নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ব্লগ সার্চম্যান

ব্লগ সার্চম্যান

ব্লগ সার্চম্যান › বিস্তারিত পোস্টঃ

১৯৫০সালে বরিশাল দাঙ্গা এর ইতিহাস

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৬:৫০


পূর্ববঙ্গের পঞ্চাশের গণহত্যা বা ১৯৫০ র বরিশাল দাঙ্গা ১৯৫০ সালে সে সময় পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গ বর্তমান বাংলাদেশের বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সঙ্খ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের চালিত বিরামহীন ধারাবাহিক একটি গণহত্যা ছিল। সেই গনহত্যায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং পাকিস্তানি পুলিশ,প্যারা মিলেটারি বাহিনী ইচ্ছাকৃত ভাবে হত্যা,লুটপাট,অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন,অপহরণ, ধর্ষণ চালায়। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাস জুড়ে সেই গণহত্যা চলতে থাকে ।১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে ভারত এবং পাকিস্তান নামক দুটি দেশে পরিনত হয়।ব্রিটিশভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান।অবিভক্ত বাংলা প্রদেশে জনসংখ্যার দিক দিয়ে মুসলিমরা হিন্দুদের চেয়ে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে ছিল।কিন্তু অবিভক্ত বাংলারও বিভাজন হয় মুসলিমগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ যুক্ত হয় পাকিস্তানের সাথে এবং হিন্দু গরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ যুক্ত হয় ভারতের সাথে।আসাম প্রদেশের অন্তর্গত বৃহত্তর সিলেট গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়।১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুসারে পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার ২৪.৫% অমুসলিম, যাদের অধিকাংশ বাঙ্গালীহিন্দু। আবার পশ্চিমবঙ্গের ৩০.২%ছিল মুসলিম এবং বাকিরা সবাই ছিল হিন্দু।দেশ বিভাগের পুরো দশক জুড়ে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিভাগ জাতিগত ভাবে হিন্দুদের নির্মূলীকরণের সাক্ষী হয়ে ওঠে।দেশবিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে অনিবার্য করে তোলার জন্য ১৯৪০ এর দশকে এই হিন্দু নির্মূলীকরণের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে।১৯৪৬ এর শেষ ভাগে পূর্ববঙ্গের বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালী এবং ত্রিপুরা জেলার বাঙ্গালী হিন্দুরা ধারাবাহিক ভাবে নির্মম গনহত্যা,ধর্ষণ,লুটপাট,অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তরকরণের শিকার হয় মুসলিমদের দ্বারা যা নোয়াখালী গণহত্যা নামে পরিচিত। দেশবিভাগের একমাসের মধ্যেই ঢাকাতে জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রায় মুসলিমরা আক্রমণ করেন।১৯৪৮ সালে বিখ্যাত ধামরাই রথযাত্রা এবং জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রা নিশিদ্ধ করা হয়। ১৯৪৯ সালে সমগ্র ঢাকা অঞ্চলে বাঙ্গালী হিন্দুদের সব চেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার বিরুদ্ধে পোস্টার লাগানো হয়।আর সেজন্য দুর্গাপূজার আয়তন এবং সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পায়।বিজয়া দশমীর দিনে শত শত হিন্দুদের বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগ করেন মুসলিমরা।ফলে কমপক্ষে ৭৫০ টি হিন্দু পরিবারকে খোলা আকাশের নিচে নেমে আসতে হয়।প্রেস ট্রাস্ট অব ইণ্ডিয়া বা পিটিআই (PTI) এর প্রতিনিধি সন্তোষ চট্টোপাধ্যায়কে কোন রকম অভিযোগপত্র ছাড়াই ১৯৪৯ সালের ২৫শে নভেম্বরে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং একমাস জেলে বন্দী করে রাখে।

আগস্ট১৯৪৯-জানুয়ারি১৯৫০ এর নৃশংসতা
১৯৪৯ সালের আগস্ট মাস থেকে সমগ্র পূর্ব বাংলা জুড়ে অমুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর নৃশংস বর্বরতা শুরু করে দেয় স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায় যা প্রায় তিন মাস জুড়ে চলতে থাকে। আগস্ট মাসে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার এবং বড়লেখা পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন এলাকার নিরীহ হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর স্থানীয় মুসলিম অধিবাসীরা পুলিশ এবং আনসার বাহিনীর সহযোগিতায় আক্রমণ শুরু করে।হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘর লুটপাট করা হয়,গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় এবং আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।হিন্দু গ্রামবাসীদেরকে লাঞ্ছিত করা হয় এবং হত্যা করা হয়। অনেক হিন্দু মেয়েকে সেসময় পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ধর্ষণ করেন। তার কিছুদিন পরেই বরিশাল জেলার ভাণ্ডারিয়া গ্রামের হিন্দুরা আক্রান্ত হয়।রাজশাহী বিভাগের একজন পাদ্রী ফাদার থমাস ক্যাটানিও রিপোর্ট করেন যে সেখানকার সাঁওতাল গ্রামের অধিবাসীরা আক্রান্ত হয়েছে ও তাদেরকে আটক করা হয়েছে এবং সাঁওতাল নারীদেরকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ডিসেম্বরের ১০ তারিখে উন্মত্ত মুসলিম জনতা রাজশাহীর পুঠিয়াতে বাড়ি ঘরে হামলা চালিয়ে সম্পদ লুটপাট করে এবং সে সব বাড়িঘর দখল করে নেয়।

কালশিরা গনহত্যা
১৯৪৯ সালের ২০শে ডিসেম্বরে তৎকালীন খুলনা জেলার বাগেরহাট উপজেলার মোল্লাহাট পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন জয়দেব বর্মের বাড়ীতে কম্যুনিস্ট সদস্য লুকিয়ে আছে এই অভিযোগ করে শেষরাতে চারজন পুলিশ কনস্টেবল অভিযান চালায়। কিন্তু জয়দেবের বাড়ীতে কোন কম্যুনিস্ট সদস্যকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ সদস্যরা তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে চেষ্টা করে। তার স্ত্রী চিৎকার শুরু করলে জয়দেব বর্ম এবং তার আত্মীয়রা ক্ষিপ্ত হয়ে দুইজন পুলিশ কনস্টেবলের উপর চড়াও হয় এবং ঘটনাক্রমে একজন পুলিশ কনস্টেবল সেখানেই মারা যায়।বাকি দুইজন পুলিশ বিপদ ঘণ্টা বাজিয়ে দিলে পাশের প্রতিবেশীরা এসে তাদের উদ্ধার করে। পরের দিন জেলা পুলিশ সুপারিনটেনড সশস্ত্র পুলিশ কন্টিনজেন্ট এবং আনসার বাহিনী সহযোগে কালশিরা এবং এর আশেপাশের হিন্দু গ্রামগুলোতে নির্দয় ভাবে আক্রমণ শুরু করে। তারা আশেপাশের গ্রামগুলোর মুসলিম অধিবাসীদেরকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর এবং সম্পত্তি লুটপাটে উৎসাহ দিতে থাকে।তারা হিন্দুদেরকে নির্দয় ভাবে হত্যা করতে শুরু করে এবং হিন্দু পুরুষ মহিলাদেরকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে।হিন্দু সম্প্রদায়ের পবিত্র প্রতিমা,ছবি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং হিন্দু মন্দিরগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়।সে গ্রামগুলোর ৩৫০টি বাড়ির সব গুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়।তিনটি মাত্র ঘর অবশিষ্ট ছিল।হিন্দুদের গবাদি পশু,নৌকা সব কিছু জোর করে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। মাত্র এক মাসের নৃশংস গনহত্যায় খুলনার ৩০,০০০ হিন্দু প্রাণের ভয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
নাচোলের গনহত্যা
তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের রাজশাহী জেলার নওয়াবগঞ্জ সাবডিভিশনের একটি পুলিশ স্টেশন হল নাচোল পুলিশ স্টেশন।দেশভাগের পূর্বে নওয়াবগঞ্জ ছিল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের (ভারতের) মালদা জেলার অন্তর্গত।১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পরে নওয়াবগঞ্জ রাজশাহী জেলার সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তান আর বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত হয়।নাচোল পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত এলাকা ছিল অমুসলিম প্রধান।সেখানকার বেশিরভাগ অধিবাসী ছিল সাঁওতাল এবং বাঙ্গালী হিন্দু যাদের মধ্যে প্রধান ছিল ক্ষত্রিয়,ভুঁইদাস এবং কৈবর্ত সম্প্রদায়।দেশভাগের পরপরই সদ্য জন্ম নেওয়া পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি তেভাগা আন্দোলনকে দমন করতে পৈশাচিক বর্বরতা এবং বর্ণনাতীত নৃশংসতার ঘৃণ্য পথ বেছে নেয়। কিন্তু নাচোলে তখনও সেই আন্দোলন সক্রিয় ছিল আত্মগোপনে থাকা কিছু ব্যক্তির নেতৃত্বে।১৯৪৯ সালের শরতকালে আন্দোলনের মাধ্যমে তেভাগা প্রতিষ্ঠিত হয়। ৫ই জানুয়ারি, ১৯৫০ সালে নাচোল পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন চণ্ডীপুর গ্রামের সাঁওতাল অধিবাসীরা পুলিস স্টেশনের সামনে বিক্ষোভ শুরু করে কারণ পুলিশ বাহিনী বিনা কারণে একজন সাঁওতাল আদিবাসীকে আটক করে।কিন্তু পুলিশ ওই জনসমাবেশের ওপর গুলি চালালে সাঁওতাল আদিবাসীরা সহিংস হয়ে ওঠে এবং পুলিশের সাথে তাদের হানাহানি শুরু হয়।আর তাতে ঘটনা স্থলে পাঁচ জন পুলিশ বাহিনীর সদস্য মারা যায়।সেই ঘটনার ফলশ্রুতিতে ৭ই জানুয়ারি তারিখে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ২,০০০ সদস্যের একটি সেনাবাহিনীর কন্টিনজেন্ট প্রেরণ করেন এবং তার সাথে সশস্ত্র পুলিশ ও আনসার বাহিনী যুক্ত হয়।সেই সশস্ত্র বাহিনী বারটি গ্রাম সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়,চণ্ডীপুরগামী গ্রামবাসীদেরকে ধরে ধরে হত্যা করে।চণ্ডীপুরের পুরুষ সদস্যদেরকে তারা হত্যা করে আর মহিলাদেরকে ধর্ষণ করে।তাদের বসতভিটা পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে।শতশত সাঁওতাল এবং হিন্দুদেরকে এভাবে হত্যা করা হয়।রোহানপুরের তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ইলা মিত্র সহ আরও শতাধিক দরিদ্র কৃষককে গ্রেফতার করা হয়।নাচোল পুলিশ স্টেশনে নিয়ে তাদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালানো হয় বাকি নেতাদের নাম জানার জন্য।পুলিশের এই বর্বর অত্যাচারে সেখানেই প্রায় ৭০থেকে১০০ জন কৃষক মারা যায়। ইলা মিত্রকে নওয়াবগঞ্জ পুলিশ স্টেশনে হস্তান্তরের আগে টানা চার দিন ধরে পাশবিক শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।
ঘটনাক্রম
ফেব্রুয়ারি মাসের ২ তারিখে তৎকালীন নোয়াখালী জেলার ফেনী উপজেলাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ শুরু করে মুসলিমরা,যদিও তার আগেই ঢাকাতে নৃশংসতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। একজন হিন্দুকে হত্যা করা হয় আরও নয়জনকে মারাত্মক ভাবে জখম করা হয়।হিন্দু সম্প্রদায়ের কমপক্ষে নয়টি দোকান লুটপাট করা হয়।
বিভিন্ন জেলায় সংগঠিত গণহত্যা
ঢাকাঃ
১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য মুখ্যসচিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রদেশ মুখ্যসচিব আজিজ আহমেদের সাথে একটি বৈঠকের জন্য ঢাকায় আসেন।১০ই ফেব্রুয়ারি সকাল ১০ টায় যখন আলচনার অগ্রগতি হচ্ছিল ঠিক তখনই সচিবালয়ে রক্তমাখা কাপড় পরিহিত একজন মহিলাকে হাজির করা হয়।গুজব রটানো হয় সেই মহিলাকে কোলকাতায় ধর্ষণ করা হয়েছে।সচিবালয়ের কর্মচারী এবং কর্মকর্তারা তৎক্ষণাৎ কর্মবিরতির ডাক দিয়ে একটি মিছিল বের করে যেখান থেকে হিন্দু বিদ্বেষী স্লোগান দেওয়া হয়।তারা মিছিল নিয়ে নবাবপুরের দিকে অগ্রসর হয় এবং আরও অনেকে ওই মিছিলে যোগ দেয়।তৎকালীন ভিক্টোরিয়া পার্কে বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্ক এসে তাদের মিছিল শেষ হয়।দুপুর ১২ টার দিকে পার্কে আসা মিছিল থেকে বক্তারা হিংস্র হিন্দু বিদ্বেষী বক্তব্য প্রদান করে যাদের মধ্যে অনেকেই ছিল সচিবালয়ের কর্মকর্তা।দুপুর ১টার দিকে মিছিল এবং বক্তব্য প্রদান শেষ হবার পরপরই মুসলিমরা হিন্দু বাড়িঘর ও দোকানপাট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুট করতে শুরু করে এবং লুটপাট শেষে অগুন ধরিয়ে দেয় সেগুলো।যেখানেই হিন্দুদেরকে পাওয়া যাচ্ছিল সেখানেই তাদেরকে হত্যা করতে শুরু করে মুসলিমরা। বিকেলের মধ্যেই ঢাকার ৯০% হিন্দু দোকান এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট করা হয় এবং সেগুলোর অধিকাংশ আগুন লাগিয়ে ছাই করে ফেলা হয়।হিন্দু মালিকানাধীন স্বর্ণালংকারের দোকান গুলোতে পুলিশের উপস্থিতেই লুটপাট চালায় মুসলিমরা।মাত্র সাত ঘণ্টার বীভৎস হত্যা,লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের তাণ্ডবেই ৫০,০০০ হিন্দু বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে।
প্রেস ট্রাস্ট অব ইণ্ডিয়া বা পিটিআই(PTI) এর রিপোর্ট অনুসারে সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় পড়েছিল বনগ্রাম এবং মকিম লেনের হিন্দু অধিবাসীরা।সেই দুই জনবসতির প্রতিটি বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনার জন্য নির্মিত পবিত্র মন্দির গুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়।তাজউদ্দীন আহমেদ দুপুর ১ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন এবং হিন্দুদের উপর মুসলিমদের চালানো অমানবিক বর্বর নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন।তিনি ঢাকার নবাবপুর,সদরঘাট, পাটুয়াটুলি, ইসলামপুর,দিগবাজার,ইংলিশরোড, বংশাল এবং চকবাজার ঘুরে দেখেন।১২ই ফেব্রুয়ারি তারিখে ভারতগামী ৬০ জন যাত্রীকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে আক্রমণ করে মুসলিমরা।তেজগাঁও বিমানবন্দরে আসা প্রত্যেক অমুসলিম যাত্রীকে ছুরি দিয়ে কোপানো হয়।

ঢাকতে হিন্দুদের উপর তিনদিন ব্যাপী গনহত্যা চালানোর পরে গ্রামাঞ্চল গুলোতে যেমন বিক্রমপুর,লৌহজং-এ হত্যাযজ্ঞ শুরু করে মুসলিমরা। ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে শিমুলিয়া বাজারের হিন্দু দোকানে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করে তারা।১৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত লৌহজং এবং দিঘালিতে হিন্দুদের উপর চালানো ১৫ টি ছুরিকাঘাতের রিপোর্ট আসে।২৮শে ফেব্রিয়ারি তারিখে সম্পূর্ণ দিঘালি বাজার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হয়।কালীগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন পারুল্লা গ্রামের সব হিন্দু বাড়ি লুট করা হয়। খোসলা,গজারিয়া,কারার চর,চর সিন্দুর,পলাশ,সদরচর গ্রামগুলোর প্রতিটি হিন্দু বাড়ি লুটপাট করে মুসলিমরা।ভারত সরকারের সুত্র থেকে জানা যায়,প্রথম দুইদিনের মধ্যেই নৃশংসতার শিকার কমপক্ষে ২০০ জন হতভাগ্য হিন্দুর মৃতদেহ পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হয়।সে সূত্র থেকে আরও জানা যায় যে ৮০,০০০ হতভাগ্য হিন্দু (যাদের মধ্যে ৫০,০০০ ঢাকার) জীবন বাঁচাতে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে চলে যায়।
বরিশাল
১৩ই ফেব্রুয়ারি তারিখে বরিশালে শুরু হওয়া গনহত্যায় হিন্দুদেরকে নির্বিচারে হত্যা,ধর্ষণ,অপহরণ,নির্যাতন করা হয়।পূর্ব-বাংলা প্রাদেশিক সরকারের প্রেস নোট অনুসারে দুই অজ্ঞাত পরিচয়ের যুবক ১৩ই ফেব্রুয়ারি দুপুর হতে উত্তেজনাপূর্ণ গুজব ছড়াতে শুরু করে বরিশাল শহর জুড়ে।ফলে বরিশালের দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়।আরও একটি গুজব ছড়ানো হয় যে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে কোলকাতায় খুন করা হয়েছে।বরিশালের আকাশে সন্ধ্যা নেমে আসতেই কমপক্ষে আট জায়গাতে অগ্নি সংযোগ করা হয়।ত্রিশটি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে ভস্ম করে দেওয়া হয় এবং কমপক্ষে দশ জন আগুনে দগ্ধ হয়। পরস্থিতির আরও অবনতি হতে শুরু করে যখন ১৬ই ডিসেম্বরে বরিশাল জেলার অন্তর্গত গৌরনদী, ঝালকাঠি, নলছিটি সাব-ডিভিশন গুলোতে নির্বিচারে হিন্দুদের উপর হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ শুরু করা হয়।এমনকি বরিশাল-ঢাকা যাত্রাপথের স্টিমারগুলোতেও হিন্দু যাত্রীদেরকে হত্যা করে নদীতে ফেলা দেওয়া হয়। নির্যাতনের বীভৎসতা সহ্য করতে না পেরে বরিশালের নৌ বন্দর এলাকা মুলাদী পুলিশ স্টেশনে শত শত হিন্দু এসে আশ্রয় গ্রহন করে।কিন্তু নিজেদের এলাকা থেকে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নেয়া হতভাগ্য হিন্দুদেরকে পুলিশ স্টেশন কম্পাউণ্ডের মধ্যেই নির্মম ভাবে হত্যা করে আশেপাশের মুসলিমরা।একজন হিন্দু স্কুলশিক্ষককে তারই ছাত্ররা জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে কাবাব তৈরি করে এবং জলন্ত আগুনের চারপাশে তারা নৃত্য করে হত্যা উদযাপন করে।বাবুগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত মাধবপাশা গ্রামে প্রায় তিনশ হিন্দুকে ধাওয়া করে আটক করে মুসলিমরা।তারপরে তাদেরকে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাম দা দিয়ে মাথা কেটে নেয় তারা। মাধবপাশা জমিদার বাড়ীতে ২০০ হিন্দুকে হত্যা করা হয় এবং আরও ৪০ জন মারাত্মক ভাবে আহত হয়।

ভোলা শহর থেকে মেঘনা তীরবর্তী ইলিশা স্টিমারঘাট প্রায় ৭ কি.মি. দূরে অবস্থিত।বরিশাল-চট্টগ্রাম জলপথে এই স্টিমার ঘাট পার হয়ে যেতে হয়।১৯৫০ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে রয়েল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির এস.এস.সীতাকুণ্ড চট্টগ্রাম যাবার পথে ইলিশাঘাটে নোঙ্গর করে। স্টিমারের নাবিকদল হিন্দু যাত্রীদের কাছ থেকে সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে যায়। আনুমানিক রাত ৮টার দিকে উন্মত্ত মুসলিমরা স্টিমারের হিন্দু যাত্রীদের উপর চড়াও হয় যদিও তখন স্টিমার ঘাটে নোঙ্গরকৃত অবস্থায় ছিল।তারা নিরস্ত্র হিন্দু যাত্রীদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং মৃতদেহ গুলো নদীতে নিক্ষেপ করে।কমপক্ষে ৩০ জন হিন্দু সেদিন নিহত হয় এবং ভাগ্যক্রমে তিন জন হিন্দু আহত অবস্থায় বেঁচে যায়।

বরিশালের সে সময়কার মুসলিম প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে বরিশালে বেশ কয়েক হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয় এবং ২,০০০ হিন্দুর আর কোন হদিস পাওয়া যায়নি। গবেষক শুভশ্রী ঘোষের মতে,বরিশাল জেলায় কমপক্ষে ২,৫০০ জন বাঙ্গালীহিন্দুকে হত্যা করা হয়। তথ্যচিত্র নির্মাতা সুপ্রিয় সেন ধারণা করেন ৬৫০,০০০ জন হিন্দু বরিশাল থেকে ভারতে পালিয়ে যায় এবং ওই শরণার্থীরা তাদের যাত্রা পথেও হত্যা,ধর্ষণ,অপহরণ এবং লুটপাটের শিকার হয়।
চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে চারজন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ব্যক্তিকে কুপিয়ে আহত করা হয় যাদের মধ্যে একজন ছিলেন পুলিশ ইনস্পেক্টর।তাছাড়া বেশ কিছু বৌদ্ধমঠ ধ্বংস করে দেয় মুসলিমরা।ফটিকছড়ি পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন বেশ কিছু বৌদ্ধ পরিবারের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয় মুসলিমরা।রাউজান পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত লাম্বুরহাটের বৌদ্ধ জমিদার বাড়িটি পুড়িয়ে ছাই করে দেয় মুসলিমরা।তার ফলে প্রচুর সংখ্যক ভীতসন্ত্রস্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ জীবন বাঁচাতে ভারতের লুসাই পাহাড়ে আশ্রয় নেয়।ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখে চট্টগ্রাম শহরে গণহত্যা শুরু হয়।সীতাকুণ্ডে মহাশিবরাত্রি উপলক্ষে যে সকল হিন্দু তীর্থযাত্রী সমাবেত হয়েছিল তাদের উপর মুসলিম জনতা আক্রমণ করে।পূর্ব বাংলার গণপরিষদের সদস্য নেলি সেনগুপ্ত পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে চট্টগ্রামের হিন্দু গণহত্যা সম্পর্কে চিঠি লেখেন।

নোয়াখালী

ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে নোয়াখালীর হিন্দুদের জীবনে নেমে আসে নরক যন্ত্রণা।১৩ই ফেব্রুয়ারি বিকাল বেলায় প্রকাশ্য দিবালোকে ফেনী জেলার হিন্দুদের উপর চালানো হয় পাশবিক বর্বরতা যদিও মাত্র ২০০ ইয়ার্ডের(৬০০ ফুট) মধ্যে ফেনীর এস.ডি.ও পুলিশ স্টেশন এবং আদালত অবস্থিত ছিল। ফেনীর তৎকালীন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলো যেমন মাস্টারপাড়া, উকিলপাড়া,ডাক্তারপাড়া,সহদেবপুর, বারাহীপুর,সুলতানপুরের হিন্দুদের উপর মুসলিমরা আক্রমণ করে এবং তাদের বসতভিটা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।গুরুদাস কর নামের হিন্দুসম্প্রদায়ের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে হত্যা করে মুসলিমরা।ফেনী শহরের হিন্দুদের উপর নির্মম তাণ্ডব চালানোর পর তা ছড়িয়ে ফেনী এবং ছাগলনাইয়া পুলিশ স্টেশন এলাকার গ্রামগুলোতে যেখানে মুলত হিন্দু নাথসম্প্রদায়ের অধিবাসীরা বসবাস করত।হিন্দু প্রধান বাঁশপাড়া,রামপুর, মধুপুর,শ্রীচন্দ্রপুর, বাশিকপুর,চাকবস্তা, শিবপুর,বালিগঞ্জ গ্রামগুলোকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়। বিভিন্নসূত্রে জানা যায় কমপক্ষে ৪৫ জন নিরীহ হিন্দুকে হত্যা করে মুসলিমরা এবং ২০৫ টি বাড়ি পোড়ানর পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুটপাট করে তারা।

হিন্দু মেয়েদেরকে মুসলিমরা অপহরণ করে এবং অনেককে জোরপূর্বক বিয়ে করে।হরেন্দ্রনাথ করের কন্যা মিলা করকে সুলতান মিয়াঁ নামক একজন সিভিল সাপ্লাই কন্ট্রাক্টর অপহরণ করে এবং জোর করে বিয়ে করে।অপহরণের পূর্বে মিলা করের বাবা,ঠাকুরদাদা এবং সন্তানকে তার সামনেই জবাই করে মুসলিম জনতা।বারিক মিয়াঁ নামের একজন সম্মানিত ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে রহমত আলী, রানুবালা নামের একজন বিবাহিত হিন্দু মহিলাকে জোরকরে বিয়ে করে।

২৩ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলতে থাকা বিরামহীন ধ্বংসযজ্ঞে প্রায় ৪৫০০ নিরীহ হিন্দু ফেনী কলেজে স্থাপন করা রিফুউজি ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহন করে।আরও ২৫০০ হিন্দু প্রাণের ভয়ে নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়। যে সকল হিন্দু ভারতের ত্রিপুরাতে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে, পথিমধ্যেই তাদের সর্বস্ব লুট করে নেয় মুসলিমরা।অনেক হিন্দু মহিলা এবং শিশু চাঁদপুর ও আখাউড়া রেলস্টেশনে আশ্রয় নেয়।পুলিশ,আনসার এবং মুসলিম জনতা তাদেরকে আগরতলা কিংবা কোলকাতা পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখান করে।অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বেলোনিয়াতে পালিয়ে এসে প্রায় ৫,০০০ শরণার্থী জীবন রক্ষা করে।

সিলেট
সিলেটে অসহায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর চালানো বর্বর হত্যা,ধর্ষণ,লুটপাট,অগ্নিসংযোগের বীভৎসতা এক দীর্ঘস্থায়ী রূপ লাভ করে।২০৩ টি হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলে মুসলিমরা এবং ৮০০ টি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে ফেলে তারা।ধামাই,বারাধামি,পুবঘাট,বরইতলি গ্রামের ৫০০ টি মনিপুরী পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয় মুসলিমদের আক্রমণের ফলে।সিলেটে যখন গণভোট হয় তখন থেকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো হয় যে,হিন্দুরা যেহেতু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে তাই তারা পাকিস্তানের শত্রু।১৯৫০ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি তারিখে বাজ্ঞে ট্রাইব্যুনাল(Bagge Tribunal) রায় ঘোষণা করে।সিলেটের মুসলিমরা আশা করেছিল আসামের করিমগঞ্জ পাকিস্তানের অংশ হবে কিন্তু তা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।সিলেট বার এ্যাসোসিয়েশনের কিছু আইনজীবী এবং করিমগঞ্জের কিছু মুক্তার হুমকি দেয় সেখানে তারা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।১০ই ফেব্রুয়ারি তারিখে মুসলিমরা সিলেটের প্রাণকেন্দ্র বন্দর বাজারে সুবিশাল একটি পোস্টার টানায়।লাঠি এবং অস্ত্র হাতে হিন্দুরা একজন মুসলিমের গলায় রশি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমন একটি ছবি ওই পোস্টারে আঁকা ছিল যার শিরোনাম ছিলঃহিন্দুস্থানের মুসলমানদের উপর হিন্দুদের নির্যাতন। লামডিং (আসামের একটি শহর) এবং কোলকাতায় মুসলিমদের রক্তের নদী প্রবাহিত হচ্ছে এমন গুজব ছড়ানো হয়।স্থানীয় মুসলিমরা খুব আগ্রহ সহকারে সেই পোস্টার দেখত এবং কিছু অতি উৎসাহী এর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ করবে বলে শপথ নেয়।১১ই ফেব্রুয়ারিতে গোবিন্দ পার্কে আয়োজিত র‍্যালিতে হিন্দুর রক্তের জন্য হুঙ্কার ছাড়ে মুসলিমরা।এর মাঝেই গুজব ছড়ানো হয় কোলকাতায় এ কে ফজলুল হককে হত্যা করা হয়েছে।ফলে সিলেটের অবস্থা খুব দ্রুত অবনতির দিকে যেতে থাকে।১৩ই ফেব্রুয়ারি তারিখে ঢাকায় পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ব বাংলার মুখ্য সচিবদের নেয়া যৌথ সিদ্ধান্ত অনুসারে, সিলেটে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।এর মাঝেই পৃথ্বীশ দাস নামে একজন হিন্দু যুবককে জিন্দাবাজারে ছুরি দিয়ে কোপানো হয়।১৪ই ফেব্রুয়ারি, গুজব ছড়ানো হয় আসামের করিমগঞ্জে মুসলিমদেরকে হত্যা করা হচ্ছে।আইনজীবীদের একটি সমাবেশে সিলেটের ডেপুটি কমিশনার তার অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে,করিমগঞ্জে ৫,০০০ মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে এবং সেখানকার বিশাল সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী সিলেটে আশ্রয়ের জন্য এসেছে।সেদিনই সন্ধ্যায় মতি দাস নামক একজন বাঙ্গালী হিন্দুকে জালালপুরের কাছে হত্যা করা হয়।তিনজন মনিপুরীকে কোপানো হয়,যাদের মধ্যে দু’জন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।


১৪ই ফেব্রুয়ারি বিকাল বেলায় লামাবাজার নামক বিপণীকেন্দ্র মুসলিমরা লুট করে।১৫ই ফেব্রুয়ারি সকালবেলা থেকেই গ্রামাঞ্চলে লুটপাট এবং হত্যা শুরু হয়।সকাল ন’টায় মূর্তি নামক গ্রামে আক্রমণ হয়।শত শত মুসলিম হিন্দুবিদ্বেষী স্লোগান সহকারে সেনাপতি পরিবারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে।পরিবারের সদস্যদেরকে পিটিয়ে বাড়ি ঘর লুট করে মুসলিমরা।উপাসনালয়ের পবিত্র ছবি ও মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং পরিবারের সকল সদস্যদেরকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে।এরপর মুসলিমরা আজমতপুর,দাসপাড়া,নাসিয়াঞ্জি এবং মহেশপুর গ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে।পরবর্তী দিনে মুসলিমরা পুনারায় মূর্তি গ্রামে যায় এবং সেনাপতি পরিবারের কাছ থেকে জোরপূর্বক একটি লিখিত বিবৃতি আদায় করে যেখানে লেখা ছিল সেনপাতি পরিবারের সদস্যরা স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছে।রাত ৮ টায় সিলেট থেকে মাত্র ছয় মাইল দূরে নওগ্রামের গুরুচরণ ধরের পরিবারের উপর আক্রমণ করা হয়।পরের দিন সকাল ৭ টায় ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মুসলিমরা গ্রামটি ঘিরে ফেলে।কমপক্ষে ১,৫০০ হিন্দু প্রাণের ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নেয়।মুসলিমরা সম্পূর্ণ গ্রাম ধরে লুটপাট ও অগ্নি সংযোগ করে এবং সকল পারিবারিক মন্দির,উপাসনালয় ও পবিত্র তুলসীমঞ্চ গুলো ধ্বংস করে ফেলে।পাশের গ্রাম মন্মথপুরের মহেন্দ্র চন্দ্র দে,কামাকান্ত ধর,অশ্বিনী কুমার দে’র বাড়ি সহ সকল হিন্দুর বাড়ি-ঘর লুট করে তারা।তারা অশ্বিনী কুমার দে’র এক কন্যা কে অপহরণ করে নিয়ে যায়।পরের দিন ধর্ষিত,বিকৃত,জ্ঞানশূন্য অবস্থায় হতভাগ্য মেয়েটির দেহ বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে মুসলিমরা ঢাকাদক্ষিনের ভরত দত্তের দু’জন অবিবাহিত কন্যাকে ধর্ষণ করে।১৮ই ফেব্রুয়ারি সকাল বেলায় চরম বিপর্যস্ত অবস্থায় তাদেরকে ফেরত দেয়া হয়।তাদের পরিবার পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে,পুলিশ তাদেরকে আদালতের বাইরে কেস মিমাংসার জন্য ১,০০০ রূপী দিতে বলে।সিলেট সদর পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় সব গ্রামেই অসংখ্য মেয়েকে এভাবে ধর্ষণ করে মুসলিমরা।

১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে গঙ্গাজল গ্রামের দীনেন্দ্র চন্দ্র দেব পুরকায়স্থের বাড়ি লুট হয় এবং মুসলিম দুষ্কৃতকারীরে তা দখল করে নেয়।সকাল ৯ টায় বাহুবল(পূর্বে করিমগঞ্জের একটি সাব-ডিভিশন ছিল)পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন সিলানি গ্রামে আক্রমণ চালানো হয়।সেখানে হিন্দু বিদ্বেষী স্লোগান দেয়া হয় এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়।অনেক হিন্দু প্রাণ বাঁচাতে পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নেয় এবং যারা পালাতে পারেনি তাদেরকে ধর্মান্তরিত করা হয়।আর যারা ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকার করে তাদেরকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকাদক্ষিন এবং কাচুয়ারি থেকে অনেক প্রখ্যাত ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়েদেরকে জোরপূর্বক অপহরণ করে মুসলিমরা।হবিগঞ্জ সাব ডিভিশনের চুনারঘাট পুলিশ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার কেতন দাস,অশ্বিনী নাথ,বীরেন্দ্র নাথ সহ নাম না জানা আরও অনেক হিন্দু পরিবারের সকল সদস্যদেরকে ঘৃণ্য উপায়ে ধর্মান্তর করে মুসলিমরা।ফেঞ্জুগঞ্জের একটি স্টিমার কোম্পানি লুট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়।ইলাসপুরে পুলিন দে নামক একজন হিন্দুকে হত্যা করা হয়।ফেঞ্জুগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত মাজিগাঁও এলাকার অম্বিকা কবিরাজ ও মাখন সেনের নিবাস লুট করে পুড়িয়ে দেয় মুসলিমরা।বালাগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত রুকানপুর গ্রামের দিগেন্দ্র সেন,গোপেশ সেন এবং শিব চরণ দাসের বসত বাড়ি লুট করা হয় এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা নির্মম প্রহারের শিকার হয়।মাধুরাই এবং কাঁঠালখই এলাকার হিন্দুদেরকেও প্রহার করা হয় এবং তারা জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের শিকার হয়।গোলাপগঞ্জ পুলিশস্টেশনের ফুলসাইন গ্রামের বৈকুণ্ঠ রায় এবং রাসবিহারী রায়ের বাড়িও লুট হয়।বিশ্বনাথ পুলিশ স্টেশনের দণ্ডপাণিপুরের হিন্দুরাও ভয়ঙ্কর লুটপাটের শিকার হয়।হিন্দুদের কাছে পবিত্র গরু জবাই করে তাদেরকে সেটির মাংস খাওয়ানো হয় জোর করে আর সবাইকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়।টুকেরকান্দি গ্রামের ঘোষ বাড়ি লুট করে মুসলিমরা।যোগেন্দ্র ঘোষকে নিষ্ঠুর ভাবে খুন করা হয় এবং অনেক হিন্দুকে কুপিয়ে আহত করা হয়।সিজেরকাছ নামক এলাকার পাল,চৌধুরী সহ সকল ব্রাহ্মণ বাড়ি-ঘর লুটপাট করা হয় এবং সবাইকে ধর্মান্তরিত করা হয়।বিমল স্মৃতিতীর্থ নামে একজন সজ্জন হিন্দু পণ্ডিত ইসলাম গ্রহন করতে অস্বীকার করেন।তার পবিত্র পৈতা ছিঁড়ে ফেলা হয় এবং তাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে উপর্যুপরি কোপানো হয়।ব্রাহ্মণদের মাথায় রাখা শিখা বা চুলের টিকি টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয় এবং উপাসনার মন্দির ও মূর্তি গুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়।

১৬ই ফেব্রুয়ারি তারিখে মুসলিমদের ৩০০ জনের একটি দল আখরা নামের গ্রামে আক্রমন করে।গ্রামের মন্দিরের পুরোহিত পালিয়ে গেলে তারা সকল ছবি ও মূর্তি ধ্বংস করে।এরপর তারা হরিপদ চৌধুরী ও বিমল ভট্টাচার্যের বসত বাড়ি সহ পুরো গ্রামের সব হিন্দু বাড়ি ঘর লুট করে।১৭ই ফেব্রুয়ারিতে মুসলিম গুণ্ডারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হিন্দুদেরকে আক্রমন করে।তারা ব্রাহ্মণদের পৈতা টেনে ছিঁড়ে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে দেয় এবং জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে।সুনাইতা এবং কুর্মা গ্রামের হিন্দু মহিলাদের উপরও চালানো হয় বীভৎস নির্যাতন।তাদের সিঁথির সিঁদুর মুছে দেয়া হয় এবং হাতের শাঁখা ভেঙ্গে ফেলা হয়। রাজগঞ্জ আখরা গ্রামের নীর ভট্ট এবং রাম চন্দ্র ভট্টের বাড়ি লুট করে মুসলিমরা।১৭ই ফেব্রুয়ারি তারিখে ৫০০ থেকে ৬০০ মুসলিমের একটি দল ছাতক পুলিশ স্টেশনের অন্তর্গত লোকেশ্বর গ্রামে আক্রমন করে।সেখানে হিন্দুদের বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের বাড়িঘর লুট করে তারা এবং দু’জনকে নির্মম ভাবে পিটিয়ে আহত করে।এখানেও তারা ব্রাহ্মণদের পবিত্র পৈতা ছিঁড়ে ফেলে এবং মাথায় রাখা চুলের শিখা বা টিকি কেটে দেয়।তাদেরকেও জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়।মারকুল নামের একটি গ্রাম পুরোপুরি লুট করা হয় এবং গ্রামের সকল অধিবাসীদেরকে মুসলমান বানিয়ে দেয়া হয়।১৯শে ফেব্রুয়ারি তারিখে জকিগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন সদরপুর গ্রামে আক্রমণ করে মুসলিমরা।শুকলাল নমশূদ্রের বাড়ি লুট করে তারা।তার ভাই পুলিশ স্টেশনে অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ তাকে বেয়নেট দিয়ে কুপিয়ে জখম করে এবং পা দিয়ে লাথি মেরে পুলিশ স্টেশন থেকে তাড়িয়ে দেয়।রাতের আঁধারে গ্রামের হিন্দুরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সাঁতার কেটে নদী পার হয়।পারগ্রামের অক্রু নমশূদ্র এবং রমেশ নমশূদ্রের বাড়ি মুসলিমরা লুট করে এবং দখল করে নেয়।

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৭:০৩

বীরেনদ্র বলেছেন: ধন্যবাদ। আমরা আর কিছু পারি বা না পারি অন্ততঃ নতুন প্রজনমকে জানাতে পারি।

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:০৬

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: ইতিহাস ইতিহাসই । ইতিহাস কখনো রাজনীতির সাথে মিশালে হবে না ।ধন্যবাদ।

২| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:১৬

সজীব মোহন্ত বলেছেন: আল্লাহর দুনিয়ায় কাফেরদের থাকার কোন অধিকার নেই। কাফেরদের সম্পত্তি, স্ত্রী, সব গণিমতের মাল। এসব ভোগ করা, কাফেরদের হত্যা করা ইসলামে জায়েজ।

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৯:২১

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: আল্লাহর দুনিয়ায় কাফেরদের থাকার কোন অধিকার নেই। কাফেরদের সম্পত্তি, স্ত্রী, সব গণিমতের মাল। এসব ভোগ করা, কাফেরদের হত্যা করা ইসলামে জায়েজ।
যদি কাফেরদের এখানে থাকা নিষিদ্ধ থাকত তাহলে পৃথিবীতে কাফের আসতো না।

৩| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:১৮

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন:
পুরো দাঙ্গার ইতিহাস তুলে ধরছেন।

প্রিয়তে রেখে দিলাম।

০১ লা অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৩:৪২

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: ধন্যবাদ রক্তিম দিগন্ত ভাই।

৪| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:৪১

আহা রুবন বলেছেন: নিজেকে যতটা ভাল মনে করতাম, ততটা ভাল নই! প্রিয়তে নিলাম।

০১ লা অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৩:৪৪

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই ।ওটা কোন বিষয় না,পৃথিবীতে মানুষ বলতেই ভাল মন্দের মিলে দুইয়ের আগমনই থাকবে ।

৫| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:০৭

প্রামানিক বলেছেন: মাঝখানে এটা কি হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা না ৭১ সালের গণহত্যার ছবি?

০১ লা অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৩:৪৮

ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: ধন্যবাদ প্রামানিক ভাই ওটা ৭১ এর গণহত্যার ছবিই । শুধু কেউ যাতে পড়তে গিয়ে ক্লান্ত না হন সে কারনে ছবিটা দিয়েছি ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.