![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হে মানব জাতি। তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর এবং ভয় কর এমন এক দিবসকে. যখন পিতা পু্ত্রের কোন কাজে আসবে না এবং পুত্রও তার পিতার কোন উপকার করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর ওয়াদা সত্য। অতএব পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকা না দেয় এবং আল্লাহ্ সম্পকে প্পতারক শয়তানও যেন তোমাদেরকে প্পতারিত না করে । আল-কুআন
সাধারণত মানুষ মনে করে যে, হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর ওফাতের পর মদীনা, মক্কা ও তায়িফ ছাড়া সমগ্র আরবদেশ এরুপ মুরতাদ হয়ে যায় যে, লোকেরা তাওহীদ ছেড়ে শিরকে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল এবং আল্লাহর স্থলে মূতিপূজা শুরু করে দিয়েছিলো। অথচ এটা মনে করা সম্পূর্ণ ভুল ও বাস্তবতাবর্জিত। প্রকৃত ঘটনা ছিল এই যে, মিথ্যাবাদীরা অর্থাৎ নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদাররাও সালাত প্রভৃতি ইবাদতকে অস্বীকার করতো না। তারা ইসলাম ত্যাগ করে কুফর ও শিরক গ্রহণ করেনি, বরং ইসলামের কোন কোন রুকন বিশেষ করে যাকাত দিতে অস্বীকার করে। এ অস্বীকারের কারণ ছিল আরব জাতি-গোষ্ঠীর প্রাচীন লাগামহীনতা ও উচ্ছৃংখলতা। ইসলাম মানুষের উপর যাকাত ফরয করেছিল। এটা ছিল ট্যাক্স বিশেষ। মালের পরিমাণ হিসাবে সাহেবে নিসাব লোকদেরকে তা (ট্যাক্স) আদায় করতে হতো। এই ট্যাক্স বা খাজনাকে স্বাধীনচেতনা লোকেরা তাদের জন্য একটি বোঝা স্বরুপ মনে করতো। যারা তখনো ভাল মতো ইসলামের স্বাদ আস্বাদন করেনি, তারা এই ইসলামী খাজনা পরিশোধ করতে অস্বীকার করে। অবশিষ্ট ইসলাম ধর্মকে তারা অস্বীকার করেনি । যাকাত অস্বীকার যেহেতু জাতি-গোষ্টীর মেজায ও বৈষয়িক স্বার্থেও অনুকূল ছিলো, তাই এই অস্বীকৃতির মধ্যে এক এক করে গোটা দেশ শরীক হয়ে যায়। কিন্তু এটা যেহেতু একটি বিদ্রোহ ছিল, তাই নও-মুসলিম বিদ্রোহীদেরকে মুসায়লামা ও তুলায়হা প্রমুখ মিথ্যাবাদীরা নিজেদের দিকে আকর্ষণ করার এবং আর্থিক ইবাদত ছাড়া দৈহিক ইবাদতের মধ্যেও লাঘব ঘটিয়ে নিজ নজি নবুওয়াত মানানোর সুযোগ পায়।
যাহোক, শিরক ও মূর্তিপূজার বিষয়টি আদৌ আলাচনাধীন ছিল না। কিন্তু দীন ইসলাম মানব জাতির মধ্যে যে নিয়ম-শৃংখলা ও বিধি-ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিল, তা বাহ্যত ওলট-পালট হতে বসেছিল। এই ঘোর বিপদের চিকৎসা ছিল মুশরিক ও কাফিরদের যুদ্ধবাজি থেকেও অধিক শক্ত ও কঠিন। কেননা, যাকাত অস্বীকারকারীদের সংকল্প ও ঘোষণা শোনামাত্রই হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) সাহাবায়ে কিরামকে একত্রিত করে পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত করেন। সভায় কোন কোন সাহাবা এই মত প্রকাশ করেন যে, যাকাত অস্বীকারকারীদের সাথে মুশরিক ও কাফিরদের ন্যায় যুদ্ধ করা ঠিক হবে না। কিন্তু এ অভিমতটিও ছিল ঠিক তেমনি দুর্বল, যেমন উসামা বাহিনীর যুদ্ধযাত্রার বিরুদ্ধে কোন কোন লোক প্রকাশ করেছিল। আর যে ভাবে এই অভিমত হযরত সিদ্দীকে আকবর (রা) মানেননি, তেমনিভাবে এই দুর্বল মতটিও তিনি গ্রহণযোগ্য মনে করেন নি। তিনি বলেন, “আল্লাহর কসম! যাকাতের একটি জন্তু বা একটি শস্যকণাও যদি কোন গোত্র পরিশোধ না করে, তবে আমি তার বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ করবো।” মুরতাদদের প্রতিনিধি দল মদীনা মুনাওয়ারায় আগমন করে আবেদন করেছিল : সালাত আমরা আদায় করছি, যাকাত আমাদেরকে মাফ করে দিন। কিন্তু হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর নিকট থেকে ঐ সাফ জবাব শুনে তারা নিজ নিজ গোত্রের মধ্যে ফিরে গেল। তৎণাৎ সারা দেশে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর এই দৃঢ় সংকল্পের খবর পৌছে গেলো এবং মুরতাদ ও যাকাত অস্বীকারকারীরা মুকাবিলা ও যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলো। প্রদেশসমূহের আলিমগণ তাঁদের নিজ নজি প্রদেশের লোকদের বিদ্রোহী হওয়া এবং যাকাত আদায় না হওয়ার সংবাদ পাঠান। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) পূর্ণ প্রস্তুতি, পূর্ণ সাহস ও স্থৈর্যের সাথে একজন সজাগ-মস্তিস্ক ও রাষ্ট্রনায়ক শাহানশাহরুপে আলিমদের প্রতি যথাযথ নির্দেশনামা এবং গোত্রপতিদের নামে প্রেরণ করেন। একদিকে উসামা বাহিনী রোমকদের সাথে যুদ্ধরত ছিল, অন্যদিকে মদীনার আশেপাশে সমবেত মুরতাদগণ মদীনার উপর হামলা করার হুমকি দিচ্ছিল। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) যেমন দূর-দূরান্তের মুরতাদদের নিকট চরম হুমকিমূলক পত্র প্রেরণ করেছিলেন, তেমনি আশেপাশের বিদ্রোথীদের হামলা প্রতিরোধ করার জন্যও প্রস্তুত ছিলেন।
তিনি মদীনা মুনাওয়ারার তদানীন্তন মুসলমানদের যুদ্ধযোগ্য লোকদেরকে মসজিদে নববীর সামসে সর্বণ উপস্থিত ও প্রস্তুত থাকার জন্য নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন এবং হযরত আলী (রা), হযরত যুরায়র (রা), হযরত তালহা (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা)-কে মদীনা মুনাওয়ারার আশপাশ পাহারা দেওয়ার জন্য আদিষ্ট করে রেখেছিলেন, যাতে মদীনার উপর কোন গোত্র আক্রমণ করলে সঙ্গে সঙ্গে সে খবর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর নিকট পৌছতে পারে । আবরাক নামক স্থানে আবস গোত্র এবং যুল-কিসসা নামক স্থানে যুবয়ান গোত্র অরস্থান করছিল। বনূ আসাদ ও বনূ কিনানারও কিছু লোক তাদের মধ্যে ছিল। আবস ও যুবয়াস গোত্রদ্বয় যখন জানতে পারলো যে, মদীনা মুনাওয়ারায় তখন স্বল্প সংখ্যক লোক অবশিষ্ট রয়েছে এবং যাকাত মাফ করার কথা হযরত সিদ্দীকে আকবর (রা) পরিস্কার অস্বীকার করেছেন, তখন তারা একমত হয়ে মদীনার উপর হামলা করলো। এই হামলাকারীদেরকে হযরত আলী (রা) মদীনার বাইরেই প্রতিরোধ করে মদীনায় সিদ্দীকে আকবর (রা)-এর নিকট সংবাদ প্রেরণ করেন। এদিকে থেকেও অনতিবিলম্বে সাহায্য প্রেরিত হলো। মুসলমানরা যু-খাশাব পর্যন্ত তাদেরকে হটিয়ে দিলেন। শত্র“রা পরাজিত হয়ে পলায়ন করলো বটে, কিন্তু ভিন্ন পথে দফ ও নানরকম বাজনা বাজাতে বাজাতে ফিরে এলো। এতে মুসলমানদের উটগুলো ভয় পেয়ে মদীনায় পালিয়ে আসে। এই অবস্থা দেখে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) নিজে মদীনা থেকে বের হলেন এবং শত্র“র উপর হামলা করেন। পাঁচ-ছয় ঘন্টার রক্তয়ী যুদ্ধে মুরতাদরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং মুসলমানদের হাতে বহু লোক নিহত হয়।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) হযরত নু’মান ইবন মুকাররিন (রা) ও ছোট্র একটি দলের মাধ্যমে গনীমতের মাল মদীনায় প্রেরণ করেন এবং স্বয়ং শক্রও পশ্চাদ্ধাবনে যুল-কিসসা নামক স্থান পর্যন্ত অগ্রসর হন। এদিকে শক্রদের একটি বিরাট দল ধোঁকা দিয়ে এবং দৃষ্টি এড়িয়ে মদীনা আক্রমণ করলো। তারা কতক মুসলমানকে শহীদ করলো এবং মালে গনীমত পুনরুদ্ধার করে চলে গেল। আবূ বকর সিদ্দীক (রা) ফিরে এসে এই ঘটনা শ্রবণ করে যারপরনাই দুঃখিত হলেন এবং শপথ করলেন যে, মুরতাদদের হাতে যতজন মুসলমান শাহাদাত বরণ করেছেন, ততজন মুরতাদ হত্যা না করে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবো না। তিনি এই সংকল্প ও আয়োজনে রত থাকাবস্থায়ই হযরত উসামা (রা) মালে গনীমতসহ মদীনায় প্রবেশ করেন। তিনি উসামা (রা) ও তাঁর বাহিনীকে সফরের কান্তি দূরীকরণার্থে মদীনায় আরাম করার জন্য রেখে খোদ মদীনার মুসলমানদের ছোট্র দলটি নিয়ে যুল-খাশাব ও যুল-কিসসার দিকে বের হয়ে পড়লেন। আবরাক নামক স্থানে আবস,যরয়ান, বনূ বকর, ছা‘লাবা ইবন সা‘দ প্রভৃতি গোত্র মুকাবিলায় প্রবৃত্ত হলো। ঘোর যুদ্ধ সংঘটিত হলো। শেষে মুরতাদরা পরাজিত হয়ে পলায়ন করলো। আবরাক নামক স্থানে হযরত সিদ্দীকে আকবর (রা) অবস্থান করলেন এবং বনূ যুবয়ানের জায়গাগুলো মুসলমানদের প্রদান করলেন। তাদের চারণভূমিগুলো মুজাহিদদের ঘোড়ার জন্য ওয়াকফ করলেন। এরপর সেখান থেকে তিনি যুল-কিসসা নামক স্থান পর্যন্ত গমন করেন এবং দুশমনদের ইচ্ছামতো কানমলা দিয়ে মদীনায় প্রত্যাগমন করেন। এতক্ষণে উসাম বাহিনীরও কান্তি দূর হয়েছিল।
আরবদেশে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) যেসব লোকের সাথে মুকাবিলা ও যুদ্ধ করেছিলেন, তারা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম, সেসর লোক-যারা নজ্দ, ইয়ামান, হাযরামাউত প্রভৃতি এলাকায় মুসায়লামা, তুলায়হা, সাজা প্রমুখ মিথ্যা নবুওয়াতদাবীকারীদের সাথে একমত হয়ে গিয়েছিল। এদের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষেত্রে কোন সাহাবীর দ্বিমত ছিল না। দ্বিতীয় সেসব গোত্র- যারা যাকাত পরিশোধ করতে অস্বীকার করতো । এদের সাথে যুদ্ধ করা কোন কোন সাহাবী সমীচীন মনে করেননি। কিন্তু হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর রায় প্রদানের পর সব সাহাবীই তাঁর রায়ের সাথে একমত হন। এই দুই ধরনের লোকের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য তো অবশ্যই ছিল, কিন্তু মুসলমানরা যখন উভয়ের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করা সমান জরুরী সাব্যস্ত করেন, তখন ঐ দুই শ্রেণীর মধ্যে কোন পার্থক্য ও তফাৎ অবশিষ্ট ছিল না। আর প্রকৃত ঘটনাও এই যে, এই উভয় শ্রেণীই দুনিয়াদারী ও জড়বাদিতার একই সয়লাবে ভেবে গিয়েছিল যাদেরকে সিদ্দীকী কৌশল ও আধ্যাত্মিকতা ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করে এবং এই ধ্বংসকারী তুফান থেকে নাজাত দিয়ে আরব সেনাবাহিনীকে বিজয়ের শীর্ষে নিরাপদে পৌছে দেয়।
*** ইসলামের ইতিহাস***
©somewhere in net ltd.