নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আশীষ বড়ুয়া

শখের বশেই মাঝেমাঝে হাত চালাই।

আশীষ বড়ুয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্পঃ বাঘাইছড়ির অন্ধকারে

২৬ শে মে, ২০১৫ রাত ১১:৪৮

১.
অক্টোবর মাসের ঝুমঝুম একটানা বৃষ্টিতে পুরো প্রকৃতিটাই অন্যরকম রুপ নিয়েছে। গাঢ় সবুজ, যেটাকে আমরা ইংরেজীতে বলি ‘বটল গ্রীণ’, আমাদের জাতীয় পতাকায় যে রংটা আমরা ব্যবহার করি। পাহাড়ের ঢালে ঢালে সবুজ পাতায় বৃষ্টিফোঁটার নাচন যে হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে শরিফ, তাকে তার স্বর্গ বলে মনে হয়, ইচ্ছে হয় এখানেই থেকে যায়। তবু যেতে হবে আজ, রাঙামাটি ছেড়ে বাঘাইছড়ির পথে। লঞ্চে আজ তার প্রথম চড়া হবে, তাও আবার কাপ্তাই হ্রদের বুক চিরে, যে হ্রদ যত না জল ধরে, তার বেশি ধরে আছে আদিবাসী মানুষের অশ্রুফোঁটা। জলের কোন রং নেই কে বলে, এ যে রক্তলাল!

হোটেল ছেড়ে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়ে সে। দু’রাত কাটানোর মত কাপড়-চোপড় আর প্রয়োজনীয় অফিসের কাগজপত্র ব্যাকপ্যাকটা ভারিই করে তুলেছে। কলেজ গেটের মোড় থেকে ট্যাক্সিতে বিশ টাকায় রিজার্ভ বাজার পৌঁছে খোঁজ নেয় কোন্ রাস্তায় যেতে হবে বাঘাইছড়ি। একটু হেঁটে সামনেই লঞ্চঘাট। লঞ্চের লোকজনের চিৎকারে সে একটু বিভ্রান্ত হয়; সবাই মারিস্যা, শুভলং বলে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। লঞ্চে উঠার তক্তার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করতেই সেও একই লঞ্চটাই নির্দেশ করে; কিছু বুঝে উঠার আগেই সিঁড়ি বেয়ে লঞ্চের দোতলায় পৌঁছে যায় সে, পেছনের লোকজনের ঠেলা-ধাক্কার তোড় সইতে না পেরে। একজন যাত্রীর কাছে জানতে চায়, ‘ভাই, এই লঞ্চ কি বাঘাইছড়ি যাবে?’
‘হ, অনে কডে যাইবান দে?’ শরিফ কোথায় যাবে জানতে চায় লোকটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়।
‘বাঘাইছড়ি; কিন্তু এরা যে মারিস্যা, শুভলং বলে যাত্রী ডাকছে’, নিজের সংশয় ব্যক্ত করে শরিফ।
‘বাঘাইছড়িরে মারিস্যাও কয়’ হাসতে হাসতে বলেন ভদ্রলোক ‘তই, মারিস্যা কডে যাইবান দে অনে?’ মারিস্যা কোথায় যাবে জানতে চান ভদ্রলোক। শরিফ জেনে মজা পায় যে, বাঘাইছড়ি এখানে মারিস্যা নামেও পরিচিত।
‘আমি আসলে যাচ্ছি অফিসের কাজে, এই প্রথম। ওখানে আমাদের লোক আছে’।
‘তাড়াতাড়ি যাই সিট দখল গরি লন, দেরি অইলে ন পাইবান’ দেরি হলে সিট পাবে না শুনে ভেতরে ছুট লাগায় সে। লঞ্চের মাঝামাঝি একটা সিট জোটে তার; ব্যাকপ্যাকটা কোনরকমে সিটের নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে বসে পড়ে সে।

সাতটা বেজে বিশ মিনিট হতেই লঞ্চের ভেঁপু বেজে উঠে আর লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। পলকেই লঞ্চে যেন আর তিল ধারণের জায়গা থাকে না। ভোঁ ভোঁ শব্দে অন্য লঞ্চগুলোকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঢেউ তুলে ঘাট থেকে বেরিয়ে পড়ে লঞ্চটি। শরিফ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখে হ্রদের জলে ঢেউয়ের খেলা। পূর্বাকাশের সূর্যকিরণ রূপালি জলের বুকে আছড়ে পড়েছে; যতদূর চোখ যায় সোনালি-রূপালি জল-আলোর খেলা, কাঁপন ছুটিয়ে দেয় চোখের পাপড়িতে। যত না কষ্ট এ জলনৃত্য উপভোগ করা, তার চেয়ে বেশি কষ্ট চোখের পলক ফেরতে না পারায়। পাপড়ি দুটো একে অন্যের ছোঁয়া পেতে না পেতেই মনে হয় কী যেন মিস্ হয়ে যাচ্ছে। মিনিট কেটে ঘন্টা পার হয়ে যায়, শরিফ টের পায় না। বিস্ময়ে নির্বাক তাকিয়ে রয় সে, আর গুনগুন রব তুলে, ‘জন্ম আমার ধন্য হল মাগো . . . . . . ’।

২.
একসময় চোখে পড়ে দু’টো পাহাড়ের পেটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে লঞ্চটি। আকাশটাকে পেছনে ফেলে দু’টো পাহাড়চূড়া যেন ছুটে চলেছে একে অন্যকে উষ্ঞ আলিঙ্গনে জড়াতে। খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তারা, কিন্তু কিছুতেই একে অন্যের নাগাল পাচ্ছে না আর একটুর জন্য। কঠিন পাথুরে আবরণ, তার উপর জন্মেছে নানা লতাগুল্ম আর গাছপালা। নিচে জলের বুকে তার ছায়া যেন আরো কাছে ডাকছে ‘আয় আয়’ বলে। তাকাতেই মনে হয় এই বুঝি ঝুপ করে খসে পড়বে মাথার উপর। এখানে হ্রদের জল অদ্ভূত রকম শান্ত, শুধুমাত্র লঞ্চের ঢেউজল গড়িয়ে গড়িয়ে লুটিয়ে পড়ছে পাহাড়ের পাদদেশে খুব মৃদুস্বরে। ‘হেই ব্যাডা, ঠ্যাং নামা’ পাহাড়-জল-গুল্মলতায় আটকে যাওয়া শরিফের চোখটা বাহির থেকে নব্বই ডিগ্রী ঘুরে এসে সরলরেখায় থামে। তার দু’চোখ জুড়ে একটা কঠিন কঠোর আদিবাসি মুখ; যেন এক্ষুণি ঝাঁপিয়ে পড়বে তার উপর। সে চকিতে পা দু’টো নামিয়ে নেয় সামনের সিট থেকে। বুঝতেই পারে না সে কখন আনমনে এ কাজটা করেছে। তবু মানুষটার আচরণে একটু কষ্ট হয় তার। প্রকৃতির এ আর্শ্চয সুন্দর মৌনতার মাঝে মানবিক রূঢ়তা তাকে ব্যথিত করে, বিমর্ষ করতে থাকে ক্রমাগত। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারে না। তার সতর্ক মন তাকে নাড়া দেয়, ‘সাবধান, কিছু বলতে যেও না, ওরা পাহাড়ি, তুমি বাঙালি; ওরা সংখ্যাগুরু এখানে’। সারা পৃথিবীর সংখ্যালঘু মানুষগুলো কখন যে সংখ্যালঘুর প্রতাপ থেকে মুক্তি পাবে, ভাবতে থাকে শরিফ।

শুভলং পেরিয়ে আরো কিছুদূর যাবার পর লঞ্চটি ধীরে ধীরে লেক ছেড়ে একটি নদীতে ঢুকে পড়তে থাকে। এখানে পাহাড়ি বাড়ি-ঘর, ক্ষেত-খামার যেন আরেকটু নিকটে এসে ধরা দেয়। যাপিত জীবনের ছোঁয়া পায় শরিফ একটু একটু করে। পাহাড়ের বুকে জুম চাষ, কাজে নিবৃত্ত আদিবাসী নারীর পিঠের ঝুড়িতে কোমল শিশুর মায়াময় চোখ, বাঁশের চালায় পাইপে তামাকের ঘ্রাণ, লম্বা দা আর ঝুড়ি হাতে সমর্থ পুরুষের আনাগোনা, টং দোকানে ঝুলে থাকা লম্বা কলার ছড়া-এতদিনের দেখা ছবির দৃশ্যগুলো তার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠে। তাকে মুগ্ধ করে পাকা কলা আর পেঁপের ঘ্রাণ, মোহিত করে পাহাড়ি নারীর সতেজ, সদম্ভ বিচরণ।

শেষ ঘাটটিতে পৌঁছে ঠিক পৌনে দু’টায় পা দেয় শরিফ বাঘাইছড়ির মাটিতে। ঘাট থেকে নামতেই বিশাল সবুজ মাঠ; মাঠটাকে সামনে রেখে দাঁড়ালে বামদিকে আনেকগুলো টং দোকানের সারি, বাঘাইছড়ি বাজার আর বিপরীত দিকে মাঠটা মিশে গেছে একটি ছোট্ট টিলার সাথে, তার উপর সুন্দর একটি টিনের বাড়ি, যার পুরো চালা জুড়ে ছায়া দিচ্ছে বিশাল একটি বট গাছ। সে বাজারের দিকে এগিয়ে যায়, একটি রিকশা নিয়ে রওনা দেয় বাবুপাড়ার দিকে; তাদের অফিসে।

৩.
কাজশেষে তার এক সহকর্মী রাত্রে থাকার জন্য তাকে নিয়ে আসে আঞ্চলিক পরিষদের ডাকবাংলোতে, লঞ্চঘাটের পাশের টিলার উপর সুন্দর সেই টিনের বাড়িটিতেই; শরিফ দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। অদ্ভূত ভাল লাগায় তার মন ভরে যায়। ‘এতো সুন্দর একটি বাড়িতে রাত কাটাব আজ’ ভাবতে থাকে সে। সামনে বিশাল সবুজ মাঠের ওপারে বাজার, যার কোলাহল এখানে কিছুতেই ছুঁতে পারে না। একপাশে শান্ত, স্থির কাচালং নদী; ঘাটে গুটিকয়েক নৌকা, মাঝি আর যাত্রীর কোলাহল; দুপুরের আসা সেই লঞ্চটা সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে, তার মাথার উপর পতপত উড়ছে কিছু লাল-হলুদ-নীল বিভিন্ন রঙের পতাকা, কাল সকালে আবার ছেড়ে যাবে রাঙামটির দিকে। বাংলোটির টিলা পূর্বদিকে ঢালু হয়ে যেখানে নেমে গেছে সেখানে একটি ছোট্ট সরু লাল মাটির রাস্তা আড়াআড়ি দু’পাশের ধানক্ষেত চিরে চলে গেছে দূরের পাহাড়ি গ্রামের দিকে; দু’পাশে ধূ ধূ সবুজ ধানক্ষেত। এ অদ্ভূত নির্জনতায় মাথা উঁচু করে বাংলোটির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সে বিশাল বটবৃক্ষ, মনে হচ্ছে যেন বাড়িটিকে ঘিরে থাকার জন্যই পৃথিবীতে জন্ম তার।
‘নমষ্কার’।
‘নমষ্কার’, এ হচ্ছে বাবু ভাই, উনিই এ বাংলোর কেয়ারটকোর’, শরিফের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় রুপম চাকমা, তার সহকর্মী।
‘তো বাবুদা, আপনি তো বেশ লাকি, এতো সুন্দর একটা ডাকবাংলো, আমার তো খুব ঈর্ষা হচ্ছে’।
‘জ্বী ছার, যতদিন খুছি থাগার পারিবু, কোন চমচ্যা নেই’। যতদিন খুশি থাকতে বলে বাবু ভাই চাকমা আর বাংলা মিশিয়ে।
‘আপনি আছেন তো’?
‘না ভাই, বাবুদা’র বাড়ি আমাদের অফিসের পাশেই, উনি বাড়িতেই থাকেন, এখানে সন্ধ্যা ছ’টা পযর্ন্ত ওনার ডিউটি, খুব বেশি লোকজন তো আসে না এখানে, তাই থাকার দরকার হয় না’ বলে রুপম।

বাবু চাকমা তার কোমর থেকে চাবি বের করে দরজার তালা খুলতে থাকে, শরিফ সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে বিস্তীর্ণ খোলা আকাশের নিচে অবারিত সবুজের বুকে ডুবে যাবার চেষ্টা করে। পশ্চিমাকাশের সূযর্টা ডুবিডুবি করছে, তার লালচে কিরণ সবুজ ঘাসের বুকে তৈরি করেছে অপরূপ এক মোহ, এ যেন শ্যামল আত্নীয়তা। পেছনে বটের ছায়াটা সমানভাবে দোল খাচ্ছে দিগন্তজোড়া মাঠের সবুজ ধানক্ষেতের উপর। বিকেলের ঝিরিঝিরি হাওয়া বটপাতায় টুপটাপ আওয়াজ তুলছে। আজ শুক্লা দ্বাদশী, খেয়াল হতেই তার চোখের সামনে রাতের ডাকবাংলোর দৃশ্যকল্প ভেসে উঠে; বিস্তীর্ণ সবুজের বুক জুড়ে রূপালি চাঁদের আলো, মাঝখানে সে একেলা।

সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে বিদায় নেয় রুপম চাকমা আর বাবু ভাই। গাঢ় এক নীরবতা নেমে আসে আশপাশ জুড়ে, সন্ধ্যার আলো-আঁধারির ছায়ায় ধীরে ধীরে মানুষের কোলাহল কমে আসতে থাকে নদীর ঘাটে। কাপড় পাল্টে একটা চেয়ার টেনে এনে বারান্দায় বসে পড়ে শরিফ। কেমন যেন একটু অবাক শূণ্যতা বাজে বুকের ভেতর, কেউ নেই এ ক্ষণটিতে পাশে বসে থাকার, হাতে হাত রেখে নির্জনতা খুন করার। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামে, বারান্দার আলোটা জ্বালতে ইচ্ছে হয় না তার, পাছে এ সুন্দর আলো-আঁধারিটা নষ্ট হয়। আকাশ ভেঙে ধীরে ধীরে জোৎস্না নেমে আসছে সবুজের বুক জুড়ে, তার বুক জুড়ে কবিতার উথাল-পাতাল ঢেউ।

৪.
বাজারের ছোট্ট একটা হোটেলে রাতের খাবার সারতে সারতে আচমকা বৃষ্টি নামে। খুব মন খারাপ হয় তার, আর বুঝি রাতটা উপভোগ করা হল না। দেখতে দেখতেই বৃষ্টির তোড় বাড়তে থাকে। দোকানে লোকজনও খুব একটা বেশি নেই। খাওয়া শেষ হতে দেখে দোকানি তার পাট চুকানোর আয়োজন করে। আশপাশের সমস্ত দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে ততক্ষণে। একটু একটু বাতাসের ঝাপটা গায়ে এসে লাগে, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই একটু দ্রুতগতিতে হাঁটা শুরু করে শরিফ; একদিকে নদীজল, অন্যদিকে সবুজের মাঠজুড়ে এখন গাঢ় অন্ধকার। পথ খুঁজে পেতে কষ্ট হয় তার, রীতিমতো হাতড়ে হাতড়ে আগাতে হয়; পলক ফেললেই শুধু বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ার শব্দ। কাদামাটি পেরিয়ে সে কোনরকমে উঠে আসে বাংলোর বারান্দাটিতে।

তালা খুলে রুমে ঢুকে আলো জ্বালায় শরিফ। চারপাশে শুধু বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ আর বাতাসের ঘোঙানি, পাহাড়ি নৈঃশব্দ যেন ঘিরে আছে সবকিছু। হাতের বৃষ্টিভেজা ছাতাটা বাথরুমে রাখতে না রাখতেই ঝুপ করে চারপাশে অন্ধকার নেমে আসে; বিদ্যুৎ চলে যায়। ওর মনে পড়ে, তার কলিগদের কথা, ‘এখানে ইলেকট্রিসিটি যায় না, মাঝে মাঝে আসে’। কোনরকমে হাত-মুখ ধুয়ে সে হাতড়ে হাতড়ে বাইরে এসে দেশলাইটা জ্বালিয়ে নেয় সে। মোমের আলোয় প্যান্ট-শার্ট ছেড়ে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে সকালের কেনা পত্রিকাটা হাতে নিয়ে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়।

বাইরে কিসের যেন খুটখাট একটা আওয়াজ টের পায় শরিফ, বাইরে বৃষ্টিটা অনেকটাই কমে এসেছে এর মধ্যে। সে পেপারটা গুছিয়ে বাইরে যাবার জন্য উঠে পড়ে, হঠাৎ মনে আসে সে আজ এখানে একা, ধারেকাছে কেউ নেই। নিঃসঙ্গ এ ডাকবাংলোতে একাকী বাইরে যাওয়াটা এত রাত্রে, নিশ্চয়ই ঠিক হবে না। যদি কিছু হয়! এসময় বাইরে দরজার কাছেই একটা কাশির শব্দ তাকে কাঁপিয়ে দেয়। শরিফ উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

‘কে? কে ওখানে’?
‘ছার, আমি’।
‘কে?’
‘ছার, আমি বাবু।
‘বাবু ভাই?’
‘জ্বী ছার’।
বাবু চাকমার কথা শুনে তার বুকে সাহস আসে কিছুটা; দরজা খুলে বাইরে আসে শরিফ। বাংলোর বারান্দা আর বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে ঝাপসা অন্ধকার, বাবু চাকমা বসে আছে সিঁড়ির উপর; তার ডানপাশে লম্বা একটা কাঠের লাঠি শুইয়ে রাখা।
‘কী ব্যাপার, আপনি এখানে? আপনার না বাড়িতে থাকার কথা?’
‘জ্বী ছার, এসছি, আপনি যদি ভয়-তয় পান!’ বাবু চাকমার চাকমা আর বাংলা ভাষায় মিশ্রিত উচ্চারণগুলোতে খুব মজা পায় শরিফ।
‘আরে, ভয় পাবার কি আছে, এরকম বাইরে বাইরে তো রাত কাটে আমার, কত জায়গায় যেতে হয়, থাকতে হয়; ভয় পেলে চলবে?’ একটু আগেই ভয় পাওয়া শরিফের কন্ঠে স্বাভাবিকতা।
‘না ছার, অচুবিধে নেই, আমি এনে বাইরেই আগি, আপনি গিয়া ছুয়া পড়েন’। সে বাইরে থাকবে বলে আশ্বাস দিয়ে তাকে শুয়ে পড়তে বলে।
‘না, ঠিক আছে, আপনি আসছেন যখন কিছুক্ষণ গল্প করি, আপনার কথা শুনি’, বলে বাবু চাকমা’র ডান পাশে বসতে যায়।
‘জ্বী ছার, বসেন’, তাকে বসতে জায়গা করে দিয়ে কী যেন একটা সরিয়ে নেয় টের পায় শরিফ।
‘কী ওটা?’ কৌতুহল দেখায় শরিফ।
বাবু চাকমা কিছু না বলে শরিফের হাতে জিনিসটা তুলে দেয়। সে হাতে নিয়ে টের পায় জিনিসটা, সব পাহাড়িদের নিত্য সঙ্গী। লম্বা ধারালো দা’টা এই আলো-আঁধারিতেও যেন চিকচিক করতে থাকে, সেই হ্রদের জলে সূযর্রশ্মির নাচনের মতই।
‘এটা সবসময় লাগে আপনাদের, না? সবার হাতে হাতেই দেখি।’
‘বন-জঙ্গলের মানুচ আমরা, কখন কী হয় থিগ নেই, ছাথে তো রাখতি অয়’।
‘কিন্তু, এখানে তো কোন বন-জঙ্গল নেই, এখন এটার কাজ কী?’ দায়ে হাতের পরশ বুলাতে বুলাতে জানতে চায় শরিফ।
‘বন-জঙ্গল তো নাই ছার, কিন্তু পছু তো আছে চারপাছে, এরা বনের পছুর চায়াও খারাপ’।
‘পশু! চারপাশে!’ বিস্মিত হয় শরিফ।
‘অ ছার, বাঘ-ছিংহ, ছাপে আমাদের কয়কজনরে আর খায়, কিন্তু এখানকার পছুগুলাই আমাদের দলে দলে ছেচ করতাছে, নিব্বংছ করতাছে’, মনে হয় খুব দূর থেকে যেন ভেসে আসছে বাবু চাকমার কন্ঠস্বর; খুব ভারী শোনায় যদিও।
‘বুঝলাম না, এখানকার পশু মানে?’ কেমন যেন একটু মজা পায় সে।
‘এখানকার পছু মানে আপনারা’, কিছুটা কঠিন এবং আরো ভারি হয়ে উঠে বাবু চাকমার কন্ঠস্বর। শুনে শরিফের শরীর যেন একটু কেঁপে উঠে।
‘আমরা মানে?’ কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে।
‘অ ছার; আপনারা, বাঙালিরা। এ জন্যই তো আমরার আজ এ অবছথা। বাঘ-ছিংহের ছাথে লড়াই করে তো আমরা পাহাড়িরা থিগে আছি যুগ যুগ ধইরা, কিন্তু আপনাদের ছাথেই তো পারি না, ছার। এক পাহাড় ছাড়ি আর এক পাহাড়, ভিতর থাগি আরো ভিতরে আর কই যাব ছার?’ প্রশ্ন না ক্ষোভ বুঝে উঠতে সময় লাগে শরিফের। সে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে কিন্তু কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না।
‘দেচ ছাড়ি যাবার তো আর উপায় নেই; তাই লড়াই করি থিগে থাগা লাগবে। মারের বদলে মার, লাছের বদলে লাছ’। শরিফ বুঝতে পারে বাবু চাকমা কী বলতে চায়। এর পর সে কীভাবে আগাবে ভেবে পায় না, তার চোখ যায় বাবু চাকমা’র দা’এর দিকে। ভয়ে তার সারা শরীরে একটু একটু করে কাঁটা ফুটে উঠতে থাকে, ‘শান্তি চুক্তি-টুক্তি হল’, কোনরকমে উচ্চারণ করল সে।
‘এতা চান্তি চুক্তি না, এতা অচান্তি চুক্তি!’ রাগে ফেটে পড়ে বাবু। ‘চান্তির আছায় জঙ্গল ছাইড়ে আচছিলাম, অস্ত্র জমা দিছিলাম; এহন বুঝি কী ভুল কচ্ছিলাম’। উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে, রাগে থরথর করে কাঁপতে তাকে তার শরীর; হাতে লম্বা লাটিটা।
‘বাবু ভাই?’ শরিফ বাবু চাকমার হাত ধরে।
‘অ, এই ভুলের জন্যিই উল্তো অল ছব, ছব হারাতে অল, মা-বাবা-ভাই-বোন’ রাগে কাঁপতে থাকা শরীরটা থেকে ভেজা কন্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ে। শরিফ একটু সাহস পায়, দু’হাতে নিচের দিকে টেনে তাকে আবার সিঁড়িতে বসায়। ‘মা-বাবা-ভাই-বোন?’ খুব ধীর লয়ে উচ্চারণ করে সে।
‘অ ছার, ছব গ্যাছে, ছবাইরেই নিছে আপনাদের ঐ বাঙালিরা।’
‘কীভাবে?’ বিস্মিত হয় শরিফ।
‘গত বছর পাহাড়ি-বাঙালি মারামারির ছময়। আমি আছিলাম রাঙামাইত্যাত অফিছর কামে; আইছা দেখি ছব চেছ, বাড়ি-ঘর ছব জ্বলি ছারখার, পুইড়্যা অঙ্গার অইছে ছবাই’। শরিফের গা শিউরে উঠে। ‘লাচ ছুঁই ছপথ নিছিলাম, এর ছোধ না নিয়া মরুম না, আবার তো গন্ডগোল ছুরু অইছে, একতারেও ছাড়ুম না, হের লাইগাই ঐ দাও, লাথি ছাথে লই ঘুরি’। বাবু চাকমার চোখ দু’টো বাঘের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে; অন্ধকারেও টের পায় শরিফ।
‘গন্ডগোল শুরু হয়েছে মানে?’ খুব ভয় হয় শরিফের।
‘অ ছার, আবার শুরু অইছে, লাচ পরব, মানুচ পুরব, আর হেরা ছব দখল করব’ শরিফের সারা শরীর যেন ঠান্ডা হয়ে আসতে থাকে, সে যেন লাশের গন্ধ পেতে থাকে, পোড়া গন্ধে তার নাকটা ভরে উঠে, তার গলা যেন চেপে ধরে কেউ। বাম হাতে বাবু চাকমার হাঁটু চেপে ধরে খুব জোর দিয়ে।
‘ভয় পাইয়েন না ছার, আপনার কিচ্ছু হবে না, আপনি ঘুমান, আমি আছি’ বাবু চাকমা যেন শরিফের ভেতরটা দেখতে পায়।
‘কিন্তু আমিও তো একজন বাঙালি, বাবু ভাই’, তার ভেতর থেকে কেউ যেন উচ্চারণ করে খুব ধীরে ধীরে।
‘ছব বাঙালিই যদি এক অইতো তাইলে তো আর এইখানে বইছা থাকতে পারতাম না ছার। ভয় পাইয়েন না ছার, পাহাড়ির গায় যতক্ষণ দাগ না লাগে, ততোক্ষণ কারো কুনো ক্ষতি করে না ছার। আপনি আমার মেহমান ছার, আপনার কেউ যদি ক্ষতি করতেও চায়, আমার লাছের উপর দিয়াই যাইতি অব’। বাবু চাকমা আশ্বস্ত করতে চায় তাকে। ‘আর আমি তো এতো তাড়াতাড়ি লাচ অব না ছার, পতিছোধ যে বাকী আছে’ প্রতিশোধের উচ্চারণটা বাবু চাকমার কন্ঠস্বর ছাড়িয়ে যেন চারপাশের জনমানবহীন প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। শরিফ উঠে রুমের দিকে যেতে চায়; কিন্তু তার শরীর তাকে ক্রমাগত কাবু করতে থাকে, বাবু চাকমার আরো কাছে টেনে নিয়ে যায়। সর্বস্ব হারানোর বেদনা বুকে বসে থাকা মানুষটাকে তার মমতায় জড়িয়ে ধরতে ইচেছ হয়; যদিও তার মাথার ভেতরে তুমুল প্রতিধ্বনি তোলে সে উচ্চারণটি ‘পতিছোধ যে বাকী আছে’।

আশীষ বড়ুয়া
২৫.০৫.২০১৫
যশোর

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে মে, ২০১৫ রাত ১:০৫

ক্ষতিগ্রস্থ বলেছেন: ‘চান্তির আছায় জঙ্গল ছাইড়ে আচছিলাম, অস্ত্র জমা দিছিলাম; এহন বুঝি কী ভুল কচ্ছিলাম’।

হাস্যকর মিথ্যা তথ্যের ডায়লগ। আর মিথ্যা তথ্যের আড়ালে ভুঁয়া, মিথ্যা সেন্টিমেন্টে রঙ মাখিয়ে প্রচারণামূলক গল্প ফাঁদা হয়েছে। ইউপিডিএফ, জেএসএস (মূল) ও জেএসএস (সংস্কার) - এইসব পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠির নাম শুনেন নাই? তাদের ভাঙ্গা-অকেজো অস্ত্র জমা দেয়ার আড়ালে কত অস্ত্র থেকে গেছে জানেন? তাদের হাতে কি পরিমাণ অস্ত্রের ভান্ডার আছে তা জানেন? না জানা থাকলে বলবেন, পার্বত্য পাহাড়িদের কি পরিমাণ অস্ত্র গত দু বছরে শুধু মিজোরামের পুলিশ আর বিএসএফ মিলে জব্দ আর গ্রেফতার করছে তার লিংকগুলা কমেন্টে দেব। বাংলাদেশের লিংকতো আর বিশ্বাস করবেন না! প্রতিটা পার্বত্য সন্ত্রাসীর কাছে একটা করে অটোমেটিক গান আছে। আর ইউপিডিএফ-এর উদ্ধৃতও হয়ে গেছে অনেক অস্ত্র, এখন তারা দেশের ভেতরে চোরাচালানে নেমেছে। সংস্কারবাদী জেএসএসও সেই পথে হাটছে। কিছুদিন আগেই ১৬০ জন চাকমা সন্ত্রাসী মিজোরামে প্রশিক্ষণ নিয়েছে, তাদের ৪৫ জনের একটা দল ত্রিপুরা হয়ে বাংলাদেশে ঢুকার আগে ত্রিপুরা পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে টাকাপয়সা দিয়ে ছাড়া পেয়েছে - এসবতো পত্রিকার খবর। সেটার কর্ডিনেশন করতে আবার সন্তু লারমা আর উষাতন তালুকদার চিকিৎসার নামে মিজোরাম গিয়েছিল।

এইসব সন্ত্রাসীর কাজ কী? তারা চাঁদাবাজি আর অপহরণ বাণিজ্য করে। সেটা এমনি এমনি করা যায়? করতে অস্ত্র লাগে, মাঝে মাঝে ঘাড় ত্যাড়াগুলাকে মারধোর করতে হয়, খুন করতে হয়। তো কারা এই চাদাবাজি, অপহরণ এবং মারধোর ও হত্যার শিকার? আপনাকে কষ্ট দিয়ে জানাচ্ছি, তারা মূলত সবাই বাঙালি। সত্যটা লিখতে হলে এই নিপীড়িত ও নির্যাতিত বাঙালিদের নিয়ে লিখতে হবে। অবশ্য আপনিতো আর সত্য গল্প লিখতে বসেননি, প্রপাগান্ডা করতে বসেছেন... তো লিখুন বানিয়ে বানিয়ে।

অস্ত্র দিয়ে কী করে আর? আর চাঁদাবাজির এলাকা ঠিক রাখতে নিজেদের মাঝে আধিপত্যবাদী গুলাগুলি, খুনাখুনি করতে হয়। সেটা যদি না জানেন, বলবেন, আবার কমেন্টে তথ্যগুলো দিয়ে যাব।

তাদের চাঁদাবাজি সম্বন্ধে আপনার ধারণা আছে? প্রতিটা ব্যাবসা-বাণিজ্যে চাঁদার রেট করা আছে। প্রতিটা ইউনিয়নে চাঁদা কালেকটর আছে আর প্রতিটা উপজেলায় একজন করে চাঁদা ডিরেকটর। কালেকটরের বেতন কমবেশি ৭ হাজার টাকা আর ডিরেকটরের বেতন মাসে কমবেশি ২০ হাজার টাকা। চাঁদাবাজি তাদের প্রাতিষ্ঠানিক আয়-ইনকামের অংশ। এতে কর্মিদের বেতন হয়, সন্ত্রাসী যোদ্ধা (!) দের বেতন হয়, তাদের স্ত্রী-সন্তানদের ভাতা, লেখাপড়ার খরচ, স্টাইপেন্ড, কোচিঙের খরচ, সভা-সমাবেশ-মিটিং-মিছিলের খরচ হয়, ঢাকার পত্রিকা, এনজিও ও বুদ্ধিজীবীদের মাসোহারা সবই দেয়া হয়। অবাক হয়ে যাবেন না শুনে যে কিছু সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীর শুধু মাসোহারায় হয় না, তাদের পাহাড়ি নারীসঙ্গ লাগে, সেটার জন্যও সুবন্দোবস্ত করে দেয়। সেবাদানকারীর মাসেহারাও থাকে। আর অস্ত্র কেনার টাকাতো আছেই। ইউএনডিপিসহ সমস্ত পশ্চিমা এনজিও তাদের সমস্ত টাকা ঢালে পাহাড়িদের পিছনে। বাঙালিরা তাদের উন্নয়ন তালিকায় নাই। ৯৩ শতাংশ এনজিও কাজ করে শুধু পাহাড়িদের নিয়েই, আর বাকি ৭ শতাংশ নামেমাত্র বাঙালিদের তালিকাভূক্ত করলেও বাস্তবে তাদের উপকারভোগী শুধু পাহাড়িরাই।

পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ, ৩টি জেলা পরিষদসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সবখানে পাহাড়িদের একাধিপত্য। এমন কি, সংসদ, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও তাদের আধিপত্য। এই আধিপত্য দিয়ে বাঙালি ও বাঙালি এলাকার সমস্ত উন্নয়ন তারা রুখে দিচ্ছে। বাঙালিদের জন্য রাস্তাঘাট, বাজার, বিদ্যুৎ - সবখানেই তারা সাধ্যমত বাধা দিয়ে যাচ্ছে। এসবই চুক্তির বলে। অথচ চুক্তি অনুযায়ী তাদের অস্ত্র সমর্পন করার কথা যা তারা একদিনের জন্যেও করেনি। লেখাপড়ায় অঘাবগারাও কোটা ব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকরি করছে। কিন্তু সেখানকার বাঙালিরা বঞ্চিত হচ্ছে।

এমনকি এই শান্তিচুক্তি যে সংবিধান ও বাঙালিবিরোধী তা হাইকোর্টের রায়ে বেড়িয়ে এসেছে। সরকার তাদের নিজেদের করা চুক্তি বাতিল করে দেয়া দেখতে চায় না বলে আপিলেড ডিভিশনে ঐ মামলা ডাম্প করে রেখেছে। অস্ত্র সমর্পন ও সশস্ত্র সন্ত্রাস বন্ধ করার শর্তে যে চুক্তি হয়েছে তা যেখানে একদিনের জন্যেও মানা হয়নি, সেখানে শান্তিচুক্তিইতো বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা! মিথ্যা আরও চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে? বাঘাইছড়ির অন্ধকারে অন্ধকারের জীব হয়ে ক্রমাগত বিষ উগরে যাবেন, নাকি একআধটু আলো ভালবেসে জীবনটাকে দেখবেন?

২৭ শে মে, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৭

আশীষ বড়ুয়া বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ, ক্ষতিগ্রস্থ, আপনার তথ্যসমৃদ্ধ মন্তব্যের জন্য! অন্ধকারের জীব ভেবে যদি দেন, তাতে হয়তো কিছুটা ঘাটতির আশঙকা থাকে। মানুষ ভেবে দেবেন, ভালোবেসে গ্রহণ করব। কে না আলোকিত করতে চায় নিজেকে!!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.