নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ৩০ বছর চাকরি করেছি; অবসর নিয়েছি কর্নেল পদবীতে ২০০৬ সালে। এরপর এযাবৎ প্রিন্সিপাল হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে; এখন অর্কিড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা-তে। ‘স্কুল সাইকোলোজি’ নিয়েও কাজ করছি।

আশরাফ আল দীন

কবি, শিক্ষাবিদ ও প্যারেন্টিং এক্সপার্ট

আশরাফ আল দীন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা

০৮ ই জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১০

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা।। আশরাফ আল দীন

৩১শে ডিসেম্বর ২০১৯ ছিল ইন্টারন্যাশনাল টেলেন্ট কেয়ার একাডেমির বার্ষিক অনুষ্ঠান। এবছর আমাদের অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা প্রদান। সুধী সমাবেশে স্থানীয় ৩৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়। বয়োবৃদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধারা তা গ্রহণ করেন সহাস্যে। তিন জন শারীরিক অসুস্থতার জন্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। দু'জন মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে তাঁদের সন্তানেরা ক্রেস্ট গ্রহণ করেন। মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন শেখরনগর, চিত্রকোট এবং বারইখালি থেকে অধিকাংশ বীর মুক্তিযোদ্ধা এসেছেন। পার্শ্ববর্তী জেলা নবাবগঞ্জের কয়েকটি ইউনিয়নের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও আছেন। ষাটোর্ধ্ব বয়সের উপস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধারা এই আয়োজনের জন্য ভীষণ আনন্দিত হয়েছেন এ কারণে যে, সমগ্র জেলাতেই আগে কখনো এ ধরনের আয়োজন করা হয়নি। আমরা আমাদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে মোট ৩৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, এবারের জন্য।

আমাদের দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার বিষয়টা রাজনীতির কাদায় কর্দমাক্ত হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। আমরা কিছুটা কানাঘুষা শুনতে পাচ্ছিলাম যে, কয়েকজনের 'ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা' হওয়ার ব্যাপারে কেউ কেউ সরব হতে পারেন। এতে অনুষ্ঠানে বিশৃংখলার সৃষ্টি হতে পারে। তাই শুরুতেই অনুষ্ঠানের লাগাম টেনে ধরার জন্য আমি নিজে অনুষ্ঠানের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও অনুষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম। শুরু থেকেই সবাইকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করেছি কোন প্রকার বিতর্কে না জড়ানোর জন্য। আমাদের উদ্দেশ্য আমরা যেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কীর্তিগাথাকে আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে, আমাদের ছাত্রদের কাছে সুন্দর ভাবে তুলে ধরতে পারি। সেটাই ছিল আমাদের প্রত্যাশা। তারপরও একজন প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা নিজে এসে মঞ্চে উঠে বসলেন এবং তিনি বক্তব্যের সুযোগ নিতে গিয়ে নাম ধরে দুই জন মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গেলেন। আমি তাঁকে বিনয়ের সাথে সরিয়ে এনে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। আমি এই প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল হিসেবে সকলের কাছে ক্ষমা চাইলাম এজন্যে যে, আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না পুরো জেলার অথবা উপজেলার সকল মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে হাজির করা। আমরা চাইনা কে 'মুক্তিযোদ্ধা' আর কে 'ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা' সেটা নিয়ে আজকের অনুষ্ঠানে কোন প্রকার বিতর্কে জড়াতে। আমি বরং অনুষ্ঠানে উপস্থিত পরবর্তী প্রজন্মের সবাইকে তৎকালীন পরিস্থিতি জানানোর জন্য আমার নিজের পরিবারের ইতিহাস বলতে শুরু করলাম।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-সংশ্লিষ্ট বিখ্যাত কালুরঘাটের কয়েক মাইল দূরে আমাদের গ্রামের বাড়ি। আমাদের বাড়ির পাশেই, আমার আব্বার প্রতিষ্ঠিত, পূর্ব গোমদন্ডী পাইলট হাই স্কুলে এসে ৮ ইস্ট বেঙ্গলের অফিসার, জেসিও এবং সৈনিকরা ক্যাম্প স্থাপন করলো, তৎকালীন মেজর জিয়ার নেতৃত্বে, ২৬শে মার্চ তারিখে। পাশেই আমাদের বাড়ি। আমরা ছয় ভাই, তিন বোন এবং আব্বা-আম্মা মিলে আমাদের বেশ বড় পরিবার। মার্চের ২৫ তারিখের পর থেকে আমরা পুরো পরিবার বাড়িতেই ছিলাম। আমি এবং আমার সেজ ভাই দু'জনই ছিলাম এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমরা দু'জন গোপনে সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়ি ছেড়ে ভারত চলে যাব। কিন্তু হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি দেখলাম সেজো ভাই নেই। আমি বুঝতে পারলাম তিনি আমাকে ছেড়ে একাই ভারত চলে গেছেন, মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছেন। বাড়িতে সকলেই আমার উপর চাপ প্রয়োগ করলো জানতে যে তিনি কোথায় গেছেন। কিন্তু আমি অস্বীকার করে বললাম যে আমি কিছুই জানি না। ঘরের সবাই ব্যাপারটা বুঝে নিলো। কিন্তু এই সত্যটাকে বাইরে প্রকাশ করার উপায় ছিল না। বরং পরিবারের নিরাপত্তার জন্য আমাদের সবাইকে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলো। পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন সকলের কাছেই আমরা সেজ ভাই সম্পর্কে বলতে থাকলাম যে, তিনি খালার বাড়ি গেছেন। কয়দিন পরে আবার বলি, তিনি নানার বাড়ি গেছেন বা অন্য কোথাও গেছেন। কাছেই ছিল রাজাকার ক্যাম্প এবং শান্তি কমিটির অফিস। পরিস্থিতি এমনই যে ঘুর্ণাক্ষরেও কাউকে বলা যাবে না, এই বাড়ির একটি ছেলে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। তাহলে পরদিন ওই বাড়ি অগ্নিদগ্ধ হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে এবং ওই বাড়ির মানুষের উপর, বিশেষত নারীদের উপর চলবে নির্যাতন। তাই আমাদেরকে দেখাতে হলো যে, আমরা পাকিস্তান সরকারের অত্যন্ত অনুগত নাগরিক। সত্যটাকে কখনও আমরা প্রকাশ করতে পারলাম না!

যুদ্ধ যখন শেষ হলো, ১৮ ই ডিসেম্বর তারিখে, সেজো ভাই ফিরে এলেন হাতে একটা এসএলআর নিয়ে গুলি ফোটাতে ফোটাতে। তিনি জীবন নিয়ে ফিরে আসাতে পরিবারের সবাই নিশ্চিন্ত ও ভারমুক্ত হলো। কিন্তু আমি তাঁকে প্রথমেই একটা প্রশ্ন করলাম, "আপনি কেন আমাকে একা ছেড়ে চলে গেলেন? কথা তো ছিল আমরা দুজন একসাথে যাবো! আপনি জানেন আমি কি মুসিবদের মধ্যে পড়েছিলাম?" আমার কণ্ঠে আক্ষেপ আর ক্রোধ। তখন তিনি শুধু একটা কথাই বললেন যে, "যাবার মুহূর্তে খেয়াল হলো আমরা দুই ভাই একসাথে মারা যাবো? তারচেয়ে বরং আমিই মারা যাই, তুই বেঁচে থাক।" জবাব শুনে আমার আর কোন রাগ তাঁর উপর রইল না। এটাই ছিল তখনকার বাস্তব অবস্থা।

আজকে যেভাবে আমরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কথা বলি বা লোকেরা যেভাবে গালগপ্প করে, বাস্তব পরিস্থিতি ছিলো তা থেকে একেবারেই ভিন্ন রকম। আমরা ছয় ভাই এর মধ্যে এখনো আমরা পাঁচ ভাই জীবিত আছি, আলহামদুলিল্লাহ। শুধু আমার সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা ভাইটি কয়েক বছর আগে আল্লাহর কাছে চলে গেছেন। একথা বলতে গিয়ে আমি খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লাম। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধা সুধিমন্ডলী এবং ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বললাম, এখন আমাদের সামনে লক্ষ্য হবে মুক্তিযুদ্ধকে আমরা যেন রাজনীতিতে পরিবর্তিত না করি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেন আমাদের জাতিকে বিভক্ত না করে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে আমরা যেন অনুপ্রেরণা ও সুশিক্ষা গ্রহণ করি, অন্য কিছু নয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকেরই এখন অনেক বয়স হয়ে গেছে। আমাদের সহপাঠী ও সাথীদের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা সকলেই বিদায় হয়ে যাব। মৃত্যুর পর কে ভুয়া কে খাঁটি এই নিয়ে বিতর্কের কোন সুযোগ থাকবে না। বরং তখন আল্লাহ জবাবদিহি করবেন আমাদের সৎকর্ম সম্পর্কে। তাই, এই বয়সে আমরা কেউ কারো বদনাম না করে, বিরোধ ও শত্রুতা সৃষ্টি না করে, কেউ কারো বিরুদ্ধে কথা না বলে, যে টুকু সময় বা হায়াত আমাদের আছে সেটুকুতে আমরা বরং রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণ চিন্তা এবং মানুষের উপকারের চিন্তায় কিছু কাজ করার চেষ্টা যেন করি।

এই ধরনের একটি উদ্যোগ হচ্ছে আজকের এই ইন্টারন্যাশনাল ট্যালেন্ট কেয়ার একাডেমি। এই মহতী প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান স্বপ্নদ্রষ্টা জনাব আজমল হোসেন নিজেও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং আপনাদের এলাকারই সন্তান। বর্তমানে তিনি আমেরিকা প্রবাসী হয়েও একান্তই আন্তরিকতা এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেছেন ২০১২ সালে। মেধাবী এতিমদের সেবার জন্য এবং সমাজের কল্যাণের জন্য এই প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়েছে। আপনারা বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যেকেই অথবা কয়েকজন মিলে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান বা এ ধরনের কাজ করতে পারেন, যাতে বাংলাদেশের সমাজ উপকৃত হবে এবং মানুষ উপকৃত হবে। আর এই ধরনের ভালো কাজের মাধ্যমেই আখেরাতে আমরা আল্লাহর কাছে উত্তম বিনিময় আশা করতে পারবো। আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে এই ধরনের ভালো কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার, সংশ্লিষ্ট হওয়ার, উদ্যোগী হওয়ার তৌফিক দিন। আমিন।

এই বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করলাম। উপস্থিত সকল বীরমুক্তিযোদ্ধার প্রতিনিধি হিসেবে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে আমরা মঞ্চে আসন দিয়েছিলাম। তাঁদেরকে অনুরোধ করেছিলাম কিছু বলার জন্য। তাঁরা তাঁদের অনুভূতি প্রকাশ করলেন আবেগে ও উচ্ছ্বাসে। অনুষ্ঠান শেষে উপস্থিত সবাইকে দুপুরের খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩০

চাঁদগাজী বলেছেন:



অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র আসল মুক্তিযোদ্ধাদের আনা সম্ভব ছিলো না?

২| ০৯ ই জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ৯:২৪

রাজীব নুর বলেছেন: মুক্তিযোদ্ধারা ভালো থাকুক।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.