![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফাল্গুনের প্রথম দিনে নতুন রঙ্গীন পাঞ্জাবী পরে অফিসে আসছি। সহকর্মী সকলের সাথে ফাল্গুনী শুভেচ্ছা বিনিময় হলো আর শুরু হলো ফাল্গুন নিয়ে আলাপ। এতদিনে কার ফাল্গুন কেমন কেটেছে। আমি নিজেরটা নিয়ে ভাবলাম। ২০০৬ সাল থেকে ২০১২ সাল এই ছয় বছরে ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন সময়ে কাটানো ফাল্গুনই আমার জীবনের সেরা। শুধু কী ফাল্গুন? এ সময়ের প্রতিটি মুহুর্ত কেটেছে অনেক আনন্দে। নিঃসন্দহে সেই দিনগুলি ছিল জীবনের সেরা দিন। এখন প্রতিনিয়ত স্মৃতিকাতর হই অইসব দিনগুলোর কথা ভেবে। কিছুদিন ধরে ভাবছি যে জীবনের সেরা সময়গুলো নিয়ে ব্লগে কিছু লিখব। তো লিখেই ফেললাম-
২০০৫ সালে এইসএসসি পাশ করার পর কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষায় অংশ নিয়ে আমার পড়ার সুযোগ হয় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ভর্তিপরীক্ষায় আমার মেধাক্রম ছিল ১১। পছন্দের সাবজেক্ট ইংরেজি সাহিত্য পাব বলে দ্বিতীয় কোন চিন্তা না করেই ভর্তি হয়ে গেলাম। ভর্তির সময় আমার আব্বা আমার সাথে সিলেটে গেছিলেন। ২০০৬ সালের মার্চ মাস। আমার কাজিন রেমন ভাই তখন ওখানেই সমাজবিজ্ঞানে পড়েন। আমার ভর্তির কাজে উনি অনেক হেল্প করেছিলেন। ভর্তির দিনটা ছিল অনেক স্পেশাল। সিলেট যাবার আগে ময়মনসিংহ থেকে নতুন জামাকাপড় কিনে নিয়ে গেছিলাম। মনে হেয়েছিল যেন উৎসব। ক্যাম্পাসের বি বিল্ডিঙ্গে আমাদের ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। আমার রেজিস্ট্রেশন নম্বর/রোল নম্বর ২০০৫২৩৬০০৬। ভর্তিচ্ছু অনেকের সাথে দেখা হলো। সবাই কিশোর-কিশোরী। এর মধ্যে দুইজনের কথা মনে আছে। একজন আমার সামনের রোল ০৫, একটা মেয়ে, নাম কলি, আরেকজন আমার পেছনের রোল ০৭। কাকতালীয়ভাবে ওর নামও বিপুল। বিপুল সরকার। দুইদিন থেকে ভর্তি হয়ে বাডি ফিরে আসলাম। ক্লাস শুরু হবে এপ্রিলে।
ক্লাস শুরু হবে এই অপেক্ষা করছি। হঠাত করে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক গোলযোগে এক স্টুডেন্ট মারা গেলে ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে কিছু মনে না হলেও পরে ক্যাম্পাস খুলতে দেরি হচ্ছে দেখে বিরক্তি লাগছিলো। এপ্রিল-মে-জুন-জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ক্যাম্পাস খোলার নাম নেই। হতাশ হয়ে পরলাম। ভাবলাম সাস্টে আর পড়া হবে না। আবার এডমিশন টেস্ট দিব কিনা ভাবছিলাম এ সময়ই খবর এলো যে ক্যাম্পাস খুলছে। আমরা স্কুলের তিন ফ্রেন্ড একসাথে ভর্তি হয়েছিলাম। ইরফান ম্যাথ এ, শাকিল ফিজিক্স এ আর আমি ইংলিশে। ওদের সাথে যোগাযোগ হলো। হুটহাট করে সিলেট যাবার প্রস্তুতি নিতে হলো। নভেম্বর ১২ তারিখ থেকে ক্লাস। ইরফান শাকিল আর আমি একসাথে ব্যাগপত্র গুছিয়ে সিলেটে চলে এলাম। যদিও আনন্দের ব্যাপার কিন্তু বাড়ি ছেড়ে আবার বেরিয়ে পরলাম। আব্বা আম্মা আপার মন খারাপ।
সিলেটে এসে রেমন ভাইয়ের কাছে উঠলাম। শাহপরান হল, রোম নং ৩০৬। যতদিন হলে সিট না পাই বা মেস ভাড়া না পাই ততোদিন এখানে থাকতে হবে। হলে আছি। ফার্স্ট ইয়ার ফার্স্ট সেমিস্টারের অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টরাও একে এক আসছে। কারো কারো সাথে পরিচয় হচ্ছে। কিন্তু ক্লাস শুরুর আগেই নিজের ডিপার্টমেন্টের কারো সাথে পরিচয় হয়নি। অতঃপর ১২ নভেম্বর ২০০৬, আমাদের প্রথম ক্লাস। আমি নিশ্চিত যে আমাদের ব্যাচের কেউই এই দিনটির কথা ভুলবেনা।
ইউনিভার্সিটি, ক্যাম্পাস, ক্লাসরুম, হল, ছাত্র-ছাত্রি, ক্যান্টিন সবকিছু নিয়ে ক্যাম্পাসের যারা স্টুডেন্ট না তাদের একটা ভাবনা থাকে। সবাইকে দেখে কেমন অচেনা লাগলেও এরা এখানকার ছাত্র এটা ভেবে কেমন একটা লাগলো যেটা এখনো অন্য কোন ক্যাম্পাসে গেলে লাগে। অজানা পরিবেশ আর অচেনা একদল মানুষের সাথে আমার যাত্রা শুরু হচ্ছে এজন্য কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে ক্যাম্পাসে এলাম। ক্যাম্পাসের ডি বিল্ডিং এ সোসাল সাইন্স অনুষদের সব বিভাগে ক্লাস হয়। আমাদের ক্লাসরুম ছিল ১০২২ নম্বর কক্ষ। সোসাল সাইন্স অনুষদের বিল্ডিং বলে অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিং এর তুলনায় এখানে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি। এজন্য ডি বিলিং এর একটা বিশেষ সুনাম ছিল। ছেলেপেলেরা প্রেম করার জন্য এদিকেই টাংকি মারতো। এজন্য ক্যাম্পাসে ডি বিলিং কে ডার্লিং বিল্ডিং বলা হতো। ক্লাসে আসার আগেই এগুলো শুনেছি গত দুই দিন ধরে।
ক্লাসে বসেছি। ওরিয়েন্টেশন ক্লাস। পাশে বসা সম্রাট আর শাওনের সাথে প্রথম পরিচয় হলো। একে একে সবাই আসছে। আমাদের ক্লাসে ৫০ জন স্টুডেন্ট ছিলাম। এর মধ্যে ১৭ জন মেয়ে। কারো সাথে কথা বলছিনা। শুধু দেখছি। ক্লাশ শুরু হলো ১০টায়। আমাদের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন মোহাম্মদ আতিউল্লাহ স্যার। স্যার আরো কয়েকজন স্যারকে নিয়ে ক্লাসে এলেন। স্যার এসে ইংরেজিতে বক্তব্য দেয়া শুরু করলেন। স্যারের জিজ্ঞাসা মত সব স্টুডেন্টরা নাম পরিচয় বলতে লাগলো। আমি কিছুটা ভয় পাচ্ছি, কারণ ইংরেজীতে ইন্ট্রোডাকশন চলছে। আমি জীবনেও ইংরেজী বলিনি। ইংরেজি বলা নিয়ে সেই যে ভয় পেলাম পুরা ক্যাম্পাস লাইফে সেই ভয় থেকে গেছিলো।
ক্লাসের বেশিরভাগ স্টুডেন্টই সিলেট রিজিওনের আর বেশিরভাগ মেয়েই বোরখাওয়ালী। সাস্ট ক্যাম্পাসে যারা নন-সিলোটি তাদের বলা হতো আবাদি। সেই মতে ক্লাসে আমরা অল্পকয়েকজনই ছিলাম আবাদি। এই নিয়ে আমাদের ক্ষ্যাপানো হতো। আমরা অবশ্য সিলোটিদের নাম দিয়েছিলাম গবাদি। মধুর কথা কাটাকাটি চলতো। কিন্তু সবাই খুব ভাল।
অরিয়েন্টেশন ক্লাসে টিচারদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। তাহসিন স্যার, মাসুম স্যার, রাজিক স্যার, ম্যাট স্যার। সাথে অফিস সহকারী আশরাফ। অফিস সহকারীর ভাব এমন যে সেই নিজেই মনে হয় ভিসি। পরে আমরা তাকে ভিসি আশরাফ বলে ডাকতাম। ক্লাসরুম, ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরি, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, কম্পিউটার ল্যাব সবকিছু ঘুরিয়ে দেখানো হলো। এভাবেই শেষ হলো আমাদের প্রথম দিনের ক্লাস।
ক্যাম্পাসে নবাগত সেটা আমাদের দেখে সবাই বুঝতে পারে। তাই হাটাচলায় অস্বস্তি ছিল শুরুতে। কী ধরণের কাপড়চোপড় পড়ব সেটাও ভাল করে জানতাম না। স্কুল কিডের মতই আমাদের হাবভাব। পরেরদিনের ক্লাস থেকে সাবলীল হতে শুরু করলাম। সবজায়গায় কিছু ছেলেপেলে থাকে যারা অটো লিডার হয়ে যায়। আমাদের ক্লাসেও এমন কয়েকজন লিডার দাঁড়িয়ে গেলো। ওরা ক্যাম্পাসে আসার আগে থেকেই সবকিছু চিনে জানে। কে কোন ক্লাস নেয়, কে কেমন টিচার, কোন কোর্স কোন সেমিস্টারে - এসব। আমি এগুলো কিছুই জানিনা। আর ইংরেজি তো বলতেই পারিনা। তাই টিচারদের থেকে দূরে দূরে থাকার প্রবনতা আমার শুরু থেকেই। প্রথমে লিডারসুলভ জহির, নোমান এরপরে করিম, জামান, ক্লাসের ফার্স্ট রোলধারী আনোয়ার আর মেয়েদের মধ্যে তামান্নার সাথে আলাপ হলো। এর মধ্যে একজন সম্ভবত অনুপমা খাতায় ক্লাসের সবার নাম, ফোন নাম্বার, জন্মতারিখ লিখে নিলো। এইটা মনে হয় খুবই কমন একটা কাজ- সবার জন্মদিন ঠুকে নেয়া। তখনো ফেসবুক আমাদের পায় নাই। ক্লাসের একজন ছিলো আমার পূর্বপরিচিত। শামিম ভাই। আমার স্কুলের সিনিয়র, একসাথে হোস্টেলে ছিলাম। এক বছর ড্রপ দিয়ে সেকেন্ড টাইমে সাস্টে ভর্তি হইছে। তাকে দেখে খুশি হবার চেয়ে কিছুটা বিব্রত হলাম। বড় ভাইয়ের সাথে এক ক্লাসে কেমনে পড়ব! সেও কিছুটা অস্বস্তিতে পরছে। শিবলীর সাথে পরিচয় হলো। সেও আবাদি, শাহপরান হলে উঠছে। আমরা দুজনেই থাকার জন্যে মেস খুজছি।
বয়স বেশি ছিলো না। চেহারাতেও বাচ্চা বাচ্চা ভাব। কিন্তু বিড়ি খাই। কেউ কেউ হয়ত আমার বিড়ি খাওয়া দেখে অবাক হয়েছে। ডি বিল্ডিং এর পাশে চা-সিগারেটের টং। যাদের সাথে পরিচয় হয়েছে তার মধ্যে সম্রাট, শামিম, শিবলী(অকেশনাল) আর আমি বিড়ি খাই। আরেকজন পেয়ে গেলাম। তুষার পাল। শুরু হলো বিড়ি খাওয়া দোস্তির খায়-খাতির। পরেরদিন পেয়ে গেলাম আব্দুল বাসিতকে। তান্না নামের এক মেয়ের সাথে খাতির জমাচ্ছে। সেও বিড়ি খায়। টং এ বসে আড্ডায় আমাদের সাথে তারও খাতির হয়ে গেলো। বাসিতের মাধ্যমে তান্না, তান্নার মাধ্যমে ডালিয়া এমন করে সবার সাথেই পরিচয় হচ্ছে।
ক্যাম্পাসে ছিলো র্যাগের ভয়। ক্যাম্পাসের ফ্রেশারদেরকে সিনিয়রা র্যাগ দেয়। বড় ভাইয়ের রুমে থাকতাম বলে হলে র্যাগ খাই নাই। কিন্তু ক্যাম্পাসে আর ছাড় পাইনি। আমাদের ক্যাম্পাসের শহীদ মিনারটা ইউনিক। অনেকগুলো সিড়ি বেয়ে চীনের গ্রেট ওয়ালের মতো পাহাড়ের উপরে উঠে শহীদ মিনার। সুন্দর জায়গা। আমরা নতুন ফ্রেন্ডরা ঘুরতে গিয়ে সিনিয়রদের হাতে পড়লাম। আমরা ছিলাম চার/পাচজন, তারাও ছিলো চার/পাচজন। আমাদের একে একে ধরে র্যাগ দিলো। আমাকে বললো- 'অই তোর চেহারা তো নায়কের মতো। আজ থেকে তুই নায়ক, সিনেমার ডায়লগ বল'। আমার বা হাতের আঙ্গুলের নখে মেহেদি দেয়া ছিল। অইটা দেখে এক ভাই বললো- 'আরেহ, তুই তো নায়ক না, নায়িকা। এইবার নেচে দেখা'। সেই র্যাগ খাইলাম! র্যাগের পরে ভাইয়ের সমাদরে খুব ভালো লাগলো। পরে এই ভাইদের সাথেই ভাল খাতির হয়েছিলো। এই জন্যেই র্যাগ জিনিসটা ভালো।
এভাবে দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে গেলো। খুবই মজার দিন।
©somewhere in net ltd.