নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভালো মানুষ হিসাবে নিজেকে দাবি করি না কখনোই, চেষ্টা করছি ভালো মানুষ হতে। জানিনা কবে ভালো হতে পারব! আর আমি এমনিতে বেশ ঠাণ্ডা, কিন্তু রেগে গেলে ভয়াবহ! একটু introvert টাইপের। স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি, তার যদিও অধিকাংশই ভেঙ্গে যায়! আশার পিঠে আশা বেঁধে তবুও নির্লজ্

অতনু কুমার সেন

সংক্ষেপে নিজের সম্পর্কে মূল্যায়নঃ ভালো মানুষ হিসাবে নিজেকে দাবি করি না কখনোই, চেষ্টা করছি ভালো মানুষ হতে। জানিনা কবে ভালো হতে পারব! আর আমি এমনিতে বেশ ঠাণ্ডা, কিন্তু রেগে গেলে ভয়াবহ! একটু introvert টাইপের। স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি, তার যদিও অধিকাংশই ভেঙ্গে যায়! আশার পিঠে আশা বেঁধে তবুও নির্লজ্জের মত স্বপ্ন দেখে যাই। স্বপ্ন দেখি আকাশ ছুবো, মেঘের ভেলায় উড়ে যাব, নিজের রঙে রাঙ্গিয়ে দিব, সত্য ও সুন্দরের আলো ফোটাবো। জানিনা পারব কি ব্যর্থ হবো। চেষ্টা তবু করেই যাবো।

অতনু কুমার সেন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম গ্রাজুয়েট নারী কোনো ইংরেজ রমণী নয়, কোনো আইরিশ কন্যা নয়, নয় কোনো স্কটিশ নারীও। দুইজন বাঙালি নারী এই কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। আজ নারী দিবসে সেই দুই বাঙালি নারীর গল্প শোনাই আপনাদের।

০৯ ই মার্চ, ২০২২ রাত ৮:১৪

দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় জন্মেছিলেন ১৮৪৪ সালে, ঢাকার বিক্রমপুরের মাগুরখণ্ড নামক গ্রামে। এখন আমরা যেটাকে এসএসসি বলি, আগে সেটাকে ব্রিটিশ আমলে এন্ট্রান্স পরীক্ষা বলা হতো। দ্বারকানাথ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করতে পারেন নি। কয়বার ফেল করেছিলেন, সে বিষয়ে অবশ্য তথ্যটা সঠিকভাবে জানা যায় না। যাই হোক, এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফেল করে গ্রাম ত্যাগ করেন তিনি। শিক্ষকতার চাকরি শুরু করেন ফরিদপুরের লোনসিং গ্রামে।

নিজে পড়ালেখাতে বেশি দূর যেতে না পারলেও অন্যদের শিক্ষা দেবার ব্যাপারে অদম্য এক আগ্রহ ছিলো দ্বারকানাথের। বিশেষ করে নারী শিক্ষার প্রতি তাঁর অসাধারণ্ন এক ঝোঁক ছিলো। শুরুর দিকে তিনি একটা পত্রিকা বের করতেন ফরিদপুর থেকে। সেটার নাম ছিলো অবলাবান্ধব। শুধু পত্রিকা প্রকাশ করেই তিনি ক্ষান্ত থাকতেন না। সেই সময়ে বিধবা মেয়েদের গোপনে হত্যা করার একটা জঘণ্য প্রথা চালু ছিলো গ্রামে। এদের যেহেতু দ্বিতীয় বিয়ে হতো না, ফলে স্বাভাবিকভাবেই এরা এমন কিছু কাজ করতো যেটা পরিবার নিজেদের জন্য কলংক হিসাবে বিবেচনা করতো। সেই কলংক থেকে বাঁচার জন্য এদেরকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করতো তাদের নিজেদের পরিবারের লোকেরাই। এই সমস্ত বিপন্ন মেয়েদের উদ্ধার করে কোলকাতায় পাঠাতেন তিনি। এক পর্যায়ে তিনি নিজেও কোলকাতায় চলে আসেন। অবলাবান্ধব পত্রিকা ফরিদপুরের চেয়ে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হলে সেটা বাংলার মেয়েদের উপরে বেশি প্রভাব ফেলবে, এই ধারণা থেকেই তিনি মূলত কোলকাতায় চলে আসেন।

এখানে আসার পরে মেয়েদের জন্য একটা স্কুল খোলেন তিনি। এই স্কুলে দুর্গামোহন দাস আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন। সেখানে তাঁর দুই মেয়ে সরলা দাস এবং অবলা দাসকেও পড়তে দিয়েছিলেন। অবলা দাস পরে জগদীশ চন্দ্র বসুর ঘরণী হয়েছিলেন। এই স্কুলে জগদীশচন্দ্র বসুর বোন স্বর্ণপ্রভা বসুও পড়তেন।

মেয়েদের অঙ্ক, ভূগোল, স্বাস্থ্যতত্ত্ব এগুলো শেখানোর জন্য ভালো বাংলা বই না থাকাতে দ্বারকানাথ নিজেই এই সমস্ত বিষয়ে বই লিখে ফেলেছিলেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সরলা দাস এবং কাদম্বিনী বসু এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবার জন্য তৈরি হয়ে গেল। কিন্তু, সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। এন্ট্রান্স পরীক্ষা তখন হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ভারতবর্ষ তো অনেক দূরের কথা, ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়েও মেয়েদের পরীক্ষা দেবার অনুমতি ছিল না তখন। এই সমস্যা সমাধানের জন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন জানানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিলো না। সেটাই করার জন্য প্রস্তুত হলেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়।

দ্বারকানাথ যখন তাঁর ছাত্রীদের নিয়ে কোলকাতায় লড়াইয়ের মাঠে প্রস্তুত হচ্ছেন, তখন সবার অলক্ষ্যে ভারতের আরেকপ্রান্তে আরেক বাঙালি খৃস্টান নারী একাকী এই লড়াইয়ে এর মধ্যেই নেমে পড়েছেন। এই নারীর নাম চন্দ্রমুখী বসু।

চন্দ্রমুখী দেরাদুনের ‘ডেরা স্কুল ফর নেটিভ ক্রিশ্চান গার্লস’ নামের একটা মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করতেন। এন্ট্রান্সের পড়া সমাপ্ত হবার পরে, ওখানেই সাধারণত মেয়েরা থেমে যেতো। যেহেতু তাদের পরীক্ষা দেবার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু, চন্দ্রমুখী অন্য ধাতুতে গড়া মেয়ে। তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবার জন্য আবেদন করে বসলেন। স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল রেভারেন্ড ডেভিড হিরন পড়ে যান বিপদে। তাঁকে ঘুষ হিসাবে বেশ কিছু বই দিয়ে পরীক্ষা দেবার সংকল্প থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু, চন্দ্রমুখী অনড়। তিনি পরীক্ষা দেবেনই। ফলে বাধ্য হয়ে রেভারেন্ড হিরন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন জানালেন চন্দ্রমুখীর পরীক্ষা নেবার জন্য।

১৮৭৬ সালের ২৫শে নভেম্বর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এ বিষয়ে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হয়। চন্দ্রমুখী বসুকে প্রাইভেটলি পরীক্ষা দেবার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে সেখানেও নানা ধরনের শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। পাশ করলেও অফিসিয়াল পাশ লিস্টে তাঁর নাম থাকবে না, এটাও বলে দেওয়া হয়। সহজ কথায় চন্দ্রমুখী এন্ট্রান্স পাশ, এটা অফিসিয়ালি কোথাও দাবী করতে পারবে না।

সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তটা ছিল এরকম:

“এই শর্তে চন্দ্রমুখীকে মুসৌরী শহরে পরীক্ষা দেবার অনুমতি দেওয়া হলো যে, তাঁকে নিয়মিত পরীক্ষার্থী বলে গণ্য করা হবে না এবং পরীক্ষকগণ তাঁর উত্তর পরীক্ষা করে পাশের যোগ্য নম্বর দিলেও উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের তালিকায় তাঁর নাম প্রকাশ হবে না।”

দ্বারকানাথ তাঁর ছাত্রীদের এন্ট্রান্স পরীক্ষার বিষয়ে অগ্রসর হতে গিয়ে চন্দ্রমুখীর ঘটনা জানতে পারলেন। চন্দ্রমুখীর উদাহরণ তাঁর জন্য কাজে লাগবে বলে মনে হলো তাঁর। তাঁর কাজ অনেকখানি সহজ করে দিয়ে গিয়েছেন চন্দ্রমুখী। চন্দ্রমুখীর দেখানো পথ ধরে এগিয়ে গেলেন। প্রভাবশালী লোকজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ এবং আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর স্যার আর্থার হবহাউজের সাথেও দেখা করলেন তিনি। সৌভাগ্যক্রমে ইনিও নারী হিতৈষী ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয় এই সিদ্ধান্তে এলো যে, এদের পরীক্ষা নেওয়া হবে, তবে তার আগে এদেরকে একটা প্রারম্ভিক পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।

১৮৭৭ সালে এই পরীক্ষা নেওয়া হলো। পোপ সাহেব ইংরেজির, গ্যারেট সাহেব অঙ্কের, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিহাসের এবং পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার বাংলার পরীক্ষক নিযুক্ত হলেন। সরলা এবং কাদম্বিনী দুজনে পরীক্ষা দিলেন। এই পরীক্ষকদের সকলেই তাঁদের পরীক্ষা পর্যালোচনা করে তাঁরা যে পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত এই সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন।

১৮৭৮ সালের ২৭শে এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে মার্কবি সাহেব এই ঐতিহাসিক প্রস্তাব দিলেন, “That the female candidates be admitted to the University examination, subject to certain rules.”

সিণ্ডিকেটের সভায় সিদ্ধান্ত হলো যে, পুরুষ ও নারী পরীক্ষার্থীদের পাঠ্য পুস্তকে ও পরীক্ষা প্রশ্নে কোনো তারতম্য থাকবে না, তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মনোনীত একজন মহিলা তত্ত্বাবধায়িকার তত্ত্বাবধানে মহিলা প্রার্থীরা পরীক্ষা দেবে। এর জন্য স্বতন্ত্র পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হবে।

কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখনও ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের প্রবেশাধিকার নেই। ভারতবর্ষের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা তো বলাই বাহুল্য।

সরলা দাস এবং কাদম্বিনী বসু প্রারম্ভিক পরীক্ষা দিলেও মূল পরীক্ষায় অংশ নেন শুধুমাত্র কাদম্বিনী বসু। সরলার ইতোমধ্যে বিয়ে হয়ে যাওয়াতে তিনি ঢাকা চলে যান। কাদম্বিনী দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মাত্র এক নম্বরের জন্য প্রথম বিভাগ মিস করেছিলেন তিনি।

কাদম্বিনী এন্ট্রান্স পাশ করার ফলে বেথুন স্কুলে, স্কুলের পাশাপাশি কলেজ খোলার দাবি উঠলো। কলেজ খোলাও হলো। এই সময় দৃশ্যপটে এসে হাজির হলেন আবার চন্দ্রমুখী বসু। তিনিও কাদম্বিনীর সাথে কলেজে পড়ার আবেদন জানালেন। কিন্তু, তাঁকে যেহেতু সরকারীভাবে সনদ দেওয়া হয়নি তাঁকে, তাই তাঁর ভর্তি হওয়ার আবেদন নাকচ হয়ে যায়। চন্দ্রমুখীও ছাড়বার পাত্র নন। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে দাবী জানালেন তাঁকে কলেজে ভর্তি হবার সুযোগ করে দেবার জন্য। কারণ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তিনিও পাশ করেছেন। তাঁর এ দাবি সিনেটে উঠলো এবং সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তাঁকেও কলেজে ভর্তি হবার অনুমতি দেবার। অর্থাৎ, তাঁর এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফলাফল বেসরকারি থেকে সরকারী হয়ে গেলো।

১৮৮৩ সালে চন্দ্রমুখী বসু এবং কাদম্বিনী বসু দুজনেই কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁরা দুজন শুধু ভারতবর্ষের নয়, সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম স্নাতক ডিগ্রিধারী মহিলা।

চন্দ্রমুখী বসু ১৮৮৪ সালে এমএ পাশ করেন। মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম এমএ। পড়ালেখা শেষে বেথুন কলেজেই লেকচারার হিসাবে যোগ দেন তিনি। এই কলেজেই প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে পেশাগত জীবন শেষ করেন। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাওয়া নারী তিনিই প্রথম।

অন্যদিকে, কাদম্বিনী চিকিৎসাবিদ্যায় ভর্তি হন। ১৮৮৬ সালে জিবিএমসি (গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ) ডিগ্রি অর্জন করেন। ভারতবর্ষের প্রথম নারী ডাক্তার তিনি। পরবর্তীতে চিকিৎসাশাস্ত্রে উন্নত ডিগ্রি অর্জনের জন্য বিলেত গমন করেন তিনি। এর আগে, তাঁর বয়স যখন একুশ, তিনি তাঁর শিক্ষক দ্বারকানাথকেই বিয়ে করেন।

Ⓒ Farid Ahmed
দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় জন্মেছিলেন ১৮৪৪ সালে, ঢাকার বিক্রমপুরের মাগুরখণ্ড নামক গ্রামে। এখন আমরা যেটাকে এসএসসি বলি, আগে সেটাকে ব্রিটিশ আমলে এন্ট্রান্স পরীক্ষা বলা হতো। দ্বারকানাথ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করতে পারেন নি। কয়বার ফেল করেছিলেন, সে বিষয়ে অবশ্য তথ্যটা সঠিকভাবে জানা যায় না। যাই হোক, এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফেল করে গ্রাম ত্যাগ করেন তিনি। শিক্ষকতার চাকরি শুরু করেন ফরিদপুরের লোনসিং গ্রামে।

নিজে পড়ালেখাতে বেশি দূর যেতে না পারলেও অন্যদের শিক্ষা দেবার ব্যাপারে অদম্য এক আগ্রহ ছিলো দ্বারকানাথের। বিশেষ করে নারী শিক্ষার প্রতি তাঁর অসাধারণ্ন এক ঝোঁক ছিলো। শুরুর দিকে তিনি একটা পত্রিকা বের করতেন ফরিদপুর থেকে। সেটার নাম ছিলো অবলাবান্ধব। শুধু পত্রিকা প্রকাশ করেই তিনি ক্ষান্ত থাকতেন না। সেই সময়ে বিধবা মেয়েদের গোপনে হত্যা করার একটা জঘণ্য প্রথা চালু ছিলো গ্রামে। এদের যেহেতু দ্বিতীয় বিয়ে হতো না, ফলে স্বাভাবিকভাবেই এরা এমন কিছু কাজ করতো যেটা পরিবার নিজেদের জন্য কলংক হিসাবে বিবেচনা করতো। সেই কলংক থেকে বাঁচার জন্য এদেরকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করতো তাদের নিজেদের পরিবারের লোকেরাই। এই সমস্ত বিপন্ন মেয়েদের উদ্ধার করে কোলকাতায় পাঠাতেন তিনি। এক পর্যায়ে তিনি নিজেও কোলকাতায় চলে আসেন। অবলাবান্ধব পত্রিকা ফরিদপুরের চেয়ে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হলে সেটা বাংলার মেয়েদের উপরে বেশি প্রভাব ফেলবে, এই ধারণা থেকেই তিনি মূলত কোলকাতায় চলে আসেন।

এখানে আসার পরে মেয়েদের জন্য একটা স্কুল খোলেন তিনি। এই স্কুলে দুর্গামোহন দাস আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন। সেখানে তাঁর দুই মেয়ে সরলা দাস এবং অবলা দাসকেও পড়তে দিয়েছিলেন। অবলা দাস পরে জগদীশ চন্দ্র বসুর ঘরণী হয়েছিলেন। এই স্কুলে জগদীশচন্দ্র বসুর বোন স্বর্ণপ্রভা বসুও পড়তেন।

মেয়েদের অঙ্ক, ভূগোল, স্বাস্থ্যতত্ত্ব এগুলো শেখানোর জন্য ভালো বাংলা বই না থাকাতে দ্বারকানাথ নিজেই এই সমস্ত বিষয়ে বই লিখে ফেলেছিলেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সরলা দাস এবং কাদম্বিনী বসু এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবার জন্য তৈরি হয়ে গেল। কিন্তু, সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। এন্ট্রান্স পরীক্ষা তখন হতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ভারতবর্ষ তো অনেক দূরের কথা, ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়েও মেয়েদের পরীক্ষা দেবার অনুমতি ছিল না তখন। এই সমস্যা সমাধানের জন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন জানানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিলো না। সেটাই করার জন্য প্রস্তুত হলেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়।

দ্বারকানাথ যখন তাঁর ছাত্রীদের নিয়ে কোলকাতায় লড়াইয়ের মাঠে প্রস্তুত হচ্ছেন, তখন সবার অলক্ষ্যে ভারতের আরেকপ্রান্তে আরেক বাঙালি খৃস্টান নারী একাকী এই লড়াইয়ে এর মধ্যেই নেমে পড়েছেন। এই নারীর নাম চন্দ্রমুখী বসু।

চন্দ্রমুখী দেরাদুনের ‘ডেরা স্কুল ফর নেটিভ ক্রিশ্চান গার্লস’ নামের একটা মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করতেন। এন্ট্রান্সের পড়া সমাপ্ত হবার পরে, ওখানেই সাধারণত মেয়েরা থেমে যেতো। যেহেতু তাদের পরীক্ষা দেবার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু, চন্দ্রমুখী অন্য ধাতুতে গড়া মেয়ে। তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবার জন্য আবেদন করে বসলেন। স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল রেভারেন্ড ডেভিড হিরন পড়ে যান বিপদে। তাঁকে ঘুষ হিসাবে বেশ কিছু বই দিয়ে পরীক্ষা দেবার সংকল্প থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু, চন্দ্রমুখী অনড়। তিনি পরীক্ষা দেবেনই। ফলে বাধ্য হয়ে রেভারেন্ড হিরন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন জানালেন চন্দ্রমুখীর পরীক্ষা নেবার জন্য।

১৮৭৬ সালের ২৫শে নভেম্বর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এ বিষয়ে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হয়। চন্দ্রমুখী বসুকে প্রাইভেটলি পরীক্ষা দেবার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে সেখানেও নানা ধরনের শর্ত আরোপ করা হয়েছিল। পাশ করলেও অফিসিয়াল পাশ লিস্টে তাঁর নাম থাকবে না, এটাও বলে দেওয়া হয়। সহজ কথায় চন্দ্রমুখী এন্ট্রান্স পাশ, এটা অফিসিয়ালি কোথাও দাবী করতে পারবে না।

সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তটা ছিল এরকম:

“এই শর্তে চন্দ্রমুখীকে মুসৌরী শহরে পরীক্ষা দেবার অনুমতি দেওয়া হলো যে, তাঁকে নিয়মিত পরীক্ষার্থী বলে গণ্য করা হবে না এবং পরীক্ষকগণ তাঁর উত্তর পরীক্ষা করে পাশের যোগ্য নম্বর দিলেও উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীদের তালিকায় তাঁর নাম প্রকাশ হবে না।”

দ্বারকানাথ তাঁর ছাত্রীদের এন্ট্রান্স পরীক্ষার বিষয়ে অগ্রসর হতে গিয়ে চন্দ্রমুখীর ঘটনা জানতে পারলেন। চন্দ্রমুখীর উদাহরণ তাঁর জন্য কাজে লাগবে বলে মনে হলো তাঁর। তাঁর কাজ অনেকখানি সহজ করে দিয়ে গিয়েছেন চন্দ্রমুখী। চন্দ্রমুখীর দেখানো পথ ধরে এগিয়ে গেলেন। প্রভাবশালী লোকজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ এবং আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর স্যার আর্থার হবহাউজের সাথেও দেখা করলেন তিনি। সৌভাগ্যক্রমে ইনিও নারী হিতৈষী ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয় এই সিদ্ধান্তে এলো যে, এদের পরীক্ষা নেওয়া হবে, তবে তার আগে এদেরকে একটা প্রারম্ভিক পরীক্ষা দিয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।

১৮৭৭ সালে এই পরীক্ষা নেওয়া হলো। পোপ সাহেব ইংরেজির, গ্যারেট সাহেব অঙ্কের, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিহাসের এবং পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার বাংলার পরীক্ষক নিযুক্ত হলেন। সরলা এবং কাদম্বিনী দুজনে পরীক্ষা দিলেন। এই পরীক্ষকদের সকলেই তাঁদের পরীক্ষা পর্যালোচনা করে তাঁরা যে পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত এই সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন।

১৮৭৮ সালের ২৭শে এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে মার্কবি সাহেব এই ঐতিহাসিক প্রস্তাব দিলেন, “That the female candidates be admitted to the University examination, subject to certain rules.”

সিণ্ডিকেটের সভায় সিদ্ধান্ত হলো যে, পুরুষ ও নারী পরীক্ষার্থীদের পাঠ্য পুস্তকে ও পরীক্ষা প্রশ্নে কোনো তারতম্য থাকবে না, তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মনোনীত একজন মহিলা তত্ত্বাবধায়িকার তত্ত্বাবধানে মহিলা প্রার্থীরা পরীক্ষা দেবে। এর জন্য স্বতন্ত্র পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হবে।

কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখনও ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের প্রবেশাধিকার নেই। ভারতবর্ষের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা তো বলাই বাহুল্য।

সরলা দাস এবং কাদম্বিনী বসু প্রারম্ভিক পরীক্ষা দিলেও মূল পরীক্ষায় অংশ নেন শুধুমাত্র কাদম্বিনী বসু। সরলার ইতোমধ্যে বিয়ে হয়ে যাওয়াতে তিনি ঢাকা চলে যান। কাদম্বিনী দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মাত্র এক নম্বরের জন্য প্রথম বিভাগ মিস করেছিলেন তিনি।

কাদম্বিনী এন্ট্রান্স পাশ করার ফলে বেথুন স্কুলে, স্কুলের পাশাপাশি কলেজ খোলার দাবি উঠলো। কলেজ খোলাও হলো। এই সময় দৃশ্যপটে এসে হাজির হলেন আবার চন্দ্রমুখী বসু। তিনিও কাদম্বিনীর সাথে কলেজে পড়ার আবেদন জানালেন। কিন্তু, তাঁকে যেহেতু সরকারীভাবে সনদ দেওয়া হয়নি তাঁকে, তাই তাঁর ভর্তি হওয়ার আবেদন নাকচ হয়ে যায়। চন্দ্রমুখীও ছাড়বার পাত্র নন। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে দাবী জানালেন তাঁকে কলেজে ভর্তি হবার সুযোগ করে দেবার জন্য। কারণ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় তিনিও পাশ করেছেন। তাঁর এ দাবি সিনেটে উঠলো এবং সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তাঁকেও কলেজে ভর্তি হবার অনুমতি দেবার। অর্থাৎ, তাঁর এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফলাফল বেসরকারি থেকে সরকারী হয়ে গেলো।

১৮৮৩ সালে চন্দ্রমুখী বসু এবং কাদম্বিনী বসু দুজনেই কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁরা দুজন শুধু ভারতবর্ষের নয়, সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম স্নাতক ডিগ্রিধারী মহিলা।

চন্দ্রমুখী বসু ১৮৮৪ সালে এমএ পাশ করেন। মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম এমএ। পড়ালেখা শেষে বেথুন কলেজেই লেকচারার হিসাবে যোগ দেন তিনি। এই কলেজেই প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে পেশাগত জীবন শেষ করেন। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাওয়া নারী তিনিই প্রথম।

অন্যদিকে, কাদম্বিনী চিকিৎসাবিদ্যায় ভর্তি হন। ১৮৮৬ সালে জিবিএমসি (গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ) ডিগ্রি অর্জন করেন। ভারতবর্ষের প্রথম নারী ডাক্তার তিনি। পরবর্তীতে চিকিৎসাশাস্ত্রে উন্নত ডিগ্রি অর্জনের জন্য বিলেত গমন করেন তিনি। এর আগে, তাঁর বয়স যখন একুশ, তিনি তাঁর শিক্ষক দ্বারকানাথকেই বিয়ে করেন।

Ⓒ Farid Ahmed

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই মার্চ, ২০২২ রাত ৯:৩৭

আহমেদ জী এস বলেছেন: অতনু কুমার সেন,




সমগ্র বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম স্নাতক ডিগ্রিধারী দু'জন বাঙালী নারীর কথা জেনে গর্ব অনুভব করছি।


লেখাটি দু'বার এসেছে। একটি মুছে দিন।
আর তথ্যসূত্র থাকলে ভালো হতো!

২| ০৯ ই মার্চ, ২০২২ রাত ১০:১৬

কাদা মাটি জল বলেছেন: তথ্যগত ভুল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম গ্রাজুয়েট কানাডার,
https://en.wikipedia.org/wiki/Grace_Annie_Lockhart
তাতে অবশ্যই ঠাকুর কন্যাদ্বয়ের কৃতিত্ব ম্লান হয়না।

৩| ০৯ ই মার্চ, ২০২২ রাত ১০:৪৭

গরল বলেছেন: খুবই চমকপ্রদ তথ্য, সেই যুগেও বাঙালী নারীরা অনেক এগিয়ে গিয়েছিলো। তবে সামান্য একটু ভূল আছে সেটা হল পুরো বৃটিশ সম্রাজ্যে না উনারা ভারতবর্ষে প্রথম নারী গ্রাজুয়েট।

প্রথম: Grace Annie Lockhart
সময়: ১৮৭৫, মাউন্ট অ্যালিসন কলেজ, বর্তমান নিউ বার্নসউইক, কানাডা
https://www.thecanadianencyclopedia.ca/en/article/grace-annie-lockhart

দ্বিতীয়: Helen Connon
সময়: ১৮৮০, ক্যান্টেবারি ইউনিভার্সিটি কলেজ, বর্তমান নিউ জিল্যান্ড।
https://nzhistory.govt.nz/page/first-woman-master-arts-british-empire-graduates

৪| ১০ ই মার্চ, ২০২২ রাত ১:০০

রাজীব নুর বলেছেন: বাহ ভালো।
যেদিন শেখ হাসিনা তসলিমা নাসরিনকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনবেন, দেশে সেই দিন নারী স্বাধীনতা আসবে।

৫| ১০ ই মার্চ, ২০২২ রাত ১:২৩

সোবুজ বলেছেন: নারীর পথচলা ছিল বড় কঠিন।এখনো অনেক পথ বাকি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.