![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দেহ-রাজ্যের জায়গা-জমিন (The land of the body-kingdom)
আপন দেহভূমির পরিমাণ নির্ণয় করতে গেলে সর্ব প্রথমেই স্মরণ করতে হয় মহাত্মা লালন সাঁইজিকে। তিনি লিখেছেন;
“আপন ঘরের খবর নেনা,
অনায়াসে দেখতে পাবি,
কোনখানে সাঁইয়ের বারামখানা।” (পবিত্র লালন- ১০৬/১)।
“ও যার আপন খবর আপনার হয় না,
একবার আপনারে চিনতে পারলেরে,
যাবে অচেনারে চেনা।” (পবিত্র লালন- ২৫৭/১)।
“ক্ষ্যাপা তুই না জেনে তোর,
আপন খবর যাবি কোথায়,
আপন ঘর না বুঝ বাইরে খুঁজে
পড়বি ধাঁধায়।” (পবিত্র লালন- ৩৭৪/১)।
অতঃপর মানিকগঞ্জের কালুশাহ ফকিরের একটি বাণীও মনে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে। সেটি হলো;
“আগে আপনকে চিনো,
পরে গুরুকে মানো,
দেহ পাশ করে আনো,
ওরে সই মহলের নকলগুরু
দেবেন তোমায় দয়া করে।” (কালুশাহ ফকির)।
অতঃপর একটি মাশহুর হাদিসের কথাও মনে পড়ে। হাদিসটি হলো-
“ﻤَﻦْ ﻋَﺮَﻑَ ﻨَﻔْﺴَﻪُ ﻔَﻗَﺪْ ﻋَﺮَﻑَ ﺮَﺒَّﻪ”
উচ্চারণঃ “মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু।”
অর্থঃ “যে ব্যক্তি তার আপনকে চিনল, সে তার প্রভুকে চিনল।”
ওপরোক্ত সব বাণীই কেবল আপন চেনা বা আপনার দেহের সংবাদ জানাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। আপন চেনার সর্ব প্রথমেই আসে আপনার ভূমির পরিমাণ জানা ও চেনা। এ বিষয়টি নিয়ে আত্মতাত্ত্বিক ও মরমী মনীষীদের মধ্যে একটা প্রবাদের প্রচলন রয়েছে। প্রবাদটি হলো;
“নিজের ভূমির পরিমাণ যে সাধক জানে,
মানব, দানব, দেব-দেবতাও তারে মানে।”
বিশ্ববিখ্যাত আত্মতাত্ত্বিক মনীষীদের মতে মানবদেহের ভূমির পরিমাণ ১৪ বিঘা। অর্থাৎ নিজ নিজ প্রাকৃতিক ভূমির পরিমাণ ১৪ বিঘা। এই “১৪ বিঘা ভূমির সংবাদ যারা জানে- মানব, দানব ও দেব-দেবতারাও তারে মানে।”
১৪ বিঘা ভূমির ব্যাখ্যা
মানবদেহ যার যার হাতের সাড়েতিন হাত। একহাত = চার পোয়াহাত। তাহলে তিনহাত = ১২ পোয়াহাত। এবং আধাহাত = দুই পোয়াহাত। অর্থাৎ সাড়েতিন হাত = ১৪ পোয়া হাত। শ্বরবিজ্ঞানে; ১৪ পোয়াহাতকেই ১৪ বিঘা বলা হয়।
আত্মতাত্ত্বিক ও মরমী সাধকরা আরও বলে থাকেন যে- উক্ত ১৪ বিঘা ভূমির মধ্যে দুই বিঘা খাস খতিয়ানভুক্ত এবং ১২ বিঘা চাষযোগ্য। খাস দুইবিঘা ভূমি হলো- ১.নাভিমূল ও ২.পায়ু। এ দুই বিঘা খাস বলে সাধকের কোন প্রকার কর্ষণ-চর্ষণ নেই। অর্থাৎ সাধক জীবনে স্থূলভাবে মানবদেহের এ দুটি সদস্যের কোন সাধন-ভজন নেই। অবশিষ্ট রইল ১২ বিঘা। তবে এ ১২ বিঘাকে আর ১২ বিঘা বলা যাবে না। এখন একে বলতে হবে ১২ নেতা। এবার বলতে হবে;
“মানবের বারো নেতার সংবাদ যে সাধক জানে,
মানব, দানব, দেব-দেবতা সবাই তারে মানে।”
“দেবতার কথা বলি শুন দিয়া মন
দ্বাদশ দেবতা স্থান এ দেহধাম।”
শ্বরবিজ্ঞানে; গরুকে বছর বলা, তারকাকে রাজা বলা, ১০ ইন্দ্রকে ১০ ভাই বলা এবং দিনকে বছর বলার ধারা প্রায় ৭ হাজার বছর পুরোনো। তাই এখানে ১২ বিঘাকে ১২ নেতা বলা হয়েছে। এতে আশ্চর্য বা অভিভূত হওয়ার কিছু নেই। কারণ সারা বিশ্বের সর্ব প্রকার শাস্ত্রীয়সাহিত্য বা রূপকসাহিত্য এ সূত্র দ্বারাই নির্মিত।
বারোর কয়েকটি টীকা তুলে ধরা হলো।
১. বারো পূর্ণিমাঃ
১.চৈত্রাবলী, ২.বৈশাখী, ৩.জ্যৈষ্ঠী, ৪.আষাঢ়ী, ৫.শ্রাবণী, ৬.ভাদ্রপদা, ৭.আশ্বিন্যা, ৮.কার্তিকী, ৯.অগ্রহায়ণী, ১০.পৌষালী, ১১.মাঘী ও ১২.দোল।
২. বারো চান্দ্রমাসঃ
১.মুহররম, ২.সফর, ৩.রবিউল আউয়াল, ৪.রবিউস সানি, ৫.জুমাদিউল আউয়াল, ৬.জুমাদিউস সানি, ৭.রজব, ৮.শাবান, ৯.রমজান, ১০.শাওয়াল, ১১.জুলকাদ ও ১২.জুলহাজ্জ।
৩. বারো উপনিষদঃ
ঋকবেদীয়ঃ ১.ঐতরেয়, ২.কৌশীতকী, সামবেদীয়ঃ- ৩.ছান্দোগ্য, ৪.কেনকৃষ্ণযজুর্বেদীয়ঃ ৫.তৈত্তিরীয় ৬.কঠ, ৭.শ্বেতাশ্বতর শুক্লযজুর্বেদীয়ঃ৮.বৃহদারণ্যক, ৯.ঈশ, ১০.প্রশ্ন, ১১.মুণ্ডক ও ১২.মাণ্ডুক্য।
৪. দ্বাদশ আদিত্যঃ
১.বিবস্বান, ২.অর্যমা, ৩.পূষা, ৪.তুষ্টা, ৫.সবিতা, ৬.ভগ, ৭.ধাতা, ৮.বিধাতা, ৯.বরুণ, ১০.মিত্র, ১১.অতিজেতা ও ১২.উরুক্রম।
৫. বারো জলঃ
১.মান্দ, ২.ভন্দন, ৩.কেতন, ৪.নৃতন, ৫.রেশী, ৬.মেষী, ৭.বাশী, ৮.বিশ্বভৃৎ, ৯.সাধ্বী, ১০.কুকুহ, ১১.শক্বরী ও ১২.শুক্র।
৬. বারো নেতাঃ
১.চরিত্র, ২.কর্ম, ৩.বুদ্ধি, ৪.বিদ্যা, ৫.ডান, ৬.বাম, ৭.ভাব, ৮.ভাষা, ৯.বিনয়, ১০.অটল, ১১.ভেদ ও ১২.যজ্ঞ।
৭. বারো নেতাঃ
১.নাবায়ুত, ২.কায়দার, ৩.অদবেল, ৪.মিবসম, ৫.মিশম, ৬.দূমা, ৭.মসা, ৮.হদদ, ৯.তেমা, ১০.যিটূর, ১১.নাফীশ ও ১২.কেদমা। (তৌরাত, সূচনাক্রম, ২৫/১২-১৭)।
৮. বারো বিষয়ঃ
১.দান, ২.শীল, ৩.সমাধি, ৪.প্রজ্ঞা, ৫.ধ্যান, ৬.বিমোক্ষ, ৭.অনিত্য, ৮.দুঃখ, ৯.অনাত্ম, ১০.চিত্ত, ১১.চৈতসিক ও ১২.নির্বাণ। (ত্রিপিটক পরিচিতি-৩৭)।
৯. বারো বুরুজঃ
১.চক্ষু, ২.কর্ণ, ৩.নাসিকা, ৪.জিহবা, ৫.ত্বক, ৬.বাক, ৭.পাণি, ৮.পাদ, ৯.পায়ু, ১০.উপস্থ, ১১.রবি ও ১২.শশী। (কুরান- মায়িদা-১২, আরাফ-১৬০, কাহাফ-২৫)।
১০. বাংলা বারো মাসঃ
১.বৈশাখ, ২.জৈষ্ঠ, ৩.আষাঢ়, ৪.শ্রাবণ, ৫.ভাদ্র, ৬.আশ্বিন, ৭.কার্তিক, ৮.অগ্রহায়ণ, ৯.পৌষ, ১০.মাঘ, ১১.ফাল্গুন ও ১২.চৈত্র।
১১. বারো শিষ্যঃ
১.শিমোন, ২.আন্দ্রিয়, ৩.ইয়াকুব, ৪.ইউহেন্না, ৫.ফিলিপ, ৬.বর্থলময়, ৭.থোমা, ৮.মথি, ৯.ইয়াকুব-২, ১০.থদ্দেয়, ১১.এহুদা ও ১২.ইস্কারিয়োৎ (ইঞ্জিল)।
এবার বারো নেতার কয়েকটি পরিভাষা তুলে ধরা হলো।
বলন হতে; বারো, বারো অনিষ্ট, বারোজন, বারো দিন, বারো নেতা, বারো প্রধান, বারো বছর, বারো মাল্লা, বারো মাস, বারো সাথী ও বারো হাত।
লালন হতে; বারো, বারো এলাহি, বারো গুণ, বারো জাত, বারো তাল, বারো ভাটি ও বারো মাস।
কুরান হতে;
বারো, বারো ঝর্ণা, বারো ঝর্ণাধারা, বারো দল, বারো দলপতি, বারো বংশ ও বারো মাস।
ইঞ্জিল হতে;
বারো, বারো উদ্দীপক, বারো গোষ্ঠী, বারোজন, বারো টুকরী, বারো তারা, বারো নাম, বারো নেতা, বারো পিংগল মণি, বারো প্রধানদ্বার, বারো প্রেরিত্, বারো ফল, বারো বংশ, বারো বছর, বারো ভিত্তি, বারো মুক্তা, বারো শিষ্য ও বারো সিংহাসন।
তৌরাত হতে;
বারো, বারো গামলা, বারে গোষ্ঠী, বারো ছাগল, বারো ছেলে, বারো ঝর্ণা, বারো থাম, বারো নেতা, বারো পাথর, বারো বছর, বারো বলদ, বারো বাচ্চা, বারো বাসন, বারো ভাই, বারো ভেড়া, বারো রুটি, বারো লাঠি, বাো লোক ও বারো ষাঁড়।
বেদ হতে;
বারো, বারো অক্ষর, বারো অঙ্গুলি, বারো অর, বারো আদিত্য, বারো ঋক, বারো ঋতু, বারো ঋষি, বারো কপাল, বারো গাভী, বারো চরু, বারো জল, বারো দর্শ , বারো দিবস, বারো দ্বন্দ্ব, বারো পরিধি, বারো পাত্র, বারো পুরুষ, বারো পুরোডাশ, বারো পূর্ণিমা, বারো বছর, বারো বাক্য, বারো মাস, বারো মূর্তি, বারো রাত্র, বারো রজ্জু, বারো স্তোত্র, বারো স্থান, বারো হবি, বারো হোম, দ্বাদশাহ, দ্বাদশাহ সত্র ও দ্বাদশাহ যাগ।
এবার আমরা বারো নেতার ওপর মহাগ্রন্থাদি হতে কিছু কিছু প্রমাণ তুলে ধরার চেষ্টা করব।
‘বেদ’
“সত্যত্মক আদিত্যের ‘দ্বাদশ অরবিশিষ্ট চক্র’ স্বর্গের চারদিকে পুনঃপুন ভ্রমণ করছে ও কদাচিৎ জরাগ্রস্থ হয় না। হে অগ্নি! এ চক্রে পুত্ররূপ সপ্তশত বিংশতি মিথুন বাস করে।” (ঋবেসপ্রখপ্রম ঋ-১১)।
‘ত্রিপিটক’
“দ্বাদশ প্রকারের আয়তন’ দেশের ব্যবস্থাপক তুল্য বলে গ্রহণ করে দেশ নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং ঐ দেশের কোষাধ্যক্ষ মন্ত্রীর ন্যায় নন্দীরাগ বা পুনঃপুন অভিনন্দনকারিণী তৃষ্ণাকে অনুচররূপে অভিহিত করা হয়েছে। বাঘ যেমন বন্য পথে পথিকের অন্তরায় সৃষ্টি করে, তদ্রূপ বাঘরূপী পঞ্চনীবরণ ক্ষীণাস্রব ব্রাহ্মণ অর্হৎ জ্ঞানরূপ তীক্ষ্ণাস্ত্রের সাহায্য নিঃশেষে হত্যা করে সর্ব দুঃখ হতে মুক্তিলাভ করে চির-শান্তিতে বাস করেন।” (ত্রিপিটক-ধম্মপদ-৩৬০)।
‘তৌরাত’
“ইসরাইলের ‘বারোজন ছেলে’ এর জন্য মোট ‘বারোটা পাথর’ বসানো হল। তার প্রত্যেকটা মধ্যে ‘বারোটা গোষ্ঠী’ এর একটি করে নাম খোদাই করা হয়েছিল। (তৌরাত, স্থানান্তর, ৩৯/১৪)।
‘ইঞ্জিল’
“যে সাতজন প্রতীতির হাতে শেষ সাতটা আঘাতভরা সাতটা পেয়ালা ছিল। তাদের মধ্যে একজন আমার নিকট এসে বললেন- “এসো আমি তোমাকে কনে অর্থাৎ মেষ শিশুর স্ত্রীকে দেখাই”। অতঃপর সে প্রতীতি আমাকে একটা বড় ও উঁচু পাহাড়ে বহন করে নিয়ে গেলেন। তখন আমি পবিত্র আত্মার বশে ছিলাম। কানীনের মহিমাতে উজ্জ্বল যে পবিত্র নগর জঠর স্বর্গের মধ্য হতে এবং কানীনের নিকট নেমে আসতেছিল। তিনি আমাকে তা দেখালেন। সেই নগরের উজ্জ্বলতা অনেক মূল্যবান পাথরের উজ্জ্বলতার মত। স্ফটিকের মত পরিষ্কার সূর্যকান্ত মণির মত। সে নগরের একটা বড় উঁচু দেওয়াল ছিল ও তাতে প্রধান ‘বারোটা দ্বারছিল। সে প্রধান দ্বারগুলিতে ‘বারোজন প্রতীতি’ ছিলেন। ইন্দ্রদেবের‘বারোনেতা’ এর নাম ঐ প্রধান দ্বারগুলির ওপর লিখা ছিল। দ্বারগুলির মধ্যে তিনটা পূর্বদিকে, তিনটা উত্তরদিকে, তিনটা দক্ষিণদিকে এবং তিনটা পশ্চিশদিকে ছিল। সে শহরের দেয়ালের ‘বারোটা ভিত্তি’ ছিল এবং সেগুলির ওপর মেষ শিশুর ‘বারোজন প্রেরিত’ এর ‘বারোটি নাম’ লিখা ছিল।” (ইঞ্জিল- ২৭শ খণ্ডঃ প্রকাশিত কথা, ২১/৯-১৪)।
‘কুরান’
“وَقَطَّعْنَاهُمْ اثْنَتَيْ عَشْرَةَ أَسْبَاطًا أُمَمًا وَأَوْحَيْنَا إِلَى مُوسَى إِذْ اسْتَسْقَاهُ قَوْمُهُ أَنْ اضْرِب بِعَصَاكَ الْحَجَرَ فَانْبَجَسَتْ مِنْهُ اثْنَتَا عَشْرَةَ عَيْنًا قَدْ عَلِمَ كُلُّ أُنَاسٍ مَشْرَبَهُمْ وَظَلَّلْنَا عَلَيْهِمْ الْغَمَامَ وَأَنزَلْنَا عَلَيْهِمْ الْمَنَّ وَالسَّلْوَى كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ وَمَا ظَلَمُونَا وَلَكِنْ كَانُوا أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ (160)”
“আমি তাদেরকে প্রধান প্রধান ‘বারো দল’-এ বিভক্ত করেছি এবং অসির নিকট যখন তার দল জল প্রার্থনা করল, প্রত্যাদেশ করা হলো যে- “তুমি তোমার দণ্ডদ্বারা পাথরে আঘাত কর। অতঃপর ওটা হতে ‘বারোটি ঝর্ণাধারা’ নির্গত হবে। নিশ্চয় সকলে তাদের ঘাট চেনে নিবে। এবং তাদের ওপর আমরা মেঘ দ্বারা ছায়া করেছি। এবং তাদের প্রতি সুধা ও পীযূষ অবতরণ করেছি। বলেছি আমরা তোমাদের যে সব শুদ্ধবস্তু খাদ্য পানীয়রূপে দান করেছি তা খাও। তারা আমার প্রতি অত্যাচার করে নাই কিন্তু আপন জীবনের প্রতিই নির্যাতন করেছে।” (কুরান, আরাফ- ১৬০)।
And We divided them into ‘twelve tribes’ nations. We directed Chopper by inspiration, when his people asked him for water, (saying): “Strike the stone with your stick”, and there gushed forth out of it ‘twelve cascade’, each group knew its own mooring. We shaded them with the clouds and sent down upon them nectar and elixir the quails (saying): “Eat of the good things with which We have provided you.” They harmed Us not but they used to harm themselves. (Quran a’râf-160).
‘লালন’
“বারো ভাটি’ বাংলা জুড়ে
এক মাটি আছে পড়ে
সিরাজ সাঁই কয়, লালন ভেড়ে
ঠিক দাও আপন নসিবী।
চল দেখি মন কোন দেশে যাবি
অবিশ্বাস করে কোথায় কি পাবি।” (পবিত্র লালন- ৪৩৩)।
‘বলন’
“অষ্ট যোগে দাঁড়িপাল্লা
আগে পরে ‘বারো মাল্লা’
ছয়জনে করে হল্লা
অঘাটে কে পিছলে মরে।
অবোধ মন যাবি কি করে,
সাঁইজির গোপন সে ঘরে।” (বলন কাঁইজি, বলন তত্ত্বাবলী- ৫)।
এ ১২ নেতার পরিচয় না জেনে ও না বুঝে কথিত মুসলমান সিয়ারা (সিয়াদের একদল)- ইমাম হাসান হতে ইমাম আবুল হাসান আশয়ারী পর্যন্ত শ্বরবিজ্ঞানের ১২টি চরিত্রকে ১২ নেতা বলে বিশ্বাস ও মান্য করে থাকেন। আবার অন্যদল আলী হতে মাহদী পর্যন্ত ১২ জনকে ১২ নেতা বলে অভিহিত করে থাকেন। তাদের একদলের বারোনেতার মতবাদ নিম্নরূপ।
সিয়াদের একদলের কথিত ১২ নেতা হলো-
১. হযরত আলী (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু)।
২. হযরত ইমাম হাসান (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু)।
৩. হযরত ইমাম হুসাইন (রাদিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু)।
৪. হযরত জয়নুল আবেদীন (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)।
৫. হযরত বাকির (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)।
৬. হযরত জা’ফর ছাদিক্ব (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)।
৭. হযরত মূসা কাযিম (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)।
৮. হযরত আলী রেজা (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)।
৯. হযরত মুহম্মদ ত্বক্বী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)।
১০. হযরত আলী নক্বী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)।
১১. হযরত হাসান আসাকারী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)।
১২. হযরত মাহদী (আলাইহিস সালাম)।
বা ১.আলী, ২.হাসান, ৩.হোসাইন, ৪.জয়নাল আবেদীন, ৫.বাকির, ৬.জাফর সাদিক্ব, ৭.মূসা কাযিম, ৮.আলী রেজা, ৯.মুহম্মদ ত্বক্বী, ১০.আলী নক্বী, ১১.হাসান আসাকারী ও ১২.মাহদী।
——————————————
এবার পরের ভূমি বা পরের মাটি কী? পরের মাটিতে আমরা কিভাবে বাড়ি করে বাস করি? আবার আমরা কেন বাড়ির প্রভু নই? তবে আমার বাড়ির প্রভু বা প্রতীভূ কে? আমার ব্যবহৃত ভূমির প্রতীভূর দেখা আমরা পাইনা কেন? আবার ভূমিকর দেওয়ার পরও ভূমি কিভাবে নিলাম হয়ে থাকে? এরূপ প্রসঙ্গ নিয়ে বিখ্যাত মরমী গীতিকার আব্দুল লতিফ নিচের বাণীটি রচনা করেছেন।
“পরের জায়গা পরের জমিন
ঘর বানাইয়া আমি রই
আমি তো এই ঘরের মালিক নই।
সেই ঘরখানা যার জমিদারি
আমি পাইনা তাহার হুকুমদারী
আমি পাইনা জমিদারের দেখা।
মনের দুঃখ কারে কই।
জমিদারের ইচ্ছামত দেই না জমি চাষ
তাইতো ফসল ফলে না রে দুঃখ বারো মাস।
আমি খাজনাপাতি সবই দিলাম
তবু জমিন আমার হয় যে নীলাম।
আমি চলি যে তার মন জোগাইয়া
দাখিলায় মেলে না সই।”
শিল্পীঃ আব্দুল আলিম
গীতিকারঃ আব্দুল লতিফ
সুরকারঃ আব্দুল লতিফ
——————————————
‘দেহতত্ত্ব’ (Theology. থিওলোজি)
ওপরোক্ত বর্ণনাদি সবই ছিল ‘রূপকতত্ত্ব’ (Mythology. মিথোলজি)। আর সর্ব প্রকার ‘রূপকতত্ত্ব’ (Mythology. মিথোলজি) এরই ‘বাস্তবতত্ত্ব’ বা ‘দেহতত্ত্ব’(Theology. থিওলোজি) অবশ্যই আছে। এবার আমরা আমাদের আলোচ্য ১২ নেতার প্রকৃত ‘দেহতত্ত্ব’ (Theology. থিওলোজি) তুলে ধরলাম।
১. ১২ নেতাঃ
কর্ণে- ১ নেতা (শ্রাবক)
চোখে- ২ নেতা (১.সম্মুখদ্রষ্টা ও ২.সর্বদ্রষ্টা)
নাকে- ৩ নেতা (১.শ্বসিন, ২.ঘ্রাণিন ও ৩.শুভাশুভিন)
মুখে- ২ নেতা (১.খাদক ও ২.বাগ্মী)
নাভির নিচে- ৪ নেতা (১.শুক্র, ২.বসিধ, ৩.সাঁই ও ৪.কাঁই)।
বা ১.শ্রাবক, ২.সম্মুখদ্রষ্টা, ৩.সর্বদ্রষ্টা, ৪.শ্বসিন, ৫.ঘ্রাণিন, ৬.শুভাশুভিন, ৭.খাদক, ৮.বাগ্মী, ৯.শুক্র, ১০.বসিধ, ১১.সাঁই ও ১২.কাঁই।
১. শ্রাবক
ইনি কর্ণ প্রতীতি। কর্ণে বসে মানুষের শ্রবণক্রিয়া পরিচালনা করে থাকেন।
২. সম্মুখদ্রষ্টা
ইনি সম্মুখদ্রষ্টা প্রতীতি। চোখে বসে মানুষকে স্থূল পদার্থাদি দর্শন করিয়ে থাকেন।
৩. সর্বদ্রষ্টা
ইনি সর্বদ্রষ্টা প্রতীতি। জ্যোতিচক্রে বসে মানুষকে সব কিছু দর্শন করিয়ে থাকেন।
৪. শ্বসিন
ইনি শ্বাস গ্রহণকারী প্রতীতি। নাসিকায় বসে মানুষের শ্বসনক্রিয়া পরিচালনা করে থাকেন।
৫. ঘ্রাণিন
ইনি ঘ্রাণ গ্রহণকারী প্রতীতি। নাসিকায় বসে মানুষকে সব কিছুর ঘ্রাণ প্রদান করে থাকেন।
৬. শুভাশুভিন
ইনি কোন কিছুর ভালো-মন্দ জ্ঞানদানকারী প্রতীতি। নাসিকায় বসে মানুষকে সব কিছুর ভালো-মন্দ জ্ঞান প্রদান করে থাকেন।
৭. খাদক
ইনি খাদ্য গ্রহণকারী প্রতীতি। ইনি মুখে বসে খাদ্যাদি গ্রহণ করে জীবকুলকে জীবিত রাখেন।
৮. বাগ্মী
ইনি কণ্ঠ প্রতীতি। ইনি জীবের কণ্ঠে বসে কথা পরিচালনা করে থাকেন।
৯. শুক্র
ইনি জীবের বংশবৃদ্ধিকারী প্রতীতি। ইনি জনন ইন্দ্রিয়তে বসে জীব দ্বারা জীব সৃষ্টি করে থাকেন।
১০. বসিধ
ইনি স্বর্গীয় প্রতীতি। ইনি কুমারী দেহে অবতরণ করে কুমারীকে যুবতী বা রজস্বলায় পরিণত করে থাকেন।
১১. সাঁই
ইনি স্বর্গীয় প্রতীতি। ইনি দ্বিপস্থ জীবের জরায়ুতে অবতরণ করে ভ্রূণ লালনপালন করে থাকেন।
১২. কাঁই
ইনি স্বর্গীয় প্রতীতি। ইনি জীবদেহে অবতরণ করে জীব দ্বারা জীবসৃষ্টি ক্রিয়া পরিচালনা করে থাকেন।
ওপরোক্ত এই ১২ নেতার সংবাদ জানানোর জন্যই গীতিকার আব্দুল লতিফ এমন অমীয়বাণী নির্মাণ করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত শাস্ত্রীয় গ্রন্থাদির মধ্যে এতসব অমূল্যবাণী বর্ণনা করা হয়েছে। মহাত্মা লালন সাঁইজি ‘আপন ঘরের খবর নেনা’, ‘ও যার আপন খবর আপনার হয় না’ ও ‘ক্ষ্যাপা তোর আপন খবর না জেনে তুই যাবি কোথায়?’ ইত্যাদি বাণী নির্মাণ করেছেন। কিন্তু শাস্ত্রীয় বা সাম্প্রদায়িকরা আত্মতত্ত্ব বা দেহতত্ত্ব না জেনে কেবল বাহ্যিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এ বাহ্যিক ব্যাখ্যার সূত্র ধরেই কুরানি সিয়ারা রূপকসাহিত্য হতে তাদের বারো নেতা ওপরোক্তভাবে খুঁজে বের করেছেন।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই মরমীগীতি ও মূল শাস্ত্রীয় গ্রন্থ সর্বকালে ও সর্বস্থলেই কেবল আত্মদর্শন কেন্দ্রিক। কিন্তু শাস্ত্রীয়রা ঐসব গীতি বা শাস্ত্রীয়বাণীর মর্মার্থ বা ব্যাখ্যা আত্মতত্ত্বের মধ্যে অন্বেষণ না করে কেবল বাহ্যিক প্রকৃতি বা সৌরজগতে অন্বেষণ করে থাকে। সে জন্য তারা নিজেরাও যেমন চির অন্ধ, তাদের অনুসারীরাও তেমন চির অন্ধ। অন্যদিকে; মরমী ও তাত্ত্বিকরা নিজেরাও যেমন মরমীগীতি বা শাস্ত্রীয়বাণীর মর্মার্থ জানেন ও বুঝেন, তাদের অনুসারীরাও তেমন জানেন ও বুঝেন। এ কারণেই শাস্ত্রীয় বা সাম্প্রদায়িকদের মধ্যে হতে উদ্ভব হয়, হচ্ছে ও হবে উগ্রবাদ ও আতংবাদ। কিন্তু মরমী বা তাত্ত্বিকদের মধ্যে থেকে উদ্ভব হয়, হচ্ছে ও হবে বিশ্ববিখ্যাত মহামানব, দার্শনিক ও সাধুপুরুষ।
(সংক্ষিপ্ত)
সূত্রতথ্যঃ
আত্মতত্ত্ব ভেদ (১ম খণ্ড)
লেখকঃ বলন কাঁইজি
©somewhere in net ltd.