নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মো: আওয়াল হোসেন টুটুল

টুটুল

সৎকাজে ১০০% বিশ্বাসী।

টুটুল › বিস্তারিত পোস্টঃ

ব্যর্থতার গল্প

০৫ ই মে, ২০১৬ রাত ৩:৫৪

এক
কি-বোর্ডের খটখট শব্দে ম্যানেজার স্যার হুড়মুড় করে ঘুম থেকে জেগে, বিছানায় বসে পড়লেন। ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছেন; ভীষণ-ভয়াল-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। কিছু বললেন না। যখন তিনি দেখলেন যে সবকিছু ঠিকঠাক আছে, শব্দটা আমার কম্পিউটার কি-বোর্ডের শব্দ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না, তখন তিনি যতোটা ব্যস্তসম্মত হয়ে জেগেছিলেন, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ততোটা শান্তভাবেই বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন কী জানি আবারও আমি আত্মহত্যার চালাই কি না। এমনটা হওয়া যে তার জন্য অস্বাভাবিক আমি তা বলতে চাচ্ছি না। যেকোনো একটা ঘটনা মনের মধ্যে গভীরভাবে দাগ কেটে গেলে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। তিন চারদিন আগে ঘটে যাওয়া আমার ঘটনাটাও হয়তো তিনি দেখেছিলেন প্রথমবারের মতো। তাই তাঁর ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে।
আজ বেশ কিছুদিন হলো আমার দিনগুলো, রাতগুলো, এক কথায় সময় ভালো যাচ্ছে না একেবারেই। এর কারণগুলোও ঠিব বুঝে উঠতে পাচ্ছি না। এই মনে হয় কিছুটা এর বুঝতে পারি, আবার পরক্ষণেই মনে হয়, না সবতো ঠিকই আছে। দিন কাটে, রাত কাটে, ক্ষুৎপিপাসার প্রতি কোনোই আগ্রহ নেই্‌। রাতে ঠিক মতো ঘুমুতেও পাচ্ছি না। প্রায় বছরখানেক ধরেই নিয়মিত সামান্য মাত্রার স্লিপিং-পিল খেয়ে ঘুমাতে হচ্ছে। আজকাল আমার একটা পিলে ঘুমও আসে না। ম্যানেজার স্যার আর আমি একই কক্ষে থাকি। তাই তিনিও জানেন আমি যে স্লিপিং পিল সেবন করি। মাঝে মাঝে তিনি আমাকে মানাও করেন। কিন্তু আমাকে তো বাঁচতে হবে। ঘুম না হলে কি সুস্থভাবে বাঁচা যায়!
এই কু-উপসর্গগুলোর মধ্যে যে-দু একটা ধরতে পারি, সেগুলো হলো যখন আমার সহপাঠী, বন্ধু বা জুনিয়ারদের সামাজিক অবস্থানের দিকে তাকাই, তখন মনে হয়, আমি যেনো ধ্বংসের সর্বনিম্নস্তরে আছি। চেষ্টার কোথাও ত্রুটি করেছি বলেতো মনে পড়েনা। সেই ছোটো বেলা থেকে সংগ্রাম করেই মানুষ হয়েছি। কোন্‌ কাজটা বাকি আছে যা আমি অস্তিত্বের প্রয়োজনে করি নি। দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য অন্যের জামিতে মজুরি খেটেছি, কাঁধে-ভারে-মাথায় মাটি কেটেছি; অন্যের জমির ধান কেটেছি, মাড়াই করেছি; দিন-চুক্তিতে অন্যের জমিতে হালচাষ করেছি; দিনের রোজগারে চলে না বলে, রাতের বেলা অন্যর জমিতে ঢেঁকি কল চেপে জলসেচ করেছি। বাজার খরচ চালানোর জন্য রিক্সা চালিয়েছি। নিজের এলাকায় যখন কাজ ছিলো না, অন্যের এলাকায় গিয়ে কাজ করে পয়সা কামিয়েছি। তবুওতো হাল ছাড়িনি। এতো প্রতিকূলতার পরেও দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে পড়াশুনা করেছি। আর এখন যখন আমার এই বিপরীত-অবস্থানের দিকে তাকাই, নিজের এই পরাজয় এত সহজে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। দীনতায়, হীনতায়, ঘৃণায়, লজ্জায় নিজের প্রতি নিজেবকেই অসহ্য মনে হয়। সারাক্ষণই এই চিন্তাগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনা।
আবার যখন এর বিপরীত দিকটা চিন্তা করি, প্রথমে মনে হয়, না আমার চেয়েওতো অনেকে দীন-হীন অবস্থায় আছে। আমার স্কুল জীবনের অনেক সহপাঠীই ছিলো যারা এখন দিন মজুরের কাজ করে। আবার ভাবনারা জড়ো হয়! ঘুরপাক খায়- না, ঠিক নেই; কিচ্ছু ঠিক নেই। সব, সব বিচ্ছিরি, এলোমেলো, অগোছালো; সব হিজিবিজি! আমার চেয়ে যারা নিচু অবস্থানে আছে, থাকতেই পারে। তাদের আর আমার জীবন-সংগ্রামের ইতিহাস এক নয়। তাদের মধ্যে কজন বলতে পারবে রাতের বেলা ঘুম ভাঙানোর জন্য দড়ি দিয়ে দুই পা বেঁধে ঘুমানোর গল্প যাতে ঘুম ভাঙলে বই পড়তে পারে! আমি পারবো। তখন মনে হতো ইস! রাতটা এতো খাটো হয় কেনো! আরকেটু লম্বা হলে ঘমানো যেতো দু-চোখের সাধ মিটিয়ে ঘুমানো যেতো, অথবা মনে হতো আল্লায় চোখে এতো ঘুমই বা কেনো দিলো! ঘুম কম দিতে পারলো না, তাহলেতো কতো আরামে বই পড়তে পারতাম। এখন আমার ভাবনা শতাভাগ বিপরীত! উহ! ঘুম কেনো আসেনা! কী দুঃসহ একাকী দীর্ঘ রাত! অথচ ইচ্ছে করেও দুচোখের পাতা সারা রাতেও এক করতে পারিনা- এমননো রাত পার করতে হয় আমাকে। ঘুমানোর জন্য এমন কোনো চেষ্টা নেই যা আমি বাকি রাখি। এই ডানে কাৎ হয়ে, এই বামে কাৎ হয়ে, এই চিৎ হয়ে, এই উপুড় হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করি। কোনো কাজ হয়না। ভাবি একুটু বই পড়লে হয়তো ঘুম পাবে- কারণ এর আগে ঘুমানোর জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় ছিলো বই পড়া। চোখের সামনে বই মেলে ধরলেই, ঘুম যেনো আমার চোখে লাঠি ভর দিয়ে আসতে শুরু করতো। এখন পাতার পার পাতা বই পদে যাই, ঘুমে আর আভাসটুকুও আসেনা। মনে ম ভাবি, হয়তো হালকা ভলিউমে কিছু গান শুনলে, ঘুম আসতে পারে-একের পর এক গান বেজে যায় ল্যাপটপে, মোবাইলে ঘুমের লেশমাত্র আসে না। আবার ভাবি একটু লেখালেখি করলে, মাথায় চাপ পড়বে; ঘুম আসতে পারে- তাও কাজে আসে না। বিছানায় শুয়ে বন্দি পাখির মতো ছটফট করতে থাকি। বাইরে শুনাশান নীরবতা! তবুও মনে হয় কী যেনো এক দুঃসহ শব্দে ঘুম আসে না। এক কান বালিশের উপর রেখে, অন্য কানের ওপর বালিশ চাপা দিয়ে পড়ে থাকি; ঘুম নামক জিনিস টি যেনো উদ্বায়ী পদার্থের মতো শূন্যে চলে গেছে। আরেকবার মনে হয়, শরীরে কাঁথা জড়িয়ে নিলে হয়তো একটু ঘুম আসতে পারে; কাঁথা জড়িয়ে নিই। পর মুহূর্তেই কাঁথাটা দুসঃসহ লাগে। কাঁথা ফেলে দিই। চিৎ হয়ে শুয়ে দুই চোখ হাত দিয়ে চেপে দরে রাখি, বেসিনে গিয়ে চোখ ধুয়ে এসে শুই, কছিুতেই কিছু হয় না। সকালবেলা ম্যানেজার স্যার উঠে দেখেন আমি হয়তো বসে কিংবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। তিনি আমাকে ধমাকান, “এই আওয়াল, ঘুমাও না! ঘুমাও!” আচ্ছা, ঘুমের অনুভূতি না হলে জোর করে কি ঘুমানো যায়!
যাদের সাথে আমার তুলনা করছি তাদের কজনের অভিজ্ঞতা আছে সারাদিন অন্যের কাজ করে, অন্যের বারান্দার আলোর নিচে বসে পড়া লেখা করার গল্প! তাদের কজন জানে যে অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া একটা ছেলে পঞ্চাশ কেজি ওজনের সারের বস্তা মাথায় করে নিতে পারে না বলে গৃহস্থের লাথি খাওয়ার গল্প! সে-বড়াই আমি করতে পারবো। এত বৈপরীত্যের মধ্যে কার দেখাবার মতো সাহস আছে প্রাথমিক ও জুনিয়ার দুটো বৃত্তি পরীক্ষাতেই কৃতকার্য হওয়ার। সে-সাহস আমার আছে। আমি জানি, অন্য কেউ পারবে না, কেউ না। এসব ভাবতে গেলেও এখন চশমার কাঁচ ঝাঁপসা হয়ে আসে। মাথায় ভেতরে প্রচণ্ড রকম চাপ অনুভূত হয়, ভয়ানক বিভীষীকা চেপে বসে। আমি আমার পরাজয় মেনে নিতে পারি না। পারার কথাও নয়। তখন আমার মাথায় শুধু একটা চিন্তাই কাজ করে- আত্মহত্যা। এ ছাড়া জনম-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই।
আমার এই জীবন-যুদ্ধে আমি যে একা লড়ে গেছি তা নয়। আমার বড়ভাই ছিলেন আমার সহযোদ্ধা। তিনি আমাকে দক্ষ সেনাপতির মতো কিংবা সর্বজ্ঞ-সর্বদ্রষ্টা-বিধাতার মতো শক্তি, সাহস ও প্রেরণা দিয়ে সাহায্য করেছেন। এ কথা আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করি, আমার জীবনে যদি কিছু অর্জন থেকে থাকে, সেখানে শতকরা একভাগ আমার আর নিরিানব্বই ভাগ আমার বিধাতাতুল্য ভাইয়ের অবদান। তার প্রতি আমার এমনই একটা অগাধ গভীর বিশ্বাস (বা অন্ধ বিশ্বাসও হতে পারে) ছিলো যে তিনি, ধন সম্পদ, সামাজিক বিত্ত মর্যাদা সবছিুর ওপরে মনুষ্যত্বকেই স্থান দেন। তিনিও জীবনে কষ্ট কম করেন নি। তিনিও পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই।
ছোটোবেলা থেকেই আমার একটাদোষ ছিলো, আছে আজও। আমি প্রচণ্ড রকম একগুঁয়ে। যা-কথা, তা-কাজ। আমার এমন কোনো কাজ মনে পড়েনা যে আমি এটা করবো বলেছি, আর সেটা করতে পারিনি বা করিনি (দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া-যেমন আমার কর্মজীবনের ব্যর্থতা)। তবে হ্যাঁ, দু একটা কাজ করবো না বলেও করেছি- সেটা আমার দেবতুল্য ভাইয়ের কথা রাখতে গিয়ে। আমি কোনো কাজে না করে বসেছি মানে সেটা অনেকটা বেদবাক্য-স্বরূপ, আমার পরিবারের সবাই সেটা জানতো। একমাত্র ব্যতিক্রম যেটা হাতে থাকতো, সেটা ভাইয়ার কথা। এবং, ভুলক্রমেও যদি ভাইয়ার কথাতে না করে বসতাম, সেটা স্বয়ং বিধিাতাও আমাকে করাতে পারতেন বলে মনে হয় না। কথাগুলো এভাবে বললাম শুধু ভাইয়ার আদেশের গুরুত্বটা তুলে ধরার জন্যই।

দুই
সবকিছু মিলিয়ে আমার জীবনটা কেমন যেনো একটু তালগোল পাকানো; গোলমেলে। আমার ভালোলাগা মন্দলাগাগুলোও হয়তোবা অনেকের কাছেই সেরকমই মনে হতে পারে। আমার আনুষ্ঠানিক/প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনাটা শুরুই হয়েছিলো চতুর্থ শ্রেণি থেকে- সেটা অন্য এক গল্পে বলেছিলাম। আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার দুটো প্রথম বর্ষ আছে। প্রথমটায় আমি ভর্তি হয়েছিলাম ‘ঘ’ ইউনিট থেকে এ্যাকাউন্টিং এ্যান্ড ইনফামেশান সিস্টেম (এমআইএস) এ। সেটায় ভালো লাগলো না। পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চলে এলাম ইংরেজিতে। যখন আমি ইংরেজি প্রথম বর্ষে পড়ি, আমাদের পাশের বাড়ির এক ছোট্ট/পিচ্চি মেয়কে আমার একটু একটু ভালো লাগতে শুরু করে। পিচ্চি বললাম আমার সাথে তার বয়সের পার্থক্য আট বা নয় বছরের। সে তখন সবে সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে। তার মানে আবার কেউ এই ভাষায় তর্জমা করে নেবেন না যে আমি সেই পিচ্চিকে গিয়ে প্রেম-প্রস্তাব পাঠাই বা প্রেম-পত্র দিয়ে বসি। শুধু মনের মধ্যে ওকে অনুভব করলেই কেমন যেনো একটা সুখানুভূতির শিহরণ লাগতো, যা আসলে বলে বোঝানোটা আমার মতো কমবক্তার পক্ষে সহজ নয়। মাঝে মাঝে নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হতাম- কী এসব এলোমেলো ভাবনা ভাবি আমি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একটা ছেলে, অবারিত স্বাধীনতা আমার। ছেলেতে মেয়েতে তফাৎ করেন না এমনও অনেকেই আছে। আর সেই রাজমহল ত্যাগ করে আমি ভাবতাম কোথাকার অজপাড়াগাঁ’র এক কাকে না কাকে। মন থেকে এসব এলোমেলো ভাবনা ঝেড়েও ফেলতে চেষ্টা কম করিনি। কিন্তু পারিনি। চূড়ান্ত ফলাফল বদলাতে পারিনি। আমার মনে হয়, মানুষের বেঁচে থাকার পেছনে জগতের কোনো না কোনোছিুর প্রতি ভালোলাগার সম্পর্ক কিংবা কোনোকিছুর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হয়। যদি কারো জীবনে একবারেই তা না থাকে, তাহলে তার বেঁচে থাকার কোনো মানেই হয়না, বেঁচে থাকার প্রতি তার আসক্তিও থাকেনা।
এ ভালোলাগার অনুভূতিটাই একসময় আলোতে বাতাসে ছোট্ট-ক্ষুদ্র-চারা থেকে যেনো ধীরে ধীরে বৃক্ষে পরিণত হতে লাগলো। যাকগে, ‘পিচ্চি পিচ্চি’ না বলে ওর একটা কল্পিত নাম দিয়ে নিলাম ‘সিনথিয়া’। তখনও সিনথিয়ার দাদি বেঁচে ছিলেন। আমরা তাঁকে নানি বলে সম্বোধন করতাম। ঢাকায় থাকার ফলে বাড়িতে আসার সুযোগই হতো কমই, তবুও মাঝে মাঝে বেড়াতে এলে নানির সাথে তাঁর নাতনিকে নিয়ে দুষ্টামি করে ঠাট্টা-তামাশা করতাম। এবং এ তামাশা আমার মনের মধ্যে তামাশার তমসা কাটিয়ে কখন যে সত্যিকার আশায় রূপ নিচ্ছিলো, সে বিষয়ে আমিও পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলামনা। সিনথিয়াও হয়তো বিষয়টা ওর দাদির কাছ থেকে তামাশার ছলেই শুনে থাকবে- আমি জানা নেই। ও যে বিষয়টা জেনেছে সেটা ওর আচরণ দেখলেই বোঝা যেতো। আমাকে দেখলেই কেমন যেনো লজ্জাবতীর পাতার মতো মিইয়ে যেতো, চলার পথে কখনো সখনো দেখা হলে যথাসম্ভব পাশ কাটিয়ে যেতে চেষ্টা করতো কিংবা বিকল্প পথ ব্যবহার করতো- অপরিণত বয়সের ছেলে মেয়েরা যে ধরণের আচরণ করে আরকি। আর কোনোদিন ওর সাথে কুশল/সুশল বিণিময় করা ছাড়া ও সাথে আমার বাড়তি কোনো কথা হয়নি। ওইটুকুন একটা মেয়ের সাথে কীই কথা থাকতে পারে!
যদিও ভার্সিটির প্রথম (কিংবা অন্য অর্থে দ্বিতীয়) বর্ষের ছাত্র, তখনও মোবাইল ব্যবহার করতাম না। ব্যবহার করতাম না অনেকটা ইচ্ছে করেই। তখন যে মোবাইল ব্যবহার করার সাধ্য ছিলোনা, তা নয়। আমি যখন ইন্টামিডিয়েট পড়ি, তখন ভাইয়া চাকরি পান। এবং ভাইয়া আমাকে একটা মোবাইল দেবার পক্ষেই ছিলেন। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই সেটা নিইনি। অতীত বাস্তবতার আঘাতগুলো আমাকে এত তীব্রভাবে আলোড়িত করতো যে আমার মনে হতো একটা মোবাইল ব্যবহার মানে অপচয়। আরেকটা বিষয়ও যে আমার মনে কাজ করে নি, তা নয়। গ্রামে তো তখন মোবাইল অনেকটা বিরল। যদিও দুএকটা ‘রেডিও সেট’ টাইপের মোবাইল কারো কারো হাতে দেখা যেতো, নেটওয়ার্ক পাওয়া যেতো না। টিভি এন্টেনার মতো এন্টেনা সংযোগ লাগিয়ে সংযোগ পেতে হতো। আর সেই মোবাইল ওয়ালাদের ভাব দেখলে মনে হতো যেনো দিল্লীর সম্রাট। আর যিনি মোবাইল দেখছেন তার ভাব দেখে মনে হতো পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্যের একটা কিংবা আফ্রিকার কোনো জঙ্গলের অচেনা প্রাণী দেখছেন। শহরে যাদের পরিবারের সদস্যদের কারো হাতে মোবাইল ছিল, তারা আমাদের কাকরকান্দি বাজারের ইউসুফ ডাক্তারের দোকান থেকে অপারেটরভেদে ছয় থেকে বারো টাকা মিনিটে কথা বলতো। এবং, তখন কোনো পাল্‌স প্রযোজ্য ছিলোনা। এক সেকেন্ড গেলেও গুণতে হতো পুরো মিনিটের টাকা। শুধু তাই নয়, কেউ যদি মিস্‌ড কল দিয়ে কলব্যাক করিয়ে কথা বলতো, তার জন্যও মিনিটপ্রতি খরচ ছিলো দু’টাকা। আমার মনে আছে, আমার গ্রামের যে-নারীকে আমি প্রথম মোবাইলে কথা বলতে দেখেছিলাম, তিনি মোবাইল হাতে নিয়ে ‘হ্যালো’ বলার আগেই, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে, অজ্ঞান হয়ে ধপাস করে মোবাইলসহ পড়ে গিয়েছিলেন।
‘সেদিন গিয়াছে... কহিছে কালের ঘড়ি’। এতো তখনকার গ্রামের চিত্র। ক্যাম্পাসে এস দেখলাম ভিন্ন চিত্র, ভিন্ন জগৎ, ভিন্ন পরিবেশ। তখনও যদিও এখনকার মতো সবার হাতে একাধিক অত্যাধুনিক সেট, ট্যাব কিংবা স্মার্টফোন ছিলোনা, কিন্তু গ্রামের তুলনায় অনেকটাই সহজলভ্য ছিলো, এটা বলাই যায়। এবং তখনকার এই ‘ছয় টাকা মিনিট’-এর সময়টাতেও দেখতাম ছেলেমেয়রা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে কথা বলতো। আর এ জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ‘মোবাইল, গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড’ আমার কাছে কেমন যেনো গরিবের ঘোড়া রোগ মনে হতো। অনেকটা বিতৃষ্ণার মতোও ছিলো। হয়তো এ জন্যই নয় বছরের ক্যাম্পাস জীবনে ‘গার্লফ্রেন্ড’ নামক বস্তুটি আমার ধারে কাছে ভীড়তেও পারেনি। আর সহপাঠী ও বন্ধুরা যখন মোবাইল ও গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, আমি ছিলাম তাদের ভাষায় ‘ব্যাকডেটেড’, ‘ক্ষ্যাত’। কারণ আমি তখনও মোবাইল ব্যবহার করতামনা, আমার গার্লফ্রেন্ড ছিলোনা, আমি তখনও চিঠি লিখে যোগাযোগ রক্ষা করতাম ইত্যাদি। আবার অনেকের মুখে আমাকে ‘কিপটা’ শব্দটা ব্যবহার করতেও শুনেছি। আগের শব্দটা অনেকটা মেনে নিয়েছিলাম; কিন্তু পরেরটা আমি কোনোভাবেই মানতে পারিনি, পারিনা এবং কোনোদিন পারবো বলেও মনে হয়না। ‘অ-কৃপণতা’য় আমাকে ছাড়িয়ে যাবে- আমার হাতে টাকা থাকলে, কারো সাধ্য নেই। তার মানে এই নয় যে আমি অপচয় করি, প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে আমার কাপর্ণ্য নেই, সহপাঠী-বন্ধু-জুনিয়ারদের আড্ডায় খরচ করতে আমি ভালোবাসি, আমার কোনো পছন্দের জিনিস চোখের সামনে পড়লে, লুফে নিতে দেরি করিনা, কাউকে উপহার দিতে ভালো লাগে, কিছু টাকা খরচ করে হলেও কাউকে খুশি করতে আমি আনন্দ পাই (ভিক্ষুক বাদে)। হ্যাঁ, আরেকটা বিষয়- অনেকে ভাবেন যে, কার্পণ্য শুধু টাকা-পয়সার গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমার মতে মোটেই তা নয়; বরং তা আরো বড় ও বিস্তৃত বিষয়াদিতে ব্যাপৃত। ‘ভালো’কে ভালো আর ‘মন্দ’কে মন্দ বলে স্বীকার করতে আমার দ্বিধা লাগেনা, আমি গুণীজনের গুণকে সমাদর করতে জানি, ‘সত্য’কে সত্য বলে মেনে নেবার সৎসাহস আমার আছে, যার যার প্রাপ্য মর্যদা দিতে আমার কুণ্ঠাবোধ নেই, অকাতরে আমি আমার ভুলগুলোকে ভুল বলে অসঙ্কোচে মেনে নিই, ছলনা-চাতুরী-মিথ্যা-ভণ্ডামি ইত্যাদি আমার কাছে ঘৃণ্য মনে হয়, মানুষকে আমি মনুষ্যত্ব দিয়েই বিচার করি- ধর্ম বা অন্য কোনো সংকীর্ণ মানদণ্ডে নয়, পরিবর্তনকে মেনে নেবার মানসিকতা আমার আছে (তবে পরাজয়কে নয়)- সুতরাং আমি আর যেখানেই থাকি, অন্তত ‘কিপটা’র দলে আমি নেই। আর যারা এর বিপরীত আচরণ করে, কৃপণের দলে তাদেরই পড়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।
থাক, ঢোল আস্তে পেটানোই ভালো; নয় ফেটে যেতে পারে। আমার সাথে যাদের চলাফেরা আছে, তারাই ভালো জানেন এবং বলতে পারবেন আমি কোন্‌ দলে আছি (তবে কোন্দলে নেই)। আমি মোবাইল ব্যবহার করি ইংরেজি দ্বিতীয় বর্ষ থেকে। সিনথিয়ার সাথে আমার প্রথম মোবাইলে কথা হয়, সে যখন নবম শ্রেণিতে পা দেয়। এরপর মাঝে মাঝে কথা হতো। যেহেতু তার নিজের মোবাইল ছিলোনা, অন্যের মোবাইল থেকে মিস্‌ড কল দিয়ে সে আমার সাথে কথা বলতো। তারপর আস্তে আস্তে সেও কিছুটা বুঝতে শিখলো, আমার ভালোলাগার শাখা প্রশাখাও বিস্তার লাভ করে, ভালোবাসার পরিণত বৃক্ষে রূপান্তরিত হতে শুরু করলো। সিনথি ইন্টারমিডিয়েট ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের দুজনের কেউই সরাসরি ‘ভালোবাসি’ কথাটি মোবাইলে কিংবা সামনাসামনি বলতে পারার চৌকাঠটুকু পেরুতে পারিনি। যেদিন মোবাইলে প্রথম সেই কাঙ্ক্ষিত শব্দটা বলেছিলাম, আমার নিজেকে এতো বেশি অসহায় মনে হয়েছিলো যে, সে মুহূর্তে আকাশে চাঁদ ছিলো নাকি সূর্য ছিলো, হাটে-মাঠে-বাটে কী বাঁশি বেজিছিলো, নৌকার মাঝি বদর দিয়ে নৌকা চালাচ্ছিলো কিনা, কিংবা পূজার জন্য মন্দিরে মঙ্গল-ঘন্টা বেজেছিলো কিনা, কী গান পাখি গেয়েছিলো স্বর্গ-মর্ত-পাতালের কোথায় ছিলো আমার অবস্থান অথবা মোবাইলের ওপাশ থেকে ও কী উত্তর দিয়েছিলো, কিচ্ছু মনে নেই। শুধু এটুকু মনে করতে পারি, আমার মনে হয়েছিলো, সমস্ত আকাশ, সমস্ত পৃথিবী, সমস্ত গ্রহ-নক্ষত্র-নীহারিকাপুঞ্জ, মহাবিশ্বের সমস্ত ভার হয়তো আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলো কেউ। কী মহা-শক্তিধরের মতোই না আমি সে ভার তখন বয়েছিলাম।

তিন
সিনথি আর আমার সম্পর্কটা শুরু থেকেই আমার পরিবারের কেউ মেনে নিতে পারেননি। এমন কি আমার আশপাশের সমাজের কেউও নয়। কয়েকটা কারণে। প্রথম কারণটা ব্যতিক্রম কিছু নয়। পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্রের। তার বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ, আমার ভাইয়ার ভালো। আমি একবারেই ছোটোবেলাতে বাবাকে হারিয়েছি, তাই ভাইয়ার অবস্থার কথাই বলতে হয়। দ্বিতীয় কারণ, ‘কান টানলে মাথা আসা’র মতো। সিনথির বাবা-মার বিয়ের পরপরই ওর বাবার একটা পা কেটে ফেলতে হয় কোনো এক কারণে। সিনথি সংসারের বড় মেয়ে। এই আধুনিক যুগেও ওর বাবা-মা সন্তান নিয়েছেন ওকে ছাড়াও আরো তিনজন। যেহেতু বাবার আর্থিক অবস্থা ভালোনা সুতরাং, সংসারের বড় মেয়ে হিসেবে যে-তাকে গ্রহণ বা বিয়ে করবে, ওর পুরো পরিবারের দায়ভার তার কাঁধেই এসে পড়বে- ছোটো ভাইোবানদের পড়াশনার গুরুভারসহ। তৃতীয় কারণ, আমি ছিলাম আমার পরিবারের নয়জন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোটো। সেদিক থেকে আমার প্রতি তাদের প্রত্যাশাটাও বেশি থাকাই সমীচীন। অভিভাবকেরা চিরদিনই বাস্তববাদী হন।
যদিও আমার পরিবার, সমাজ সবই আমার প্রতিকূলে ছিলো, আমার মনে একটা চিরন্তন বিশ্বাস ছিলো যে ভাইয়া কোনোদিন আমার আশায় বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না। আমার বিশ্বাসের ভিত্তিমূলে আরেকটা বিশ্বাস শিকড় গেঁড়ে বসেছিলো, সেটা আমি আগেই বলেছি। ভাইয়া কখনো কাউকে টাকা-পয়সা, অর্থ-সম্পত্তি দিয়ে বিচার করতেন না; বিচার করতেন মনুষ্যত্ব দিয়ে। অথবা তিনি অন্যভাবে বিচার করলেও অন্তত আমি কখনো দেখিনি। সময় পাল্টেছে, অবস্থা পাল্টেছে, পাল্টছে আরো অনেক কিছু। ভাইয়া এখন আর গ্রামের তৃতীয় বা দ্বিতীয় শ্রেণির আমজনতার কেউ নন। তিনি এখন নগর জীবনের প্রথম শ্রেণির নাগরিক। এখন তার স্বপ্ন ছোট্ট সোনার সংসার, বিএমডব্ল্যু গাড়ি, আকাশচুম্বি বাড়ি... এতসব পরিবর্তনের মধ্যে তাঁর বিশ্বাসেও যে পরিবর্তন আসবে, সে-ধারণাটা আমার অনুমিত ছিলোনা।
সিনথি এবং আমার বিষয়টা নিয়ে ভাইয়ার সাথে আমার মুখোমুখি যে খুব বেশি দর কষাকষি হয়েছে তা নয়। জোর দাবি নিয়ে ভাইয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর দুঃসাহস ছোটোবেলা থেকেই আমার ছিলোনা। তবুও সাহস করে দু একদিন যেটুকু কথা হয়েছে, তাতে ইতিবাচক সাড়া পাইনি। কিন্তু মা, আপা, ভাইজান অধিকন্তু ভাবিকে দিয়ে অজস্রবার বলিয়েছি। এবং, প্রত্যেকবারই নেতিবাচক ফলাফল। তবুও আমার একটা বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিলো ভাইয়া আমার দাবিটা শেষমেষ মেনে নেবেন। কারণ তাঁর হৃদয়ে যে আমার জন্য আলাদা একটা স্নেহের আসন ছিলো, একটা প্রস্রবণ আছে, সেটা আমি জানতাম।
সিনথি এবার ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে। ওর সাথে প্রায়ই এসব নিয়ে কথা হতো। পরিবার, পরিস্থিতি, সমাজ, সংসার- সব কিছু নিয়ে। সেও এখন এতটুকুন মেয়েটি আর নেই। বুঝতে শিখেছে বাস্তবতা কী, কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্যটা কী! ও প্রায়ই আমাকে বলতো-
-আচ্ছা, আমাদের এই যে সম্পর্ক আর বাস্তবতা, এর শেষ কোথায়?
-দ্যাখো সিনথি, আমি আশাবাদী মানুষ। আমার বিশ্বাস আমি আমার পরিবারকে রাজি করাতে পারবো।
-যদি না করাতে পারো!
-পারি কি না পারি, শেষটাতো দেখতে দাও। “I will drink life to the lees.”
-বাদ দাও তোমার Tennyson এর কবিতা। কবিতা দিয়ে জীবন চলে না। ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেনো ঝলসানো রুটি’।
-আরে তুমিই আর ছেড়ে দিলে কোত্থেকে। সুকান্তকে টেনে নিয়ে এলে একেবারে জীবন্ত করে। আর হুঁম! কবিতা দিয়ে জীবন চলে না ঠিক, কিন্তু কবিতা জীবনেরই কথা বলে।
-নারে, আমি সত্যি সিরিয়াস। আমার পরিবারের অবস্থা তো জানোই। আমাকেই কি বসিয়ে রাখবে বাবা-মা! আর আমিই বা কোন্‌ বিশ্বাসে বা থাকবো, বল! তুমিতো আমাকে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কোনোটাই বল না।
-আচ্ছা, তুমিই আমাকে বল, আমি কী বলবো! আমার অবস্থানে তুমি থাকলে কী করতে- একটু ভাবতো! ছোটোবেলা থেকে মা আর ভাইয়েরা কষ্ট করে মানুষ করেছেন, পড়ালেখা শিখিয়েছেন, তাঁদের অবাধ্যই এতো তাড়াতাড়ি কী করে হই বল।
অপর প্রান্তে কোনো উত্তর নেই। বুকভাঙা একটা দীঘর্শ্বাস শুনতে পেতাম শুধু। মনে হতো ঝঞ্ঝাঁ-বিক্ষুব্ধ-সাগরের কোনো ঢেউ যেনো বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ছে আর ভেঙেচুড়ে, দুমড়ে মুচড়ে সুনামির ঢেউয়ের মতো সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সম্মুখে যা-পাচ্ছে, তাই।
ওর বিয়ের আগে সিনথির সাথে মোবাইলে আমার সবশেষ কথা হয়েছিলো ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ শনিবার রাত নটার দিকে। তার কথার সারমর্ম ছিলো গাইবান্ধার সাঘাটা থেকে এক ছেলের জন্য তাকে দেখতে এসেছিলো। মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে, মেয়ে পক্ষের মতামত কী জানাতে বলেছে। আমি তখন সিএনজি অটোরিক্সায় কর্মস্থলের দিকে আসছিলাম। শুধু বললাম আমি সিএনজি থেকে নেমে তোমাকে কল দেবো। আমার কথায় সে অনেকটা রাগে-ক্ষোভে-অভিমানেই ফোন রেখে দিলো। এরপর বাসায় ফিরে ওর মোবাইল বন্ধ পেলাম বেশ ক’বার চেষ্টা করার পরও। পরেরদিন সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস ছিলো। যারা ব্যাংকে কাজ করেন, ভালোভাবেই জানেন, মাসের প্রথমার্ধের সপ্তাহের প্রথম দিনগুলোতে কতটা বেশি ব্যস্ততা থাকে। সারাদিন ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মোবাইলের দিকে নজর দেবার অবসরটুকুও পাইনি। সন্ধ্যায় মোবাইলে মিস্‌ড কল পেলাম তেরোটা। এর মধ্যে সিনথির মোবাইল থেকেই পাঁচটা। সন্ধ্যার পর আবারো ফোন অফ। এরকমটা যে ওর সাথে আমার হতো না, তা নয়। এই দু’একদিন রাগ করে থেকে আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যেতো। এবং মান ভাঙাভাঙিটা হতো দুজনের পক্ষ থেকেই। এবার কেনো যেনো হলো না।
আমি বাড়িতে বিষয়টা জানিয়েছি, ভাইয়াকেও জানিয়েছি। তাঁদের আগের অবস্থানের কোনোই পরিবর্তন হয়নি। হবেও না মনে হচ্ছিলো। আমিও মনে মনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম। এবার অবাধ্য হতে বাধ্য হবো। ভাইয়া আমার সাথে ফেইসবুকে সংযুক্ত আছেন। শুধু তাঁকে জানান্‌ দেবার জন্য এ বিষয়ে একটা স্ট্যাটাসও দিয়ে রাখলাম।
মনে বিশ্বাস ছিলো- সিনথি রাগ-অভিমান যা-ই করুক সবশেষ সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাকে জানাবে। কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম কোঁৎ দ্য মিরাবু’র কথাটা Short absence quickens love; long absence kills it. তবুও বিরতিটা এতো লম্বা হয়তো বা হতোও না। সিনথির মান করার পরের দিন দুপুর বেলার খাবার খেতে গিয়ে ঘটে গেলো আরেক ঝঞ্ঝাট। আমরা, আমাদের শাখার সব অফিসার মিলে, একটা মেসে দুপুরের খাবার খেতাম। শার্টের বুক পকেটে মোবাইল রেখে প্লেট ধুতে গিয়েছি, অমনি মোবাইলটা বালতির শীতল জলে ডুব দিয়ে, ফাগুনের আগুন-ঝরা রোদে যেনো তৃপ্তি পেলো। এরপর সার্ভিসিং করানো পর কিছুটা কাজ হলো। তবে সেটের মেমোরিতে থাকা নাম্বারগুলো হারালাম। আবার সব ফাংশান কাজও করে না। মাঝে মাঝে কল করা যায়, মাঝে মাঝে যায় না। ইনকামিং কল এর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ক্ষুদে বার্তা লেখা খুবই খষ্টকর। একটা লিখলে আরেকটা হয়ে যায়। কল করা এবং কল ধরাটা কিংবা এসএমএস করাটা এখন আমার জন্য এমন হয়ে দাঁড়ালো যেনো এটা মোবাইলের ইচ্ছেমাফিক ব্যাপার- আমি কল করতে দেবো তো করবে; ধরতে দেবো তো ধরবে। আরেকটা বাড়তি ফাংশান যোগ হলো। এর ব্যালাইট আর নেভেনা। জ্বলছে তো জ্বলছেই। সেটের সুইচ অফ করলেও জ্বলেই থাকে।
প্রতি মাসের পঁচিশ বা ছাব্বিশ তারিখে আমাদের বেতন হয়। বিগত মাসের বেতন পুরোটা উঠিয়ে, মাত্র পাঁচশত টাকা হাতে রেখে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। বাড়ি করার জন্য মাটি কাটার কাজ ধরিয়েছি, শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের জন্য। এখন সপ্তাহ শেষে দুপুরের খাবারের জন্য যে-এক হাজার টাকা পেতাম, তাই দিয়ে চলছিলো। সুতরাং, মোবাইল কেনার কথা কল্পনায় আনতেও ভয় করছিলো। তাছাড়া, কোনোকিছু করার জন্য পেছন থেকে যে-তাড়নাটা থাকতে হয়, সেটাও ছিলো না। দিন যেতে নিয়ম করে তিনবার মার সাথে কথা বলা আর ওর সাথে কানেক্টেড থাকা ছাড়া সেরকম কোনো দরকারও যে মোবাইলের ছিলো, তা-ও নয়। অফিসিয়াল যে-প্রয়োজনগুলো ছিলো, সেটা সারতাম অফিসের ফোন থেকেই। মোবাইলটার বেশিরভাগ প্রয়োজনীয়তাই ছিলো সিনথির সাথে যোগাযোগ রাখা। এখন যেহেতু সে আমাকে কলই দিতোনা, আমি আরেকটা মোবাইল কেনা ততোটা জরুরী মনে করিনি। তারপরও অনেক দিন আগে ভাইয়া একটা অব্যবহৃত মোবাইল ফোন আমাকে দিয়েছিলেন, সার্ভিসিংয়ে সারিয়ে ওটাকে দিয়ে ‘ঠ্যাকা’র কাজ চালাই। ওটাও যে শতভাগ ঠিক, তা-ও না। এক মিনিট আগে দেখাবে ব্যাটারি ফুল, পরের মিনিটেই ব্যাটারি শূন্য। নতুন ব্যাটারি লাগানোর পরও একই অবস্থা। অনেকটা জং ধরা জিনিস গ্যালভানাইজিং করে চকচকে করে রাখার মতো। তবে তুলনামূলক আগেরটার চেয়ে ভালো। আমার মোবাইলের অবস্থা দেখে পাশের বাড়ির এক ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেলো। উনি কোনো ভাঙাচুড়া জিনিস ঠিক করে কাজে লাগাতে দেখলেই বলেন, “জিনিসটাত তুমার বালাই, খালি জালাই আর জালাই (ঝালাই)”। এনবিআর কর্মকর্তা, বন্ধু জামাল, আমার মোবাইলের এই অব্সথা দেখে, ইচ্ছে করেই বলেছিলো, “চলো, তোমাকে একটা স্মার্টফোন কিনে দিই”। আমি বলেছিলাম, “আরে ভাই, আমি হলাম এক আন-স্মার্ট-লোক, আমার কি ওসব স্মার্ট ফোনটোন মানায়”! আমার হেয়ালির কারণ ছিলো একটাই- ওই যে বললাম আসল প্রয়োজনীয়তাই শেষ হয়ে গিয়েছিলো।
এরপর ওর সাথে কথা হলো ১৪ এপ্রিল ২০১৬। বাংলা নববর্ষের ছুটির দিন ছিলো। ম্যানেজার স্যার চলে গেছেন ফ্যামিলির সাথে সময় দিতে। ছুটির দিনগুলোতে আলসেমিটা আমাকে সবসময় কেনো যেনো ঘনিষ্ট বন্ধুর মতো আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। কিছুতেই ছাড়তে চায়না। বরাবরের মতোই স্লিপিং পিল নিয়ে, মোবাইলের সুইচ অফ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে; বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করলো না। এপাশ ওপাশ করতে করতে বেলা এগারোটা বেজে গেলো। বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে মোবাইলটা অন করতেই দুটো ক্ষুদ বার্তা পেলাম। আজকের দিনে ক্ষুদে বার্তা পাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। অনেকেই নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা পাঠাতে পারে। তবে প্রতিবছর আমি যাঁর ক্ষুদে বার্তা সবার আগে পেতাম, তিনি ভাইয়া। ঠিক রাত বারোটা এক মিনিটে ভাইয়ার বার্তা আসাটা অনেকটা অবধারিত থাকতো বিশেষ দিনগুলোতে। এবারের টানাপোড়েনে আর ভাইয়ার কাছ থেকে বার্তা জোটেনি। বার্তা দু’টো খুলে দেখলাম, দু’টো বার্তাই সিনথির বাবার মোবাইল থেকে। প্রথম বার্তার ভাষাটা এরকম- ‘আমি তোকে আমার সারাটা জীবন দিয়ে দিলাম, আর তুই আমাকে কিছুই দিতে পারলি না’। হঠাৎ বুকের মধ্যে আচমকা একটা ধাক্কা খেলাম। দ্বিতীয় বার্তাটা খুললাম তড়িঘড়ি করে। লেখা ছিলো, ‘তাই বলে ভেবোনা তোমাকে দোষ দিচ্ছি; ভেবে নেবো এটা আমার ভাগ্যে লেখা ছিলো; কখনো ভাবিনি আমাকে এটাও মেনে নিতে হবে’। কেমন যেনো একটা চাপা ভয়ে হাত পা আক্ষরিক অর্থেই কাঁপতে শুরু করলো। কাঁপা কাঁপা হাতেই ওর নাম্বারটা ডায়াল করলাম। নষ্ট মোবাইল ম্যাজিকের মতো কাজ করলো।
-কী হইছে তোমার! এইসব কী লেখছো! কম্পিত কণ্ঠে আমার প্রশ্ন।
-আজ আমার বিয়ের কাবিন। একবাক্যেই বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো ওর কণ্ঠ। শেষ শব্দটা ভালোভাবে বোঝাই গেলোনা।
-কী বললে! কখন কাবিন! আমাকে আগে বলনি কেনো?
-ছেলেপক্ষ প্রায় চলে এসেছে। তারপর আর কোনো কথা নেই। ফুঁপিয় ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ।
-সত্যি বলছ ত! তোমার মাথা ঠিক আছে? নাকি আমাকে নববর্ষে বোকা বানাতে চাইছো! বলতেই অপর প্রান্তে শ্রাবণের ভারি মেঘ ঝরঝর করে ঝরে পড়ার মতো সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। ফোন ডিস্কানেক্টেড।

তৎক্ষণাৎ ভাবিকে ফোন দিয়ে ভাইয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানতে চাইলাম। ভাবির কথা অনুযায়ী ভাইয়া তখন বাসায় ছিলেন না। বাবুদের নিয়ে বৈশাখী মেলায় গিয়েছেন। ফেরার পর সিদ্ধান্ত জানাবেন।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ভাইয়ার সিদ্ধান্ত যাই আসুক আমি চলে যাবো ওর কাছে। এ বিয়ে কোনোভাবেই হতে দেবোনা। My life, my way. কিন্তু তার আগে আমার ওদের বাড়ির অবস্থাটা জানা জরুরি ছিলো। কেনো না, ইতিমধ্যে বরপক্ষ চলে এলে, সেখানে আমার উপস্থিতি আমার জন্য যতোটা ভালোই হোক, ওর জন্য, একটা পুরুষ শাসিত সমাজের মেয়ের জন্য, ততোটাই খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া আমার এখান থেকে বাড়ি পৌঁছুতে সময় লাগে সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। দূরত্বটা বিশি নয়; কিন্তু সরাসরি ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা নেই। সিএনজি অটোরিক্সা পাল্টাতে হয় সাতটা স্থানে। এদিকে মোবাইল আবার বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসেছে। কল করা যাচ্ছিলো না। চার পাঁচবার সেট রি-স্টার্ট দিয়ে, একবার ব্যাটারি-SIM খুলে লাগানোর পর আমার বন্ধু আরিফকে বিষয়টা সংক্ষেপে জানিয়ে, পরিস্থিতি কী আমাকে জানাতে বললাম। তিন মিনিটের মধ্যে আরিফের উত্তর পেলাম। মোবাইল ওর বাবার কাছে; বিয়ের কাজ সমাপ্ত।

চার
বিশ্বাসগুলো আমার প্রতিবারই মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমি ভেবেছিলাম সে হয়তো পরিবারের চাপে পড়ে বিয়েতে রাজি হয়েছে। সে নিশ্চয়ই আমার কাছে ফিরে আসবে। এরপর ওর সাথে, ওর পরিবারের সদস্যদের সাথে একাধিকবার কথা বলেও তাদের আমি বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। এখনো বলছি ফিরে এসো, সিনথিয়া! সে তার সমাজ, সংসার ছেড়ে, ওর জীবনঙ্গীকে একা ফেলে আসতে পারবে না; এটা তারপক্ষে অ-সম্ভব। অথচ সে গভীর রাতে আমাকে ফোন করে, চোখের জলে ভাসে যেনো আমার বুকে মাথা রেখেই চাপা অভিমানে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। আমার কোথায় অপারগতা! সব স্থানে, সর্বত্র, সব কাজে। আমি পরাজয়গুলোকে সহজভাবে মেনে নিতে পারি না। আমার কাছে পরাজয় মানে এক প্রকার মৃত্যু। ওকে আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে, ওর বার্তার উত্তরে বলেছিলাম, ‘তুমিতো আমাকে তোমার সারাটা জীবন দিয়ে দিলে, আর আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারলাম না আর তুমি তোমার সমাজ-সংসার ও জীবনসঙ্গীকে ছেড়ে আসতেও পারবেনা। সব নিয়ে তুমি নিয়ে সুখে থাক, আমি বিদায় নিলাম’।
মে দিবসের ছুটিসহ তিনদিনের ছুটি ছিলো। ম্যানেজার স্যার ২৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় বাড়ি চলে গেলেন। আমি এক হাজার পাওয়ারের স্লিপিং পিল নিয়ে, বিদায়ের ডালা সাজিয়েছিলাম। সেখানেও আমি ব্যর্থ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.