নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে নাকি একলা চলতে হয় ..........

অপার্থিব ছায়া

অপার্থিব ছায়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

পিতা পুত্রের আবিষ্কার হারিয়ে যাওয়া এক জনপদ উয়ারী-বটেশ্বর

৩০ শে এপ্রিল, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৫৫



বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন হারিয়ে যাওয়া জনপদ উয়ারী-বটেশ্বরকে আবিস্কার করেন স্বশিক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক হাবিবুল্লা পাঠান এবং তার বাবা হানীফ পাঠান। শুধুমাত্র ব্যক্তি উদ্যেগে একটি হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা কে আবিস্কার করতে পুরা দুইটা জেনারেশন ব্যায় হয়ছে।
একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হাবিবুল্লা পাঠানের একটি সাক্ষাতকার তুলে ধরা হল।
প্রত্নবস্তুর সঙ্গে কী করে পরিচয়?
বাবার [হানীফ পাঠান] সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হলেই দেখতাম, পথের দিকে তাঁর দৃষ্টি। জিজ্ঞেস করতাম, কী খোঁজেন? বলতেন, ‘উয়ারী-বটেশ্বর খুব পুরনো জায়গা, এখানে অনেক প্রাচীন শিল্পনিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, বিশেষ করে প্রচুর পাথরের গুটিকা পাওয়া যায়।’ চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ ছিল বলে তিনি সেগুলো খুঁজে পেতেন না। একদিন বৃষ্টি মধ্যে যাওয়ার সময় বড় আকৃতির একটি পাথরের গুটিকা পেলাম। লম্বাটে, মাঝখানে ছিদ্র। অ্যামিথিস্ট পাথরের ঝকঝকে গুটিকাটি দেখালে তিনি চমকে উঠলেন। বললেন, ‘পেলে কোথায়?’ বললাম, এই তো পেছনে পেয়েছি। আমার বালক মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠল। মনে করলাম, বিরাট কিছু পেয়েছি [দীর্ঘশ্বাস]। সে বছরই এক বিকেলে ফুটবল খেলা শেষে সন্ধ্যায় ফিরছি, দেখলাম, এক জায়গায় মাটি খোঁড়া, শ্রমিকরা দুটি পিণ্ড ফেলে গেছে। ওজনদার ত্রিকোণাকার পিণ্ড দুটি খেলার ছলে দুই হাতে ছুড়তে ছুড়তে নিয়ে এলাম। বাবা দেখে বললেন, ‘এ তো সাংঘাতিক জিনিস।’ পরদিন ভোরে তিনি আমাকে সেই জায়গায় নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আরো আছে কি না খুঁজে দেখ।’ এই যে গুটিকা আর লোহার দুটি হাতকুঠার পেলাম—এ দুটি ঘটনা সংগ্রহের দিকে আমাকে মনোনিবেশে সাহায্য করে। ফলে ১৯৫৫ সাল থেকে বাবার উৎসাহে সংগ্রহে লেগে পড়লাম। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা নেই, কিন্তু প্রত্নবস্তু সংগ্রহের নেশা হয়ে গেল।
তিনিই প্রথম উয়ারী-বটেশ্বরের গুরুত্ব তুলে ধরেন?
১৯৩৩ সালে তিনিই প্রথম এখানে ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা পেলেন। তিনিই এই প্রত্নক্ষেত্রের আবিষ্কারক। তখনো আমার জন্ম হয়নি। শ্রমিকদের মাটি খননে ভাণ্ডটি মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। শ্রমিকরা হয়তো সেগুলো বেনের দোকানে বিক্রি করে ফেলেছিল। তিনি কিছু সংগ্রহ করেছেন। পরে ‘প্রাচীন মুদ্রাপ্রাপ্তি’ শীর্ষক একটি ছোট্ট খবর কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতেও ছাপেন। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত এই খবরই উয়ারী-বটেশ্বরসংক্রান্ত প্রথম খবর।
সে বছর আর কী পেলেন?
১৯৫৫ সালে একটি বস্তু সংগ্রহ করেছিলাম। পরে বুঝেছি, এটি হলো পাথরের ছুরি। উয়ারী থেকে সংগ্রহ করা ছুরিটি এখনো আমার সংগ্রহে আছে। এর অগ্রভাগ খুব সূক্ষ্ম। শ্রমিকরা মাটি খননের সময় পরিত্যক্ত বস্তু হিসেবে ছুড়ে ফেলেছিল। তারা কোনো পাথরের বা শক্ত বস্তুতে পড়ে যাতে কোদাল নষ্ট না হয়, সে জন্য ছুড়ে ফেলে দেয়। পরে আমি সংগ্রহ করে রাখি। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত মৃদুভাবে খুঁজেছি। ১৯৬৩ সালের আগ পর্যন্ত গুটিকা সংগ্রহ করতাম। অনেককে অনুরোধ করতাম। এগুলো যে অমূল্য সম্পদ তা তারা জানত না। তাদের কাছে গিয়ে বলতাম, মা তসবিহ বানাবেন, দু-চারটি গুটিকা থাকলে দিন, তারা দিয়ে দিত। তখন বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি প্রত্নবস্তুও সংগ্রহ করেছি। ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করে বাজনাবো গ্রামের এক বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম। বটেশ্বর, উয়ারী গ্রাম পেরিয়ে সে স্কুলে যেতে হয়। সে সময় কিছু গুটিকা সংগ্রহ করেছি। তখন এগুলো প্রচুর পাওয়া যেত। উয়ারী-বটেশ্বরে গুটিকা তৈরির কারখানা ছিল। কাজেই এখানে এগুলো এত বেশি পাওয়া যেত যে জাদুঘর হলে আমার কাজের নমুনা বোঝা যাবে।
টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ শুরু করলেন কবে?
স্কুলের সেই চাকরিটি বলতে গেলে বিনা পয়সারই ছিল। ফলে সেটি ছেড়ে দিলাম। অনেক দিন বেকার ছিলাম। ১৯৬২ সালে ঠাকুরগাঁও সুগার মিলে ফিল্ডম্যানের মৌসুমি চাকরি নিয়ে চলে গেলাম। আখের মৌসুমে আখ থেকে চিনি তৈরি হয়। মোটামুটি ভালো মাইনে, ১৫০ টাকা পেতাম। ওভারটাইম করলে ডাবল পেতাম। ফলে বেশ কিছু টাকা জমল। চার-পাঁচ মাস পর সিজন শেষে বাড়ি ফিরলাম। তখনই মনে হলো, পয়সা দিলে তো আরো বেশি গুটিকা সংগ্রহ করতে পারব। উয়ারী-বটেশ্বর, রাঙ্গারটেক, সোনারুতলার দিকে ছুটে যেতাম। বলতাম, কার কী আছে—মুদ্রা, গুটিকা; আমাকে দাও, টাকা নাও। বাবা বললেন, ‘চাকরির টাকা কী করিস?’ বললাম, খরচ হয়ে যায়। তাঁর কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াই। এভাবে ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে থাকলাম। উয়ারী-বটেশ্বর আমার দিনের চিন্তা, রাতের স্বপ্ন হয়ে গেল। প্রতিদিন না বেরোলে পেটের ভাত হজম হতো না, নেশা হয়ে গিয়েছিল [হাসি]। দেখলাম, এভাবে অনেকখানি কাজ হচ্ছে। বেশির ভাগ পাথরের গুটিকা এভাবে সংগ্রহ করেছি। এগুলো খ্রিস্টপূর্ব আমলে উয়ারী-বটেশ্বরে ব্যবহার হতো।
ড. দানীর সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা গেলেন কবে?
১৯৫৮ সালে কিছু প্রত্নদ্রব্য—গুটিকা, বল্লম, একটি কুঠার নিয়ে বাবার সঙ্গে ঢাকা গেলাম। জাতীয় জাদুঘরের যে পুরনো ভবন [এখন এশিয়াটিক সোসাইটি], সেখানে ড. আহমদ হাসান দানী বসতেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। পিতা-পুত্রের উদ্দেশ্য ছিল উয়ারী-বটেশ্বরের সত্যিকার তথ্য উদ্ঘাটন। তাঁকে এগুলো দেখালাম। তিনি মধ্যযুগের ইতিহাসে পণ্ডিত, কিন্তু প্রাচীন যুগের প্রত্নদ্রব্যগুলো নিয়ে খুব একটা উৎসাহ দেখাননি। আমরা ফিরে এলাম, কিন্তু উদ্যম হারাইনি। বরাবরই আমি মুদ্রা, গুটিকা, প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করে চলেছি।
কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সংগ্রহ করতে পারেননি—এমন ঘটনাও তো আছে।
১৯৫৬ সালে জাডু নামের এক লোক, মাটি খনন করতে গিয়ে ৯ সের ওজনের একটি ভাণ্ড পেল। তখন আমি মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ি। সেগুলো সে বেনের কাছে ৮০ টাকা সের দরে বিক্রি করল। এই আক্ষেপ আমার জীবনে যাবে না। কারণ এটি প্রায় পাঁচ হাজার রৌপ্য মুদ্রার বিশাল এক ভাণ্ড ছিল। এটি পেলে হয়তো উয়ারী-বটেশ্বরের ইতিহাসের অনেক নতুন তথ্য সংযোজিত হতে পারত। তবে শ্রমিকরা দুই-চারটি করে মুদ্রা রেখে দিয়েছিল। সেগুলো কিনে দুই-চারটি রৌপ্য মুদ্রা আমি জোগাড় করেছি। এ পর্যন্ত উয়ারী-বটেশ্বরের ৯ জায়গায় ছাপাঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া গেছে, সবই খ্রিস্টপূর্বাব্দ যুগের মুদ্রা। এটি যে বিশাল এক বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল, মুদ্রাপ্রাপ্তি তা প্রমাণ করে। এখানে যে গুটিকা পাওয়া যায়, সেগুলো বহির্বাণিজ্যের নিদর্শন। এ ধরনের অ্যামিথিস্ট, কার্নিলিয়ান, অ্যাগেট ইত্যাদি পাথর বাংলাদেশের কোনোখানে নেই। এগুলো বাইরে থেকে নৌকায় আসত। পরে এখানকার কারখানায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে কেটে মালা তৈরি করা হতো।
পাথরের ছুরিটি পাওয়ার পর কী পেলেন?
কমবেশি প্রত্নবস্তু খোঁজা অব্যাহত ছিল। চলার সময় পথের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কারণ পায়ের ঘায়ে বা বৃষ্টি পড়লে প্রত্নবস্তুগুলো ঝকঝক করত, ভেসে উঠত। বৃষ্টির পর চষা ভূমিতে ঘুরতাম। বাবা বলতেন, বৃষ্টির পর চষা ভূমিতে এগুলো পাওয়া যায়। এভাবে বেশ কিছু গুটিকা সংগ্রহ করেছি। অনুসন্ধানে দুটি ছাপাঙ্কিত রুপার মুদ্রাও খুঁজে পেয়েছি। এগুলো বিক্ষিপ্ত অবস্থায় মাটির ওপর চলে এসেছিল। বেশ বুঝজ্ঞান নিয়েই আমি অনুসন্ধানে বের হতাম। বর্ষাকালে বেশি পাওয়া যেত বলে আমার সঙ্গে অনেক ঢাল-হাতিয়ার থাকত—ছাতা, টাকা, ভাঙতি পয়সা, কাস্তে, লোহার বড় পেরেক ও ব্যাগ। পরে দেখা যেত, হাঁড়ির ভাঙা টুকরো ইত্যাদি ব্যাগে ভরে বাড়ি ফিরেছি। আমি যেকোনো সময় বেরিয়ে যেতাম। ছুটির দিনে তো পাগলপারা হয়ে যেতাম, দুই দফা ঘুরতাম। স্কুল থাকলে শেষ বেলায় চক্কর খেতাম। উয়ারী-বটেশ্বর, সোনারুতলা, রাঙ্গারটেক—এই জায়গাগুলোই আমার প্রাণকেন্দ্র ছিল। এগুলোতেই বেশি ঘুরেছি। এখানে এখন পর্যন্ত উয়ারী-বটেশ্বরসহ ৫২টি প্রত্নক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোতে প্রত্নবস্তুর খোঁজে বেরিয়ে আমি কখনো খালি হাতে ফিরিনি।
লেখালেখির শুরু?
তখন দৈনিক পূর্বদেশ ছিল, সেখানে ১৯৭০ সালে এই প্রত্নস্থান নিয়ে ‘ব্রহ্মপুত্র সভ্যতা’ নামে তিন পৃষ্ঠার প্রবন্ধ লিখলাম। তাতে বলেছিলাম, এখানে যে এত কিছু পাওয়া যাচ্ছে, তা প্রমাণ করে, এটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল, সভ্যতার বিকাশও ঘটেছিল। তার পর থেকে যখনই সময় পেয়েছি, পত্রিকায় লিখেছি। পূর্বাচল পত্রিকায় ১৯৭৫ সালে ২৯ পৃষ্ঠাব্যাপী ‘বাংলার আদি ইতিহাসের বিস্মৃত অধ্যায় উয়ারী-বটেশ্বর’ নামে প্রবন্ধ লিখেছি। ১৯৭৮ সালে সেই পত্রিকায় ‘প্রাচীন বাংলার ছাপাঙ্কিত মুদ্রা’ শিরোনামে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
আর বই?
আমার বই আবার কে ছাপবে? [হাসি] অজ্ঞাত, অখ্যাত লেখক। ১৯৮৯ সালে ‘প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উয়ারী-বটেশ্বর’ শিরোনামে নিজেই বই বের করলাম। আমার আগে এই প্রত্নস্থান নিয়ে বই আকারে আর কেউ লেখেননি। বইটির দাম ২৫ টাকা। তবে প্রিন্টিং ইত্যাদি মিলিয়ে প্রতি কপিতে ৩০ টাকা খরচ পড়েছে। বইটি কিছু বিক্রি হয়েছিল। এরপর সুফি [মোস্তাফিজুর রহমান] স্যারের সঙ্গে ‘উয়ারী-বটেশ্বর শেকড়ের সন্ধানে’ লিখেছি। এটি ভালো চলেছে। আমাদের এখানকার গুটিকা ও ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রার ওপর আলাদা বই লেখার পরিকল্পনা আছে। আসলে উয়ারী-বটেশ্বর বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্থান। আমরা কেবল এর শুরু করেছি। আমার প্রথম বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন প্রফেসর আবু ইমাম। সেই সুবাদে ১৯৮৮ সালে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। পাণ্ডুলিপি পড়ে তিনি এই প্রত্নস্থানের ব্যাপারে আগ্রহী হলেন। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান ছিলেন। দিলীপকুমার চক্রবর্তী তখন এই বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর।
তাঁরা তো এখানে এসেছিলেন?
তাঁরা দুজন এবং প্রফেসর মোজাম্মেল হক এখানে এলেন। তাঁরা কত কষ্ট করতে পারেন! একটি পিকআপের সামনে ড্রাইভার ও দিলীপবাবু এবং পেছনে আবু ইমাম, মোজাম্মেল সাহেব বসে এলেন। রাস্তা খারাপ বলে তিন কিলোমিটার দূরে গাড়ি রেখে হেঁটে উয়ারীতে পৌঁছলেন। আমরা গেলাম। তখন এই অঞ্চলে সর্বহারাদের ভীষণ উত্পাত। আমরা দেখলাম, আখক্ষেতের ভেতর থেকে চাদর গায়ে পাঁচ-সাতজন লোক বের হয়েছে। চাদরের নিচে হাতিয়ার। মনটা ধুঁকধুঁক করতে লাগল। সামনে এসে তারা বলল, কোথায় যাবেন? বললাম, এঁরা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, গবেষণা করেন, উয়ারী-বটেশ্বর দেখতে এসেছেন। শুনে একদিকে সরে গেল।
তাঁরা কী দেখলেন? দেখে কী বললেন?
আমরা বটেশ্বর, অসম রাজার গড়, পরিখাগুলো দেখে উয়ারী ঘুরলাম। ছাপাঙ্কিত মুদ্রা যেখানে পাওয়া গেছে, সেখানে গেলাম। প্রচুর মৃত্পাত্রের ভগ্নাবশেষ পাওয়া যাচ্ছে—এমন জায়গায়ও গেলাম। দিলীপবাবু খুব উৎসাহিত হলেন। আবু ইমাম সাহেবও বললেন, ‘এটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।’ আমার প্রতি দিলীপবাবুর ধারণা খুব ভালো। তিনি বলেছেন, ‘সংগ্রহকাজের এই যে ক্ষীয়মাণ দশা, তাতে তিনি বিরল ব্যতিক্রম। ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা সংগ্রাহক, তাঁরা এখন ভিন্ন উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করেন। টাকাপ্রাপ্তি, লাভালাভির প্রশ্ন থাকে; কিন্তু এই একজন সংগ্রাহক সারা জীবন ধরে একটি জায়গার তথ্য-উপাত্তের পেছনে জীবনপাত করছেন এবং প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করছেন।’ তাঁর মতে, ‘এটি বিরল ব্যতিক্রম।’ তবে আমার অভিজ্ঞতা হলো, প্রত্নতত্ত্বের চাহিদা আছে; কিন্তু এখান থেকে কিছু পাওয়া যাবে না। উল্টো আরো দিতে হবে [হাসি]। বাংলাদেশ বা ভারতের কোথাও ব্যক্তিপর্যায়ে আমার মতো পাগল আর পাবেন না।
এখানে খনন শুরু হলো কবে?
২০০০ সালে। জাতীয় জাদুঘরের তখনকার পরিচালক ড. এনামুল হক সাহেব উদ্যোক্তা ছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দু-তিনজন প্রফেসরও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। খুব সীমিত আকারে খনন শুরু হয়েছিল। খননে এখানে যে গুটিকা তৈরির কারখানা ছিল, সেটি প্রমাণ হলো। কারণ কাচ ও পাথরের প্রচুর ভাঙাচুরা টুকরো, ভাঙা গুটিকা বেরিয়ে এসেছিল। সেসব টুকরোর কিছু আমার কাছে রয়ে গেছে। ভাঙাচুরা টুকরোও সংগ্রহ করেছি। যা কিছু পেয়েছি, অমূল্য সম্পদের মতো কুড়িয়েছি, কোনো কিছুই ফেলে দিইনি। ২০০০ সালের খননেই মাটির দেয়াল যে খ্রিস্টপূর্বাব্দেও ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মাটির দুই মিটার নিচে মাটির ঘরের ধসে পড়া দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে।
সুফি স্যারের সঙ্গে কি তখনই পরিচয়?
তিনি এর দুই বছর আগেও এখানে এসেছেন। একই পথের পথিক যখন এক জায়গায় মিলিত হন, তাঁদের অন্তরঙ্গতা বাড়ে। তিনিও নিবেদিতপ্রাণ। বিদেশে সভা-সেমিনার, পরিবারপরিজন বাদ দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে উয়ারী-বটেশ্বরে খননের কঠিন কাজ করে চলেছেন। কই, অনেক প্রফেসরই তো আছেন, তাঁদের কেউ তো আর খনন করতে আসেননি। সেই থেকে বরাবর খনন হতে লাগল, ২০১৬ পর্যন্ত চলছে। মাঝে এক বছর গ্যাপ ছিল। তাঁর আবিষ্কারও আছে। ঐতিহাসিকদের মধ্যে এই মতটি প্রাধান্য পেয়েছিল—এখানে মুসলিম শাসনামলের আগে চুন-সুরকির ব্যবহার হয়নি, কিন্তু সুফি স্যার ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত খনন করে উয়ারীতে খ্রিস্টপূর্বাব্দের একটি রাস্তা পেয়েছেন, যাতে চুন-সুরকির ব্যবহার মিলেছে। এটি বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসে বিস্ময়কর ব্যাপার। তিনি গর্তবসতির উপরিভাগ থেকে ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রার ভাণ্ড আবিষ্কার করেছেন। এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে জমা আছে। ভাণ্ডটি খুলে, মুদ্রাগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা অনেক তথ্য পাব। আর প্রতিবারই খননের সময় আমি থাকি।
সংগ্রহের কোনো স্মরণীয় স্মৃতি?
অনেক বাধাবিপত্তি পেরোতে হয়েছে। তার পরও আমার সীমিত জ্ঞান, শ্রমে সংগ্রহ করেছি। যেমন বিষ্ণুপট্ট একটি অনুপম সৌন্দর্যমণ্ডিত পট্ট। সোনারুতলা গ্রাম থেকে ১৯৮৮ সালে এটি আবিষ্কার করেছি। খবর পেলাম, খুব সুন্দর একটি জিনিস পাওয়া গেছে। যার বাড়ি খনন করে এটি পাওয়া গেছে, তিনি আবার আমার সম্পর্কে খালু, নাম বাহাউদ্দিন ভুঁইয়া। তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, এটি সংগ্রহশালায় দিয়ে দিন। তিনি বললেন, ‘না বাবা, দেওয়া যাবে না।’ দু-তিন মাস চেষ্টা করলাম, তিনি দেবেনই না। তাঁর সঙ্গে যাঁদের ওঠাবসা, পট্টটি উদ্ধারের জন্য তাঁদের লাগালাম, কিন্তু তিনি কিছুতেই দেবেন না। আমার তো মাথা নষ্ট হয়ে গেল। এটি না পেলে তো আমার জীবনের কোনো অর্থ হয় না। একদিন সাহস করে ৫০০ টাকা নিয়ে তাঁর বন্ধু আবদুল হাই মাস্টারকে সঙ্গে নিয়ে বেলাব থেকে দুই পদের আড়াই কেজি করে মিষ্টি কিনে তাঁর বাড়ি পৌঁছালাম। তিনি বললেন, ‘বাবা এত সব কেন এনেছ? কী দরকার?’ বললাম, মামা, এগুলো নেন, আসতেও পারি না, খবরও নিতে পারি না। আপনার শরীর কেমন? বন্ধু তাঁকে কি নাকি বললেন। এরপর সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, ‘এই যে বাবা, নাও।’ মনে হলো, আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। এটি বঙ্গ-ভারতের একক, অনন্য নিদর্শন। পট্টটি বহন করে সেদিনই দিলীপবাবু, আবু ইমাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে ঢাকা চলে গেলাম। যেতে যেতে রাত ১১টা। নিউ মার্কেটের এক স্টুডিওতে দিলীপবাবু বিভিন্নভাবে এর ছবি নিলেন। পরে ছোট ভাইয়ের আজিমপুরের বাসায় গেলাম। ওরা অবাক হয়ে রইল, ‘নিউ মার্কেট থেকে এত রাতে এখানে এসেছ? তোমার মালপত্র সব তো ছিনতাই করতে পারত।’ বিষ্ণুপট্টটি যথাস্থানেই আছে। এভাবে সংগ্রহ গড়ে তুলেছি। তবে দুঃখ লাগে, পরিবার-পরিজনকে সাংঘাতিক বঞ্চনা দিয়েছি।
বনবাদাড়, পুকুর, কবরও তো চষে বেড়িয়েছেন।
সেই জীবনটি একদিকে সংগ্রামের, অন্যদিকে আনন্দের ছিল। পদব্রজে ঘুরেছি, সঙ্গে টাকাও খরচ করেছি। টার্গেট শুধু উয়ারী-বটেশ্বরের ইতিহাস কত পুরনো, এর শেকড় কত গভীরে প্রোথিত, সেটি উদ্ঘাটন। এ জন্য বনবাদাড়ে, হাটে-মাঠে, কবরস্থানে, দিবা-দুপুর, সন্ধ্যায় বেড়িয়েছি। ১৯৭৪ সালের দিকে সংগ্রহের কাজ করতে গেলে ৫০ হাত দূরে বজ্রপাত হলো। আমার ছাতা মাথায় ছিল। ছাতাসহ একটু ওপরে উঠে গেলাম। কটূক্তি তো আছেই। অনেকে সন্দেহ করেছে, এগুলো সংগ্রহ করে আমি বিক্রি করি, লাভবান হই। অনেকে এও বলেছে, লেখাপড়া শিখে আর কোনো কাজ পায়নি, এসব চারা [মৃত্পাত্রের টুকরো] টোকাতে এসেছে।
‘বটেশ্বর প্রত্ন-সংগ্রহশালা ও পাঠাগার’ কবে গড়ে তুললেন? এখানে উল্লেখযোগ্য কী আছে?
এই প্রত্ন-সংগ্রহশালাটি ১৯৭৪ সালে স্থাপিত হয়। তবে আমার সংগ্রহ আরো আগের। এটি বাবার উৎসাহে করা। এখানে কিছু সংগ্রহ আছে—[জাদুঘরের শোকেসের সামনে দাঁড়িয়ে সব দেখালেন] একটি গাছের গোড়া থেকে [প্রস্তরীভূত কাঠ] ফসিল উডের বাটালি সংগ্রহ করেছি। খ্রিস্টপূর্বাব্দ যুগের অন্তত ৫০-৬০টি পাথরের বাটখারা খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করেছি। ২০টি লকেট পেয়েছি, একজীবনে এত মন্ত্রপূত কবচ সংগ্রহ করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। এগুলোর মধ্যে ত্রিরত্ন, ঘুমন্ত হাঁস, কচ্ছপ, সিংহচিহ্নিত লকেটও আছে। তারা বিশ্বাস করে এগুলো পরত। কচ্ছপের লকেট পরলে তারা মনে করত—দীর্ঘায়ু হবে। আমার উয়ারী-বটেশ্বরের কালেকশনের সবই বিশিষ্ট। এই যে কালো মসৃণ মৃত্পাত্র, এটি খ্রিস্টপূর্বাব্দ আমলের। পুকুর খোঁড়া হচ্ছিল, সেখান থেকে নিজে খুঁড়ে বের করেছি। ওরা তো জোরে কোপাবে, ভেঙে যাবে, আমি আস্তে আস্তে বের করেছি। এটি লোটা [বদনা], বটেশ্বরে পেয়েছি, মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। যেখানে এটি পাওয়া গেছে, সেটি সম্ভবত পরিত্যক্ত আঁস্তাকুড় ছিল, তাতে এগুলো অনেক ছিল। আস্ত ছিল বলে এটি নিয়ে এসেছি। এগুলো উত্তরভারতীয় মসৃণ কালো মৃত্পাত্র, অভিজাত পরিবার ব্যবহার করত। এগুলো ভাঙা টুকরো হলেও এখনকার মৃিশল্পীরাও এমন পলিশ দিতে পারে না। দুই হাজার বছর মাটিতে পড়ে থেকেও উপরিভাগের প্রলেপ চকচক করছে। এটি মৃত্পাত্রগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য, গবেষণার অমূল্য উপকরণ। ২০০০ সালে এই লোহার বল্লমগুলো বটেশ্বর গ্রামে পেয়েছি। মাটি খুঁড়তে গিয়ে শ্রমিকরা খ্রিস্টপূর্ব আমলের ৮০০ লোহার কুঠার পেল। অনেক অনুরোধ করলাম, তারা আমাকে দেয়নি। পরে ৪০ টাকা মণ দরে কামারের কাছে বিক্রি করেছে। আট-দশটি আমার কাছে আছে, ঢাকা জাদুঘরেও ৩০টি দিয়েছি। এটি আড়াই হাজার বছরের আগের তাম্র প্রস্তর যুগের ব্রোঞ্জের বলয়। মাটি খুঁড়তে গিয়ে দেখল, একটি বড় কড়াইয়ের মধ্যে জমাট অবস্থায় চার-পাঁচ শ বলয় আছে, আমি সেগুলো সংগ্রহ করতে পারলাম না। তবে এই কড়াই থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ শিব-নৈবেদ্যপাত্র সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম। আর বলয়গুলোর চার-পাঁচটি আমার কাছে আছে। তিন ধরনের পাথরের শিবলিঙ্গ পেয়েছি, শিবের পূজা কিন্তু বহু পুরনো। আমার বাড়িতে ঘর খুঁড়তে গিয়ে সাতটি লোহার কুঠার পেয়েছি। এই ভস্মাধার দুটিতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ছাই ছিল। ছাইগুলো রক্ষা করতে পারিনি, শ্রমিকরা এলোমেলো করে ফেলেছে। তবে পাত্র দুটি পেয়েছি। অনেক রকমের জাল ডোবানোর জালের কাঠি পেয়েছি। এটি হলো পাত্রের কাঁধ। এই দুটি লোহার কুঠার বানানোর নেহাই, ১৯৭৪ সালে উয়ারী গ্রামে খোঁড়াখুঁড়িতে মাটির নিচ থেকে উঠে এসেছে। এগুলো এই অঞ্চল থেকে সংগৃহীত নানা ধরনের পাথর। কোনোটি স্থানীয়, কোনোটি বাইরের। এখানে নানা ধরনের পাথরের ব্যবহার দেখা যায়। যেটি অন্য কোথাও দেখা যায় না। এই কড়িগুলো মুদ্রারূপে চলত। এই যে হাতির পায়ের তিনটি খুরা—বটেশ্বর, রাঙ্গারটেক ও উয়ারীতে পেয়েছি। এখানে একসময় প্রচুর হাতি ছিল। এটি বড় পাতিলের হাতলের একদিক, উয়ারীতে পেয়েছি। সব তো আমার কাছে নেই, আমার জায়গাও নেই। সংগ্রহও ছড়ানো ছিটানো আছে। এর পেছনে কত টাকা খরচ হয়েছে, হিসাব রাখিনি। কত খরচ হয়েছে সেই বাজে অজুহাত আর প্রয়োজন নেই। কারণ আমার লক্ষ্য—জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছি।
আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া এবং ড. এনামুল হক এসেছিলেন।
তাঁরা ১৯৭৩ সালে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে গাড়ি রেখে হেঁটে এসেছেন। তাঁরা স্রেফ জায়গাটি দেখে গেছেন। আমার সংগ্রহ তখন এ ঘরে ছিল না। আলমারিটি ভেতরের রুমে ছিল। তাঁরা এটি দেখেছেন। তখন বাড়িতে ছিলাম না। যাকারিয়া সাহেবের মন্তব্য মনে নেই। তবে ১৯৮৯ সালে বগুড়া ইতিহাস পরিষদ সম্মেলনে উয়ারী-বটেশ্বর নিয়ে পাথরের ছুরিটি ধরে একটি প্রবন্ধ পাঠ করলাম। সেখানে বলেছি, এখানে নব্য প্রস্তর যুগের মানুষও বসবাস করত। আমরা যদি নিয়মতান্ত্রিক খননের দিকে এগিয়ে যাই, তাদের বসতির সন্ধান মিলতে পারে। এক উন্নাসিক সমালোচক পরে আমাকে খুব হেস্তনেস্ত করলেন। তিনি বললেন, ‘তিনি এসব তথ্য কোথায় পেলেন? সব অহেতুক।’ যাকারিয়া সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘অহেতুক শব্দ পরিহার করে আগে তাঁর বক্তব্য শোনেন, উয়ারী-বটেশ্বর খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল।’ আমি রক্ষা পেলাম। তিনি পরেও দুই দফা এখানে এসেছেন। আমরা পিতা-পুত্র ১৯৭৪ সালে তাঁর ধানমণ্ডির ১৬ নম্বর লেক সার্কাসের বাসায় গিয়েও দেখা করেছি। সেবার ৩০টি লোহার কুঠার জাদুঘরে অর্পণ করেছি। তিনি আমার সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। ২০১০ সালে উয়ারীতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের বিদায়ী অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে এসে বলেছেন, ‘এখানে আমার তরুণ বন্ধু হাবিবুল্লা পাঠান উপস্থিত আছেন।’ তিনি বিশাল হৃদয়ের অধিকারী, পণ্ডিত লোক ছিলেন।
জাদুঘরের অবৈতনিক সংগ্রাহক কিভাবে হলেন?
উয়ারী-বটেশ্বর একটি বিখ্যাত প্রত্নক্ষেত্র। এখানে অনেক কিছু পাওয়া যায়। এ জন্য ড. এনামুল হক ১৯৭৫ সালে বললেন, ‘এখানকার অবৈতনিক সংগ্রাহক হিসেবে থাকেন।’ সে পদে নিযুক্ত হলাম। তখন জিরাহী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। মাটি খনন করতে গিয়ে একজন কুঠারগুলো পেয়েছিল। তখনকার দিনে ১০০ টাকা দিয়ে কুঠারগুলো কিনে জাদুঘরে পাঠালাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল, ব্যক্তিগতভাবে উয়ারী-বটেশ্বর নিয়ে আমি কী আর করতে পারব, এটি জাতীয়ভাবে আলোচিত হোক, এটি নিয়ে গবেষণা হোক। তাহলে হয়তো উয়ারী-বটেশ্বরের রহস্য বেরিয়ে আসবে। এই সুবাদে বহু ছাপাঙ্কিত মুদ্রা, লোহার বল্লম, লোহার কুঠার, প্রচুর গুটিকা জাদুঘরে অর্পণ করেছি। দু-একবার দেখেছি, ছাপাঙ্কিত মুদ্রা ও কুঠার প্রদর্শিত হচ্ছে। সব তো আর প্রদর্শিত হয় না। তবে সেগুলো এখন কী অবস্থায় আছে জানা নেই। আর এই চাকরিতে বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকতে হয়। সংগৃহীত সব জিনিস ওখানে পৌঁছাতে হয়। সংগ্রহও কঠিন কাজ। এসব কারণে এক বছর চাকরি করে এই পদে আর থাকিনি।
একসময় ছোট ছেলেমেয়ে আপনাকে দেখেই ছুটে আসত?
আমি অনেকটা হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো ছিলাম। উয়ারী-বটেশ্বর বা সোনারুতলা গেলেই ২০-৫০টি ছোট ছেলেমেয়ে আমার পেছনে পেছনে আসত। ওরা যা কিছু পেত, আমাকে দিত। বিনিময়ে আমি টাকা দিতাম। এই ছোটদের কাছ থেকে অনেক দুর্লভ প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করেছি। সূর্য প্রতীক সংবলিত একটি গুটিকা পেয়েছি, ছিদ্রহীন খুব দুর্লভ একটি গুটিকাও পেয়েছি। ১৯৯০ থেকে ২০১৩ সালের গোড়ার দিক পর্যন্ত আমার স্ব-উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি চালু ছিল। তার পর থেকে সংগ্রহে বের হই না।
কেন?
২০১৩ সালে সরকার একটি জাদুঘর স্থাপনের জন্য টাকা মঞ্জুর করল। জাদুঘর কোথায় হবে? সুফি স্যার উয়ারী গ্রামে গিয়ে বললেন, জাদুঘরের জায়গা দেন। ওরা দিতে অস্বীকার করল। তারপর আমি দিলাম। আমার ভাইয়েরা মিলে চার বিঘা দুই কাঠা [৮২ কাঠা] জমি দিয়েছি। এর মধ্যে ৪০ কাঠা আমার। আমার তো জায়গাজমি খুব বেশি নেই। এখন তো আমার বাগবাগিচা শূন্যের কোঠায়, ভাইদের কিছু আছে। পৈতৃক সম্পত্তি দিয়ে কী হবে? আমার বই আছে। বইয়ের ভেতর ডুবে গেছি। বই আমাকে যা দিয়েছে, মানুষের কাছে পাইনি। বন্ধুবান্ধব এসেছে, স্বার্থের দ্বন্দ্ব্বে চলে গেছে, কিন্তু বই আমাকে পরম আনন্দ দিয়েছে। বাকি জীবনও দেবে। এই কারণে আমার সাহস, শক্তি এত বেশি।
জমি দেওয়ার পর কী হলো?
উয়ারীবাসী আমাদের পিছে লাগল। সুফি স্যার ও আমার নামে দুটি মামলা হলো। কোর্টে যেতে হলো, টাকা নষ্ট হলো। তারা টিভি সাংবাদিক এনে বিরাট মিটিং করে আমাদের কুশপুত্তলিকা দাহ করল। মামলা দেড় বছর চলল। এরপর সেটি ডিসমিস হলো।
জাদুঘরের এখন কী অবস্থা?
টাকা জেলা পরিষদে পড়ে আছে। আশায় আছি—জাদুঘর হবে। তবে এখনো হচ্ছে, হবে চলছে। কবে হবে জানি না। আমি তো ২০১৩ সালের জুন মাসেই জায়গা দিয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর কোথাও কিন্তু গণ্ডগ্রামে বেসরকারি খাতে সরকার জাদুঘর করতে দেয়নি। উয়ারী-বটেশ্বর যেহেতু বিশেষ প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গা, সে কারণে এটি করতে দিয়েছে। জাদুঘরের নাম হবে ‘গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘর’। ১৯৮৯ সালে ‘প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উয়ারী-বটেশ্বর’ বইয়ে প্রশ্ন রেখেছিলাম, আলেকজান্ডার পাঞ্জাব থেকে গঙ্গারিডায়ি জাতির ভয়ে চলে গিয়েছিলেন। সেই জাতির বসবাস কী উয়ারী-বটেশ্বরে? এই যে লোহার কুঠার, এগুলো এই অঞ্চলে ১২ হাজার পাওয়া গেছে। এ বৈশিষ্ট্যের কুঠার বঙ্গ-ভারতের কোথাও নেই। এগুলো কি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রয়োজনে তৈরি? না রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে? কোন রাষ্ট্র? আমার মধ্যে প্রশ্নটি জেগেছিল। উয়ারী-বটেশ্বর এবং তার সন্নিহিত ৫২টি প্রত্নক্ষেত্রে নিজের ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে বলছি, এখানেই গঙ্গারিডায়ি জাতির বসবাস ছিল। গড়, পরিখায়ও লোহার কুঠার পাওয়া গেছে। এই উয়ারী-বটেশ্বরই যে এই গঙ্গারিডায়ি জাতির রাজধানী ছিল, এই সিদ্ধান্তের খুব কাছাকাছি ভাবনায় আমি পৌঁছে গেছি। অর্থাৎ আলেকজান্ডার পাঞ্জাবে এসে জানতে পারলেন যে পূর্ব ভারতে গঙ্গারিডায়ি জাতি বসবাস করে। তাদের বিরাট হস্তীবাহিনী আছে, এরা অত্যন্ত পরাক্রমশালী। ফলে গ্রিক সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। তিনি ফিরে যান।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ৮:১১

শায়মা বলেছেন: অজানা ইতিহাস।
জেনে ভালো লাগলো ।
কোন পত্রিকায় ছেপেছিলো এই লেখা ভাইয়া?

৩০ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ৯:১০

অপার্থিব ছায়া বলেছেন: দৈনিক ইত্তেফাক

২| ৩০ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ৮:১২

নিমো বলেছেন: দৈনিক পত্রিকার নামটা কী ?

৩০ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ৯:১০

অপার্থিব ছায়া বলেছেন: দৈনিক ইত্তেফাক

৩| ৩০ শে এপ্রিল, ২০২২ রাত ১০:৫৪

প্রতিদিন বাংলা বলেছেন: অজানা কিছু জানা হলো

৪| ০১ লা মে, ২০২২ রাত ১২:২৫

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: ইত্তেফাকে তো এই ধরনের কোন লেখা খুঁজে পেলাম না। পেলাম তো কালের কন্ঠে।

৫| ০১ লা মে, ২০২২ রাত ৩:১০

জ্যাকেল বলেছেন: পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম, উচ্ছসিতও ছিলাম কিন্তু এখন তো প্রশ্ন জাগছে লেখাটা কি আপনার নিজের?

৬| ০১ লা মে, ২০২২ সকাল ৮:৩০

বিজন রয় বলেছেন: অনেক কিছু জানতে পারলাম।
পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.