![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
I am a social worker.
পবিত্র রমজানে আত্মশুদ্ধির চেতনায় জাগ্রত হোক বিশ্ব মানবতা
--প্রভাষক বি এইচ মাহিনী
বিশ্ব মানবতার কল্যাণের বারতা নিয়ে ধরার বুকে আসীন হলো রমজান। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে প্রতি বছর হাজির হয় পবিত্র মাহে রমজান। তাইতো বিশ্ব মানবতা মাঝে এ মাসে আত্মশুদ্ধির চেতনা জাগ্রত হয়। শুধু আত্মশুদ্ধিই নয়; বরং এ মাসে সিয়াম সাধনার ফলে রোজাদারের দৈহিক সুস্থতাও ফিরে আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান ও আশেপাশের হাসপাতাল, ক্লিনিক এবং ফার্মেসি সূত্রে জানা যায়, এ মাসে প্রায় সব ধরণের রোগ প্রশমিত থাকে। দেহ ও মনের প্রশান্তির মাস তাই রমজান। সিয়াম সাধনার মাধ্যমেই মানুষ তার নিজের অবস্থার পরিবর্তন সাধন করতে পারে। সূরা আনফালের ৫৩ নম্বর আয়াতে ঘোষিত হয়েছে, ‘যদি কোনো সম্প্র্রদায় নিজের অবস্থার পরিবর্তন না করে তবে আল্লাহ এমন নন যে, তিনি তাদের যে সম্পদ দান করেন তিনি তা পরিবর্তন করবেন; এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ সূরা আর রাদের ১১ নম্বর আয়াতে আরও স্পষ্টভাবে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের জন্য তার সামনে ও পেছনে একের পর এক প্রহরী থাকে; তারা আল্লাহর আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে। এবং আল্লাহ কোনো সম্প্র্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে। কোনো সম্প্র্রদায়ের সম্পর্কে যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন তবে তা রদ করার কেউ নেই এবং তিনি ছাড়া তাদের কোনো অভিভাবক নেই।’
মহান রব্বুল আ’লামিনের নিয়ামত স্থায়িত্বের যে নিয়ম বা মূলনীতি তা হলো কোনো ব্যক্তি বা জাতিকে যে নিয়ামত দান করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তা ফিরিয়ে নেওয়া হয় না, যে পর্যন্ত না নিজের বা নিজেদের অবস্থা ও কার্যকলাপকে পরিবর্তিত করে আল্লাহর আজাবকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এখানে অবস্থা পরিবর্তনের অর্থ হলো ভালো ও সৎ অবস্থা বা কর্মের পরিবর্তে মন্দ অবস্থা ও কার্যকলাপ অবলম্বন করা কিংবা আল্লাহর নিয়ামত আগমনের সময় যেসব মন্দ ও পাপ কাজে লিপ্ত ছিল নিয়ামতপ্রাপ্তির পর তার অধিক মন্দ কাজে লিপ্ত হওয়া। নিয়ামত প্রাপ্তির পর তার জন্য শুকরিয়া আদায় করা, সচেতন দায়িত্ব পালনের দ্বারা এর মর্যাদা রক্ষা করা এবং নিজেদের মধ্যে সংশোধনীয় বিষয়গুলোর ব্যাপারে সচেতন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বিবেক, বুদ্ধি ও ভালো, মন্দ জ্ঞানসহ সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। সিয়াম পালনের একটি অন্যতম পূর্বশর্ত হলো সংযম। রোজা পালনের দ্বারা প্রবৃত্তির ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। এর দ্বারা মানুষের পাশবিক শক্তি অবদমিত হয় এবং রুহানী শক্তি বৃদ্ধি পায়। কেননা ক্ষুধা ও পিপাসার কারণে মানুষের জৈবিক ও পাশবিক ইচ্ছা হ্রাস পায়। এতে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়। যে কোনো পরিস্থিতিতে ধৈর্য অবলম্বন, সহনশীলতা প্রকাশ, পারস্পরিক সম্ভ্রমবোধ ও সৌজন্য প্রদর্শন, সর্বোপরি সব কার্যকলাপে মুক্তবুদ্ধি বিবেচনা প্রসূত মাত্রা ও মূল্যবোধের অনুসরণ ব্যক্তি তথা সমাজ জীবনের অনিবার্য অবলম্বন হওয়া আবশ্যক। চলনে বলনে চিন্তা-চেতনায় আগ্রহ-আকাক্সক্ষায় আবেগ-উৎকণ্ঠায় আনন্দ সর্বনাশে সর্বত্র একটা মধ্যপন্থা অবলম্বনের ওপর আল-কুরআনে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এটা অনস্বীকার্য যে, যে কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ভিন্নতর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। যেমন মাত্রা অতিক্রম করলেই সাহস হঠকারিতায়, আত্মোৎসর্গ আত্মহত্যায়, প্রতিযোগিতা হিংসায় পরিণত হতে পারে। অবস্থাবিশেষে সমালোচনা পরচর্চায়, প্রশংসা চাটুবাদে, তেজ ক্রোধে, দেশপ্রেম দেশদ্রোহিতায় এবং অতিধর্মপ্রীতি ধর্মান্ধতার স্তরে নেমে আসতে পারে।
পবিত্র কুরআনে পরিমিতিবোধের ব্যাপারে বহুবার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। লুকমান হাকিম তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিচ্ছেন, ‘অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না। কারণ আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। তুমি পদক্ষেপ করো সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করো; স্বরের মধ্যে গর্দভের স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’ সূরা লুকমান : ৮-১৯। ক্যানভাসে রং ও তুলির সুষম সমন্বয়ে শিল্পের সার্থকতা ফুটে ওঠে। পারিপার্শ্বিক সবকিছুর পরিমিত অবস্থান ও শৃঙ্খলামণ্ডিত উপস্থাপনার মধ্যেই সৌন্দর্যের যথার্থ বিকাশ। নিয়মনিষ্ঠা ও সহনশীলতা যে কোনো পরিবেশ-পরিস্থিতিতে মেজাজ-মর্জি, আস্থা ও অবস্থান এমনকি প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ক্ষেত্রেও দান করে এক অনুপম মর্যাদা। ওভারটেকিং প্রবণতায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘিত হলে যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় তাতে দুর্ঘটনাই ঘটে। দেহে রক্তচাপের স্বাভাবিক মাত্রা অতিক্রান্ত হলে নানান আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। সংগীতে সাতটি স্বরের মধ্যে পঞ্চমটিই মিষ্ট ও সুষম; সপ্তম সুর তো চড়া সুর। রাত ও দিনের মধ্যবর্তী প্রভাত ও গোধূলিবেলা সবচেয়ে পেলব প্রশান্তির মুহূর্ত। অর্থনীতিবিদরা স্পষ্টতই মত প্রকাশ করেছেন, অর্থ সরবরাহে অসম আচরণ এবং সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম কারণ এবং মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতির অন্যান্য শৃঙ্খলাকে সংক্রমিত করে বিপর্যস্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অনভিপ্রেত প্রতিযোগিতা শৃঙ্খলা ও ভারসাম্যে হানে আঘাত; পরিবেশ-প্রতিবেশ হয় কলুষিত।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তি তথা সামষ্টিক জীবনে সর্বক্ষেত্রে ও পর্যায়ে সংযম ও সহনশীলতা প্রদর্শনের, যুক্তিনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ মধ্যপন্থা অবলম্বনের আবশ্যকতা রয়েছে। সূরা ফুরকানের ৬৭ নং আয়াতে এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, ‘যখন তারা ব্যয় করে তখন তারা অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা আছে এই উভয়ের মাঝে, মধ্যম পন্থায়।’ সূরা বনি ইসরাইলের ১১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সালাতে স্বর উচ্চ করো না এবং অতিশয় ক্ষীণও করো না; এ দুইয়ের মধ্যপথ অবলম্বন কর।’ ।
আমাদের বিশ্বাসে ও ব্যবহারে, জীবনযাপন ও মানবিকতায় মাত্রা অতিক্রমকারী বনি ইসরাইল, লুত ও সামুদ জাতির অশুভ পরিণতির কথা পবিত্র কুরআনে প্রায়শই উদাহরণস্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। সংযম ও সহনশীল হওয়ার উপদেশ বার বার দেওয়ার পর, আল কোরআনে একাধিক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন সূরা মায়েদা’ ৮৭; ও সূরা বাকারা’র ১৯০নং আয়াতে মাত্রা অতিক্রমকারীর অশুভ পরিণতি এবং বলা হয়েছে আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন না। পবিত্র কুরআনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, আচার-আচরণ, চিন্তা-চেতনায় ও কার্যকলাপে মাত্রা অতিক্রমকারীদের স্বাভাবিক সুচিন্তাবোধ ও বুদ্ধি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। পবিত্র কুরআনের সুরা ইউনুসের ১২ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মানুষকে যখন দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করে তখন সে শুয়ে-বসে অথবা দাঁড়িয়ে আমাকে ডেকে থাকে; অতঃপর আমি যখন তার দুঃখ-দৈন্য দূরীভূত করি, সে এমন পথ অবলম্বন করে, যেন তাকে যে দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করেছিল তার জন্য সে আমাকে ডাকেইনি। যারা সীমালঙ্ঘন করে তাদের কর্ম তাদের কাছে এভাবে শোভন প্রতীয়মান হয়।’ পবিত্র রমজান মাসে আত্মশুদ্ধি ও আত্মগঠনের নিমিত্তে আমাদের মধ্যপন্থা অবলম্বন করা করা একান্ত জরুরী।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র
প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, অভয়নগর, যশোর।
©somewhere in net ltd.