নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্লগ সার্চম্যান

ব্লগ সার্চম্যান

ব্লগ সার্চম্যান › বিস্তারিত পোস্টঃ

নোয়াখালী দাঙ্গা এর ইতিহাস

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:১৫


নোয়াখালী দাঙ্গা Noakhali riots নোয়াখালী গনহত্যা, বা, নোয়াখালী হত্যাযজ্ঞ নামেও পরিচিত এটি হচ্ছে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারত স্বাধীন হওয়ার এক বছর পূর্বে ১৯৪৬ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বরে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পূর্ববঙ্গের বর্তমানে বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলায় স্থানীয়দের দ্বারা সংঘটিত ধারাবাহিক একটি গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা। এতে নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর, ছাগলনাইয়া ও সন্দ্বীপ থানা এবং ত্রিপুরা জেলার হাজীগঞ্জ, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর, লাকসাম ও চৌদ্দগ্রাম থানার অধীনে সর্বমোট প্রায় ২০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।তৎকালীন অবিভক্ত নোয়াখালী ছিল বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী নিয়ে এবং অবিভক্ত ত্রিপুরা জেলা ছিল বর্তমান কুমিল্লা, চাঁদপুর এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়া অঞ্চল নিয়ে গঠিত।

হিন্দুদের উপর এই গণহত্যার শুরু হয়েছিল ১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবর কোজাগরি লক্ষ্মী পূজার দিন এবং প্রায় চার সপ্তাহ ধরে অব্যাহত ছিল। তাতে প্রায় কমপক্ষে ৫০,০০০ হিন্দু হত্যা করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়।তাছাড়া অনেক হিন্দু নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং হাজার হাজার হিন্দু নার পুরুষদের জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়।প্রায় ৫,০০০ থেকে ৭,৫০০ বেঁচে থাকা হতভাগ্যকে কুমিল্লা, চাঁদপুর, আগরতলা ও অন্যান্য জায়গার অস্থায়ী আশ্রয় শিবির গুলোতে আশ্রয় দেয়া হয়। তাছাড়া প্রায় ৫০,০০০ হিন্দু আক্রান্ত এলাকায় মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকে। কিছু এলাকায় হিন্দুদেরকে স্থানীয় মুসলিম নেতাদের অনুমতি নিয়ে চলা ফেরা করতে হত। জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিতদের কাছ থেকে জোর করে লিখিত রাখা হয়েছিল যেখানে লেখা ছিল তারা স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছে। তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট বাড়িতে বা ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হত এবং যখন কোন আনুষ্ঠানিক পরিদর্শক দল পরিদর্শনে আসত তখন তাদেরকে ওই নির্দিষ্ট বাড়িতে যাবার অনুমতি দেয়া হত। হিন্দুদেরকে ওই সময় মুসলিম লীগকে চাঁদা দিতে হত যাকে বলা হত জিজিয়া যা একসময় ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। মুসলিম শাসন আমলে হিন্দুরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তৎকালিন শাসকদের ‍জিজিয়া নামক বাড়তি প্রদান করত।

বঙ্গীয় আইন সভার নোয়াখালী থেকে একমাত্র হিন্দু প্রতিনিধি হারান চন্দ্র ঘোষ চৌধুরী এই দাঙ্গাকে হিন্দুদের প্রতি মুসলিমদের প্রচণ্ড আক্রোশের প্রকাশ বলে বর্ণনা করেন।বাংলার সাবেক অর্থ মন্ত্রী এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নোয়াখালী দাঙ্গাকে একটি সাধারণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হিসেবে দেখানোর বিতর্ককে প্রত্যাখান করেন। তিনি সে ঘটনাকে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সংখ্যাগুরু মুসলিমদের সুপরিকল্পিত এবং সুসংঘটিত আক্রমণ বলে বর্ণনা করেন।মহত্মা গান্ধী নোয়াখালীতে ক্যাম্প করেন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নোয়াখালী ও তার আশেপাশের এলাকা গুলো ঘুরে দেখেন। যদিও এই শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কংগ্রেস সভাপতি আচার্য্য কৃপালনির স্ত্রী সুচেতা কৃপালনি নোয়াখালিতে নারী উদ্ধার করতে যান। বেঁচে যাওয়া হিন্দুদের আত্মবিশ্বাস চিরতরে নষ্ট হয়ে যায় এবং তারা কোন দিন তাদের নিজেদের গ্রামে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেনি। তার মধ্যে কংগ্রেস নেতৃত্ব ভারত বিভাগ মেনে নেন যার ফলে শান্তি মিশন এবং আক্রান্তদের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম পরিত্যক্ত হয়। বেশির ভাগ বেঁচে যাওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুরা তাদের বাড়ি-ঘর ফেলে পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা এবং আসামে চলে যান।

যখন কলকাতায় দাঙ্গা চলতে থাকে তখন নোয়াখালীতে কোন সহিংসতা হয়নি। যদিও তখন থেকেই আবহাওয়া গরম হতে শুরু করে। কলকাতা দাঙ্গার এক সপ্তাহের মধ্যে এবং নোয়াখালীতে দাঙ্গার ছয় সপ্তাহ পূর্বে কলকাতায় অবস্থিত ইস্টার্ন কম্যান্ড হেডকোয়ার্টার এমন কিছু রিপোর্ট হাতে পায় যেখানে বলা হয়েছিল চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর গ্রাম এলাকায় মুসলিমরা উত্তেজিত অবস্থায় আছে এবং গ্রামের মুসলিমেরা হিন্দু বিদ্বেষ ছড়ানোর লক্ষ্যে নানা ধরেনর ছড়া, পালা, জারিগান, ছন্দবদ্ধ স্লোগান তৈরি করেছে যেগুলো বিভিন্ন হাট-বাজারে গান গেয়ে ও আবৃত্তি করে প্রচার করা হচ্ছে।

ঈদের দিনে সহিংসতা
১৯৪৬ সালের ২৯ আগস্ট ছিল ঈদ-উল-ফিতরের মুসলিমদের সব থেকে বড় ধর্মীয় উৎসবের দিন।সেদিন থেকেই নোয়াখালীর মানুষের মনে আশঙ্কা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল।পরিকল্পিত ভাবে একটি গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হল যে হিন্দু এবং শিখ সম্প্রদায় অস্ত্র হাতে জড় হচ্ছে।ফেনী নদীতে মাছ ধরার সময় কিছু হিন্দু জেলেকে আক্রমণ করে।তাদের একজন মারা যায় আর আরও দুজন মারত্মক আহত হয়।নিয়ে চর উড়িয়াতে নয় জন হিন্দু জেলেকে আক্রমণ করা হয়। তাদের বেশির ভাগ মারাত্মক জখম হয়। সাত জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। রামগঞ্জ থানার আওতাধীন বাবুপুর গ্রামের কংগ্রেস নেতার পুত্র দেবীপ্রসন্ন গুহকে হত্যা করা হয়।দেবীপ্রসন্নের আরেক ভাই এবং তাদের কর্মচারীকে মারাত্মক ভাবে আহত করে তারা।দেবীপ্রসন্নের বাড়ির সামনে থাকা কংগ্রেস অফিস আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।জামালপুরের কাছে মনপুরার চন্দ্রকুমার কর্মকারকে এবং ঘোষবাগের হোটেল কর্মচারী যামিনী দে কে হত্যা করা হয়। চর পার্বতীর তাজুমিয়ার হাটে দেবীসিংহপুরের অশু সেনকে নৃশংস ভাবে পেটানো হয়। বাঁশপাড়ার রাজকুমার চৌধুরীকে তার বাড়িতে যাবার পথে মারাত্মক ভাবে পিটিয়ে জখম করে ফেলে রাখা হয়।

সাম্প্রদায়িক প্রচারণা
১৯৩৭ সালে মুসলিম পীর পরিবারের বংশধর গোলাম সরোয়ার হুসেনি কৃষক প্রজা পার্টি থেকে মনোনয়ন নিয়ে বঙ্গীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত হন। যদিও ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগ দলের প্রার্থীর নিকট পরাজিত হন। গোলাম সরোয়ারের পিতা এবং পিতামহ খুবই ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন এলাকায় এবং কঠোর ভাবে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলতেন। তারা বংশানুক্রমিক ভাবে শ্যামপুরের দিয়ারা শরীফের খাদিম ছিল। দিয়ারা শরীফ ওই এলাকার হিন্দু-মুসলিম সবার কাছেই খুব পবিত্র স্থান হিসেবে গন্য হত। কোলকাতা দাঙ্গার প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের পর থেকেই হুসেনি উস্কানি মুলক বক্তব্য দেওয়া শুরু করে এবং মুসলিমদেরকে হিন্দু নিধনে উৎসাহিত করতে থাকে।কিছু এলাকায় মুসলিমরা হিন্দু দোকান-পাট থেকে দ্রব্যাদি কেনা থেকে বিরত থাকে।রামগঞ্জ ও বেগমগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন এলাকার নৌকার মুসলিম মাঝিরা হিন্দু যাত্রীদেরকে পারাপার করতে অস্বীকৃতি জানায়।সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুসলিমরা সাহাপুরের হিন্দু দোকান-পাট লুট করে। কোলকাতা থেকে যে সকল হিন্দু তাদের গ্রামে দুর্গা পূজার ছুটি কাটাতে এসেছিল তারা স্থানীয় মুসলিমদের নিকট হয়রানি,নির্যাতন এবং নিগ্রহের শিকার হন।মুসলিমরা অক্টোবরের ২ তারিখ থেকে সুযোগ পেলেই হিন্দুদের সম্পদ লুট,হিন্দুদেরকে হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে দেয়।

ঘটনা প্রবাহ

খুব দ্রুত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। গোলাম সরোয়ার হুসেনির বক্তব্যের পর রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন বাজারের হিন্দু দোকান মুসলিমরা লুট করে। মুসলিমরা নোয়াখালী বারের সভাপতি এবং হিন্দু মহাসভার নেতা সুরেন্দ্রনাথ বসু এবং রাজন্দ্রলাল চৌধুরীর বসত-বাড়ি আক্রমণ করে।
হত্যাকাণ্ড
১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসের ১০ তারিখ কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন। নোয়াখালীর হিন্দুরা বাড়িতে পূজার আয়োজনে ব্যস্ত। অন্যদিকে মুসলিম লীগ নেতা-কর্মীরা প্রচার করে যে শিখ সম্প্রদায় দিয়ারা শরীফ আক্রমণ করেছে।গুজবের ফলে আশে পাশের এলাকার মুসলিমরা দলে দলে দিয়ারা শরিফে জড় হয়। গোলাম সরোয়ার হুসেনি সমবেত মুসলিমদেরকে সাহাপুর বাজার আক্রমণ করতে নির্দেশ দেয়। কাশেম নামের আরেকজন মুসলিম লীগ নেতাও তার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে সাহাপুর বাজারে পোঁছায় যাদেরকে কাশেমের ফৌজ বলা হত।
কাশেমের ফৌজ নারায়ণপুর থেকে সুরেন্দ্রনাথ বসুর ‘জামিনদার অফিসের দিকে এগিয়ে যায়। কল্যাননগর থেকে আসা আরেকদল দাঙ্গাবাজ মুসলিম দল কাশেমের ফৌজের সাথে যোগ দেয়। এদের সাথে আরও অনেক ভাড়া করে আনা মুসলিম গুণ্ডারা জামিনদার অফিসে আক্রমণ করে। সামান্য প্রতিরোধের পরই সুরেন্দ্রনাথ বসু ধারাল অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মক ভাবে আহত হন। মুসলিম জনতা হাত-পা বেধে তাকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে।সুরেন্দ্রনাথ বসুকে মুসলিমরা আক্রমণ করেছে শুনতে পেয়ে পাশের পাঁচঘরিয়া গ্রামের ডাক্তার রাজকুমার পাল তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু পথিমধ্যে তাকে মুসলিম দুর্বৃত্তরা ছুরিকাহত করে।
অক্টোবর মাসের ১১ তারিখে গোলাম সরোয়ারের ব্যক্তিগত বাহিনী ‘মিঞার ফৌজ’ নোয়াখালী বার এ্যাসোসিয়েশন এবং জেলা হিন্দু মহাসভার সভাপতি রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরীর বসতবাড়িতে আক্রমণ করে। সে সময়ে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের স্বামী ত্রেম্বকানন্দ তার বাড়িতে অতিথি হিসেবে ছিলেন। রাজেন্দ্রলাল পুরোটা দিন তার বাড়ির ছাদ থেকে রাইফেল নিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করেন। রাত নেমে আসার পর যখন দাঙ্গাবাজেরা ফিরে গেল তখন রাজেন্দ্রলাল স্বামী ত্রম্বকানন্দ এবং তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেন। পরের দিন আবার মুসলিম দাঙ্গাকারীরা সংগঠিত হয়ে রাজেন্দ্রলালের বাড়িতে আক্রমণ করে। তারা বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে। রাজেন্দ্রলাল তার অগ্রজ চিন্তাচরন এবং অনুজ সতীশসহ পরিবারের ২২ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। রাজেন্দলাল রায় চৌধুরীর শরীর থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ফেলে মুসলিমরা।তারপর সে ছিন্ন মস্তক একটি থালায় করে গোলাম সরোয়ার হুসেনির নিকট নিয়ে আসে তার বাহিনী। রাজেন্দ্রলালের বাড়ি থেকে তার দুই মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে আসে হুসেনির বাহিনী যাদেরকে হুসেনি তার দুই বিশ্বস্ত অনুচরকে গনিমতের মাল হিসেবে দেয়।কংগ্রেস সভাপতি আচার্য্য কৃপালনির স্ত্রী সুচেতা কৃপালিনির মতে, রাজেন্দ্রলাল শিবাজি এবং গুরুগোবিন্দের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন এবং তার পরিবারের সম্মান এবং নিজের বিশ্বাসকে রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন।গান্ধিবাদী অহিংস আন্দোলনের একনিষ্ঠ অনুসারী আচার্য কৃপালিনী মনে করেন, রাজেন্দ্রলাল আর তার পরিবার নিজেদের রক্ষা করতে সম্পূর্ণ অহিংস পন্থা বেছে নিয়েছিলেন। তিন মাস পরে নোয়াখালী পরিদর্শনের সময় মহাত্মা গান্ধী লুটপাট আর ধ্বংসকৃত রাজেন্দ্রলালের বাড়িতে যান। ১৯৪৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাজেন্দ্রলালের গলিত শব আজিমপুরের জলা থেকে তুলে লামচর হাই স্কুলে গান্ধীজীর প্রার্থনা সভাতে নিয়ে আসা হয়। প্রার্থনার পরে রাজেন্দ্রলালের মস্তক বিহীন শরীর হিন্দু রীতিতে দাহ করা হয়।
অক্টোবরের ১২ তারিখে রাইপুর থানার অন্তর্গত শায়েস্তাগঞ্জের চিত্তরঞ্জন দত্ত রায়চৌধুরীর বাড়িতে একদল মুসলিম হামলা করে। তিনি তার পরিবারের সকল সদস্যদেরকে বাড়ির ছাদে তুলে দেন এবং নিজে ছাদ থেকে রাইফেল দিয়ে গুলি করে আত্মরক্ষার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেন; কিন্তু আক্রমণ কারীদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি অপরদিকে তার গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। তখন তিনি প্রতিরোধের জন্য আক্রমণকারীদের উপর জল কামান ব্যবহার করেন। অবশেষে নিরুপায় হয়ে তিনি তাঁর বৃদ্ধ মা এবং বাচ্চাদেরকে নিজ হাতে গুলি করেন এবং সব শেষে নিজে আত্মহত্যা করেন। রামগঞ্জ পুলিশের নিয়ন্ত্রণাধীন সোমপাড়া বাজারের কাছে গোপাইরবাগে দাস পরিবারের উপর কাশেমের নিজস্ব বাহিনী আক্রমণ করে। দাস পরিবার ছিল কাশেমের নিকটতম প্রতিবেশী। আক্রমণকারী বাহিনী দাস পরিবারের ১৯ জন সদস্যকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। হত্যার পূর্বে বাড়ির নারীদের ধর্ষণ করা হয়। মুসলিমরা রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন নোয়াখোলা গ্রামের চৌধুরী পরিবারের উপর হামলা চালায় বর্বর দাঙ্গাকারীরা। হামলাকারীরা উন্মত্তের মত হত্যার তাণ্ডব চালায়, লুটপাট করে এবং আগুন লাগিয়ে দেয়। ওই বাড়ির মোট ৮ জন পুরুষ সদস্যের সবাইকে হত্যা করা হয়। বাড়ির মহিলাদের টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে প্রকাশ্য দিবালোকে জনসম্মুখে গণধর্ষণ করা হয়।মুসলিমদের আরেকটি দল রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের গোবিন্দপুরের যশোদা পাল ও ভরত ভূঁইয়ার বাড়িতে আক্রমণ করে।তারা পরিবারের ১৬ জন সদস্যকে দড়ি দিয়ে বেধে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে নির্মম ভাবে হত্যা করে। বাড়ির মহিলাদের উপর্যূপরি ধর্ষণ করা হয়।আমিশাপাড়া এবং সাতঘরিয়ার মধ্যবর্তী এলাকার ভৌমিক এবং পাল পরিবারের সবাইকে আগুনে পুড়িয়ে ছাই বানানো হয়। এই দুই পরিবারের ১৯ সদস্যকে হত্যা করে মুসলিমরা। বাড়ির নারীদের সম্মানহানি করা হয়।গোলাম সরোয়ারের নিজস্ব বাহিনী নন্দীগ্রামের নাগ পরিবারের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে শুধু ক্ষান্ত হয়নি, রমনীকান্ত নাগের প্রতিষ্ঠিত পোস্ট অফিস ও বিদ্যালয় ভবনও পুড়িয়ে দেয়। আশেপাশের হিন্দু পরিবার গুলো নাগ পরিবারের বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং প্রথম দিকে পুলিশ বাহিনীও তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়। যখন গোলাম সরোয়ারের বাহিনী নাগ পরিবারের বাড়িতে আক্রমণ করে, পুলিশ তাদের হটিয়ে দেয়।পরবর্তীতে আক্রমণকারী মুসলিম জনতা সুসংগঠিত হয়ে সমস্ত গ্রাম জুড়ে নির্বিচারে লুটপাটের তাণ্ডব চালায়। কুঞ্জ কুমার নামে বৃদ্ধকে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা করে দাঙ্গাকারীরা।১৩ অক্টোবর দুপুর ১২টার সময় মারাত্মক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত ২০০-২৫০ জনের মুসলিমদের একটি দল চাঙ্গিরগাঁও এর হিন্দুদের উপর হামলে পড়ে। তারা হিন্দুদের ১,৫০০ মণ ধান পুড়িয়ে ভস্মে পরিণত করে দেয়। এলাকার সমস্ত মন্দির গুড়িয়ে দেয়া হয়। তারা সকল হিন্দু মহিলাদের শাঁখা ভেঙ্গে ফেলে, সিঁথির সিঁদুর মুছে দেয় আর হিন্দু পুরুষদের নামাজ পড়তে বাধ্য করে।

ত্রিপুরা জেলা ছিল কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে। চাঁদপুর থেকে যোগেন্দ্র চন্দ্র দাস (এম.এল.এ.) অক্টোবরের ১৪ তারিখে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নিকট চিঠিতে লেখেন, নোয়াখালীর রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় হাজার হাজার নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের উপর নির্যাতন করে মুসলিমরা। তাদের বাড়িঘর লুটপাট করে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় বসত ভিটা আর তাদেরকে জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরকরনের মত ঘৃণ্য কাজ করে তারা।
চাঁদপুরে দাঙ্গায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি বাড়ি

প্রত্যক্ষদর্শীদের দেয়া তথ্য অনুসারে, আক্রমণকারীরা বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে পেট্রোল ব্যবহার করত। প্রত্যন্ত দ্বীপ সন্দ্বীপে মোটর গাড়ি বা পেট্রল ছিল না তাই হিন্দুদের বাড়িঘর পোড়ানোর জন্য মূল ভূখণ্ড থেকে পেট্রোল নিয়ে আসা হত। এ প্রসঙ্গে রাকেশ বটব্যাল বলেন, পেট্রোল এবং কেরোসিনের এমন ব্যবহার দেখে বোঝা যায় হিন্দুদের উপর এই বর্বর আক্রমণ পূর্ব পরিকল্পিত এবং খুবই সুসংগঠিত।সন্দীপে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী লালমোহন সেন হিন্দুদের রক্ষার চেষ্টা কালে মুসলিম জনতা তাকে নির্মম ভাবে হত্যা করে।
১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসের ১০ তারিখ থেকেই নোয়াখালী জেলার উত্তরের রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা গুলোতে নৃশংসতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই লেলিয়ে দেয়া নৃশংসতাকে বর্ণনা করা হয়, ‘মুসলিম জনতার সংগঠিত হিংস্রতা (the organised fury of the Muslim mob)’।[৪৪] দ্রুত এই হিংস্রতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আশেপাশের নোয়াখালী জেলাধীন রাইপুর পুলিশ স্টেশন, লক্ষ্মীপুর, বেগমগঞ্জ, সন্দ্বীপ এবং ত্রিপুরা জেলার অন্তর্গত ফরিদ্গঞ্জ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর, লাকসাম ও চৌদ্দগ্রামে।এই সহিংসতা এবং ধ্বংসযজ্ঞ ছিল মাত্রাহীন নিষ্ঠুরতা। তখনকার এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এখনও পরিমাপ করা সম্ভব হয়নি। তৎকালীন পরিসংখ্যানগুলো থেকে নিশ্চিত করে এ সম্পর্কে ধারনা করা যায় না। যদি হিন্দু পত্রিকা গুলো মৃতের সংখ্যা এক হাজার বলত তাহলে মুসলিম লীগের পত্রিকা গুলো ভিন্ন সংখ্যা প্রকাশ করত এমনকি কোন হতাহতের সংবাদ সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে বসত। গান্ধীবাদী অশোক গুপ্ত মহাত্মা গান্ধীর সাথে গনহত্যা সংগঠনের এলাকা গুলো পরিদর্শন করে বলেন, কমপক্ষে ২,০০০ হিন্দুকে জোরপূর্বক মুসলমান করা হয়েছে। তিনি অন্তত ছয় জনকে দেখেছেন যাদের জোর করে বিয়ে করেছে মুসলিমরা এবং যাদের একজন খুন হয়েছে পাশবিক ভাবে। দাঙ্গার সময় নোয়াখালী নউরির জমিদার যশোদা রঞ্জন দাসকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। নিরাপত্তার জন্য তিনি তার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের পশ্চিমবঙ্গে পাঠিয়ে দিয়ে ভাইয়ের সাথে নোয়াখালী ছিলেন। কয়েক মাস পর মহত্মা গান্ধীর প্রচেষ্টায় তার গলিত দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণ
দাঙ্গা কবলিত গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে হিন্দুদেরকে জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করার মত ঘৃণ্য পাশবিকতায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে মুসলিমরা।হিন্দু পুরুষদেরকে মাথায় টুপি এবং মুখে দাঁড়ি রাখা বাধ্যতামুলক করা হয়। মহিলাদের হাতের শাঁখা ভেঙ্গে ফেলে এবং কপালের সিঁদুর মুছে দেয় মুসলিমরা। তাদেরকে কলেমা পড়ে ইসলামে ধর্মান্তকরন করা হয়। সেখানে হিন্দু মহিলাদের মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে মুসলিম লীগের গুণ্ডারা পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে সিঁথির সিঁদুর মুছে দিয়ে হাতের শাঁখা ভেঙ্গে তাদের স্বামী ও পুত্র ও শিশু কন্যাদের হত্যা করে ওই হিন্দু মহিলাদের জোর করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে বিয়ে করত। মুসলিমরা তাদের বাড়ি টহল দেয়া শুরু করে এবং গ্রামের মৌলবিরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইসলামিক শিক্ষা নিতে বাধ্য করতে থাকে। হিন্দু পুরুষদেরকে মুসলিমরা জোর করে মসজিদে নিয়ে নামাজ পড়াত। হিন্দুদেরকে জোর করে গরুর মাংস খেতে বাধ্য করা হয় কারণ হিন্দুধর্মানুসারে গরু তাদের কাছে পবিত্র প্রাণী বিধায় এর মাংস তারা খায় না। হিন্দু মেয়ে এবং মহিলাদের মুসলিমরা জোর করে বিয়ে করে।ধর্মান্তরিত হিন্দুদের আরবী নামে নতুন নামকরণ করা হয়। মুসলিম নেতারা উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের নামের টাইটেল যেমন চৌধুরী, ঠাকুর প্রভৃতি নামের শেষে যুক্ত করতে অনুমতি দেয়।অশোকা গুপ্ত যার স্বামী চট্টগ্রামের একজন বিচারক ছিলেন। তিনি সেই সব মানুষদের মধ্যে একজন যারা সর্বপ্রথম নোয়াখালীতে দুর্গতদের সাহায্যের জন্য এসেছিলেন। তিনি একজন দুর্ভাগা মহিলার কথা জানতেন যার স্বামী তাদের কাছে সাহায্যের জন্য এসেছিলেন।প্রতি রাতে গ্রামের মুসলিমরা ওই মহিলাকে ধরে নিয়ে যেত এবং ধর্ষণ করত। কিন্তু তারা গ্রাম থেকে পালাতেও পারত না। অশোকা গুপ্ত বলেন তারা পুলিশ স্টেশনে গিয়ে এ ব্যাপারে অভিযোগ করেন। কিন্তু ওই দুর্ভাগাদের সাহায্যের জন্য কেউ ছিল না।

ধর্মান্তরিতদের চলাচল ছিল মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণাধীন।কখনও গ্রামের বাইরে যেতে হলে স্থানীয় মুসলিম নেতাদের অনুমতি নিতে হত ।রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত খালিশপাড়াতে মুসলিমরা ধর্মান্তরিত হিন্দুদের কাছ থেকে জোর করে লিখিত আদায় করে।
যখন এই পাশবিক হিন্দু নিধন আর নেক্কার জনক ধর্মান্তকরনের খবর বিভিন্ন সংবাদ পত্রে প্রকাশ হতে শুরু করে আশ্চর্যজনক ভাবে মুসলিম লীগ পরিচালিত সংবাদপত্র দি স্টার অফ ইণ্ডিয়া(The Star of India) জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণের ঘটনা অস্বীকার করে বসল।যদিও এসেম্বেলিতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রশ্নের উত্তরে হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী বলেন শুধুমাত্র ত্রিপুরা জেলাতে ৯,৮৯৫ টি ধর্মান্তকরনের ঘটনা ঘটেছে।যদিও এটিত মূল সংখ্যার তুলনায় হয়ত খুবই নগন্য।নোয়াখালীতে কতগুলো ধর্মান্তকরনের ঘটনা ঘটেছে তার হিসাব হয়নি কিন্তু সহজে বোঝা যায় তার সংখ্যা হবে কয়েক হাজার। এডওয়ার্ড স্কিনার সিম্পসন তার রিপোর্টে কেবলমাত্র ত্রিপুরা জেলার তিনটি পুলিশ স্টেশন যথা ফরিদ্গঞ্জ,চাঁদপুর ও হাজীগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত এলাকাতেই ২২,৫৫০ টি ধর্মান্তকরনের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন। ডঃ তাজ-উল-ইসলাম হাশমী মনে করেন,নোয়াখালী গণ হত্যায় যে পরিমান হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে তার কয়েকগুন বেশি হিন্দু মহিলাদের ধর্ষণ এবং ধর্মান্তকরন করা হয়েছে।এম.এ.খান এর মতে, নোয়াখালীর ৯৫ ভাগ হিন্দুদেরই জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তকরন করেছিল মুসলিমরা। বিচারপতি জি.ডি. খোসলা মনে করেন, নোয়াখালীর সমগ্র হিন্দু জনগোষ্ঠীর সর্বস্ব লুট করে নেয়া হয়েছিল এবং তাদের কে জোরপূর্বক মুসলমান বানানো হয়েছিল।কংগ্রেস সভাপতি আচার্য্য কৃপালনির স্ত্রী সুচেতা কৃপালনি নোয়াখালিতে নারী উদ্ধার করতে যান। দাঙ্গার খলনায়ক গোলাম সরোয়ার ফতোয়া দেয়, যে সুচেতাকে ধর্ষণ করতে পারবে তাকে বহু টাকা দেওয়া হবে এবং গাজী উপাধিতে ভূষিত করা হবে। সুচেতা সবসময় পটাসিয়াম সাইনাইড ক্যাপসুল গলায় ঝুলিয়ে রাখতেন।

আনুষ্ঠানিক পর্যায়

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা এবং বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য কামিনী কুমার দত্ত ১৩ অক্টোবরে নোয়াখালীতে ব্যক্তিগত ভাবে অনুসান্ধানে যান এবং নোয়াখালী জেলা পুলিশ সুপারেণ্টেনডেনট আবদুল্লাহর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। ১৫ তারিখে বাংলা সিভিল সাপ্লাই এর মন্ত্রীর সাথে তিনি সাক্ষাত করেন যিনি তখন নোয়াখালী যাচ্ছিলেন।নোয়াখালী থেকে ফেরার পরে তিনি কার্যকরী প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সাথে যোগাযোগ করেন।তিনি বিবৃতি দেন,দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় জীবনের ঝুঁকি ব্যতীত বাইরে থেকে কেউ ঢুকতে পারত না।দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় ১৪ অক্টোবরের আগে কোন আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের পাঠানো হয়নি।তিনি আরও বিবৃত করেন, কর্তৃপক্ষ মুলত বাইরের দুনিয়ার চোখ থেকে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি লুকানোর জন্যই বেশি উদ্বিগ্ন ছিল। ১৬ অক্টোবরে কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী নোয়াখালীতে হিন্দুদের উপর চলতে থাকা পাশবিক গণ হত্যা,ধর্ষণ,জোরপূর্বক ধর্মান্তকরনের কথা স্বীকার করেন।তিনি আরও বলেন এই দাঙ্গার সুত্রপাত কিভাবে সে ব্যপারে তার কোন ধারণা নেই।তিনি এই মর্মে বিবৃতি দেন যে,খাল-বিল সমূহের নাব্যতা কম থাকায়,ব্রিজ-সাকো গুলো ভেঙ্গে ফেলায় এবং রাস্তা গুলো আটকে রাখায় সেখানে সৈন্য পাঠানো ছিল দুরহ ব্যপার।তিনি বলেন সৈন্য পাঠানোর পরিবর্তে সেখানে ছাপানো প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছে, রেডিওতে সতর্কবার্তা প্রেরণ করা হয়েছে।১৮ অক্টোবর বাংলার গভর্নর ফেড্রিক ব্যুরোস, হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী এবং বাংলার পুলিশের মহাপরিদর্শক প্লেনে করে আকাশ পথে দাঙ্গা উপদ্রুত ফেনী জেলার কিছু অংশ ঘুরে দেখেন।এরপরে বাংলার প্রাদেশিক সরকার নোয়াখালী ও ত্রিপুরা জেলার করুন অবস্থা মূল্যায়নের জন্য একটি পরিদর্শক দল পাঠায়। এই পরিদর্শক দলে ছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদ্য নিয়োগ পাওয়া ভারপ্রাপ্ত আইনমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল,বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকারের শ্রমমন্ত্রী শামসুদ্দিন আহমেদ,বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম,ফজলুর রহমান,হামিদুল হক চৌধুরী,মোয়াজ্জেম হোসেন,এ. মানিক, বি. ওয়াহেদুজ্জামান।

১৯ অক্টোবর মহত্মা গান্ধীর পরামর্শে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি জীবাত্মারাম ভগবানদাস কৃপালিনী,অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শ্রম,খনি ও জ্বালানী মন্ত্রনালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী শরৎচন্দ্র বসু,বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ,সুচেতা কৃপালিনী, মেজর জেনারেল এ.সি. চট্টোপাধ্যায়, কুমার দেবেন্দ্র লাল খাঁ এবং আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদক আকাশ পথে চট্টগ্রামে যান।সেসময় তারা কুমিল্লাতে সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতি করেন যেখানে হাজার হাজার নির্যাতিত হিন্দু তাদের উপর পাশবিক নির্যাতনের বর্ণনা দেন।বাংলার গভর্নর ফেড্রিক ব্যুরোস পরিদর্শক দলকে বলেন,প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীর নির্দেশে দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।তিনি হাজার হাজার হিন্দু মহিলাদের ঘৃণ্যভাবে ধর্ষিত ও নিগৃহীত হবার প্রসঙ্গে বলেন,হিন্দু মহিলারা প্রকৃতিগত ভাবেই মুসলিম মহিলাদের তুলানায় বেশি সুন্দর।২১শে অক্টোবরে ভারত এবং বার্মার (মিয়ানমার) আন্ডার সেক্রেটারি আর্থার হ্যান্ডারসন বাংলার প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক প্রস্তুতকৃত নোয়াখালী দাঙ্গা সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন হাউস অফ কমেন্সে পাঠ করেন।প্রতিবেদনে বলা হয় হতাহতের সংখ্যা তিন অঙ্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।শরৎ চন্দ্র বসু হাউস অফ কমেন্সে এই অদ্ভুদ মিথ্যাচারপূর্ণ প্রতিবেদনের তীব্র সমালোচনা করে প্রত্যাখ্যান করেন।তিনি বিবৃতি দেন,জমিদার সুরেন্দ্রনাথ বসুর বসত বাড়ি এবং অফিসে আক্রমণের একটি ঘটনাতেই ৪০০ এর উপর হিন্দুকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়।

২৫শে অক্টোবরে আনন্দ বাজার এবং হিন্দুস্থান স্ট্যানডার্ড এর ব্যবাস্থাপনা পরিচালক সুরেশ চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে নতুন দিল্লীতে একটি একটি সভা হয়। সেখানে একটি প্রস্তাব পাশ করা হয় যেখানে দাঙ্গা দমনে ব্যর্থ মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভাকে অবিলম্বে অব্যহতি দিয়ে নোয়াখালীতে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ দাবী করা হয়েছিল।২৬শে অক্টোবরে পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল এফ.আর.আর. বুচার একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ভয়াবহ দাঙ্গায় বিপর্যস্ত হিন্দু জনগোষ্ঠীর আত্মবিশ্বাস কবে নাগাদ ফিরে আসবে তা বলা অসম্ভব। ইতিহাসে এই জঘন্য ও বর্বর হত্যাকাণ্ড ও নারী নিগ্রহের ঘটনা যখন বাইরের বিশ্বে পৌঁছাতে সক্ষম হল তখন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক,সামাজিক,ধর্মীয় সংগঠন দাঙ্গা পীড়িত নোয়াখালীর সর্বহারা হিন্দুদেরকে উদ্ধার করতে ও ত্রাণ বিতরণে এগিয়ে আসল। এদের মধ্যে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য কিছু সংগঠন হলঃ ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ,হিন্দু মহাসভা,ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস,ভারতীয় কম্যুনিস্ট দল,ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি, প্রবর্তক সঙ্ঘ,অভয় আশ্রম, আর্য সমাজ,গীতা প্রেস প্রভৃতি। দাঙ্গা কবলিত হতভাগ্য হিন্দুদের জন্য ৩০ টি ত্রানবিতরণকারী সংস্থা এবং ৬টি মেডিক্যাল মিশন কাজ করতে থাকে।তাছাড়াও সর্বস্ব হারানো দাঙ্গা পীড়িতদের জন্য গান্ধীর এক গ্রাম এক সেচ্ছাসেবী’ পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ছিল ২০ টি অস্থায়ী ক্যাম্প।

মুসলিম দাঙ্গাকারিদের হাতে নোয়াখালীর হিন্দুদের অসহায়ত্বের সংবাদ জানার পরে হিন্দু মহাসভার সাধারণ সম্পাদক আশুতোষ লাহিড়ী দ্রুত চাঁদপুরে চলে আসেন।ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নির্মল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পণ্ডিত নরেন্দ্রনাথ দাস আরও সাহায্য কর্মীদের নিয়ে কুমিল্লা ও দাঙ্গা পীড়িত অঞ্চলে প্রবেশ করেন। অবশ্য তাদের নিরাপত্তার জন্য সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিল।দুর্গত,খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান হারিয়ে ধ্বংসপ্রায় হিন্দুদের জন্য একটি উড়জাহাজে করে চাল,চিঁড়া,রুটি,দুধ,বিস্কুট,বার্লি এবং ওষুধ প্রেরণ করা হয়।অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী ট্রেনে করে পাঠানো হয়।ভাগ্যগুনে বেঁচে যাওয়া কিন্তু আত্মবিশ্বাস হারা যে সকল হিন্দু পূর্ববঙ্গের সরকারের উপর আস্থা হারিয়ে পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন জায়গাতে বিশেষ করে কলকাতায় চলে এসেছিল তাদের জন্য কলকাতা শহর ও শহরের বাইরে ৬০ টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়। এদেরকে সাহায্যের জন্য অনেক উদার ব্যক্তিবর্গ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই ফান্ডের হিসাব,সংগ্রহ এবং পর্যবেক্ষণের জন্য কলকাতার একটি বেসরকারি হিসাবরক্ষক সংস্থা M/S. P.K.Mitter & Co কে নিয়োগ দেন।

মহত্মা গান্ধীর শান্তি মিশন
মহত্মা গান্ধী দাঙ্গা পীড়িত এলাকায় শান্তি স্থাপন করতে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন। তিনি নিজে এবং আরও কিছু ভলেণ্টিয়ার নিয়ে যে সব এলাকায় গণহত্যা চালানো হয় সেগুলো পরিদর্শন করেন। তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করেন। ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় ১৮ অক্টোবরে ব্যক্তিগত ভাবে মহত্মা গান্ধীর সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি গান্ধীজীকে হিন্দু গনহত্যা বিশেষ করে হিন্দু মেয়েদেরকে লাগামহীন ধর্ষণ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে বলেন।বিকেলের প্রার্থনা সভাতে গান্ধীজী নোয়াখালীর বর্বরোচিত হিন্দু নিধন সম্পর্কে কিছু কথা বলেন।তিনি বলেন, ‘যদি ভারতের অর্ধেক মানুষ পক্ষাঘাতগ্রস্থ থাকে তাহলে ভারত কোনদিন মুক্তির স্বাদ পাবে না’।তিনি মনে করতেন ভারতের মেয়েদের মুক্তির জন্য তাদের অস্ত্র শিক্ষা নেয়া উচিত। ১৯ অক্টোবর গান্ধীজী নোয়াখালী যাত্রার সিদ্ধান্ত নেন। নোয়াখালী যাত্রার আগে ডঃ অমিয় চক্রবর্তী কলকাতার নিকটে সোদপুরের অভয় আশ্রমে গান্ধীজীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।সাক্ষাৎকার গ্রহনের পর ডঃ অমিয় চক্রবর্তী বিবৃতি দিয়ে বলেন,এই মুহূর্তের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ধর্ষিত ও অপহরিত হিন্দু মেয়েদের উদ্ধার করা। কারণ জোরপূর্বক ধর্মান্তকরনের পরে তাদের কে মুসলিমরা বোরকা দিয়ে আবদ্ধ করে রাখবে এবং আইন রক্ষাকারী বাহিনী আর তাদেরকে চিহ্নিত করতে পারবে না। গান্ধীজী ৬ নভেম্বর তারিখে নোয়াখালীর উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করেন এবং পরেরদিন তিনি নোয়াখালীর চৌমুহানীতে পৌঁছান। সেখানে যোগেন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে দুই রাত কাটান। নভেম্বরের ৯ তারিখে তিনি পুনরায় খালি পায়ে যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তী সাত সপ্তাহ ধরে গান্ধীজী ১১৬ মাইল হেঁটে প্রায় ৪৭ টি বিপর্যস্ত গ্রাম পরিদর্শন করেন। তিনি শ্রীরামপুর গ্রামের একটি অর্ধ দগ্ধ বাড়িতে তাঁর আবাস স্থাপন করেন এবং ১ জানুয়ারি পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। তিনি সেখানে প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন এবং স্থানীয় মুসলিম নেতাদের সাথে বৈঠক করে হিন্দুদের আস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু হিন্দু মুসলিমের মধ্যকার সম্পর্কের অনাস্থা দূর করতে গান্ধীজী ব্যর্থ হন এবং তার নোয়াখালীতে অবস্থানকালেই দুর্বৃত্ত মুসলিমরা তাদের হিংস্রতা চালিয়ে যেতে থাকে।১০ নভেম্বর বিকালে গান্ধীজীর সান্ধ্যকালীন প্রার্থনা সভা থেকে দত্তপাড়া আশ্রয় কেন্দ্রে ফেরার পথে দুজনকে হত্যা করে মুসলিমরা।

গান্ধীজীর নোয়াখালী যাত্রা এবং সেখানে অবস্থান মুসলিম নেতাদের অসন্তুষ্ট করেছিল।১৯৪৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে কুমিল্লাতে একটি শোভাযাত্রায় বক্তৃতা প্রদান কালে এ কে ফজলুল হক বলেছিলেন,নোয়াখালীতে গান্ধীর অবস্থানের কারণে ইসলামের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়েছে।গান্ধীজীর মুসলিমদের বিরক্তির কারণ হিসেবে দেখা যায়।গান্ধীজীর প্রতি মুসলিমদের এই বিরক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছিল।১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মুসলিম সমাজের এই বিরক্তি প্রকাশ রীতিমত অমার্জিত ও কদর্য রূপ ধারণ করে।মুসলিমরা গান্ধীজীর চলার পথে কাদা, ময়লা,আবর্জনা ছড়িয়ে রাখত।তারা গান্ধীজীর সকল সভা-সমাবেশ বয়কট শুরু করে।গান্ধীজীর সাথে সব সময় একটি ছাগল থাকত যেটি তিনি ভারত থেকে নোয়াখালীতে নিয়ে এসেছিলেন। মুসলিমরা ওই ছাগলটিকে চুরি করে নিয়ে যায় এবং জবাই করে ভুরিভোজ দেয়।

গান্ধীজী তার নোয়াখালী মিশন অর্ধ সমাপ্ত রেখেই বাংলার মুসলিম লীগ নেতাদের অনুরোধে ১৯৪৭ সালের ২ মার্চ বিহারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। নোয়াখালী ছাড়ার একমাসেরও বেশি সময় পরে গান্ধীজী একজন কংগ্রেস কর্মীর কাছ থেকে একটি টেলিগ্রাম পান যেখানে বলা হয়েছিল,দাঙ্গা পীড়িত অঞ্চলে হিন্দুদেরকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে।গান্ধীজী অত্যন্ত দুঃখের সাথে মন্তব্য করেন, নোয়াখালীর অবস্থা এমনই দুর্বিষহ যে হিন্দুদের কে নোয়াখালী ছাড়তে হবে অথবা ধ্বংস হয়ে যেতে হবে।

বেঁচে যাওয়া হিন্দুরা দুই ধাপে নোয়াখালী ও ত্রিপুরা( বর্তমান কুমিল্লা) ছেড়েছিল। গনহত্যা,ধর্ষণ এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তকরন শুরুর হওয়ার সাথে সাথেই প্রথম পর্যায়ে হিন্দুরা কলকাতা পালিয়ে বেঁচেছিল।কলকাতায় দুর্গত আশ্রয় প্রার্থীদের আসার সংখ্যা ধিরে ধিরে কমে এসেছিল যখন সরকার ও বিভিন্ন সংগঠন নোয়াখালী ও কুমিল্লাতে ত্রান বিতরনের ঘোষণা দিল। ১৯৪৭ সালে কোন বিকল্প হাতে না পেয়ে অবশেষে কংগ্রেস যখন ভারত বর্ষের বিভাজন মেনে নেয় তখন ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। দাঙ্গায় পীড়িত ও আর্ত সহায় সম্বলহীন হিন্দুরা ত্রিপুরা,আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভন্ন জায়গাতে চলে আসে যে জায়গা গুলো ভারতের ভিতর পড়েছিল। শুধু মাত্র আসামের রাজধানী গৌহাটিতেই ৫০,০০০ উপরের রিফিউজিদের অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রাকেশ ব্যাটবলের মতে,এই দুরবস্থা কখনই স্বাভাবিক হয়নি হিন্দুদের জন্য।বিক্ষিপ্ত ভাবে দাঙ্গা চলছিল এবং পুলিশ বাহিনীও নুন্যতম প্রতিরোধের ব্যবস্থা করতে পারেনি। ফেড্রিক ব্যুরোস ফেড্রিক পেঠিক-লরেন্স এর একটি রিপোর্ট উল্লেখ করেন,নভেম্বরের শুরুর দিকের একটি ঘটনায় একজন সিনিয়র আই.সি.এস অফিসার ও তার পুলিশ বাহিনী একটি ক্যাম্পে দুর্গত হিন্দুদের রক্ষার চেষ্টা কালে তিন বার মুসলিম সসস্ত্র বাহিনীর দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়। তখন বাধ্য হয়ে পুলিশ উন্মুক্ত গোলাবর্ষণ শুরু করলে ৭ জন নিহত হয় এবং ১০ জন আহত হয়।বাংলা সাময়িকী ‘দেশের বাণী’ তাদের একটি সংবাদে নোয়াখালীর একজন উদ্ধারকর্মীর বরাত দিয়ে উল্লেখ করে, দাঙ্গা পরবর্তী চার মাস পার হয়ে গেলেও হিন্দুরা তাদের বাড়িতে ফিরতে পারেনি।
তদন্ত কর্মকাণ্ড এবং তদন্তের ফলাফল প্রকাশ নিয়ে লুকোচুরি

১৯৪৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার একটি অর্ডিন্যান্স পাশ করে যেখানে বলা হয়, দাঙ্গা বিষয়ক কোন সংবাদ এমনকি সত্য সংবাদও প্রকাশ করা যাবে না।যে সকল বিষয় সংযুক্ত থাকলে যে কোন বিবৃতি,বিজ্ঞাপন,বিজ্ঞপ্তি,সংবাদ,বা মতামত নিষিদ্ধ হবে সেগুলো হল; (১)যে সকল স্থানে দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছে সে সকল স্থানের নাম (২) যে উপায়ে ভিক্টিমদের কে মারা বা নির্যাতন করা হয়েছে (৩) যে সকল সম্প্রদায় নির্যাতিত হয়েছে এবং যে সকল সম্প্রদায় নির্যাতন করেছে তাদের নাম (৪)যে সকল স্থান বা মন্দির বা উপাসনালয় যে গুলো ধ্বংস করা হয়েছে সেগুলর নাম । রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতে,এক সপ্তাহ বিভিন্ন সংবাদ পত্রে দাঙ্গার ঘটনা প্রকাশ করার কারনেই এই অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়।

বাংলার প্রাদেশিক সরকার এডওয়ার্ড সিম্পসন নামের এক অবসর প্রাপ্ত বিচারককে নোয়াখালী গনহত্যা তদন্তের ভার দেয়।কিন্তু সিম্পসনের জমা দেয়া রিপোর্ট প্রাদেশিক সরকার আটকে রাখে।নোয়াখালী যাবার আগে মহত্মা গান্ধী এই রিপোর্টের একটি কপি সোহ্‌রাওয়ার্দীর কাছে চান। সোহ্‌রাওয়ার্দী তাঁকে সে সময় রিপোর্ট দিতে সম্মতি জানিয়ে একটি পত্রও লেখেন।কিন্তু সরকারের সচিববৃন্দ এমন একটি রিপোর্ট গান্ধীজীকে দিতে আপত্তি তোলেন এবং সোহ্‌রাওয়ার্দীও রিপোর্ট দিতে অসম্মত হন।রিপোর্টের সামান্য সারাংশ সোহ্‌রাওয়ার্দীর সচিব মথুরের মাধ্যমে স্টেটম্যান পত্রিকার কাছে পাচার হয়ে যায়।স্টেটম্যানের সম্পাদক ওই রিপোর্ট থেকে স্পর্শকাতর বিষয় সমূহ বাদ দিয়ে ১৯৪৬ সালের ১৩ নভেম্বর একটি লেখা প্রকাশ করেন। ওই রিপোর্ট থেকে জানা যায় সিম্পসন প্রাদেশিক সরকারের কাছে নোয়াখালী গনহত্যা সুষ্ঠু তদন্তের জন্য অন্তত ৫০ জন সিনিয়র অফিসার কমপক্ষে ছয় মাসের জন্য চেয়েছিলেন।
ভারত বিভাজনের পূর্বমুহূর্তে নোয়াখালী দাঙ্গা

অক্টোবর মাসে এসে নোয়াখালীতে হিন্দু গনহত্যা এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তকরনের মত ঘৃণ্য বর্বরতা মুসলিমরা বন্ধ করলেও অন্য আরও উপায়ে আর্ত হিন্দু জন গোষ্ঠীর উপর নির্যাতনের ষ্টীম রোলার চালানো তারা বন্ধ করেনি। এমনকি গান্ধীজীর নোয়াখালীতে অবস্থানকালেও তারা সমান বেগে নির্যাতন করে গিয়েছে।গান্ধীজীর নোয়াখালী ত্যাগের এক সপ্তাহ পরে ৯ মার্চে এ.ভি. থ্যাকার মুম্বাইতে ফিরে গিয়েছিলেন। তিনি তখনকার নোয়াখালী ও ত্রিপুরার(বর্তমানের কুমিল্লা) চরম অরাজকতা সম্পর্কে চাঁদপুর থেকে লিখেছিলেন।এমনকি দাঙ্গা সংগঠনের পরে পাঁচ মাস অতিক্রন্ত হয়ে গেলেও সেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নুন্যতম কোন লক্ষণ ছিল না। বরং দাঙ্গা পীড়িত এলাকা থেকে কিছু অস্থায়ী পুলিশ স্টেশন তুলে নিয়ে পরোক্ষ ভাবে দাঙ্গাকারীদের পুনরায় অরাজকতা সৃষ্টির উৎসাহই দেয়া হয়েছিল।১৯ মার্চে মুসলিমরা বিভিন্ন জায়গাতে গোপন মিটিং করে এবং কোনভাবে টিকে থাকা হিন্দুদেরকে হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি দিতে শুরু করে।এরই মাঝে ২৩ সেপ্টেম্বর,১৯৪৭ সালে দাঙ্গার খল নায়ক গোলাম সরোয়ার রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন সোনাপুরে বিশাল জনসভার জন্য মুসলিমদেরকে আহ্বান করে। তারা সেদিনকে ‘পাকিস্তান দিবস’ হিসেবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিন এলাকা জুড়ে সর্বাত্মক ধর্মঘট ডাকা হয়। হাজার হাজার মুসলিম বিভিন্ন গ্রাম থেকে সমাবেশস্থলে এসে জমা হতে পারে এজন্য গ্রামের বিভিন্ন হাটবাজারে ২০ মার্চে ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়।মুসলিম সমাবেশের সংবাদ পেয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হিন্দুরা পুনরায় দাঙ্গার আশঙ্কায় তাদের ঘর-বাড়ি, আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। চৌমুহনী রেল স্টেশন হাজার হাজার হিন্দু নর-নারীতে পূর্ণ হয়ে ওঠে নিমেষের মধ্যে।গান্ধীজীর শান্তি মিশনের কর্মীরা পুলিশে জেলা সুপারিনটেণ্ডেট,অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং একজন মন্ত্রী আব্দুল গোফরানকে এই জনসভার অনুমতি না দেবার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু জেলা পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেট এই অনুরোধ গ্রাহ্য না করে বিবৃতি দেন এই জনসভা হবে এবং পুলিশ নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সাহায্য কর্মীরা এ বিষয়টি গান্ধীজী এবং হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী কে জানানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং জেলা পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেট নিকটে একটি আদেশ প্রেরনের ব্যবস্থা করেন যেখানে ২২ মার্চে পাবলিক প্লেসে সকল প্রকার জনসভা,মিছিল, স্লোগান নিষিদ্ধ করা হয়।কিন্তু ব্যক্তিগত স্থান যেমন মাদ্রাসা,মসজিদে জনসভার অনুমতি দেয়া হয়।রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেহান আলী মতামত দেন,জনসভা হবে মসজিদ সংলগ্ন আমতলি মাঠে। ফলে সরকারী নির্দেশের লঙ্ঘন হবে না।মুসলিম লীগের নেতারা যে কোন মুল্যে এই জনসভা করার সিদ্ধান্ত নেয়। মুসলিম লীগ নেতা মুহাম্মদ এরশাদ এবং মুজিবর রহমান জনসভায় মন্ত্রী আব্দুল গোফরানকে একজন বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ করে।২৩ মার্চ প্রায় ৪০০০-৫০০০ মুসলিম রামগঞ্জ থেকে কাজীরখিল পর্যন্ত মিছিল করতে করতে আসে এবং পুনরায় রামগঞ্জে ফিরে যায়। এসময় তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে এবং এভাবেই সমাবেশ স্থলে প্রবেশ করে। ওই সমাবেশে বক্তব্য দেবার সময়ে ইউনুস মিয়াঁ পণ্ডিত নামে একজন বক্তা হিন্দু সমাজের তীব্র সমালোচনা করে। সমালোচনায় সে হিন্দুদের ছুতমার্গ,পর্দা প্রথা না করা সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশদ্গার করে এবং হিন্দুদের সাথে সকল প্রকার সামাজিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক বর্জনের আহ্বান করে।

১৯৪৭ সালের ১৩ মে তারিখে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার উইলিয়াম ব্যারেট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব পি.ডি. মারটিনকে একটি গোপন নথি প্রেরণ করেন।সেখানে বলা ছিল, বাংলার প্রাদেশিক সরকার সুক্ষ ভাবে হিন্দু নির্যাতনে সহায়তা করছে।রিপোর্টে তিনি আরও উল্লেখ করেনঃ মুসলিমরা দল বেধে হিন্দুদের উপর আক্রমণ করে এবং হিন্দুদের মুল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। প্রায়ই পথিমধ্যে হিন্দুদের বাজার করে আনা মালামাল লুট করে নিয়ে যায় মুসলিমরা। হিন্দুদের নারকেল, সুপারি বাগান থেকে তারা জোর করে নারকেল সুপারি নিয়ে যায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর থেকে গবাদি পশু-পাখি লুট হয়ে যায়। হিন্দু দের বাড়ি ঘর থেকে লোহার টিন ও দামি কাঠের খিলান খুলে নিয়ে আসে। হিন্দুদের মালিকানায় থাকা সিনেমা হল গুলো তারা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করে।মুসলিমরা শতকরা ৫০ ভাগ তাঁত দাবী করে যেখানে প্রায় সকল তাঁতের মালিক যোগী সম্প্রদায়ের হিন্দু। হাট-বাজার থেকে সকল হিন্দু ব্যবসায়ী এবং দোকান মালিকদেরকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করে মুসলিমরা। যে সকল হিন্দু পুনরায় তাদের লুটপাটকৃত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি-ঘর পুনঃনির্মাণের চেষ্টা করছিল তাদেরকে এলাকা ছাড়ার হুমকি দেয়া হয়।হিন্দুদেরকে পুলিশ স্টেশনে যে কোন অভিযোগ প্রদানে বাধা দেয়া হত এবং যে সকল হিন্দু কোন অভিযোগ দায়ের করেছিল তাদেরকে সে গুলো উঠিয়ে নেয়ার জন্য মুসলিমরা হুমকি দিত। হিন্দু দম্প্রদায়ের নারী-পুরুষদেরকে মুসলিমরা প্রকাশ্যে মালাউন, কাফের প্রভৃতি অপমানসূচক নামে সম্বোধন করত মুসলিমরা।১৩ মে তারিখে রিপোর্ট করা হয় যে, ধর্মপুর গ্রামে মুসলিমরা এক হিন্দু গৃহবধুকে ধর্ষণকালে উদ্ধার করা হয়।১৬ মে তারিখে এরকম আরও দু’জন হিন্দু নারীকে উদ্ধার করা হয়।

বিহার ও অন্যান্য স্থানের দাঙ্গা এবং ভারত বিভাজন
১৯৪৬ নোয়াখালীর দাঙ্গার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিহারে দাঙ্গার সুত্রপাত হয়। ৩০ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বরের মধ্যকার সংগঠিত বিহার দাঙ্গার ফলে ভারত বিভাজন ত্বরান্বিত হয়। ২৫ থেকে ২৮ অক্টোবরের মধ্যে বিহারের ছাপরা এবং শরণ জেলায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পরে। শীঘ্রই পাটনা, মুঙ্গের, ভাগলপুরে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সরকারের পক্ষে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিত স্বাভাবিক রাখা ক্রমেই কঠিন হয়ে ওঠে এবং ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। পরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট দাঙ্গার নারকীয়তা-বীভৎসতা দেখে গান্ধী-নেহেরু তথা কংগ্রেস নেতৃত্ব জিন্নাহের নেতৃত্বে থাকা মুসলিম লীগের ভারত ভাগের দাবী মেনে নেন।ফলে ভারত বিভাগের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামে নতুন দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:৪৩

মূল-উপদল বলেছেন: এই বিপর্যয়ের কারন কি ছিলো? কলকাতার দাঙ্গার প্রতিশোধ, নাকি অন্য কিছু? সেসময়ের নেতারা বিশেষ করে একে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দি যাদেরকে আমরা অনেক সম্মানের সাথে আমাদের জাতীয় ক্ষেত্রে স্থান দিয়েছি তারা কেন এটাতে ইন্ধন দিয়েছিলেন, নাকি তারা ঠেকাতে অপারগ ছিলেন?

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:০৬

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: আমি ভাই বিস্তারিত না বলতে পারলেও এটা নিশ্চিত যে কোথাও একটা গড়মিল ছিল অবশ্যয়ই ।

২| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:০৬

অরুনি মায়া অনু বলেছেন: ধর্ম নিয়ে রেষারেষি সেই অতীত আমল থেকেই। আজও হিন্দু মুসলিমের মাঝে সমঝোতা হলনা।

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৪

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: আর কোনদিন হবে বলে মনেও হচ্ছে না আপু।

৩| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:৫৪

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: কিন্তু ওই দুর্ভাগাদের সাহায্যের জন্য কেউ ছিল না।
এইসব হত্যাকান্ডে জড়িত মুসলিমলীগ নেতাদের কি বিচার হয়েছিলো?

২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৬

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: হয়ত কিছু কিছু হয়েছিল ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.