখা। মা'র ব্যাগের মাংস ওজন হয়ে গেলে ,এবার ওরটা। মা বললো -
'এই, তোর ব্যাগটা বাইর কর ,মাংস গুলান ঢাল দেহি।'
করুণ দৃষ্টিতে একবার মার দিকে চেয়ে যেন আরও জোরে বুকে চেপে ধরে। দেবে না কিছুতেই ,অসহায় ভাবে মা'র দিকে তাকাল । দু চোখ কা্ন্নায় ভরা, কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল । মা'র তীক্ষ্ণ চোখের দিকে চেয়ে বুঝল প্রতিবাদ করে লাভ নেই। আস্তে আস্তে সব বের করে । আলাদা করে রাখা সেই লোকটার দেয়া নরম মাংসগুলো শেষবারের মত দেখে সবটাই হোটেলওয়ালাকে ঢেলে দিল। একবার ভাবলো মা'র অগোচরে চট করে নিয়ে আলাদা করে হাতের আড়ালে লুকিয়ে নেবে। কিন্তু নেবে কোথায়,আর রাখবেই বা কোথায়। তার ছোট দুইহাতে আর কটাই বা ধরবে । তবে মা'র দিকে চোখ পড়তেই ভয়ে আর কিছু বলে নি। লোকটা এবার সব মেপে হিসেব করে ওর মা'কে টাকা দিল।
সারাদিনের মাংস যোগাড় করে সেইটা বেচার টাকায় কিছু প্রয়োজনীয় চাল আর ফুটপাথের এক হোটেল থেকে উচ্ছিস্ট কিছু সব্জি নিয়ে এই দুই আদিম হোমো-স্যাপিয়ানস্ ফিরে চললো তাদের প্রাগৈতিহাসিক আস্তানায়, নীল পলিথিনে মোড়া ফুটপাথের একপাশে আস্তানার দিকে। সারাদিন ওরা শুধু শুকনো কিছু রুটি খেয়ে ছিল। অবসন্ন দেহে মা'ও চলছিল কোনরকম পা টেনে টেনে। পরীর একহাতে খালি করা মাংসের ব্যাগটা, অন্য হাতে মা'কে ধরে চলেছে। পা দুটো ভারী ভারী লাগছে।
রাস্তায় অনেক মানুষ। সবার সুন্দর জামা কাপড়। কেউ বন্ধুদের সাথে। কেউ পরীর মতই বয়সের, বাবার হাত ধরে ,হাতে বেলুন। ওর সে সবে খেয়াল নেই। হাঁটতে২ মা'কে বলছে,
- 'মা, আমি যে মাংস পাইছিলাম ওই গুলা নরম ছিল--গরুটার দাম নাকি এক লাখ টাকা । জান মা কাবাব বানাইতে হাড়ি লাগেনা, শুধু নুন আর ঝাল দিয়া আগুনে পুড়াইলেই অয় , আমি দেখছি ওই ড্রেনের ধারে বিহারীরা বানায়-- বুলা বলছিল খাইতে খুব নরম । তয় ঝাল বেশি, ও পারে না, আমি ঝাল খাইতে পারি'--.কথাগুলো শোনার কেউ নেই, আপন মনেই বলে চলেছে-- বলতে২ একসময় আর স্বর বেরোয় না, চোখটা ঘোলাটে হয়ে আসে...
পরীদের ঘরে ফেরার পথটাও যেন শেষ হতে চায় না। পথের ধারের দালান বাড়িগুলো থেকে বাতাসে ,ভেসে আসছে রান্নার সুঘ্রাণ। পাশের একটা দোকানে কাবাব বানাচ্ছে ,টকটকে লাল কয়লার উপরে লাল লাল নরম মাংসগুলো শিক দিয়ে ঢুকিয়ে পোড়াচ্ছে , একটা ছেলে পাখা দিয়ে নাড়ছে জোরে ,বাতাসে পোড়া মাংসের গন্ধটা ভেসে আসছে ।
পরী ওই দিকে তাকিয়ে হাঁটতে২ একসময় অজান্তেই কখন ওর হাতটা মুখের কাছে চলে আসে, হাতের তালুতে কুরবানীর মাংসের গন্ধ ,লেগে থাকা রক্ত গুলোও শুকিয়ে, কালচে হয়ে গেছে, সেটাই মুখের কাছে এনে জিভ দিয়ে আলতো ভাবে স্পর্শ করে ওর স্বাদ নিতে থাকে....
এরপর আর ওদের দেখা যায় নি । কেননা একসময় মা ও মেয়ের প্রতিচ্ছবি আলোর রাজপথ থেকে ক্রমশঃ অন্ধকারে মিশে গেল ।
২| ২১ শে জুলাই, ২০২১ বিকাল ৪:৫০
নেফারতিতি❣️ বলেছেন: আহ পরি
©somewhere in net ltd.
১|
১৯ শে জুলাই, ২০২১ দুপুর ২:১৩
তারেক ফাহিম বলেছেন: মন খারাপ হয়ে গেল পাঠে।
পরীর মাও কেমন শক্ত স্বভাবের, মমতা নাই।